ফ্লোরা লিমিটেডের এমডি ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ
Published: 22nd, September 2025 GMT
নিজের অনুগত সিন্ডিকেট দিয়ে আইটি প্রতিষ্ঠান ফ্লোরা লিমিটেডের এমডি মোস্তফা শামসুল ইসলাম ও তার স্ত্রী অপারেশন ডিরেক্টর সোফিয়া ইসলাম প্রতিষ্ঠানের টাকা হুন্ডির মাধমে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন কোম্পানির ক্ষতিগ্রস্ত ও বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
কোনো কারণ ছাড়াই পর্যায়ক্রমে কর্মকর্তা- কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করে প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে নিয়ে গিয়ে স্থায়ীভাবে দেশ ছাড়ার প্রক্রিয়া করছেন বলেও অভিযোগ করেছেন তারা।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিষ্ঠানটির নির্যাতিত কর্মচারীরা এসব অভিযোগ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য দেন ফ্লোরা লিমিটেডের নির্যাতিত কর্মচারীদের পক্ষে মোহাম্মদ মিলন হোসেন।
কর্মচারীদের পাওনা টাকা পরিশোধ, বিদেশে পাচারকৃত টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা এবং ফ্লোরার এমডি ও তার স্ত্রীসহ বিদেশে টাকা পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন তারা। এ সময় ফ্লোরার অর্ধশতাধিক ক্ষতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আইটি প্রতিষ্ঠান ফ্লোরা লিমিটেড বিগত চার দশকের বেশি সময় ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এমএন ইসলাম সাহেব ইন্তেকাল করার পর তার বড় ছেলে মোস্তফা শামসুল ইসলাম (ম্যানেজিং ডিরেক্টর) এবং স্ত্রী সোফিয়া ইসলাম (ডিরেক্টর অপারেশন) প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন। পরবর্তীতে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসের পথে ধাবিত হচ্ছে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এতে বলা হয়, ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ৮১২ জন। অথচ ২০১৯ সালের জুন মাস থেকে আইন বহির্ভূতভাবে নির্বিচারে কর্মী ছাঁটাই শুরু হয়। বর্তমানে মাত্র ৫৫ জন কর্মচারী অবশিষ্ট আছেন।
তারা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই কোম্পানির টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা শুরু করেন। এতে সহযোগিতা করেছেন কোম্পানিতে চাকরিরত তার নিজস্ব কিছু কর্মকর্তা। তাদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হলে সব তথ্য বেরিয়ে আসবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, ফ্লোরার এমডি ও তার স্ত্রী এই কোম্পানির সর্বসর্বা। তারা স্থায়ীভাবে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার জন্যই সফল ব্যবসা ধীরে ধীরে লস দেখিয়ে বিগত ছয় বছর ধরে একের পর এক চাকরিচ্যুত করছেন। একই সঙ্গে কোম্পানির সম্পদ বিক্রি করে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন। ইতিমধ্যে তারা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অফিস বিক্রি করে দিয়েছেন। পল্টনের কালভার্ট রোডে অবস্থিত ডিআর টাওয়ার থেকে কর্পোরেট হেড অফিসটি সরিয়ে মহাখালীতে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। তারা পাচারের টাকায় বিদেশে বাড়ি ও ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। বিদেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
কর্মচারীরা অভিযোগ করেছেন, যাদের কোনো কারণ ছাড়াই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাদের নিয়মিত বেতন দেওয়া হয়নি। ইনক্রিমেন্ট, বোনাস দেওয়া হয়নি। চাকরিচ্যুত করার পরও বকেয়া বেতন ভাতা ও সার্ভিস বেনিফিট দেওয়া হয়নি। প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকাও আত্মসাৎ করা হয়েছে।
তাছাড়া ওই সময় থেকে এখনো যারা চাকরি করছেন, তাদের বেতন ভাতাও অনিয়মিত। ইনক্রিমেন্ট, বোনাস কিছুই দেওয়া হয় না। মাসের পর মাস বেতন বকেয়া থাকার কারণে কর্মচারীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন, যাতে বাধ্য হয়ে তারা চাকরি ছেড়ে চলে যান। অনেকেই আর্থিক দুরবস্থার কারণে আইনি পদক্ষেপও নিতে পারছেন না। এদিকে দেশের বাইরে অবস্থান করে সোফিয়া ইসলাম বর্তমানে কর্মরত কর্মচারীদের সরাসরি ফোনে চাকরি ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছেন এবং বকেয়া পরিশোধে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন।
ফ্লোরার এমডি ও তার স্ত্রীর বিচার দাবিতে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মচারীরা মানববন্ধন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে তারা ছয়টি দাবি তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো:
১.
২. প্রভিডেন্ট ফান্ডের আত্মসাৎকৃত অর্থ ফেরত দিতে হবে।
৩. সরকারের মাধ্যমে গত ১০ বছরের এক্সটারনাল অডিট সম্পন্ন করতে হবে।
৪. অফিস স্থানান্তর বন্ধ করতে হবে যতক্ষণ না কর্মচারীদের দেনা-পাওনা পরিশোধ করা হয়।
৫.হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ তদন্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
৬. বিদেশে অবস্থানরত এমডি ও ডিরেক্টরের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
এর আগে ফ্লোরার এমডি ও তার স্ত্রীর বিচার দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মচারীরা মানববন্ধন করেন।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এসবি
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ক ষ ত গ রস ত কর মকর ত র র এম ড ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
এ গ্যাদা, এবার আমার সিরিয়াল
সপ্তাহের রোববার ও বুধবার আমাদের স্কুলের মাঠে হাট বসে। দুপুর গড়িয়ে গেলেই শুরু হতো কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ীদের হাঁকডাক। সময়ের সঙ্গে স্কুল মাঠে ব্যস্ততা বাড়ত। দুই হাটের দিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পাঠদান চলত। জানুয়ারি মাসের এমন এক রোববারের হাটের দিন আমার জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো।
মাত্র কদিন হলো উচ্চমাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পা রেখেছি। পাঠ্যবই, শিক্ষকদের নিয়ে নতুন কৌতূহল। নতুন বইয়ের গন্ধ তখনো মনোমুগ্ধকর। এমন এক সকালে আমাদের গণিত শিক্ষক ইয়াকুব আলী স্যার হঠাৎ এলেন ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস নিতে। উত্তম কুমার স্যার সেদিন আসেননি। যে কারণে ইয়াকুব স্যারের আগমন। এখন মনে পড়লে বুঝি, ভাগ্যিস সেদিন উত্তম স্যার আসেননি। কেন সেই ঘটনা বলছি।
ইয়াকুব স্যার এসেই জানতে চাইলেন, ‘আজকে রুটিনে কী পড়ানো হবে?’ আমরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠলাম, স্যার, আজ প্যারাগ্রাফ পড়ানোর দিন। সিলেবাসে অনুযায়ী সেদিন ছিল ‘দ্য নিউজপেপার’ প্যারাগ্রাফ বা অনুচ্ছেদ। স্যার শুরুতেই বললেন, ‘তোমরা কে কে খবরের কাগজ পড়ো?’ দেখা গেল একজন বাদে সবাই না সূচক মাথা নাড়ল। পত্রিকা, আমাদের বাজারের বেশ কয়েকজনকে মাঝেমধ্যে পড়তে দেখলেও তখনো আমি কোনো পত্রিকা সেই অর্থে পড়িনি। অতটা গুরুত্ব দিইনি। কখনো পত্রিকায় নায়িকাদের ছবি ছাপা হলে সেটা দেখতাম, এই যা। পারিবারিকভাবেও পত্রিকা পড়ার চল খুব একটা ছিল না। সময়টা ২০০০ সাল।
তখন স্যার পত্রিকা পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বললেন। কেন জীবনে বড় হওয়ার জন্য নিয়মিত পত্রিকা পড়া দরকার, সেটা বোঝালেন। জীবনের ভালো কিছু করার কৌতূহল ছিল। যে কারণে আমার কাছে সেদিনই মনে হলো পত্রিকা তাহলে পড়তে হবে। এবার স্যার জানালেন, পারলে প্রথম আলো পত্রিকা পড়তে পারো। এই পত্রিকায় দেশ–বিদেশের সবচেয়ে ভালো, নির্ভরযোগ্য খবর ছাপায়। সেই প্রথম শুনলাম প্রথম আলো পত্রিকার নাম। অজপাড়াগাঁয়ের কে এই পত্রিকাটি পড়েন, খোঁজা শুরু করি।
আমার গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার আটঘড়িয়া থানার একদন্ত বাড়ইপাড়া গ্রামে। আমার স্কুলের নাম আশরাফ উচ্চবিদ্যালয়। শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। যেতে হয় বেশির ভাগ কাঁচা পথ পেরিয়ে। সেই শহর থেকে একজন বয়স্ক হকার সাইকেল চালিয়ে আসতেন গ্রামে পত্রিকা দিতে। বিভিন্ন এলাকায় পত্রিকা দিয়ে বিকেল চারটার দিকে আসতেন আমাদের শিবপুর বাজারে। সেখানে বেশির ভাগই চলত করতোয়া নামে একটি পত্রিকা। কিন্তু প্রথম আলো তখনো কেউ রাখেন না। অবশেষে সেই হকারের কাছে একদিন জানতে চাইলাম, প্রথম আলো পত্রিকা কে রাখেন? শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলেন। জানতে চাইলেন, ‘তুমি প্রথম আলো পড়তে চাও।’ আমি তাঁকে আগ্রহের কথা জানালাম। তিনি আমাকে পত্রিকার একটি কপি হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটাই প্রথম আলো। তুমি পড়তে থাকো। আর আমার সাইকেল দেখে রেখো। আমি বিএসসি স্যারকে একটি পত্রিকা দিয়ে আসি।’ শাহাবুদ্দিন বিএসসি স্যার আমাদের গণিতের শিক্ষক ছিলেন। তিনিও পাবনার আঞ্চলিক একটি পত্রিকা পড়তেন। নাম আজ আর মনে নেই।
সেই প্রথম আমার প্রথম আলো পত্রিকা দেখা ও পড়া। তারপর হকারের সঙ্গে বেশ খাতির জমে গেল। কিন্তু সমস্যা একটাই, পত্রিকাটি পড়ার জন্য ১০ মিনিট সময় পাওয়া যায়। এতে মন ভরে না। এর মধ্যেই একদিন খুশির খবর শোনালেন। জানালেন, আমাদের বাজারের এক পাশে এখন থেকে নিয়মিত প্রথম আলো পত্রিকা রাখা হচ্ছে। কোনো একটি উদ্যোগে সেখানে বেশ কটি পত্রিকা রাখা হতো। হাতের কাছে প্রথম আলো পাওয়া যাবে ভেবে মনটা আনন্দ নেচে উঠল।
আমাদের বাজারের ইছামতি নদী ঘেঁষে একটি ছোট দোকানের পাশে পত্রিকা পড়ার ব্যবস্থা হলো। সেখানে নিয়মিত পত্রিকা দেখি। কিন্তু সমস্যা একটাই। আমি ছিলাম পত্রিকা পড়ার দলে বলা যায় সবার ছোট। যে কারণে প্রথম আলো হাতে নিলেই দেখা যেত বয়সে বড়রা এসে বলতেন, ‘প্রথম আলোটা কার কাছে দেখি’—এই বলে নিয়ে নিতেন।
একসময় প্রথম আলো পড়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। কিন্তু সিরিয়াল ধরে পড়ার সময় মেলানো কঠিন হয়ে যায়। কারণ, চারটার পরে পত্রিকা দিয়ে যেতেন। সেই সময়ে অনেকেই আমার মতো অপেক্ষায় বসে থাকতেন। অপেক্ষায় থাকতে হতো কখন আমার পত্রিকা পড়ার পালা আসে। এভাবে কখনো কখনো সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। তখনো ছোট দেখে অনেকে বলতেন, ‘গ্যাদা, বাড়ি যাও। রাত হয়ে গেছে।’ সবাই জানত আমাদের বাড়ি অনেকটা দূরে। ঝোপঝাড় পেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমার কাছে এটাই মনে হতো, পত্রিকা আমাকে পড়তেই হবে। প্রথম আলো না পড়লে আমি জীবনে বড় কিছু হতে পারব না।
যে কারণে ভয় উপেক্ষা করে কখনো কখনো সন্ধ্যার পরও অপেক্ষা করতাম পত্রিকা পড়তে। তারপরই পথচারি খুঁজে তার পিছু নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতাম। কখনো কাউকে না পেলে ভয় নিয়ে বাড়ি ফিরতে হতো। তখন বাড়ি এসে লবণ দিয়ে পানি খেয়েছি এমন ঘটনাও বহুবার ঘটেছে। বাজারে বাবার দোকান ছিল, কখনো বাবার সঙ্গেও আসা হতো। কিন্তু বাবার সঙ্গে আসার অপেক্ষায় থাকলে অনেক রাত হতো। যে কারণে বহুবার পত্রিকা পড়ার জন্য সিরিয়াল ব্রেক করেছি। দেখা গেল কেউ একজন পড়া শেষ করলেই দ্রুত প্রথম আলো হাতে নিয়ে পড়া শুরু করতাম। তবে বেশির ভাগই শুনতে হতো, ‘এ গ্যাদা, এবার আমার সিরিয়াল।’ তখন মুখ কালো করে পত্রিকাটি দিয়ে দিতে হতো। প্রথম আলোর শুরু থেকে সবচেয়ে ভালো লাগত তারকাখচিত বিনোদন পাতা। এখন ভাবতে বেশ গর্ব লাগে। সেই বিনোদন পাতার একজন কর্মী আমি।
মো. মনজুরুল আলম, নিজস্ব প্রতিবেদক, কালচার অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট