নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত থেকে জানা যায়, তিনি আল্লাহর বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন রাজা ও নেতার কাছে বার্তা প্রেরণ করেছিলেন। তিনি তাঁদের ইসলামের পথে আহ্বান জানানোর জন্য নিখুঁত কৌশলে চিঠি পাঠাতেন। তৎকালীন বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যে রোম সম্রাট কায়সারের নিকট পাঠানো একটি চিঠিতে তিনি তাঁকে সম্বোধন করেন: ‘বাইজেন্টাইনদের মহান নেতা’ হিসেবে। এই সম্মানসূচক উপাধির মাধ্যমে তিনি একদিকে সম্রাটকে সম্মান দেখান, আবার অন্যদিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দাওয়াতি কৌশল ব্যবহার করেন। চিঠির মধ্যে তিনি কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটি উদ্ধৃত করেন: ‘হে কিতাবধারীরা, এসো, আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একটি অভিন্ন কথায় পৌঁছাই—তা হলো, আমরা আল্লাহ ছাড়া কাউকে উপাসনা করব না। (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৬৪)

এই বার্তায় রাসুল (সা.

) একসঙ্গে কয়েকটি কৌশল ব্যবহার করেন: ১. তিনি সম্মান দেখান। ২. গ্রহণযোগ্য ও পরিচিত একটি বক্তব্য পেশ করেন, যা প্রাপক ও প্রেরক—উভয়ের মধ্যেই মিল তৈরি করে। ৩. হৃদয় আকৃষ্ট করেন এবং তারপর সত্যের দাওয়াত দেন।

রাসুল (সা.)–এর শিক্ষাদান পদ্ধতি

রাসুল (সা.)–এর জীবনে এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে তিনি আমন্ত্রিত ব্যক্তিকে প্রথমে সম্মান দিয়েছেন, তারপর তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন, হৃদয়কে কাছে এনেছেন এবং এরপর ইসলামের আহ্বান করেছেন। তাঁর এই পদ্ধতিগুলো এতটাই প্রাঞ্জল, মানবিক ও কার্যকর শিক্ষা ছিল যে আজকেরও বাস্তবতায় সেগুলো অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলমান, শিক্ষক, ইমাম ও ধাই-এর জন্য অপরিহার্য মনে করা যায়। আমরা এমন ১২টি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।

আরও পড়ুনআলী (রা.) এর শেখানো ঋণ মুক্তির দোয়া১২ ডিসেম্বর ২০২৪

ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে

আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা যা করো না, তা কেন বলো? আল্লাহর কাছে অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ এটি যে তোমরা এমন কথা বলো, যা তোমরা করো না।’ (সুরা আস-সাফ, আয়াত: ২-৩)

রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো এমন কোনো কথা প্রচার করেননি, যা তিনি নিজে পালন করতেন না। তিনি এই আয়াতের আলোকে তাঁর অনুসারীদেরও শেখান—আগে নিজে আমল করো, পরে অন্যকে শিক্ষা দাও।

হুদাইবিয়া সন্ধির একটি বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছি। হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তির সময়, যখন চুক্তি লেখা শেষ হলো, তখন রাসুল (সা.) সাহাবিদের বললেন, ‘গিয়ে কোরবানির পশু জবাই করো এবং মাথার চুল কেটে ফেলো।’ কিন্তু কেউ উঠল না। তিনি আবার বললেন, আবারও কেউ সাড়া দিল না। তিনি তিনবার একই কথা বললেন, তবু কেউ এগিয়ে এল না।

রাসুল (সা.) মন খারাপ করে উম্মে সালামার (রা.) কাছে গেলেন এবং সাহাবিদের প্রতিক্রিয়া বললেন। উম্মে সালামা (রা.) পরামর্শ দিলেন: ‘আল্লাহর রাসুল, আপনি কি চান তাঁরা আপনার কথা পালন করুক? তবে আপনি বাইরে যান, কোনো কথা না বলে নিজের কোরবানি করুন এবং নাপিত ডেকে মাথা মুণ্ডন করান।’

রাসুল (সা.) উম্মে সালামার পরামর্শমতো করলেন। সাহাবিরা তা দেখে নিজেরা কোরবানি দিলেন এবং চুল কেটে ফেললেন। হাদিসে এসেছে, ‘তারা এত ভিড় করেছিল যে মনে হচ্ছিল—একে অপরকে মেরে ফেলবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৭৩১; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩৩৩৫)

এ ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায়, কখনো কখনো আদেশের চেয়ে দৃষ্টান্তের প্রভাব অনেক বেশি কার্যকর হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন এমন এক শিক্ষক, যিনি আগে নিজে করে দেখাতেন, পরে অন্যকে উৎসাহ দিতেন।

প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে

এই পদ্ধতির এক সুপ্রসিদ্ধ দৃষ্টান্ত হলো ‘হাদিসে জিবরাইল’। জিবরাইল (আ.) মানুষের রূপে এসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে বসেন এবং জিজ্ঞেস করেন: ইমান কী? ইসলাম কী? ইহসান কী? কিয়ামত কবে ঘটবে?

রাসুল (সা.) প্রতিটি প্রশ্নের বিশদ উত্তর দেন। এরপর সাহাবিদের বলেন: ‘এ ব্যক্তি ছিলেন জিবরাইল। তিনি এসেছিলেন তোমাদের তোমাদের দ্বীন শিক্ষা দিতে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮)

এই হাদিস প্রমাণ করে, প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি একজন শিক্ষক ও ছাত্র উভয়ের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে এবং শিক্ষা সহজ ও স্মরণীয় করে তোলে।

আরও পড়ুনসাইয়েদুল ইস্তিগফার কীভাবে করবেন২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

খুতবা ও ভাষণের মাধ্যমে

রাসুল (সা.) নিয়মিত ভাষণ দিতেন এবং প্রতি জুমায় খুতবা দিতেন। এই খুতবাগুলোর মাধ্যমে তিনি সাহাবিদের: দ্বীন সম্পর্কে শিক্ষা দিতেন, উম্মাহর উদীয়মান চাহিদা ও সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করতেন এবং আত্মার পরিশুদ্ধি ও আখিরাতের প্রতি আকর্ষণের দিকেও গুরুত্ব দিতেন। খুতবার মাধ্যমে তিনি উম্মাহকে ইমান, আদর্শ, পারস্পরিক সম্পর্ক, সমাজ গঠন ও আল্লাহভীতির শিক্ষা দিতেন। এতে তাঁর ভাষণ হতো হৃদয়গ্রাহী, চিন্তাশীল এবং জীবনঘনিষ্ঠ। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৬৭; সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯১৭)

সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে

রাসুলুল্লাহ (সা.) মাঝেমধ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিতেন, যাতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মুসলমানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, অথবা কোনো গর্হিত কাজ থেকে সতর্ক করা যায়। তবে তিনি তা নিয়মিত করতেন না—কেননা, তাতে সাহাবিরা বিরক্ত বা ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারেন। তিনি মানুষের মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত তথ্য দিয়ে ‘ভারী’ করে দিতে চাইতেন না। শিক্ষা হোক হৃদয়গ্রাহী, মনে দাগ কাটে এমন—এমনটাই ছিল তাঁর পদ্ধতি।

এই পদ্ধতিতে সাহাবারাও রাসুল (সা.)–কে অনুসরণ করতেন। শকিক (রহ.) বর্ণনা করেন, ‘আমরা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের দরজার সামনে বসে ছিলাম তাঁর বক্তব্য শোনার আশায়। তখন ইয়াজিদ ইবনে মু’আবিয়া নামক ব্যক্তি আমাদের সামনে দিয়ে গেলেন। আমরা তাকে বললাম, ‘আমাদের উপস্থিতির কথা তাঁকে জানান।’ তিনি ভেতরে গিয়ে জানালে, ইবনে মাসউদ (রা.) বের হয়ে এসে বললেন, ‘আমি তোমাদের উপস্থিতির কথা জানতে পেরেছি, কিন্তু আমি বের হতে দেরি করেছি শুধু এই কারণে যে, আমি চাইনি আপনারা বিরক্ত হন। কারণ, আল্লাহর রাসুল (সা.)-ও নির্দিষ্ট দিনে নিয়মিত খুতবা দিতেন না, যাতে আমরা ক্লান্ত না হয়ে পড়ি।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮২১)

আরও পড়ুনজান্নাতে যাওয়ার সহজ উপায়০৮ ডিসেম্বর ২০২৪

নামাজের পর সামান্য আলাপে

রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজের পর সাহাবিদের সঙ্গে সামান্য আলাপচারিতা করতেন কখনো কোনো বিষয় স্পষ্ট করার জন্য, আবার কখনো চলমান প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য। এ ধরনের দিকনির্দেশনা রাসুল (সা.)-এর বহু হাদিসে পাওয়া যায়। তবে তাঁর এ অভ্যাস ছিল অত্যন্ত কার্যকর ও তাৎক্ষণিক প্রভাবশালী। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৮৬৭; সহিহ বুখারি, হাদিস: ৯১৭)

প্রশ্ন উত্থাপন করে

রাসুল (সা.) কখনো কখনো নিজেই প্রশ্ন তুলতেন, যাতে মানুষের আগ্রহ ও মনোযোগ তৈরি হয়। এভাবে তিনি আলোচনা শুরু করতেন এবং ধীরে ধীরে তার মর্মে পৌঁছাতেন। তাঁর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল—লোকজনের প্রচলিত ধারণার মধ্যে নতুন অর্থ ও উপলব্ধি যুক্ত করা। শব্দ একই থাকলেও অর্থে আসত গভীরতা।

এর একটি প্রসিদ্ধ দৃষ্টান্ত হলো ‘মুফলিস’বিষয়ক হাদিস। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে: রাসুল (সা.) একদিন সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা জানো মুফলিস কে?’ সাহাবারা উত্তর দিলেন, ‘আমাদের মধ্যে মুফলিস হলো সেই ব্যক্তি, যার কাছে টাকাপয়সা বা সম্পদ নেই।’ তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমার উম্মতের মুফলিস হলো সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও জাকাত নিয়ে আসবে; কিন্তু সে এই লোককে গালি দিয়েছে, ওকে অপবাদ দিয়েছে, অন্যের সম্পদ খেয়েছে, কাউকে মারধর করেছে বা রক্ত ঝরিয়েছে। তখন তার নেক আমল তাদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। যদি তার নেক আমল শেষ হয়ে যায়, তবে ভুক্তভোগীদের গুনাহ তাকে দিয়ে দেওয়া হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৮১)

এই হাদিসের মাধ্যমে নবীজি (সা.) কেবল একটি পরিভাষার অর্থই নতুন করে ব্যাখ্যা করেননি, বরং সাহাবিদের চিন্তার ধারা পাল্টে দিয়েছেন। এটি ছিল প্রশ্ন উত্থাপন করে চেতনা জাগানোর এক চমৎকার কৌশল।

কাহিনি বলে

রাসুল (সা.) অতীতের নবী-রাসুল ও বিভিন্ন জাতির কাহিনি বর্ণনা করতেন—এমনকি পূর্ববর্তী উম্মতের কোনো ব্যক্তির ঘটনাও তুলে ধরতেন এমনভাবে, যাতে মুসলমানরা তা থেকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করতে পারে। এই পদ্ধতির একটি বিখ্যাত উদাহরণ হলো ‘খন্দকের লোকদের’ কাহিনি, যেটি ‘জাদুকর, সন্ন্যাসী এবং দাস-শিশু’-কে কেন্দ্র করে উপস্থাপিত হয়েছে। এই কাহিনি থেকে তওহিদের পথ, ত্যাগ, দৃঢ়তা এবং শাহাদতের শিক্ষা পাওয়া যায়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩০০৫)

এ ঘটনা ‘আসহাবুল উখদূদ’ নামেও পরিচিত; যা সুরা বুরুজে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন। পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতকের গোড়ার দিকে ইয়েমেনে এক অত্যাচারী রাজা নিজেরে ঈশ্বর দাবি করত। যারা একমাত্র আল্লাহর ওপর ইমান এনেছিল, তাদের শাস্তি হিসেবে মাটিতে গভীর খন্দক (গর্ত) খনন করে এবং তাতে আগুন জ্বালিয়ে বলে, রাজাকে উপাস্য না ভাবলে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। কিন্তু তারা ইমানের ওপর অবিচল থাকল। ফলে তাদের একে একে আগুনের মধ্যে ফেলে হত্যা করা হয়। এমনকি এক নারী ও তার শিশুসন্তানকেও, তবে আল্লাহর কুদরতে শিশুটি মায়ের সাহস বাড়ানোর জন্য কথা বলে এবং মা-ও ইমান নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেন।

এভাবে কাহিনি বলার মাধ্যমে রাসুল (সা.) সাহাবিদের হৃদয় জয় করতেন, তাঁদের চেতনা জাগ্রত করতেন এবং অন্তরে প্রভাবিত করতেন।

উপমা দিয়ে

রাসুল (সা.) বিভিন্ন বিমূর্ত ধারণাকে সহজভাবে বোঝানোর জন্য উপমা ব্যবহার করতেন। এভাবে তিনি সাহাবিদের অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে ইমানের আলোয় নিয়ে আসতেন।

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত বিখ্যাত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার ও পূর্ববর্তী নবীদের মধ্যে উদাহরণ এমন, যেন কেউ একটি সুন্দর বাড়ি তৈরি করল, কেবল একটি কোনায় একটি ইটের স্থান ফাঁকা রইল। মানুষ বাড়িটি দেখে মুগ্ধ হয় এবং বলে: ‘ইশ্‌, এই ইটটা যদি থাকত!’ আমিই সেই ইট এবং আমি শেষ নবী।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৫৩৫; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২২৮৬)

এই উপমার মাধ্যমে রাসুল (সা.) বুঝিয়ে দেন, নবীচক্রের পূর্ণতা তাঁর মাধ্যমে এসেছে, তবে পূর্ববর্তী নবীদেরও ওই বাড়ির অন্যান্য ইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

ব্যবহারিক অনুশীলনের মাধ্যমে

রাসুল (সা.) শুধু মুখে বলেই শিক্ষা দিতেন না, বরং ব্যবহারিক অনুশীলনের মাধ্যমে শিখিয়ে দিতেন কীভাবে করণীয় কাজগুলো সম্পাদন করতে হয়। এর একটি বাস্তব উদাহরণ হলো—সেই বেদুইনের ঘটনা, যে তাঁর কাছে নামাজের সময় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল।

সুলায়মান ইবনে বুরাইদা (রহ.) তাঁর পিতার সূত্রে হাদিস বর্ণনা করেন, বেদুইন ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সালাতের সময় কখন?’ নবীজি (সা.) বললেন: ‘আমাদের সঙ্গে দুই দিন নামাজ পড়ো।’ প্রথম দিন: জোহরের ওয়াক্ত শুরু হলে তিনি বিলালকে আজান দিতে বললেন এবং নামাজ আদায় করলেন। এরপর তিনি আসরের ইকামত দিলেন, যখন সূর্য এখনো উজ্জ্বল ছিল। মাগরিবের সালাত পড়লেন সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। এশার নামাজ পড়লেন যখন গোধূলির আলো মিলিয়ে গেল। ফজর পড়লেন যখন ফজরের আলো ফুটে উঠল। পরের দিন: জোহর দেরিতে পড়লেন, রোদ কমে যাওয়ার পর। আসর দেরিতে আদায় করলেন। মাগরিব পড়লেন গোধূলির আগে। এশা এক-তৃতীয়াংশ রাত পার হলে আদায় করলেন। ফজর পড়লেন সূর্যোদয়ের আগমুহূর্তে। তারপর তিনি বললেন: ‘যে লোক আমাকে সালাতের সময় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল, সে কোথায়?’ লোকটি বলল, ‘আমি।’ রাসুল (সা.) বললেন: ‘তোমার নামাজের সময় এই দুই দিনের সীমার মধ্যে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬১৩)

এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, রাসুল (সা.) কীভাবে হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন, যা ছিল এক বিশুদ্ধ ব্যবহারিক শিক্ষাপদ্ধতি।

প্রয়োগ দেখিয়ে

রাসুলুল্লাহ (সা.) মাঝেমধ্যে কাউকে সরাসরি একটি কাজ করার সুযোগ দিতেন, তারপর সেই কাজের ভুলগুলো সংশোধন করে তাকে শেখাতেন। এতে শিক্ষার্থী নিজের ভুল বুঝতে পারত এবং শেখার প্রক্রিয়া আরও গভীর ও কার্যকর হতো।

এই পদ্ধতির চমৎকার উদাহরণ একটি বিখ্যাত হাদিসে পাওয়া যায়। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আছে: ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) একদিন মসজিদে প্রবেশ করলেন। একজন ব্যক্তি তাঁর পেছনে এসে নামাজ আদায় করল, তারপর এসে সালাম দিল। নবীজি (সা.) বললেন: ‘ফিরে যাও এবং নামাজ পড়ো, কারণ তুমি নামাজ আদায় করোনি।’ লোকটি আবার ফিরে গিয়ে আগের মতোই নামাজ পড়ে এল। আবার সালাম দিলে রাসুল (সা.) বললেন: ‘ফিরে যাও এবং নামাজ পড়ো, কারণ তুমি নামাজ পড়োনি।’ এভাবে তিনবার হলে, লোকটি বলল: ‘সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন, আমি এর চেয়ে ভালোভাবে নামাজ পড়তে পারি না। আমাকে শেখান কীভাবে নামাজ পড়তে হয়।’

রাসুল (সা.) বললেন, ‘যখন তুমি নামাজের জন্য দাঁড়াও, তখন তকবির বলো, তারপর কোরআন থেকে যা জানো, তা পড়ো। তারপর রুকু করো যতক্ষণ না তুমি স্থিরতায় পৌঁছাও। তারপর উঠে সোজা দাঁড়াও। এরপর সেজদা করো যতক্ষণ না তুমি স্থির হও। তারপর শান্তভাবে বসো, এরপর আবার একইভাবে করো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭৫৭; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩৯৭)

আরও পড়ুনইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার০৬ ডিসেম্বর ২০২৪

শিক্ষকের সান্নিধ্যে সময় কাটিয়ে

রাসুল (সা.)-এর শিক্ষাদানের আরেকটি পদ্ধতি ছিল, শিক্ষার্থীদের তাঁর সঙ্গে রাখা, যাতে তারা তাঁর কার্যকলাপ, ওহি গ্রহণ, সিদ্ধান্ত এবং আচরণ কাছ থেকে দেখতে ও শিখতে পারে। যখনই তিনি কোনো যুদ্ধে যেতেন, তখন যাঁরা যুদ্ধ করতে সক্ষম, তাঁরা সবাই তাঁর সঙ্গে থাকতেন। কেউ পেছনে থাকতে পারতেন না, যতক্ষণ না তাঁর অনুমতি থাকত। আরও চমৎকার হলো, যখন কোনো সামরিক বাহিনী পাঠানো হতো, তখন রাসুল (সা.) কয়েকজন সাহাবিকে পেছনে রেখে যেতেন, যাতে তারা এই সময়ে নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে থেকে ওহির যে শিক্ষা এত দিন পেয়েছেন, তা অন্যদের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারেন।

 আল্লাহ নিজেই কোরআনে এই নীতির উল্লেখ করেছেন, ‘মুমিনদের পক্ষে উচিত নয় যে, তারা সবাই একসঙ্গে বেরিয়ে পড়বে (জিহাদের জন্য)। সুতরাং প্রতিটি দলের মধ্য থেকে কিছু লোক থাকা উচিত, যারা দ্বীন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করবে এবং তাদের সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গিয়ে সতর্ক করবে, যাতে তারা সতর্ক হয়।’ (সুরা আত-তাওবা, আয়াত: ১২২)

কাউকে লজ্জা না দিয়ে

রাসুল (সা.)-এর দাওয়াতি পদ্ধতির এক অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি কখনো কাউকে প্রকাশ্যে লজ্জা দিতেন না। যদি কোনো ব্যক্তি ভুল করত, তিনি জনসমক্ষে কখনো নাম বলতেন না। বরং বলতেন: ‘কী হলো কিছু লোকের, তারা এমন এমন কাজ করে?’

এভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুঝে ফেলত যে কথাটি তার উদ্দেশ্যে, কিন্তু সে জনসমক্ষে অপমানিত হতো না। এতে সে নিজেই নিজের ভুল সংশোধনে আগ্রহী হতো।

 এই পদ্ধতি আমাদের শেখায় যে দাওয়াত মানে কাউকে নিন্দা করা নয়, বরং তাকে আল্লাহর দিকে ডেকে আনা। একজন প্রকৃত ধাই কখনো কাউকে অপমান বা উপহাস করে সংশোধন করেন না।

ওপরের ১২টি পদ্ধতি আমাদের জানায়, রাসুল (সা.) কেবল একজন শিক্ষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন হৃদয়জয়ী নেতা, আদর্শ প্রচারক এবং মহানুভব ব্যক্তিত্বের অধিকারী। আজকের যুগে আমাদের সবচেয়ে বড় সংকট—এমন প্রচারকের অভাব, যাঁরা এই মহান পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করেন। অনেকে ইসলাম শিক্ষা দিতে গিয়ে এমন সব পদ্ধতি প্রয়োগ করেন, যাতে মানুষ প্রকৃত শিক্ষা থেকে আরও দূরে সরে যায়।

আরও পড়ুনউয়ায়েস করনির কাহিনি০৮ মার্চ ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সহ হ ব খ র ব যবহ র ক ড স ম বর ক র যকর র জন য আল ল হ কর ছ ন আম দ র ম ফল স রপর ত র সময ইসল ম ত রপর করল ন করত ন র একট বলল ন রপর স ন এমন

এছাড়াও পড়ুন:

নৃশংসতার সেই রাতের ৯ বছর আজ 

৯ বছর আগের এই দিনেই ঢাকার গুলশানের এক নিরিবিলি সন্ধ্যা রূপ নেয় বিভীষিকায়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই সন্ধ্যার পর গুলশানে কূটনৈতিক এলাকার একটি রেস্তোরাঁ, হোলি আর্টিজান বেকারিতে সশস্ত্র হামলা চালায় জঙ্গিরা।

সেই রাতে ২০ জন নিরীহ মানুষ নির্মমভাবে প্রাণ হারান জঙ্গিদের হাতে। তাঁদের মধ্যে ১৭ জন ছিলেন ইতালি, জাপান, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে যাওয়া পুলিশের দুই কর্মকর্তা নিহত হন জঙ্গিদের নিক্ষেপ করা বোমায়।

রাতভর চলা সেই জিম্মি পরিস্থিতির অবসান ঘটে পরদিন সকালে, সেনাবাহিনী পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’-এর মাধ্যমে। ওই অভিযানে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। জীবিত উদ্ধার করা হয় ১৩ জন জিম্মিকে। 

হামলার দায় স্বীকার করে ওই রাতেই বিবৃতি দিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। তৎকালীন সরকার আইএসের এই দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেছিল, দেশীয় জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবি এই হামলার জন্য দায়ী।

নৃশংস সেই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় করা মামলাটি বিচারিক প্রক্রিয়ায় দুটি ধাপ পেরিয়েছে। এ মামলায় বিচারিক আদালতের পর হাইকোর্টে রায় হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেছেন দণ্ডিত আসামিরা, যা শুনানির অপেক্ষায়।

এর আগে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল এই মামলার রায় দেন। বিচারিক আদালতের রায়ে ‘নব্য জেএমবির’ সাত সদস্যকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এরপর ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল ও জেল আপিলের শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর রায় দেন। রায়ে সাত আসামিকে আমৃত্যু কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়।

হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা গত মাসে (জুন) আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় পৃথক লিভ টু আপিল করেন বলে জানান আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী মো. আরিফুল ইসলাম। তিনি গত শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছয় আসামির ক্ষেত্রে লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়েছে। আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে লিভ টু আপিলগুলো উপস্থাপন করা হবে।’

আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাত আসামি হলেন রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ, মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন ও শরিফুল ইসলাম খালেদ। এঁদের মধ্যে আসলাম হোসেন গত বছরের ৬ জুন গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে কারারক্ষীদের গুলিতে নিহত হন। গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন ওই কারাগারে কারারক্ষীদের জিম্মি করে ২০৯ জন বন্দী পালিয়ে যায়। তখন কারারক্ষীদের গুলিতে মোট ৬ জন নিহত হন।

এই মামলার হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় গত ১৭ জুন। পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রাসঙ্গিক বিবরণে বলা হয়, তদন্তকালে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, ফরেনসিক, ব্যালিস্টিক, ডিএনএ ও ইমিগ্রেশন রিপোর্ট এবং ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় জানা যায়, নিষিদ্ধঘোষিত জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতৃত্বে অতি উগ্র অংশ নব্য জেএমবি পরিচয়ে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা চালায়।

সেই হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচজন সেনা কমান্ডোদের অভিযানে নিহত হন। তাঁরা হলেন রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। 

হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, ২২ জনকে হত্যা করেছে বলে প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষ্য থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারার অপরাধে ওই পাঁচজন সন্ত্রাসী অপরাধী। তাঁদের মধ্যে যদি কেউ বেঁচে থাকতেন, তাহলে তাঁকে এই আইনের অধীনে বিচার শেষে ৬(১)(ক)(অ) ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ৬(২)(অ) ধারায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেত। বিচারিক আদালত ‘একই অভিপ্রায়ের’ বিষয়টি উল্লেখ করে আপিলকারীদের (সাত আসামি) মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন, তা সঠিক হয়নি। বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)(আ) ধারায় সাত আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।

এদিকে হোলি আর্টিজানের সেই পুরোনো ঠিকানায় এখন আর আগের মতো কোনো রেস্তোরাঁ নেই। জায়গাটির মালিকপক্ষ পরবর্তী সময়ে রেস্তোরাঁটি আর চালু না করার সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমানে সেটি একটি আবাসিক ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে ভবনের দেয়ালের ভেতর আজও জমে থাকা স্মৃতি কেউ কেউ ভুলতে পারেননি। সেই রাতের ঘটনা শুধু নিহতদের নয়, গোটা জাতির স্মৃতিতে আজও স্পষ্ট হয়ে আছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ