ক্রিকেটে মাদক কেলেঙ্কারি : ওয়ার্ন থেকে রাবাদা
Published: 5th, May 2025 GMT
চোখে তাঁর এখনও কিশোর বয়সের ছাপ, মাঠে বল হাতে আগ্রাসন থাকলেও সেলিব্রেশনে কখনও তাঁকে উগ্র হতে দেখা যায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার সেই পেসার কাগিসো রাবাদা এবার জড়িয়ে পড়েছেন মাদক কেলেঙ্কারিতে। ক্রিকেটে ‘ডোপ টেস্ট’ চালু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত ৪৪ জনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আইসিসি। যাদের কেউ কেউ শক্তি বাড়াতে গিয়ে আবার কেউ কেউ ব্যথা কমাতে গিয়ে নিষিদ্ধ ওষুধ নিয়েছেন। তবে শুধু বিনোদন বা রিফ্রেশের কারণে মাদক গ্রহণের ঘটনা খুব বেশি নেই।
অস্ট্রেলিয়ার প্রয়াত কিংবদন্তি ক্রিকেটার শেন ওয়ার্নের নাম জড়িয়েছিল কোকেন সেবনের দায়ে, পাকিস্তানের শোয়েব আকতার ও মোহাম্মদ আসিফ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন মাদক গ্রহণের কারণে। এমন বহু প্রতিভা সময়ের আগে শেষ হয়েছে শুধু এই কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে। তবে তাদের মধ্যে অনেকেই শুধরে নিয়ে আবার মাঠে ফিরতে পেরেছেন। তাদের মতো রাবাদাও কি পারবেন মাদকের কালোছায়া কাটিয়ে মাঠে ফিরতে?
‘আমি ভুল করেছি, দুঃখ প্রকাশ করছি সমর্থকদের কাছে। ক্রিকেট আমার কাছে শুধু একটি খেলাই নয়, বরং এটা আমার জীবনের বড় একটা সুযোগ ও সম্মান। আমি মাঠে ফেরার অপেক্ষায় থাকব।’ আপাতত সাময়িক নিষেধাজ্ঞায় থাকলেও রাবাদা এখনও জানেন না তাঁর শাস্তি কত মাস বা কত বছর হতে পারে। আগামী সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকার মাদকবিরোধী সংস্থা রাবাদার শাস্তির মেয়াদ জানাতে পারে।
ক্রিকেটে প্রথম মাদক কেলেঙ্কারির ঘটনা সামনে আসে ১৯৮৭ সালের মে মাসে। যখন গাজা সেবনের কারণে ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ইয়ান বোথামের ওপর। সেই ঘটনা আলোড়ন তোলে ক্রিকেটবিশ্বে। নব্বইয়ের দশকে কোকেন গ্রহণ করে ২২ মাস নিষিদ্ধ হয়েছিলেন সাবেক ইংলিশ পেসার ইয়ান স্মিথ। মাঝে বেশ কয়েক বছর এই ধরনের ঘটনা শিরোনামে আসেনি। এরপর ২০০৩ সালে শেন ওয়ার্নের মাদক কেলেঙ্কারি ট্যাবলয়েডগুলোর বাজার গরম করে দেয়। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এই লেগ স্পিনার কোকেন সেবনের দায়ে বিশ্বকাপের মাঝপথ থেকেই ফিরে আসেন। নিষিদ্ধ হন এক বছর। এর আগে সিগারেট, অ্যালকোহল, নাইট পার্টিসহ বিভিন্ন ব্যাপারে নাম জড়িয়ে যায় তাঁর। তারকা এই লেগস্পিনারকে ‘হলিউড’ ডাকনাম দেয় ব্রিটিশ মিডিয়া। যদিও শেষ দিকে রিহ্যাব করে মাদক থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন ওয়ার্ন।
অস্ট্রেলিয়ান এ তারকার পর ২০০৬ সালে দুই পাকিস্তান ক্রিকেটারের নাম চলে আসে ডোপিং কেলেঙ্কারিতে। শোয়েব আকতার ও মোহাম্মদ আসিফ শক্তিবর্ধনের জন্য নেন নিষিদ্ধ ন্যানড্রনিল স্টেরয়েড। মূত্র পরীক্ষায় তা ধরা পড়লে শোয়েব দুই বছর আর আসিফ এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন ক্রিকেটে। তারপর অবশ্য শোয়েব সুস্থ জীবনে ফিরতে পেরেছিলেন। কিন্তু আসিফ আবার জড়িয়ে যান মাদকের সঙ্গে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে দুবাই বিমানবন্দরে মাদকসহ ধরা পড়েন তিনি। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে গত বছরের এপ্রিলে এমন একটা কেলেঙ্কারির খবর সামনে আসে। কোকেন সেবনের দায়ে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় ডগ ব্রেসওয়েলকে। সেই তালিকায় সর্বশেষ নাম এবার কাগিসো রাবাদা।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স বন র
এছাড়াও পড়ুন:
স্টার্টআপ বিনিয়োগ চাঙ্গা করতে হলে
বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোগের বিস্তার একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকজুড়ে এক বৈপ্লবিক গতি পেয়েছে। স্টার্টআপ এখন শুধু একটি ব্যবসা উদ্যোগ নয়, বরং নতুন অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। প্রযুক্তি, সৃজনশীলতা ও উদ্যোক্তামনস্কতার সংমিশ্রণে এই স্টার্টআপ মডেল তরুণদের মধ্যে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই স্বপ্নযাত্রার প্রধান বাধা অর্থায়ন বা ফান্ডিং। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে, বিশেষত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জ আরও ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। এখানে সম্ভাবনা থাকলেও কাঠামোগত জটিলতা, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও বিনিয়োগকারীদের অনীহার কারণে অনেক স্টার্টআপ অঙ্কুরেই
ঝরে পড়ে।
বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগের প্রবণতাও বড় পরিবর্তন এসেছে। নিউইয়র্কভিত্তিক ক্যাপিটাল মার্কেট কোম্পানি সিবি ইনসাইটসের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বৈশ্বিক স্টার্টআপ ফান্ডিং ৩৮ শতাংশ হ্রাস পেয়ে প্রায় ২৮৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। অর্থনৈতিক মন্দা, উচ্চ সুদের হার এবং লাভজনকতার প্রতি বিনিয়োগকারীদের অধিক মনোযোগ এই পরিবর্তনের পেছনে দায়ী। এই বাস্তবতা দক্ষিণ এশিয়ার মতো উদীয়মান বাজারের জন্য একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের চিত্রটিও মোটেই ভিন্ন নয়। বাংলাদেশের ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টিং লাইটক্যাসেল পার্টনার্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৪২ শতাংশ কম। একই বছরে বিনিয়োগের ৯৯ শতাংশই এসেছে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে, যা দেশে স্থানীয় পুঁজির সীমাবদ্ধতাকে স্পষ্ট করে তোলে। ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে বিনিয়োগ আরও কমে দাঁড়ায় মাত্র ৪ মিলিয়ন ডলারে, যেখানে ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় পতন ছিল ৭৭ শতাংশ (সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার, অক্টোবর ২০২৩)। এই সংকটের পেছনে রয়েছে একাধিক কাঠামোগত দুর্বলতা। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের স্টার্টআপ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, বিনিয়োগ ঝুঁকি গ্রহণে অনীহা এবং নীতিগত অস্বচ্ছতা একটি বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে আরও গভীরভাবে বুঝতে হলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা জরুরি। ২০২৪ জানুয়ারি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের খবর অনুযায়ী, ভারতে ২০২৩ সালে স্টার্টআপ ফান্ডিং ৬০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে। পাকিস্তানেও পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। রেস্ট অব ওয়ার্ল্ডের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে পাকিস্তানে স্টার্টআপ ফান্ডিং নেমে এসেছে ১৫ দশমিক ১৫ মিলিয়ন ডলারে, যা ২০২০ সালের পর সর্বনিম্ন। অথচ এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে ভারত ইতোমধ্যে একটি শক্তিশালী স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে তুলেছে, যেখানে সরকার, করপোরেট ও একাডেমিয়া মিলিতভাবে কাজ করছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সমন্বয় এখনও অনুপস্থিত।
বিষয়টি আরও গভীরভাবে বোঝার জন্য আমাদের বুঝতে হবে, কেন বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা এখনও স্টার্টআপকে ‘নিরাপদ’ বিনিয়োগ বলে বিবেচনা করেন না। এর উত্তর লুকিয়ে আছে দেশের বিনিয়োগ সংস্কৃতিতে। স্টার্টআপের সবচেয়ে বড় সম্পদ মানুষ ও মেধাসম্পদ– যা প্রথাগত ব্যবসার দৃষ্টিতে অদৃশ্য বা অননুমেয়। ফলে প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নে এসব অ্যাসেট বিবেচনায় না নিয়ে তাকে কম মূল্য দিয়ে থাকে অনেক বিনিয়োগকারী।
এখানে যদি দক্ষিণ কোরিয়ার উদাহরণ দেখি, ২০১৯ সালে দেশটির সরকার প্রায় ২ বিলিয়ন ডলারের একটি স্টার্টআপ ইনিশিয়েটিভ চালু করে। সরকারি তহবিল, কর ছাড় ও প্রযুক্তি পার্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে তারা পাঁচ বছরে ইউনিকর্ন স্টার্টআপ সংখ্যা ১৫ থেকে ৩৪-এ উন্নীত করে। বাংলাদেশেও ২০২০ সালে আইসিটি ডিভিশনের অধীনে ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড’ গঠিত হয়, যার প্রাথমিক তহবিল ছিল ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু এই তহবিল থেকে কার্যকর প্রকল্পে কতটা বণ্টন হয়েছে, সে বিষয়ে এখনও পর্যাপ্ত স্বচ্ছতা নেই।
এই সংকট উত্তরণে সরকারি পর্যায়ে প্রয়োজন একটি জাতীয় স্টার্টআপ নীতি, যেখানে কর রেয়াত, রপ্তানি প্রণোদনা, সহজতর কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সুবিধা নিশ্চিত থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উচিত স্টার্টআপ লোন প্যাকেজ চালু করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে আংশিক গ্যারান্টি প্রদানের চিন্তা করা। একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘ইনোভেশন হাব’ বা ইনকিউবেটর তৈরির সুযোগ দিলে তরুণ উদ্যোক্তারা গবেষণা থেকে ব্যবসার বাস্তবায়ন পর্যন্ত একটি পরিপূর্ণ যাত্রা সম্পন্ন করতে পারবেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। তাদের কাছে বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলোকে পিচ করার জন্য একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গঠন করা যেতে পারে, যেটি হবে সরকার-প্রণোদিত এবং স্বচ্ছ পদ্ধতিতে পরিচালিত। একইভাবে আন্তর্জাতিক ডেভেলপমেন্ট পার্টনারদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়েও স্টার্টআপ পুঁজি সংগ্রহ সম্ভব।
স্টার্টআপ এখন শুধু ব্যবসা নয়, এটি একটি ‘ভিশন’। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনে স্টার্টআপের ভূমিকা অপরিসীম। সরকার, বিনিয়োগকারী এবং সমাজের সমন্বিত উদ্যোগ
ছাড়া বাংলাদেশ এই সম্ভাবনার দিগন্তে পৌঁছাতে পারবে না।
মীর হাসিব মাহমুদ: সহ-প্রতিষ্ঠাতা-লিড নেশন একাডেমি (এলএনএ), চিফ বিজনেস অফিসার-গোইয়ারা লিমিটেড ও ফাউন্ডার-বেস্ট এইড