মূল্যস্ফীতিতে খাদ্যবহির্ভূত সেবা ও আমদানি পণ্যের প্রভাব বেড়েছে
Published: 14th, May 2025 GMT
দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখনো ৯ শতাংশের ওপরে। তবে মূল্যস্ফীতি আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। এর কারণ, গত কয়েক মাসে শাকসবজি ও কিছু মসলাজাতীয় পণ্যের দাম কম ছিল। তবে আমদানিনির্ভর খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা খাতে আগের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে। এ কারণে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি কমেনি। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতিতে সেবা ও আমদানি খাতের প্রভাব বেড়েছে।
মূল্যস্ফীতির কার্যকারণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা সর্বশেষ এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেশে মূল্যস্ফীতি ও মজুরির পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি কীভাবে ও কেন বাড়ছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে চলতি অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) সময়ের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়, গত জানুয়ারি থেকে মার্চে দেশে যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, তার অর্ধেকের বেশি হয়েছে প্রধান কিছু পণ্যের দাম বাড়ার কারণে। যদিও এ সময় সার্বিকভাবে খাদ্যপণ্যের দাম কিছুটা সহনীয় ছিল, তবে ভুগিয়েছে জ্বালানির দাম।
গত বছরের ডিসেম্বরের সঙ্গে চলতি বছরের মার্চ মাসের দামের পার্থক্য পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সময়ে দেশে শাকসবজি, মাছ, কাঁচা মাংস ও ডিমের মতো পচনশীল পণ্যের দামে তেমন পরিবর্তন হয়নি। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি অপরিবর্তিত বা স্থিতিশীল ছিল। অন্যদিকে ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে তেল, আটা, ডাল, চিনি প্রভৃতি অপচনশীল পণ্যের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছিল। এ ছাড়া আমদানিনির্ভর বেশ কিছু খাদ্যপণ্যের দামও এ সময় কম ছিল।
তবে এ সময়ে মূল্যস্ফীতিতে আমদানিনির্ভর খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের অবদান বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গ্যাস, ডিজেলসহ বিভিন্ন জ্বালানি পণ্য; মোবাইল, ল্যাপটপের মতো ইলেকট্রনিক পণ্য, বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য প্রভৃতি। এর সঙ্গে মূল্যস্ফীতিতে বেড়েছে সেবা খাতের অবদানও। বাসাভাড়া, শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যয় প্রভৃতি হলো সেবা খাতের খরচ। অর্থাৎ এ ধরনের ব্যয় ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে বেড়েছে। অর্থনীতিবিদেরা বলেন, সেবা খাতের খরচ বাড়লে তা দীর্ঘ মেয়াদে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। কারণ, সেবা খাতে দাম একবার বাড়লে সহজে আর কমে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরের শুরুতে, অর্থাৎ গত বছরের জুলাই মাসের দিকে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছায়। এর পেছনে মূল কারণ ছিল খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এরপর গত জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে মূল্যস্ফীতি কমে সাড়ে ৯ শতাংশ হয়েছে। এ সময় দেশে শীত মৌসুম থাকায় শাকসবজির সরবরাহ ভালো ছিল। এ ছাড়া রমজানের কারণে ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, মসলাসহ বেশ কয়েকটি পণ্য আমদানিতে সরকার শুল্ক ছাড় দেয়। মূলত এসব কারণে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। যদিও গত রমজানের পরে ভোজ্যতেল, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির দাম বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে তিন ধরনের পণ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে মাছ, মাংস ও ডিমের মতো প্রোটিনজাত খাবার। এরপর চাল, আটার মতো খাদ্যশস্য এবং তৃতীয়ত শাকসবজির দাম। গত মার্চে শাকসবজির দাম কিছুটা কম ছিল; তবে বেশি ছিল মাছ-মাংসের দাম। খাদ্য মূল্যস্ফীতির সূচকেও এর প্রভাব দেখা গেছে। ২০২৪ সালে দেশে ভোজ্যতেলের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। তবে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ভোজ্যতেলের দাম আবার বাড়তে থাকায় তা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির প্রধান চলক ছিল জ্বালানির দাম। তবে গত বছরের জুলাই মাস থেকে এটি কমতে শুরু করেছে। গত বছরের মার্চে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিতে জ্বালানির অবদান ছিল ২৬ শতাংশ, যা চলতি বছরের মার্চে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ শতাংশে।
সামনের দিনগুলোতে দেশে মূল্যস্ফীতি কেমন হবে, সেটি নিয়ে গত এপ্রিলে সর্বশেষ পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। তাদের পূর্বাভাসও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এডিবি তাদের এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে বলেছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি থাকবে প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। তবে বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতে পারে। আর আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি আরও কমবে। অনুকূল আবহাওয়া, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমা ও কঠোর আর্থিক নীতিকে এর পেছনে কারণ হিসেবে বলা হয়েছে। অন্যদিকে আইএমএফ এপ্রিলে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে জানায়, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ থাকতে পারে। যদিও পরবর্তী সময়ে সেটি ৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
এদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকলেও সাধারণ মানুষের মজুরি সে তুলনায় বাড়েনি। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশে মজুরি বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি থাকছে। ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও প্রকৃত আয় কমেছে। এতে পরিবারের খরচ চালাতে চাপে থাকছেন মানুষেরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি কিছুটা কমেছে। তবে আপাত এ স্বস্তির আড়ালে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি রয়ে গেছে। বিশেষ করে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি এখনো চাপে রেখেছে ভোক্তাদের।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: খ দ যবহ র ভ ত গত বছর র ড স ম বর ভ জ যত ল শ কসবজ কম ছ ল অর থ ৎ আমদ ন অবদ ন এ সময় যপণ য
এছাড়াও পড়ুন:
চলতি অর্থবছরে ৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস এডিবির; ৪ কারণে চাপে প্রবৃদ্ধি
চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কিছুটা বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবির পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ হতে পারে। গত অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন হলো ৪ শতাংশ।
এডিবি আরও বলেছে, তৈরি পোশাক রপ্তানি স্থিতিশীল থাকলেও রাজনৈতিক পরিবর্তন, ঘন ঘন বন্যা, শিল্প খাতে শ্রমিক অস্থিরতা এবং বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই চার কারণে প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে।
আজ মঙ্গলবার এডিবি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) সেপ্টেম্বর সংস্করণ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এডিবি আরও বলেছে, চলতি অর্থবছরে ভোগ্যব্যয় বাড়বে। কারণ, রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া আসন্ন নির্বাচনসংক্রান্ত নানা ধরনের খরচের কারণেও ভোগব্যয় বাড়াবে।
বাংলাদেশে এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হো ইউন জিয়ং বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিনির্ভর করবে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বাণিজ্যে মার্কিন শুল্কের প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়। দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা অব্যাহত রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য জরুরি।
এডিবির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৬ অর্থবছরের জন্য কিছু ঝুঁকি রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং নীতি বাস্তবায়নের অনাগ্রহ প্রবৃদ্ধির অগ্রগতিতে বাধা হতে পারে। এ জন্য সঠিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বজায় রাখা এবং কাঠামোগত সংস্কার দ্রুততর করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ শতাংশ। এর পেছনে রয়েছে পাইকারি বাজারে সীমিত প্রতিযোগিতা, বাজার তথ্যের ঘাটতি, সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধা এবং টাকার অবমূল্যায়ন।
এডিবি বলছে, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হবে ভোগব্যয়, যা শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ ও নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের কারণে বাড়বে। তবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি এবং বিনিয়োগকারীদের সতর্ক মনোভাব বিনিয়োগকে মন্থর করতে পারে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রতিযোগিতা বাড়ায় রপ্তানি খাত এবং এর প্রবৃদ্ধি চাপ বাড়াবে। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে রপ্তানিকারকদের মূল্য কমাতে হতে পারে।