‘কোথায় যেন দেখেছি’ নামের একটি বাংলা চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালে। পরিচালক নিজামুল হক। সেই ছবিতে তাঁরই লেখা ও সুরারোপিত ‘রিকশাওয়ালা বলে কারে তুমি আজ ঘৃণা করো...’ গানটি খুবই জনপ্রিয় হয়। এতটাই জনপ্রিয় যে এ গানের শিল্পী খন্দকার ফারুক আহমদকে পল্টনের এক জনসভায় সোনার মেডেল পরিয়ে দিয়েছিলেন জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

এত দিন পর গানটির কথা মনে পড়ার কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহুল প্রচার পাওয়া একটি ভিডিও। ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন পে-লোডার দিয়ে ব্যাটারিচালিত একটি রিকশা ভেঙে ফেলতে উদ্যত হলে করুণ আর্তনাদে পুরো এলাকাটি প্রকম্পিত করে তুলেছিলেন রিকশাচালক। কিন্তু তাঁর এই আহাজারিতে ‘কর্তব্যরত ব্যক্তিরা’ এতটুকু বিচলিত হননি। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন রিকশাটি। এরপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রিকশাচালকের যে বিলাপ, সেটি কোনো সংবেদনশীল মানুষকে বেদনাক্রান্ত না করে পারে না।

রিকশাটি কোনো মহাজনের কাছ থেকে ওই রিকশাচালক চুক্তিতে ভাড়া নিয়েছিলেন কি না, কিংবা পরিবারের সহায়-সম্বল সর্বস্ব বিক্রি করে নিজেই কিনে নিয়েছিলেন কি না, আমরা জানি না। শুধু এটুকু বুঝি, ১৯৭০ সালে গাওয়া একটি গানের কথার বাস্তবতার সঙ্গে এতকাল পরও একজন রিকশাচালকের জীবনের বিশেষ পরিবর্তন না হলে উন্নয়ন, অগ্রগতি, সমৃদ্ধির মতো শব্দগুলো আর কোনো অর্থ বহন করে না।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের অব্যবহিত পর হাজর হাজার রিকশাচালক অবাধে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন। অনেকটা বাধ্য হয়ে শর্তসাপেক্ষে তাঁদের রিকশা চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তখন। এই সুযোগে ঝাঁকে ঝাঁকে যান্ত্রিক রিকশা নেমে পড়েছে ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে। মফস্‌সল বা ছোট শহরগুলোতে অবশ্য এগুলো চলছিল আগে থেকেই।

কোনো সন্দেহ নেই, যেখানে–সেখানে প্রচুর সংখ্যক ব্যাটারিচালিত রিকশা নগরের ট্রাফিক ব্যবস্থাকে প্রায় বিপর্যস্ত করে তুলেছে। নিয়মিত দুর্ঘটনারও কারণ হয়ে উঠেছে যানটি। ফলে এর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অভিযানকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলা যাবে না। এই কয় দিনে আমরা দেখেছি, ঢাকা শহরে এ ধরনের রিকশা পে-লোডার দিয়ে ভাঙা হয়েছে, ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরে এই রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন মেয়র। কয়েক হাজার রিকশা জব্দ করে মাঠে জড়ো করে রাখার ব্যবস্থাও আমরা দেখেছি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ব্যবস্থা নেওয়ার আগে অন্য কোনো সমাধানের পথ ভাবা হয়েছিল কি না?

এ প্রসঙ্গে আলাপকালে সড়ক পরিবহন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘এ ধরনের যেকোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আগে ট্রাফিক ডিমান্ড ম্যানেজমেন্ট নিয়ে ভাবা উচিত, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলোচনার পর উপায় নির্ধারণ করা উচিত। এখন যা করা হচ্ছে, তা শুধুই তাৎক্ষণিক সমাধান। যাত্রীদের মধ্যে চাহিদা আছে বলেই এ ধরনের যান পথে নামছে। মেট্রোরেল আর ফ্লাইওভারই যে একমাত্র সমাধান নয়, সেটাই এতে বোঝা গেল।’

ব্যাটারিচালিত রিকশা নগরের যান চলাচলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে এবং এ কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে, এ কথা সত্য। কিন্তু এটাকে একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনা যায় কি না, সেটা ভাবার সময়ও এসেছে। আমরা জানি, ব্যাংকক-সিঙ্গাপুরের মতো আধুনিক শহরগুলোতেও এ ধরনের রিকশা চলাচল করে। কিন্তু কোন এলাকায় চলবে, কোন সময়ে চলবে এবং সর্বোপরি একটি এলাকায় কী পরিমাণ চলাচল করতে পারবে, তার একটি নির্দেশনা আছে বলেই এ ধরনের ছোট যানগুলো সেখানে বোঝা বা বিপজ্জনক না হয়ে যাত্রীবান্ধব হয়ে উঠেছে।

প্যাডেল রিকশার মতো অমানবিক কায়িক শ্রমের অযান্ত্রিক বাহন আর বেশি দিন হয়তো টিকে থাকবে না। আমাদের চোখ সওয়া হয়ে গেছে বটে, কিন্তু রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে প্যাডেল রিকশাচালকের যাত্রী পরিবহনের দৃশ্য সত্যিকার অর্থেই নিষ্করুণ। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মতো পাহাড়-টিলাময় অঞ্চলে চড়াই-উতরাই বেয়ে এই যানচালকদের শরীরী শ্রম দেখলে দাসযুগের কথা মনে পড়ে যায়।

আমাদের ধারণা, শেষ পর্যন্ত এই প্যাডেল রিকশার জায়গা নেবে ব্যাটারিচালিত রিকশা। সিএনজিচালিত অটোরিকশার দাপটে যেমন হারিয়ে গেছে টু-স্ট্রোক অটোরিকশা, তেমনি ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণেই একসময় বিদায় নেবে অযান্ত্রিক রিকশা। সুতরাং যানটির চলাচল নিষিদ্ধ করা নয়, বরং নগরে এগুলোর চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে হবে। মোট কতগুলো ব্যাটারিচালিত রিকশা নগরে চলতে পারবে, তার সংখ্যা নির্ধারণ করা দরকার। সিটি করপোরেশনের বা অন্য কোনো অনুমোদিত সংস্থা থেকে বার্ষিক কর দিয়ে ছাড়পত্র নেওয়া সাপেক্ষে চলাচলের অনুমতি দেওয়া যায়। অতঃপর এসব রিকশার অভিন্ন আকৃতি, এর ফিটনেস সনদ, ড্রাইভিং সনদ বাধ্যতামূলক করা ও নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা রাখা দরকার। তাহলে চালক যেমন সচেতন হবেন, লক্কড়ঝক্কড় মার্কা যানও রাস্তায় নামতে পারবে না। দুর্ঘটনার ঝুঁকিও এতে কমবে। যে সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান এসব যান থেকে কর আদায় করবে, রাস্তায় আলাদা লেন তৈরি করা ও এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তাদের ওপর বর্তাবে।

এ ছাড়া গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো ও এই খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। এ ধরনের পরিবহন যত বাড়বে, নগরে ছোট যানের সংখ্যাও তত কমবে।

মোদ্দাকথা হচ্ছে, শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। নিজের ও পরিবারের দুই বেলার ক্ষুন্নিবৃত্তি না হলে যেকোনো উপায় অর্থ উপার্জনের জন্য নেমে পড়বে এসব মানুষ। কিছু রিকশা জব্দ করলে বা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলে গরিবের ক্রন্দনই শুধু বাড়বে, নগর ব্যবস্থাপনার বিশৃঙ্খলা দূর হবে না।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও সাহিত্যিক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ব যবস থ এ ধরন র পর বহন

এছাড়াও পড়ুন:

কোটিপতি হলেও পরিচ্ছন্নতা কর্মীর কাজ করেন তিনি

পর্যাপ্ত অর্থ সঞ্চয় করতে পারলেই আমাদের অনেকে কায়িক পরিশ্রম ছেড়ে দেন। আরাম-আয়েশে জীবন কাটান। কিন্তু সবাই তা করেন না। এমন একজন জাপানের কোইচি মাতসুবারা। ৫৬ বছর বয়সী এই জাপানি নাগরিকের বার্ষিক আয় প্রায় ৩ কোটি ইয়েন (প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা) হওয়া সত্ত্বেও তিনি এখনো নিয়মিত পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন।

মাতসুবারা সপ্তাহে তিন দিন, প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে কাজ করেন। তিনি সরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। এ কাজের অংশ হিসেবে তাঁকে ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে হয়।

এ কাজ থেকে মাতসুবারা মাসে ১ লাখ ইয়েন (প্রায় ৮২ হাজার ৬৪ টাকা) আয় করেন, যা টোকিওর গড় বেতনের তুলনায় অনেক কম। তারপরও তিনি এ কাজ করেন। কারণ, তিনি এটাকে শারীরিক সক্রিয়তা ও মানসিক প্রশান্তির উপায় হিসেবে দেখেন।

মাতসুবারা ছোটবেলা থেকেই সঞ্চয়ী ছিলেন। মাধ্যমিকের পর তিনি একটি কারখানায় মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার ইয়েন (প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা) বেতনে কাজ শুরু করেন। খরচ বাঁচিয়ে কয়েক বছরে প্রায় ৩০ লাখ ইয়েন (২৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা) সঞ্চয় করে তিনি প্রথম স্টুডিও ফ্ল্যাট কিনেছিলেন।

পরে বাড়ি কেনার ঋণ আগেভাগে পরিশোধ করে ধীরে ধীরে আরও ফ্ল্যাট কেনেন এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেন মাতসুবারা। এখন টোকিও ও এর শহরতলিতে তাঁর সাতটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার সবই ভাড়া দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেছেন।

ধনবান হলেও মাতসুবারা সাদাসিধে জীবন যাপন করেন। এখনো তিনি সস্তা ফ্ল্যাটে থাকেন, নিজের খাবার নিজে বানান, নতুন জামাকাপড় কেনেন না, সাধারণ স্মার্টফোন ব্যবহার করেন এবং প্রধানত সাইকেলে চলাচল করেন। তাঁর জীবনদর্শন—‘প্রতিদিন কিছু না কিছু করার আশা করি, সুস্থ থাকতে চাই এবং নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতে চাই।’

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে মাতসুবারাকে ‘অদৃশ্য কোটিপতি’ বলে উল্লেখ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর গল্প ছড়িয়ে পড়েছে। জাপানে ধনীদের এমন সাধারণ জীবনধারা অস্বাভাবিক নয়। দেশটিতে সাদাসিধে জীবনযাপন অনেকের মধ্যে দেখা যায়।

সম্পর্কিত নিবন্ধ