দেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে সিম বিক্রিতে প্রতিযোগিতা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে দুই অপারেটর রবি আজিয়াটা ও বাংলালিংক। তারা প্রতিযোগিতা কমিশনে এ অভিযোগ করে।

রবির অভিযোগের পর গ্রামীণফোন এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা কমিশনের বিচারিক এখতিয়ার নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিল, যা আজ সোমবার খারিজ করে অভিযোগ আমলে নিয়েছে কমিশন।

প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন এ এইচ এম আহসান প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে শুনানির তারিখ জানানো হবে।

রবি গত জানুয়ারিতে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা কমিশনে অভিযোগ করেছিল। বিষয়টি নিয়ে ১৭ সেপ্টেম্বর প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যালয়ে শুনানি হয়। এতে তিন অপারেটরের আইনজীবী অংশ নেন। শুনানিতে গ্রামীণফোন ও রবি তাদের বক্তব্য তুলে ধরে। তবে বাংলালিংক আরও সময় চেয়ে আবেদন করে।

রবির অভিযোগে বলা হয়েছে, গ্রামীণফোন বাজার প্রতিযোগিতায় আগ্রাসী কৌশল ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে সিমের দাম কমাচ্ছে, প্রতারণামূলক মূল্য নির্ধারণ করছে এবং খুচরা বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণে বৈষম্যমূলক শর্ত আরোপ করছে। এর ফলে প্রতিযোগিতা আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। এতে প্রতিযোগী অপারেটরদের বাজারে প্রবেশাধিকার সীমিত হচ্ছে এবং দীর্ঘ মেয়াদে একচেটিয়া পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

বাংলালিংকও প্রায় একই অভিযোগ করেছে। এ অভিযোগের শুনানি হবে আগামী মাসে।

রবি ও বাংলালিংক কমিশনের কাছে গ্রামীণফোনের সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম তদন্ত করা, উৎপাদন ও বিপণন খরচের চেয়ে কম দামে সিম বিক্রি বন্ধে নির্দেশনা, অস্বাভাবিক মূল্য নির্ধারণ রোধ করা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া এবং বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ চেয়েছে।

রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, রবি কমিশনকে পূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতা জোরদার করে, এমন নীতি ও অনুশীলনের পক্ষে তাদের সমর্থন থাকবে।

গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে প্রথম আলোকে জানিয়েছে, অভিযোগ আমলে নেওয়ার বিষয়ে প্রতিযোগিতা কমিশনের আদেশের কথা তারা জানতে পেরেছে। তবে আদেশের কোনো প্রত্যয়িত অনুলিপি পায়নি। তাই এ বিষয়ে এখনই বিস্তারিত মন্তব্য তারা করতে পারছে না।

বিবৃতিতে বলা হয়, গ্রামীণফোন প্রতিযোগিতা আইন মেনে ব্যবসা করছে। তারা কোনো প্রতিযোগিতাবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত নয়। দেশের টেলিযোগাযোগ খাত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিটিআরসি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাজারে প্রবেশ, মূল্য নির্ধারণ এবং সব প্রতিযোগিতামূলক কার্যক্রমের তদারকি করে থাকে। গ্রামীণফোন এখন একটি সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার বা তাৎপর্যপূর্ণ বাজার ক্ষমতাসম্পন্ন (এসএমপি) অপারেটর হিসেবে কঠোর নিয়ন্ত্রক নির্দেশনার ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

এ গ্যাদা, এবার আমার সিরিয়াল

সপ্তাহের রোববার ও বুধবার আমাদের স্কুলের মাঠে হাট বসে। দুপুর গড়িয়ে গেলেই শুরু হতো কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ীদের হাঁকডাক। সময়ের সঙ্গে স্কুল মাঠে ব্যস্ততা বাড়ত। দুই হাটের দিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত পাঠদান চলত। জানুয়ারি মাসের এমন এক রোববারের হাটের দিন আমার  জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হলো।  

মাত্র কদিন হলো উচ্চমাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পা রেখেছি। পাঠ্যবই, শিক্ষকদের নিয়ে নতুন কৌতূহল। নতুন বইয়ের গন্ধ তখনো মনোমুগ্ধকর। এমন এক সকালে আমাদের গণিত শিক্ষক ইয়াকুব আলী স্যার হঠাৎ এলেন ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস নিতে। উত্তম কুমার স্যার সেদিন আসেননি। যে কারণে ইয়াকুব স্যারের আগমন। এখন মনে পড়লে বুঝি, ভাগ্যিস সেদিন উত্তম স্যার আসেননি। কেন সেই ঘটনা বলছি।

ইয়াকুব স্যার এসেই জানতে চাইলেন, ‘আজকে রুটিনে কী পড়ানো হবে?’ আমরা সবাই একসঙ্গে বলে উঠলাম, স্যার, আজ প্যারাগ্রাফ পড়ানোর দিন। সিলেবাসে অনুযায়ী সেদিন ছিল ‘দ্য নিউজপেপার’ প্যারাগ্রাফ বা অনুচ্ছেদ। স্যার শুরুতেই বললেন, ‘তোমরা কে কে খবরের কাগজ পড়ো?’ দেখা গেল একজন বাদে সবাই না সূচক মাথা নাড়ল। পত্রিকা, আমাদের বাজারের বেশ কয়েকজনকে মাঝেমধ্যে পড়তে দেখলেও তখনো আমি কোনো পত্রিকা সেই অর্থে পড়িনি। অতটা গুরুত্ব দিইনি। কখনো পত্রিকায় নায়িকাদের ছবি ছাপা হলে সেটা দেখতাম, এই যা। পারিবারিকভাবেও পত্রিকা পড়ার চল খুব একটা ছিল না। সময়টা ২০০০ সাল।

তখন স্যার পত্রিকা পড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বললেন। কেন জীবনে বড় হওয়ার জন্য নিয়মিত পত্রিকা পড়া দরকার, সেটা বোঝালেন। জীবনের ভালো কিছু করার কৌতূহল ছিল। যে কারণে আমার কাছে সেদিনই মনে হলো পত্রিকা তাহলে পড়তে হবে। এবার স্যার জানালেন, পারলে প্রথম আলো পত্রিকা পড়তে পারো। এই পত্রিকায় দেশ–বিদেশের সবচেয়ে ভালো, নির্ভরযোগ্য খবর ছাপায়। সেই প্রথম শুনলাম প্রথম আলো পত্রিকার নাম। অজপাড়াগাঁয়ের কে এই পত্রিকাটি পড়েন, খোঁজা শুরু করি।

আমার গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার আটঘড়িয়া থানার একদন্ত বাড়ইপাড়া গ্রামে। আমার স্কুলের নাম আশরাফ উচ্চবিদ্যালয়। শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে। যেতে হয় বেশির ভাগ কাঁচা পথ পেরিয়ে। সেই শহর থেকে একজন বয়স্ক হকার সাইকেল চালিয়ে আসতেন গ্রামে পত্রিকা দিতে। বিভিন্ন এলাকায় পত্রিকা দিয়ে বিকেল চারটার দিকে আসতেন আমাদের শিবপুর বাজারে। সেখানে বেশির ভাগই চলত করতোয়া নামে একটি পত্রিকা। কিন্তু প্রথম আলো তখনো কেউ রাখেন না। অবশেষে সেই হকারের কাছে একদিন জানতে চাইলাম, প্রথম আলো পত্রিকা কে রাখেন? শুনে বেশ অবাক হয়ে গেলেন। জানতে চাইলেন, ‘তুমি প্রথম আলো পড়তে চাও।’ আমি তাঁকে আগ্রহের কথা জানালাম। তিনি আমাকে পত্রিকার একটি কপি হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটাই প্রথম আলো। তুমি পড়তে থাকো। আর আমার সাইকেল দেখে রেখো। আমি বিএসসি স্যারকে একটি পত্রিকা দিয়ে আসি।’ শাহাবুদ্দিন বিএসসি স্যার আমাদের গণিতের শিক্ষক ছিলেন। তিনিও পাবনার আঞ্চলিক একটি পত্রিকা পড়তেন। নাম আজ আর মনে নেই।

সেই প্রথম আমার প্রথম আলো পত্রিকা দেখা ও পড়া। তারপর হকারের সঙ্গে বেশ খাতির জমে গেল। কিন্তু সমস্যা একটাই, পত্রিকাটি পড়ার জন্য ১০ মিনিট সময় পাওয়া যায়। এতে মন ভরে না। এর মধ্যেই একদিন খুশির খবর শোনালেন। জানালেন, আমাদের বাজারের এক পাশে এখন থেকে নিয়মিত প্রথম আলো পত্রিকা রাখা হচ্ছে। কোনো একটি উদ্যোগে সেখানে বেশ কটি পত্রিকা রাখা হতো। হাতের কাছে প্রথম আলো পাওয়া যাবে ভেবে মনটা আনন্দ নেচে উঠল।

আমাদের বাজারের ইছামতি নদী ঘেঁষে একটি ছোট দোকানের পাশে পত্রিকা পড়ার ব্যবস্থা হলো। সেখানে নিয়মিত পত্রিকা দেখি। কিন্তু সমস্যা একটাই। আমি ছিলাম পত্রিকা পড়ার দলে বলা যায় সবার ছোট। যে কারণে প্রথম আলো হাতে নিলেই দেখা যেত বয়সে বড়রা এসে বলতেন, ‘প্রথম আলোটা কার কাছে দেখি’—এই বলে নিয়ে নিতেন।

একসময় প্রথম আলো পড়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। কিন্তু সিরিয়াল ধরে পড়ার সময় মেলানো কঠিন হয়ে যায়। কারণ, চারটার পরে পত্রিকা দিয়ে যেতেন। সেই সময়ে অনেকেই আমার মতো অপেক্ষায় বসে থাকতেন। অপেক্ষায় থাকতে হতো কখন আমার পত্রিকা পড়ার পালা আসে। এভাবে কখনো কখনো সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। তখনো ছোট দেখে অনেকে বলতেন, ‘গ্যাদা, বাড়ি যাও। রাত হয়ে গেছে।’ সবাই জানত আমাদের বাড়ি অনেকটা দূরে। ঝোপঝাড় পেরিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমার কাছে এটাই মনে হতো, পত্রিকা আমাকে পড়তেই হবে। প্রথম আলো না পড়লে আমি জীবনে বড় কিছু হতে পারব না।

যে কারণে ভয় উপেক্ষা করে কখনো কখনো সন্ধ্যার পরও অপেক্ষা করতাম পত্রিকা পড়তে। তারপরই পথচারি খুঁজে তার পিছু নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতাম। কখনো কাউকে না পেলে ভয় নিয়ে বাড়ি ফিরতে হতো। তখন বাড়ি এসে লবণ দিয়ে পানি খেয়েছি এমন ঘটনাও বহুবার ঘটেছে। বাজারে বাবার দোকান ছিল, কখনো বাবার সঙ্গেও আসা হতো। কিন্তু বাবার সঙ্গে আসার অপেক্ষায় থাকলে অনেক রাত হতো। যে কারণে বহুবার পত্রিকা পড়ার জন্য সিরিয়াল ব্রেক করেছি। দেখা গেল কেউ একজন পড়া শেষ করলেই দ্রুত প্রথম আলো হাতে নিয়ে পড়া শুরু করতাম। তবে বেশির ভাগই শুনতে হতো, ‘এ গ্যাদা, এবার আমার সিরিয়াল।’ তখন মুখ কালো করে পত্রিকাটি দিয়ে দিতে হতো। প্রথম আলোর শুরু থেকে সবচেয়ে ভালো লাগত তারকাখচিত বিনোদন পাতা। এখন ভাবতে বেশ গর্ব লাগে। সেই বিনোদন পাতার একজন কর্মী আমি।

মো. মনজুরুল আলম, নিজস্ব প্রতিবেদক, কালচার অ্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট

সম্পর্কিত নিবন্ধ