আজকের দ্রুতগতির, অনিশ্চিত ও জটিল বিশ্বে মুসলিমদের ইমান কি দুর্বল হয়ে পড়ছে? দুশ্চিন্তা, দুঃখ, উদ্বেগ ও হতাশার মতো আবেগ কি ইমানের দুর্বলতার প্রতিফলন? নাকি এগুলো আমাদের আধুনিক জীবনধারা ও সমাজের বাহ্যিক চাপের ফল? আসুন, ইসলামের আলোকে পথ খুঁজে বের করি।
মানসিক অসুস্থতা ইমানের দুর্বলতা নয়মানসিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতা একে অপরের পরিপূরক। অনেকে মনে করেন, মুসলিম হিসেবে আল্লাহ ও রাসুল (সা.
পবিত্র কোরআনে নবী ইয়াকুব (আ.)-এর ঘটনা আমাদের শেখায়, দুঃখ ও শোক মানুষের স্বাভাবিক আবেগ। তিনি তাঁর পুত্র ইউসুফ (আ.)-এর কথা শুনে এতটাই শোকে কাতর ছিলেন যে তাঁর দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবু তিনি ধৈর্য ধরেছিলেন এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। (সুরা ইউসুফ: ১৮, ৮৪)
এই সমাজে প্রত্যেকে নিজের উদ্যোক্তা, একই সঙ্গে শোষক ও শোষিত।বিয়ং-চুল হান, দার্শনিকদুঃখ, উদ্বেগ বা হতাশা ইমানের অভাবের লক্ষণ বলা সঠিক নয়। দুঃখ বা উদ্বেগ ইমানের দুর্বলতা নয় বরং এগুলো মানুষের স্বাভাবিক অংশ। এই আবেগগুলোকে নিজেদের মতো বিচার না করে বিশেষজ্ঞের সাহায্যে মোকাবিলা করা উচিত।
আরও পড়ুন অশান্ত হৃদয়ের প্রেরণা জুলাইবিব (রা.)০৫ এপ্রিল ২০২৫বার্নআউটের যুগআধুনিক সমাজ, যাকে দার্শনিক বিয়ং-চুল হান বলেছেন ‘বার্নআউট সোসাইটি’, তা ক্রমাগত উৎপাদনশীলতা ও ইতিবাচকতার ওপর জোর দেয়। এই সমাজে বিরতি বা নেতিবাচক আবেগকে নিরুৎসাহিত করা হয়। ফলে মানুষ ক্রমাগত চাপে থাকে, যা হতাশা, উদ্বেগ এবং মানসিক ক্লান্তির কারণ হয়। হান বলেন, ‘এই সমাজে প্রত্যেকে নিজের উদ্যোক্তা, একই সঙ্গে শোষক ও শোষিত।’
এই অতিরিক্ত স্ব-অপ্টিমাইজেশন মানুষকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত করে, যার ফলে তারা অস্তিত্বের শূন্যতায় ভোগে।
চার্লস টেলর তাঁর বই এ সেক্যুলার এজ–এ ব্যাখ্যা করেন, পশ্চিমা সমাজ ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষ, মানবকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই পরিবর্তন ঈশ্বর ও অদৃশ্য জগতের প্রতি বিশ্বাসকে প্রান্তিক করেছে, যা মানুষের মানসিক ও আধ্যাত্মিক ভারসাম্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে। ফলে আধুনিক জীবনধারা আমাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
দুনিয়া এমন এক স্থান নয়, যেখানে সব ইচ্ছা পূরণ হবে বা কোনো দুশ্চিন্তা ছাড়াই জীবন কাটবে। এটি উদ্বেগ, দুঃখ ও চ্যালেঞ্জের স্থান। আবু জায়েদ আল-বালখি,মাসালিক আল আবদান ওয়াল আনফুসদুনিয়া সাময়িক ও পরীক্ষার ক্ষেত্রইসলাম দুনিয়াকে সাময়িক ও পরীক্ষার স্থান হিসেবে বর্ণনা করে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এই দুনিয়ার জীবন কেবল সাময়িক সুখ, আর আখিরাতই চিরস্থায়ী আবাস।’ (সুরা গাফির, আয়াত: ৩৯)
আবু জায়েদ আল-বালখি (৮৫০-৯৩৪ সাল) তাঁর বই মাসালিক আল আবদান ওয়াল আনফুস-এ বলেন, দুনিয়া এমন এক স্থান নয়, যেখানে সব ইচ্ছা পূরণ হবে বা কোনো দুশ্চিন্তা ছাড়াই জীবন কাটবে। এটি উদ্বেগ, দুঃখ ও চ্যালেঞ্জের স্থান। পবিত্র কোরআন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আল্লাহ সর্বদা এই বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তিনি বলেন, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি বিশ্বজগতের রব, অতি দয়াময়, পরম করুণাময়।’ (সুরা ফাতিহা, আয়াত: ১-৩)
এই আয়াত আমাদের আশ্বাস দেয়, আল্লাহর রহমত আমাদের চারপাশে রয়েছে এবং আমরা কখনো একা নই।
আরও পড়ুনদুনিয়া ও আখিরাতে সাফল্য আসে যে আমলে১১ আগস্ট ২০২৩দুনিয়ার তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো:
১. দুনিয়া চিরস্থায়ী নয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি, তারপর তারা মৃত্যুবরণ করবে এবং কিয়ামতের দিন পুনরুত্থিত হবে।’ (সুরা মুমিন, আয়াত: ১২-১৬)
২. দুনিয়া পরিশ্রমের মাধ্যমে আল্লাহর সাক্ষাৎ লাভের স্থান। ‘হে মানুষ, তোমার প্রতিপালক পর্যন্ত (পৌঁছাতে) অবশ্যই তোমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। অতঃপর তুমি তাঁর সাক্ষাৎ পাবে।’ (সুরা ইনশিকাক, আয়াত: ৬-৯)
৩. দুনিয়া আমাদের কর্মের পরীক্ষা নেয়। ‘তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমাদের মধ্যে কে সর্বোত্তম কাজ করে, তা পরীক্ষা করেন।’ (সুরা মুলক, আয়াত: ১-২)
আল্লাহর সঙ্গে গভীর সংযোগ গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে। কেবল বেশি নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত বা ধর্মীয় পাঠে যোগদান নয়, বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে হবে।ইমানের মাধ্যমে ভারসাম্যশায়খ মুহাম্মাদ সাঈদ রামাদান আল-বুতি বলেন, ‘যদি তুমি বিশ্বাস করো যে আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, দয়ালু এবং করুণাময়, তবে তুমি জানবে যে তিনি তোমার কল্যাণের জন্যই এই পরীক্ষা পাঠিয়েছেন।’
ইসলাম আমাদের শেখায়, আবেগগুলো স্বাভাবিক এবং এগুলোকে দমন না করে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। আল্লাহর সঙ্গে গভীর সংযোগ গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে। কেবল বেশি নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত বা ধর্মীয় পাঠে যোগদান নয়, বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিতে হবে। পবিত্র কোরআন আমাদের প্রতিশ্রুতি দেয়, ‘যারা ধৈর্য ধরে এবং বলে, ‘আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁর কাছেই ফিরে যাব’, তাদের ওপর আল্লাহর রহমত ও নির্দেশনা বর্ষিত হয়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৭)
মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন এই দোয়া: ‘হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে দুশ্চিন্তা ও দুঃখ, অক্ষমতা ও অলসতা, কাপুরুষতা ও কৃপণতা, ঋণের ভার এবং মানুষের দ্বারা পরাভূত হওয়া থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি।’ (সহিহ বুখারি: ৬,৩৬৯; সহিহ মুসলিম: ২,৭০৬)
সূত্র: মুসলিম ডটএসজি
আরও পড়ুনআপনার মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা নিচ্ছেন তো২১ জুন ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র বলত আল ল হ আম দ র পর ক ষ দ র বল র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
এই সরকারের কি গণভোট দেওয়ার এখতিয়ার আছে, প্রশ্ন ফরহাদ মজহারের
বর্তমান সংবিধান মেনে শপথ নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের গণভোট দেওয়ার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, যিনি জুলাই অভ্যুত্থানের পর এই সংবিধান বাতিল করার মত জানিয়েছিলেন।
সংবিধান সংস্কারে গণভোটের দিকে সরকারের এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে আজ সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় এই প্রশ্ন তোলেন ফরহাদ মজহার। ‘নতুন বাংলাদেশ গঠনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করে ‘সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজ’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘গণভোট কে দেবে? এই সরকারের কি এখতিয়ার আছে গণভোট দেওয়ার? তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) তো বলছেন, এই সংবিধান রক্ষা করব। কিসের গণভোট?’
পুরোনো সংবিধান রেখে নতুন বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আপনি সংবিধান রাখবেন, আবার সংবিধানবিরোধী ভূমিকাও নেবেন, দুটো তো হতে পারে না।’
জুলাই অভ্যুত্থানের পর যখন অন্তর্বর্তী সরকার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছ থেকে শপথ নিয়েছিল, তখনই তা নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন ফরহাদ মজহার; যদিও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে তাঁর স্ত্রী ফরিদা আখতারও অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেন।
ফরহাদ মজহার মনে করেন, গত বছর ৮ আগস্ট দেশে একটি ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’ হয়েছিল। বর্তমানে যাদের অন্তর্বর্তী সরকার নামে অভিহিত করা হচ্ছে, তারা শেখ হাসিনা সরকারের তৈরি করা সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জায়গা হারিয়েছে। এখন একমাত্র গণপরিষদ গঠন করে গণপরিষদের সম্মতিতে গণভোট আয়োজন বৈধ হতে পারে।
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘এই সরকার অন্তর্বর্তী সরকার নয়। এই সরকার উপদেষ্টা সরকার। এই উপদেষ্টা সরকারের একটাই কাজ, ঠিকমতো উপদেশ দেওয়া।...এদের কাছ থেকে বেশি কিছু পাওয়ার নেই। এখন তার উচিত হবে, যত দ্রুত সম্ভব যদি কছু দেওয়ার থাকে সে দিয়ে যাবে।’
এখন একমাত্র গণপরিষদ গঠন করে সেই পরিষদের সম্মতিতে কেবল গণভোট আয়োজন বৈধ হতে পারে, বলেন ফরহাদ মজহার।
গত বছরের ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের বিজয়ের পর আট তারিখের মধ্যে কোনো একটি অংশ ‘চরম বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছে বলেও অভিযোগ করেন ফরহাদ মজহার। জুলাই অভ্যুত্থানে সৈনিকদের ভূমিকা থাকলেও ৫ আগস্টের পরে তাদের অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।
আলোচনা সভায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরের নায়েবে আমির হেলাল উদ্দিন বলেন, ছাত্ররা যে ন্যায়বিচারের দাবি করেছিল, দেশের নেতৃত্বে সৎ লোক না এলে কখনো সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে না। এখনো টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি বন্ধ হচ্ছে না।
ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার আলোচনায় দেশের সংখ্যালঘুদের কথা পৌঁছায়নি বলে অভিযোগ তোলেন জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক। আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘সেই ১৯৪৭ সালের ৩৩% মাইনরিটি এখন তো বিলুপ্তির পথে। তো সেখানে তাদের তো দু’চারটা কথা শোনার দরকার ছিল, তারা কিন্তু সেটাও শুনল না।’
সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সাদেক রহমানের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ নতুনধারা জনতার পার্টির চেয়ারম্যান মুহাম্মাদ আবদুল আহাদ নূর, গণমুক্তি জোটের চেয়ারম্যান শাহরিয়ার ইফতেখার, যুবনেতা এ বি এম ইউসুফ, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান, জামাল হায়দার, ফেরদৌস আজিজ, অধ্যাপক দেওয়ান সাজ্জাদ, এ আর খান প্রমুখ।