শেয়ারবাজারে লাগাতার দর পতন নিয়ে অস্বস্তিতে সরকার। গতকাল রোববার দিনের শুরুতে বেশির ভাগ শেয়ারের দর বৃদ্ধিতে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৩৮ পয়েন্ট বাড়লেও শেষ পর্যন্ত ২৯ পয়েন্ট পতনে লেনদেন শেষ হয়। এমন প্রেক্ষাপটে শেয়ারবাজারের পতন থামাতে আশু করণীয় হিসেবে কর ছাড় বিষয়ে কিছু পরিকল্পনা নিয়ে ভাবছে সরকার। এখনই আরও কিছু করার থাকলে তা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার আগ্রহও রয়েছে। এ জন্য গতকাল রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং ব্রোকারদের সংগঠন ডিবিএ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড.

আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
এদিকে অব্যাহত পতনে শেয়ারবাজার মারা গেছে, এমনটি বোঝাতে প্রতীকী কফিন নিয়ে ঢাকার মতিঝিলের রাস্তায় অবস্থান নেন কিছু বিনিয়োগকারী। তারা প্রতীকী কফিন সামনে রেখে জানাজা পড়েন। 
গতকালের বৈঠকে সিডিবিএল ও সিসিবিএলের প্রতিনিধি এবং শেয়ারবাজার সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স সদস্যরা অংশ নেন। এ ছাড়া বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ এবং তিন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে অংশগ্রহণকারী আইডিএলসি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফউদ্দিন সমকালকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর কথা শুনে মনে হয়েছে, সরকার শেয়ারবাজারের চলতি সমস্যার আশু সমাধানে খুবই আন্তরিক। কিছু একটা করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে চায় সরকার। অংশ নেন এমন আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের বক্তব্যের সারমর্ম হলো– বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করে পতন থামাতে সরকার আন্তরিক। তবে পতন থামাতে এখন কী করণীয়, তা কারও বক্তব্যে খুব স্পষ্টভাবে আসেনি। কেউ বলেছেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে কিছু ভালো শেয়ার আনতে পারলে পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে পারে। সরকারি নতুন কোম্পানির শেয়ার ছাড়তে কিছু সময় লাগবে। তবে পাওয়ার গ্রিডসহ বর্তমানে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার ছাড়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া ইউনিলিভারসহ যেসব বহুজাতিক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার আছে, সরকার চাইলে তা দ্রুতই বাজারে আনা যেতে পারে।

অনুষ্ঠানের শুরুত ডিএসইর চেয়ারম্যান শেয়ারবাজারের সামগ্রিক অবস্থা, কাঠামোগত সমস্যা, অর্থনীতিতে অবস্থান, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, আইপিও, অডিট রিপোর্ট, সুশাসনসহ বহু বিষয়ে সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। চলতি পতনের কারণ বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি বন্ডের অধিক সুদের হার, তালিকাভুক্ত কোম্পানির মুনাফা কমা, মার্জিন অ্যাকাউন্টে মূলধনি লোকসান এবং টাকার অবমূল্যায়নের প্রভাব রয়েছে। এর বাইরে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে বিও হিসাবের নবায়ন ফি ছাড়, মূলধনি মুনাফা কর অব্যাহতি এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ আয়ে করমুক্ত করার প্রস্তাব করেন তিনি। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর ব্যবধান ১০ শতাংশ করা, বহুজাতিক ও ভালো মৌলভিত্তির দেশীয় কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত হতে উৎসাহিত করা, ৫০০ কোটি টাকার বেশি দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নে ব্যাংক ঋণের পরিবর্তে আইপিও/বন্ডের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেন ডিএসইর চেয়ারম্যান।

বৈঠক সূত্র জানায়, শেয়ারবাজারের উন্নয়নে নতুন কিছু বলার আহ্বান জানান ড. আনিসুজ্জামান। এদিকে গত ৯ মাসে সুশাসন বাড়াতে কী করেছেন, তা বলতে চাইলে বিএসইসির চেয়ারম্যাকে থামিয়ে দেন তিনি। ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলাম তাঁর বক্তব্যে বলেন, ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন করে স্টক এক্সচেঞ্জকে পোস্ট অফিস বানানো হয়েছে। সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে বিএসইসি। শেয়ারবাজারে ‘পারসেপশন’-এর বড় গুরুত্ব আছে। মানুষ যখন মনে করে, এখানে লাভ হবে না, তাহলেই সমস্যা। ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, গত ১৫ বছরে বিএসইসি যত আইন করেছে, তার সবগুলো ছিল বিনিয়োগকারী তাড়ানোর জন্য।
ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, শেয়ারবাজারে সমস্যা আছে। সবাই মিলে এর সমাধান করতে হবে। সরকার যা করার করবে। তবে যেসব সমস্যা বিএসইসি বা স্টক এক্সচেঞ্জ নিজেরা সমাধান করতে পারে, তা বিলম্ব না করতে নির্দেশ দেন তিনি।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ য় রব জ র শ য় রব জ র র ব এসইস সমস য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা লাগবে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার পরে

সমকাল: আপনি বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে ২০০৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। ১৬ বছর পর বর্তমান বাজারে গুণগত কোনো পরিবর্তন কী দেখেন?

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: বলা উচিত হবে কিনা জানি না, আধুনিক সার্ভিল্যান্স ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও ২০০৯ পর্যন্ত বাজার আরও বেশি সুশৃঙ্খল ছিল। খারাপ কোম্পানিকে বা স্টক এক্সচেঞ্জের অমতে আইপিও অনুমোদন দেওয়া হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো– বিএসইসিকে তখন সবাই মান্য করত। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে বাজার পরিচালনা করা হতো। এখন যা দেখা যায় না। অংশীজনের সঙ্গে সম্পর্ক আন্তরিক নয়, পারস্পরিক সম্মানের জায়গা দেখি না।

সমকাল: এ দীর্ঘ সময়েও কি শেয়ারবাজারের উন্নয়ন হয়নি?

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: কয়েকটি ভালো কোম্পানি শেয়ারবাজারে এলেও প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। এ বাজারের মূল সমস্যা ভালো শেয়ারের সরবরাহ নেই। তাহলে বিনিয়োগকারীরা কোথায় বিনিয়োগ করবেন। যদি আরও অন্তত ১৫-২০টি খুব ভালো কোম্পানি আসত, তাহলে বাজার চিত্রটি অন্যরকম হতে পারত। এটিই বোধ হয় বড় ব্যর্থতা।

সমকাল: এ ব্যর্থতা কার?

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: এককভাবে কারও না। বিএসইসির কাজ নয়, কোনো কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনা। এ সংস্থার কাজ সুষ্ঠু বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করা, যাতে ভালো কোম্পানি এবং বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রয়োজনে বাজারটিকে ব্যবহার করেন। এ দায়িত্ব স্টক এক্সচেঞ্জ বা মার্চেন্ট ব্যাংকের। তাদের প্রচেষ্টা দৃশ্যমান নয়। তাছাড়া সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিও মানুষকে পুঁজিবাজারমুখী হওয়ার মতো নয়। কারণ নতুন কোম্পানি আইপিও অনুমোদন পায় না। পুরোনো কোম্পানি তার ব্যবসা বাড়াতে বা চলতি মূলধনের প্রয়োজনে আসতে পারে। এ প্রয়োজন মেটাতে ব্যাংক বসে আছে। দ্রুত সময়ে ঋণ দিচ্ছে, যেখানে পুঁজিবাজারে অনেক সময় লাগে। এখন যদি শিল্পে বিনিয়োগ এত বেশি হতো যে ব্যাংক তার জন্য অর্থায়ন করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না, তখন হয়তো পুঁজিবাজারমুখী হতো। দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ জিডিপির ২৩ শতাংশে আটকে আছে বহু বছর। যখন ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ চাহিদা বাড়বে এবং ব্যাংক তা দিতে পারবে না বা উদ্যোক্তার কাছে পুঁজিবাজার বেশি লাভজনক বলে মনে হবে, তখন তারা নিজে থেকেই আসবে।

সমকাল: দেশের শেয়ারবাজারে লাগাতার দর পতন হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারাচ্ছেন। আইপিও নেই। ফলে ব্যাপক সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে…

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: সংস্কার হতেই পারে। তবে আইনগত বড় সংস্কারের দরকার আছে বলে মনে করি না। কারণ ২০০৯-১০ সালেও এই আইন ছিল। তখনও ৩০-৩৫ লাখ বিনিয়োগকারী এ বাজারে ছিল। সমস্যাটি আইনে নয়, প্রয়োগে। লক্ষ্য করছি, সংস্কারের লক্ষ্যে ৭ মাস কেটে গেছে, এখনও সংস্কার কাজ শুরু হয়নি। একটি টাস্কফোর্স হয়েছে, যার ১৭টি বিষয়ে সুপারিশ দেওয়ার কথা, দিয়েছে তিনটি। এভাবে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। সেসব সংস্কার প্রস্তাব এসেছে, সেগুলো অংশীজনের সঙ্গে কথা বলে এক-দেড় মাসেই বিএসইসি নিজেই করতে পারত।

সমকাল: চলতি দর পতনের কারণ কী বলে মনে করেন?

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: এখন দেশে মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক সুদের হার বেশি। এমন পরিস্থিতি শেয়ারবাজারের জন্য অনুকূল নয়। কারণ বড় বিনিয়োগকারীরা এ সময়ে নিরাপদ বিনিয়োগ (যেমন– এফডিআর, সঞ্চয়পত্র, ট্রেজারি বন্ড) করেন, শেয়ারে নয়। তারপরও যেভাবে লাগাতার পতন হচ্ছে, তার যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাই না। গত তিন মাসে অর্থনীতির যতটুকু উন্নতি হয়েছে, তার প্রভাব থাকার কথা ছিল, তা হয়নি। এর কারণ অন্য কিছু।

সমকাল: অন্য কিছুটা কী?

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: সুশাসনের অভাব। বিশেষত বাজারের নিয়ন্ত্রণগত সমস্যা, কারসাজি বন্ধ না হওয়া। নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি সংশ্লিষ্টদের আস্থা না থাকা।
সমকাল: প্রধান উপদেষ্টা প্রয়োজনে বিদেশি পরামর্শক এনে শেয়ারবাজারের সংস্কার করা, ভালো শেয়ারের জোগান বাড়ানো, অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ কী? 

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: এ ক্ষেত্রে আমি কিছু দুর্বলতা দেখি। তিনি হয়তো শুধু সরকারি কর্মকর্তা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কথা শুনে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। ভালো হতো যদি বাজার অংশীজনকে সঙ্গে নিয়ে বা আগে তাদের কথা শুনে সিদ্ধান্ত নিতেন। তিনি যে সমাধান দিয়েছেন, তার কোনোটাই নতুন না।

সমকাল: বিদেশি পরামর্শক দিয়ে সংস্কারের নির্দেশনাও কী ভালো নয়?

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: বিদেশিদের দিয়ে আমাদের সমস্যার সুরাহা করা দুরূহ। কারণ উন্নত বাজারে যে সমস্যা, আমাদের ছোট বাজারে তা নয়। যদি পরামর্শক আনতেই হয়, তাহলে ফ্রন্টিয়ার বাজারের সমস্যা কাটিয়ে যারা সম্প্রতি ইমার্জিং মার্কেট হয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতা জানা ভালো।

সমকাল: সংস্কার কী ধরনের হওয়া উচিত?

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী: আমাদের সমস্যা তাৎক্ষণিক। প্রতিদিনই বাজার পড়ছে। এ সমস্যার সমাধান মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার দিয়ে হবে না। আজ বা আগামীকালের ব্যবস্থা লাগবে। তাছাড়া বিনিয়োগকারীদের না বাঁচিয়ে কোনো সংস্কার কাজে আসবে না। যত দ্রুত সম্ভব কিছু বহুজাতিক এবং সরকারি কোম্পানি বাজারে আনলে বাজারে পরিবর্তন আসবে। বাজারের সব অংশীজনের সঙ্গে বসে তাদের কথা শুনে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ তারাই ভালো জানে, এখন বাজারের কী প্রয়োজন। বিশ্বাসযোগ্যভাবে সবাইকে এ বার্তা দিতে হবে- সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাজারের উন্নতি চাচ্ছে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনোয়ার ইব্রাহীম

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে জরুরি সাক্ষাৎ, কী ঘটছে বিএসইসির চেয়ারম্যানের ভাগ্যে?
  • সরকার পুঁজিবাজারের সমস্যা দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করছে: ড. আনিসুজ্জামান
  • পুঁজিবাজারের উন্নয়নে অংশীজনদের সঙ্গে বিএসইসি’র মতবিনিময়
  • তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির করহারের ব্যবধান ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব
  • ডিএসইতে সাপ্তাহিক দাম কমার শীর্ষে শাইনপুকুর সিরামিকস
  • রবিবার ডিএসই পরিদর্শনে যাবেন ড. আনিসুজ্জামান
  • ডিএসইতে সাপ্তাহিক দাম বাড়ার শীর্ষে সিটি ইন্স্যুরেন্স
  • ডিএসইতে পিই রেশিও কমেছে ২.২৩ শতাংশ
  • তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা লাগবে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার পরে