বাংলাদেশের জনসংখ্যার ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণের জায়গাগুলোতে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার কথা থাকলেও সেটি করা হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও জুলাই আন্দোলনের সংগঠক নাজিফা জান্নাত। তিনি বলেন, সংসদীয় আসনে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার প্রশ্ন এলে তাঁরা পুরোনো পদ্ধতিতে ফিরতে চান। এই যে নারীকে টোকেন হিসেবে রাখার মেকানিজম বা মানসিকতা, আমরা গ্রহণ করব না।

নাজিফা বলেছেন, ‘অভ্যুত্থানের সময় আমরা নারীরা সামনে ছিলাম। তখন আমাদের মিছিলের সামনে রাখলে আন্দোলন ঠিকমতো হচ্ছিল। নারীদের থেকে সাপোর্ট সিস্টেম পাওয়া যাচ্ছিল। তখন কোথাও নারীদের “না” করা হয়নি। কিন্তু এত বড় এই রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের পরে যখন নারীবিষয়ক সংস্কারের আলাপ হচ্ছে, যখন নারীবিষয়ক সংস্কারের প্রধানকে খুবই বাজে ভাষায় আক্রমণ করা হচ্ছে, যেটা অশ্রাব্য, যেটা আসলে মুখে উচ্চারণও করা যায় না। এ রকমভাবে কটাক্ষ করার পরও আমরা কোনো প্রতিরোধ দেখতে পাই না।’

আজ শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘সংসদে নারী আসন ও নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ কথাগুলো বলেন। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন। এতে সংসদে নারী আসন নিয়ে ধারণাপত্র তুলে ধরেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাজনীন আখতার।

বৈঠকে নাজিফা বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে সংসদে নারীর আসন নিশ্চিতকরণ নিয়ে যে সংস্কার করার কথা ছিল, সেটি না করে তারা আগের জায়গায় ফেরত গিয়েছে। এই প্রস্তাব আমরা নিশ্চয়ই প্রত্যাখ্যান করব। কারণ, এতে আমাদের রীতিমতো অপমান করা হয়েছে। এই অন্তর্বর্তী সরকারের একটা প্রধান এজেন্ডা (আলোচ্য বিষয়) হচ্ছে ‘সংস্কার’। সংস্কার শব্দটি শুনতে শুনতে আমাদের কান পচে গেছে।’

শুধু রাজনৈতিক দলগুলো নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে না উল্লেখ করে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের এই সমন্বয়ক এর কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখতে পেয়েছি যে গত ১২টি সংসদীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশের বেশি নারী সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। অথচ এখানে আমরা কথা বলছি ৫০ শতাংশ আসনের। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি জরিপে ৪৬ হাজারের বেশি মানুষের মতামত তুলে আনা হয়েছে। সেখানে ৭৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ মানুষ মতামত দিয়েছেন যে তাঁরা নারী আসনে সরাসরি ভোট দিয়ে তাঁদের নারী প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করতে চান। এখানে জনমতের বিষয়টি স্পষ্ট।’

নাজিফা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার শুরুতে দেখছি যে বিএনপি, এনসিপিসহ অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলই ১০০টি নারী সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন করার কথা জানিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁরা একমত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে ঝামেলা লাগার কারণ হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার আসলে প্রচণ্ড পক্ষপাতপূর্ণ (বায়াসড)। যে রাজনৈতিক দলের সমর্থক বেশি, যাদের পেশিশক্তি বেশি এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো, এ সরকার তাদের পক্ষ নেয়। প্রথম দিকে সরাসরি ভোটে নারী আসন নিয়ে সব দল একমত হলেও, এখন বিএনপি বলেছে তারা আসলে এমনটি চায় না। অথচ ২০০১ সালে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে নির্বাচিত হয়ে এলে তারা সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা করবে। এখন হয়তো তাদের মনে হচ্ছে সরাসরি নির্বাচনে আসা নারীরা তাদের আনুগত্য করবে না। এ ক্ষেত্রে ঐকমত্য গঠনের জন্য গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে নাগরিক সমাজসহ অন্যান্য যত ধরনের নারী সংস্থা রয়েছে, তাদের সরাসরি সরকারকে চিঠি দেওয়া উচিত। জানানো উচিত, এত দিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেও সবার চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়নি সরকার।’

আরও পড়ুনজুলাই ঘোষণাপত্র থেকে নারীকে সচেতনভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে: খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম২ ঘণ্টা আগে

বিএনপিকে এ ধরনের পশ্চাদ্‌গামী (রিগ্রেসিভ) চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে নাজিফা বলেন, ‘নারী সংস্কার কমিশন এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব জানিয়েছে, সেখানে তাদের একমত হওয়া উচিত। তারা যে প্রস্তাবটি দিয়েছে, সেটি খুবই প্রগতিশীল। এটি গ্রহণ করলে আমরা নারীর ইকুয়ালিটির পাশাপাশি ইকুইটিও নিশ্চিত করতে পারব; অর্থাৎ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে নারীর অংশগ্রহণের জায়গাটি আমরা নিশ্চিত করতে পারব।’

গোলটেবিল বৈঠকে আরও অংশ নিয়েছেন নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির, নারীপক্ষের সভানেত্রী গীতা দাস, গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য ইলিরা দেওয়ান।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর প রস ত ব র জন ত ক সরক র প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

এ ঘটনা অধ্যাপক ইউনূসের জন্য লজ্জার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ক্ষমা চাইতে হবে

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেনের ওপর আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের ডিম নিক্ষেপের প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন দলটির নেতা–কর্মীরা। তাঁরা বলেছেন, এ ঘটনা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য লজ্জার। নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যর্থ হওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।

আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে মিছিলটি শুরু হয়ে বাংলামোটরে এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়।

নিউইয়র্কে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেনসহ রাজনীতিবিদদের ওপর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে অন্তর্বর্তী সরকারের চরম গাফিলতির প্রতিবাদ এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারের দাবিতে এই বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে দলটির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখা।

মিছিলে এনসিপি নেতা–কর্মীদের ‘ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর/ আওয়ামী লীগ নো মোর’; ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ/ শেষ হয়নি যুদ্ধ’; ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ/ মুজিববাদ মুর্দাবাদ’; ‘দিল্লি না ঢাকা/ ঢাকা ঢাকা’; ‘আওয়ামী লীগের ঠিকানা/ এই বাংলায় হবে না’; ‘আখতারের ওপর হামলা করে/ ইন্টারিম কি করে?’ প্রভৃতি স্লোগান দিতে শোনা যায়।

সংক্ষিপ্ত সমাবেশে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন বক্তব্য দেন।

নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন এবং যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারাকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাঁদেরকে আওয়ামী লীগের সামনে ছেড়ে দিয়েছেন। এটা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জন্য লজ্জার। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য লজ্জার। এ ঘটনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যর্থতার দায় নিয়ে অতিসত্বর বাংলাদেশের মানুষের সামনে এসে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।’

এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, ‘বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে এখনো আওয়ামী লীগের সাঙ্গপাঙ্গরা রয়েছে। অতিদ্রুত সিভিল সার্ভিস থেকে, সেনাবাহিনী থেকে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান থেকে আওয়ামী লীগের গুন্ডা বাহিনীদের অপসারণ করতে হবে। যদি অপসারণ করতে না পারেন, তাহলে ইউনূস সরকার বর্তমান যে অবস্থায় রয়েছে, তারা কত দিন ক্ষমতায় টিকবে সেই নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারি না।’

নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, ‘আজকে আমাদের বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল সাহেবের একটি বক্তব্য দৃষ্টিগোচর হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আসতে চায়। এ বক্তব্য জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার।...আমরা এখনো বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের শহীদ জিয়ার সৈনিকেরা মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করবেন।’

জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশে এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকে যখন রাজাকার বলে, পাকিস্তানি ট্যাগ দিয়ে অলিগলিতে পেটানো হয়েছে, তখন আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু আজকে যখন গণ–অভ্যুত্থানের নেতাদের ওপর হামলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অলিগলিতে আওয়ামী লীগ ঘোরাফেরা করছে, তখন তারা মুখে কুলুপ বসিয়েছে।’

দলীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা পাওয়া নিয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, ‘আমরা যখন নিবন্ধন কর্মসূচির সব কাজ সম্পন্ন করেছি, নির্বাচন কমিশনের কাছে গিয়ে আমরা বলেছিলাম, শাপলা প্রতীক পেতে আইনি কোনো বাধা আছে? তারা আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, আইনি কোনো বাধা নেই। কিন্তু কেন প্রতীক পাব না, সেই প্রশ্নে তারাও মুখে কুলুপ এঁটেছে। আমরা সব জায়গায় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি।’

আরও পড়ুননিউইয়র্কে এনসিপি নেতা আখতারকে হেনস্তা করলেন আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীরা, ডিম নিক্ষেপ১৩ ঘণ্টা আগে

তাসনিম জারাকে কটূক্তির প্রতিবাদ জানিয়ে এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, ‘চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল আমাদের বোনেরা। রাজপথে সামনে সারিতে দাঁড়িয়ে তাঁরা আওয়ামী লীগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছিল। রক্ত দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছিলেন। এখন সেই আওয়ামী লীগ দেশছাড়া হয়ে আমাদের বোনদের আক্রমণ করা শুরু করেছে। কারণ তারা জানে, আমাদের বোনেরা যদি তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, আমাদের বোনেরা যদি তাঁদের কণ্ঠস্বর সোচ্চার রাখেন, তাহলে এই বাংলাদেশে ওই খুনিদের আর জায়গা হবে না।’

বাংলাদেশে কোনো ‘রিফাইন্ড’ আওয়ামী লীগের জায়গা হবে না মন্তব্য করে সারজিস আলম বলেন, ‘আগামীর বাংলাদেশে যেকোনো ফরম্যাটে রিফাইন্ড আওয়ামী লীগকে আমরা আশ্রয় পেতে দেব না। আমরা আগামীর বাংলাদেশকে রিফাইন্ড বাংলাদেশের দিকে নিয়ে যাব, যেই বাংলাদেশে কোনো ফ্যাসিস্ট কিংবা ফ্যাসিস্টের দোসরের জায়গা হবে না।’

আরও পড়ুনআখতারকে ডিম নিক্ষেপ: নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের শাস্তি চায় এনসিপি৬ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ