সন্তানের জীবনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে থাকুন

১. শিশুর আস্থা অর্জন করুন। তার সঙ্গে মিশুন বন্ধুর মতো। সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলে শিশু নির্যাতনের লক্ষণগুলো খুব দ্রুত আপনার চোখে পড়বে। কোনো কিছু ঘটার সঙ্গে সঙ্গে শিশু আপনার কাছে খুলে বলবে। সন্দেহজনক কিছু দেখলে বা শুনলে আপনি আপনার সন্তানকে রক্ষা করার জন্য পদক্ষেপ নিতে পারবেন।

২.

শিশুসন্তান সারা দিন কী কী করে, সেসব বিষয়ে আগ্রহ দেখান। তাকে জিজ্ঞাসা করুন, দিনের বেলা সে কী করেছে এবং কার কার সঙ্গে মিশেছে, স্কুলের টিফিন কার সঙ্গে বসে খেয়েছে, ছুটির পর কোন খেলা খেলেছে, তারা কি নিজেদের খেলাধুলা ও বাকি সব কাজ উপভোগ করেছে?

৩. আপনার সন্তানের চারপাশের মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হোন। আপনার সন্তান কাদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে, তা জানুন, হোক তারা শিশু কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক। শিশুর কাছে তার স্কুলের বন্ধুদের সম্পর্কে জানতে চান। বন্ধুদের মা-বাবাদের সম্পর্কে জানুন। অন্যান্য যেসব ব্যক্তির কাছে আপনার শিশু নিয়মিত যায়, তাঁদের সবার সম্পর্কে খোঁজখবর নিন। যেমন শিক্ষক, খেলাধুলার কোচ ইত্যাদি। এই ব্যক্তিদের সম্পর্কে সন্তানের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলুন এবং প্রশ্ন করুন। আপনার শিশুসন্তানও যেন আপনার সঙ্গে এসব ব্যক্তির ব্যাপারে কথা বলতে এবং প্রশ্ন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

৪. যাঁরা শিশুদের দেখাশোনা করেন, যেমন গৃহসহকারী, আয়া, বেবি সিটার—তাঁদের নির্বাচন করুন খুবই সাবধানতার সঙ্গে। নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুকে ভর্তি করাতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে খুব ভালোভাবে খোঁজখবর নিন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও আপনার শিশু অন্য কোথাও নিয়মিত যাতায়াত করতে পারে। যেমন নাচ, গান কিংবা ছবি আঁকার ক্লাস, প্রাইভেট টিউটরের বাসা ইত্যাদি। সেসব জায়গায় কী কী ঘটছে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন।

আপনার সন্তানকে বোঝান যে তাকে এমনভাবে স্পর্শ করার অধিকার কারোরই নেই, যাতে সে অস্বস্তি বোধ করে। তাকে এটা জানানো গুরুত্বপূর্ণ যে তার শরীর একান্তই তার। এটাও মনে রাখতে বলবেন যে অন্য কাউকে তাদের অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করার অধিকারও তার নেই।যৌন সহিংসতার ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা করুন

গণমাধ্যমে প্রায়ই যৌন সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনা উঠে আসে। আপনার সন্তানকে ঘটনাগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন করুন। যেমন ‘তুমি কি আগে কখনো এ রকম কিছু শুনেছ?’ অথবা ‘তুমি এ পরিস্থিতিতে পড়লে কী করতে?’ এসব প্রশ্ন করলে আপনার সন্তান বুঝতে পারবে, এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এসব বিষয়ে সে আপনার সঙ্গে আলোচনাও করতে পারবে।

লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানুন

কোনো শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হলে তার শরীর, মন ও আচার আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন শরীরের স্পর্শকাতর স্থান থেকে রক্তপাত, সেসব স্থানে আচড়–কামড়ের চিহ্ন, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ইত্যাদি। আবার বারবার গোসল করা, বিষণ্নতাসহ বিভিন্ন ফোবিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। তাই শিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানুন। লক্ষ রাখুন, আপনার সন্তানের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না। পরিবর্তন যত সামান্যই হোক না কেন, উপেক্ষা করবেন না।

শিশুদের কথা বলতে উৎসাহ দিন

যখন শিশু বুঝবে যে তার কথা আপনি শুনবেন এবং গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করবেন, তখন সে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো নিয়ে কথা বলার সাহস পাবে। আপনার সন্তান যখন অনুভূতি বা আবেগ সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করবে, তখনই আপনি তার সঙ্গে এ ধরনের আলোচনা শুরু করতে পারেন।

ব্যক্তিগত সীমারেখা নির্ধারণ

আপনার সন্তানকে বোঝান যে তাকে এমনভাবে স্পর্শ করার অধিকার কারোরই নেই, যাতে সে অস্বস্তি বোধ করে। তাকে এটা জানানো গুরুত্বপূর্ণ যে তার শরীর একান্তই তার। এটাও মনে রাখতে বলবেন যে অন্য কাউকে তাদের অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করার অধিকারও তার নেই। আপনার অল্প বয়সী সন্তানকে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর নাম শিখিয়ে দিন। নামগুলো জানলে শিশু সহজেই তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া যেকোনো বিব্রতকর বা অস্বস্তিকর ঘটনা বিস্তারিতভাবে বলতে পারবে।

পূর্ণ মনোযোগে সন্তানের সঙ্গে সময় কাটান

সন্তানের সঙ্গে আলাদাভাবে সময় কাটান। এমন একটা সময় তার জন্য নির্ধারণ করুন, যখন আপনি অন্য কোনো কাজ করবেন না; আপনার সম্পূর্ণ মনোযোগ থাকবে সন্তানের দিকে। আপনার সন্তানকে যেকোনো প্রশ্ন করার সুযোগ করে দিন। কেউ যদি তার সঙ্গে এমন কথা বলে, যা তার কাছে অস্বস্তিকর লাগে, তা যেন সে আপনাকে খুলে বলতে পারে।

আরও পড়ুনশিশু-কিশোরদের জিমন্যাস্টিকস শেখাবেন কোথায়?০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫শিশুর আস্থা অর্জন করুন

অনেক অপরাধী শিশুদের নির্যাতন করার পর নানাবিধ হুমকি দিয়ে ও ব্ল্যাকমেইল করে তাদের মুখ বন্ধ করে রাখতে বাধ্য করে। যেমন ‘খবরদার, তোমার আম্মু জানলে কিন্তু খুব মারবে!’ আপনার সন্তানকে বারবার আশ্বস্ত করুন যে সে আপনার সঙ্গে খোলাখুলিভাবে কথা বলার পর কোনো সমস্যায় পড়বে না। যদি সে সাহস করে আপনাকে কিছু বলে, তখন আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন। ‘অমুকের কোলে উঠলে কেন?’ বা ‘তমুকের পাশে বসলে কেন?’ বলে বকাঝকা, মারধর শুরু করবেন না।

মুক্ত আলোচনার পথ খোলা রাখুন

সন্তানকে নতুন নতুন বিষয় নিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার সুযোগ দিন। কখনো কখনো ‘খুব মজা হয়েছে আজকে?’ কিংবা ‘আজকে সময় কেমন কাটল?’ এ রকম সরাসরি প্রশ্ন করলে গুরুত্বপূর্ণ উত্তরগুলো আপনি না-ও পেতে পারেন। বরং এসব প্রশ্ন করার পরও জানতে চান ‘তুমি কি আর কিছু বলতে চেয়েছিলে?’ এ রকম খোলামেলা প্রশ্ন আপনার সন্তানকে তাদের উদ্বেগ বা ধারণা তুলে ধরার সুযোগ করে দেবে।

যদি আপনার সন্তানের সঙ্গে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেই যায়, সব সময় মনে রাখবেন, এ ক্ষেত্রে শুধু নিপীড়কই দায়ী। আপনি দায়ী নন, আপনার সন্তান তো নয়ই। সন্তানের জীবন রক্ষার্থে কিছু সাবধানতা আমাদের সবারই অবলম্বন করতে হবে। সন্তান কোনো বিপদের মুখোমুখি হলে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে সহায়তা চাইতে দ্বিধা করবেন না। এসব পরিস্থিতিতে খুবই সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়াই উত্তম।

সূত্র: রেইন ডটঅর্গ

আরও পড়ুনআপনার সন্তান স্কুলে বুলিং থেকে সুরক্ষিত তো?১৬ এপ্রিল ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: করব ন ন অন য ক ন কর ন শ ন কর র ঘটন ন আপন

এছাড়াও পড়ুন:

সন্তান পালনে প্রচলিত পাঁচ ভুল

একটা সময় ছিল, যখন অভিভাবকের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কটা ছিল ভয়ের, বিশেষ করে বাবার সঙ্গে। তবে সেই সময় বেশির ভাগ শিশু বেড়ে উঠত এক বৃহৎ পারিবারিক পরিসরে। সময় বদলেছে। এ যুগের শিশু অনেকটাই ‘একা’। বাড়ির বাইরে শিশুকে স্বাধীনভাবে খেলতে দিতেও অনেক অভিভাবক অনিরাপদ বোধ করেন। শিশুর নিরাপদ আশ্রয় কেবল তার পরিবার। ভরসার জায়গা কেবল তার মা-বাবা আর নিকটাত্মীয়রাই।
সন্তানপালনে প্রচলিত কিছু ভুল এবং তা সংশোধন সম্পর্কে জানালেন শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক এবং যুক্তরাজ্যের সিনিয়র ক্লিনিক্যাল ফেলো ডা. টুম্পা ইন্দ্রানী ঘোষ

১. সবকিছুর চেয়ে শিশুর গুরুত্ব বেশি

আপনার সন্তান নিঃসন্দেহেই আপনার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার মানে এই নয় যে তাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আপনি নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলবেন। নিজের সুস্থতার প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে। কিছুটা সময় রাখুন নিজের জন্যও।

২. কোনো বিষয় না জানলে স্বীকার করা যাবে না

একটা মানুষ সব বিষয় জানবেন না, এটাই স্বাভাবিক। শিশুর সামনে তা স্বীকার করাও দোষের নয়। এতে আপনি তার চোখে ‘ছোট’ হয়ে যাবেন, এমন ভাবনা ভুল। বরং আপনি কিছু না জানলে তাকে বলুন যে আপনি তা জেনে নিয়ে পরে জানাবেন। শিশুকেও বিষয়টি জানার চেষ্টা করতে বলতে পারেন। জানার পর সে যাতে আপনার সঙ্গে বিষয়টি ভাগ করে নেয়, সে ব্যাপারেও তাকে উৎসাহ দিন।

৩. সব সময় শিশুর প্রশংসা করা উচিত

শিশুকে উৎসাহ দিতে প্রশংসা করতে হবে, এটা ঠিক। কিন্তু শিশুর ভুলগুলোও আপনাকেই ধরিয়ে দিতে হবে। নইলে সে অনেক কিছুই শিখতে পারবে না। ধরা যাক, শিশু ডাইনিংয়ে বাড়ির সবার সঙ্গে বসে খাচ্ছে। হয়তো সে খাবার ফেলে-ছড়িয়েই খাচ্ছে। প্রাথমিক অবস্থায় এটা মেনে নেওয়াই ভালো। তবে একটা বয়সে গিয়ে তাকে খাবার টেবিলের আদবকেতাও শেখাতে হবে, বলতে হবে টেবিল গোছানোর মতো টুকটাক কাজে সাহায্য করতেও। এসব শেখানোর পরও যদি সে না করে, তখন কিন্তু আপনাকে তার ভুল ধরিয়ে দিতেই হবে।

আরও পড়ুনশিশুর কান্না ট্যানট্রাম নাকি মেল্টডাউন? দুটির পার্থক্য জেনে রাখা এত জরুরি কেন২৬ জুন ২০২৫৪. শিশুকে দুঃখ বুঝতে দেওয়া যাবে না

দুঃখ তো জীবনেরই অংশ। নশ্বর এই পৃথিবীতে সবদিক থেকে সুখী হওয়া প্রায় অসম্ভব। অভাব, দুঃখ, কষ্ট—জীবনের বাস্তবতা থেকে শিশুকে আড়ালে রাখার প্রয়োজন নেই সব সময়। শিশুর সব চাওয়া পূরণ না করলে কোনো ক্ষতি নেই। বরং বাস্তবতা বুঝেই বড় হোক সে। আর্থিক অসংগতি থাকলে শিশুর বয়স বুঝে তা জানানো যেতে পারে। তবে এ নিয়ে তাকে হতাশাগ্রস্ত করে ফেলবেন না। সহজভাবে বুঝিয়ে বলুন। এমনভাবে বলুন, যাতে নিজের পরিবারের কারণে সে নিজেকে দুর্ভাগা মনে না করে, অন্যদের হিংসাও না করে।

৫. শাস্তি না দিলে শোধরাবে না

এমনও অভিভাবক আছেন, যাঁরা ভাবেন, শাস্তি না দিলে সন্তানের ভুল শোধরাবে না। এই ভাবনাও ভুল। প্রয়োজন হলে শিশুকে আপনি অবশ্যই শাসন করবেন। কিন্তু খেয়াল রাখবেন, তা করতে গিয়ে যেন আপনার সঙ্গে তার সম্পর্কের ভিতটা দুর্বল হয়ে না পড়ে। শিশুকে মারবেন না। কটু কথা বলবেন না। রেগে ভয়ংকরদর্শন একজন মানুষ হয়ে উঠবেন না। বরং শিশুর কোন কাজটা ভুল হয়েছে, কেন ভুল হয়েছে, তা বুঝিয়ে বলুন।

আরও পড়ুনসন্তান মানুষ করার চাপ যেভাবে সামলাবেন২১ মে ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ