গণ-অভ্যুত্থান স্মরণে বিএনপির মঞ্চে বিভিন্ন দলের নির্বাচনী আকাঙ্ক্ষা
Published: 2nd, July 2025 GMT
নিত্যনতুন ইস্যুর বেড়াজালে আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে হবে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপির মধ্যে এখনো কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবু দলগুলোর মধ্যে ভেতরে-ভেতরে নির্বাচনকেন্দ্রিক পথচলার একটা নিজস্ব পথনকশা যে তৈরি হচ্ছে, সেটি ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার বিএনপি আয়োজিত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে অনেক রাজনৈতিক দলের নেতার বক্তব্যে এর প্রকাশ ঘটে। অনেকের বক্তব্যে নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে থাকার অভিপ্রায় প্রকাশ পায়।
এখন পর্যন্ত সংস্কার ও নির্বাচন ঘিরে মুখ্য রাজনৈতিক দলগুলোতে যে তৎপরতা, তাতে একদিকে আছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো, অন্যদিকে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কিছু দলের ঐক্য প্রচেষ্টার একটি তৎপরতা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে নির্বাচন মাঠে গড়ালে তখন বিএনপির বিপরীতে ইসলামপন্থী দলগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। সে কারণে বিএনপির পাশাপাশি ইসলামপন্থী দলগুলোর তৎপরতার দিকেই অনেকে দৃষ্টি রাখছেন।
গত শনিবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বড় ধরনের সমাবেশ করে আলোচনা তৈরি করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সেখানে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ (এনসিপি) সমমনা প্রায় সব ইসলামি দল অংশ নেয়। ওই সমাবেশে বিএনপিকে আমন্ত্রণও জানানো হয়নি।
গতকাল মঙ্গলবার বিএনপি আয়োজিত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূতির অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সবচেয়ে কঠোর বক্তব্য দেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। তিনি কারও নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘যারা নতুন নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করে, নতুন নতুন ইস্যু তৈরি করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চায়, দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে আমরা সবাই টপ টু বটম, দেশপ্রেমিক জনতা অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চাই।’
এরপরেই মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, ‘যিনি যত বড়, তাঁর দায়িত্ব এবং উদারতা প্রদর্শনের জায়গাটাও তত প্রশস্ত। অতএব এই জায়গাটাকে আমরা সবাই পরিচর্যা করার চেষ্টা করব।’
লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি এই অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যুক্ত ছিলেন। অনেকে মনে করছেন, মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর এ বক্তব্য বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের উদ্দেশে, যা মনোনয়ন প্রত্যাশার প্রকাশ। আফেন্দী নীলফামারী-১ আসন (ডোমার-ডিমলা) থেকে নির্বাচন করতে চান। গত ঈদুল আজহায় এলাকাবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি পোস্টারও লাগিয়েছেন।
বিএনপির অনুষ্ঠানে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠে বক্তব্য দেন ইসলামি বক্তা জুনাইদ আল হাবিব। তিনি বলেন, ‘শেষ কথা বলতে চাই, চরম নির্যাতনের মুখেও মাঠে ছিলাম, এখন পর্যন্ত মাঠে আছি। আজকের যিনি উদ্বোধক, যিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন; জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন; তিনি প্রবাসে থেকে যে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁর নেতৃত্বে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফ্যাসিবাদের যেইভাবে পতন ঘটিয়েছেন; আজকে বলব—সেই পতনের যারা ফাটল ধরাবেন, তারা ফ্যাসিবাদের দালাল, তারা এ দেশের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু।’
জুনাইদ আল হাবিব জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন (সরাইল-আশুগঞ্জ) থেকে নির্বাচন করতে চান।
প্রসঙ্গত, ইসলামি দলগুলোর ভোট ‘একটি বাক্সে’ পাঠাতে গত ২৪ এপ্রিল একমত হয়েছিল সমমনা পাঁচ ইসলামি দলের নেতারা। সেখানে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামও রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন ঘিরে যে কী হতে যাচ্ছে, তা চলতি জুলাই বা আগামী আগস্টের মধ্যে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে কারা বিএনপির সঙ্গে, আর কারা ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ঐক্যে শামিল হবে, সেই মেরুকরণও দৃশ্যমান হবে। এখন পর্যন্ত ইসলামি দলগুলো কে কোন দিকে যাবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত নয়। এ ক্ষেত্রে মাওলানা মামুনুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তসহ কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক কিছু ইসলামি দলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
নির্বাচন ও সংস্কার ঘিরে বিএনপির বিপরীতে এখন পর্যন্ত যে তৎপরতা, তার কেন্দ্রে রয়েছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। বিএনপির জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূতির অনুষ্ঠানে জামায়াত অংশ নিলেও ইসলামী আন্দোলন যায়নি। ওই অনুষ্ঠানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বক্তব্য দেন। খুব সংক্ষেপ ও নিরুত্তাপ বক্তব্যে তিনি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে জামায়াতের অংশগ্রহণের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। একই সঙ্গে জাতীয় স্বার্থে যেকোনো ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে শামিল থাকার দলীয় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
আবদুল হালিম বলেন, ‘আমরা সব সময় জাতীয় ঐক্যে বিশ্বাসী। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আমরা ২০ বছর ২০–দলীয় জোটে আন্দোলন করেছিলাম। ভবিষ্যতে জাতীয় স্বার্থে, দেশের স্বার্থে এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যেকোনো ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে আমরা থাকব।’
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূতির অনুষ্ঠানে ৬০টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এতে ৫০টির মতো দল ও সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে ২২টি দলের নেতা বক্তব্য দেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও ইসলামী আন্দোলনকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, তারা আসেনি।
অবশ্য ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, তাঁরা বিএনপির আমন্ত্রণ পাননি।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিএনপি আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত নেতা–কর্মীরা.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত র অন ষ ঠ ন দল র ন ত ব এনপ র দলগ ল ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
‘পুরো এলাকা কাঁপছে, যেন পৃথিবীর শেষ সময় এসে গেছে’
পাকিস্তানে প্রবল বৃষ্টিতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসে গত ৪৮ ঘণ্টায় অন্তত ৩৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৩২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত ১২০ জন। আজ শনিবার দেশটির কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানিয়েছে।
খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের উদ্ধারকারী সংস্থা বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছে, ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে মরদেহ উদ্ধারে প্রায় দুই হাজার উদ্ধারকর্মী কাজ করছেন। তাঁরা নয়টি ক্ষতিগ্রস্ত জেলায় ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। বৃষ্টির কারণে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে।
খাইবার পাখতুনখাওয়ার উদ্ধার সংস্থার মুখপাত্র বিলাল আহমেদ ফয়েজি বলেন, প্রবল বৃষ্টি, বিভিন্ন স্থানে ভূমিধস ও সড়ক পানির তলে চলে যাওয়ায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে বড় বাধার সৃষ্টি হয়েছে। ভারী যন্ত্রপাতি ও অ্যাম্বুলেন্স পরিবহনে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে। বেশির ভাগ এলাকার সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে উদ্ধারকর্মীরা পায়ে হেঁটে দুর্গম অঞ্চলে তৎপরতা চালাচ্ছেন।
এমন অবস্থায় বুনের, বাজৌর, সোয়াত, শাংলা, মানসেহরা, বাট্টাগ্রামসহ গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ি জেলাগুলোকে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা ঘোষণা করেছে প্রাদেশিক সরকার।
পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভারী বৃষ্টির সতর্কতা জারি করেছে দেশটির আবহাওয়া অধিদপ্তর। এতে জনগণকে ‘সতর্কতামূলক ব্যবস্থা’ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (এনডিএ) জানিয়েছে, পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ১১ জন এবং উত্তরাঞ্চলীয় গিলগিট বালতিস্তানে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজন পাইলট ছিলেন।
এনডিএর প্রতিনিধি সৈয়দ মোহাম্মদ তায়েব শাহ বলেন, এ বছর মৌসুমি বৃষ্টি স্বাভাবিকের তুলনায় আগে শুরু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বৃষ্টি শেষ হতেও সময় লাগবে। তিনি বলেন, আগামী ১৫ দিন...মৌসুমি বৃষ্টির তীব্রতা আরও বাড়বে।
বুনের জেলায় ইতিমধ্যে অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়েছেন। সেখানকার বাসিন্দা আজিজুল্লাহ বলেন, তিনি ভেবেছিলেন ‘কেয়ামত নেমে এসেছে।’
আজিজুল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রচণ্ড শব্দ শুনলাম, যেন পাহাড়টা ধসে পড়ছে। আমি দৌড়ে বাইরে গিয়ে দেখি, পুরো এলাকা কাঁপছে, যেন পৃথিবীর শেষ সময় এসে গেছে। মনে হচ্ছিল, মৃত্যু আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।’
সোয়াত জেলা থেকে এএফপির এক আলোকচিত্রী জানিয়েছেন, সেখানকার সড়ক কাদাপানিতে ডুবে গেছে। বিদ্যুতের খুঁটি মাটিতে পড়ে গেছে। অনেক গাড়ির অর্ধেক কাদার নিচে চাপা পড়ে আছে।
পাকিস্তানে বর্ষা মৌসুমে যে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ সেটিকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে বর্ণনা করেছে। এতে এখন পর্যন্ত ৬৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ৮৮০ জনের বেশি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি পাকিস্তান। দেশটির মানুষকে প্রতিনিয়ত চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ২০২২ সালের মৌসুমি বন্যায় পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। এতে ওই বছর প্রায় ১ হাজার ৭০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।