Prothomalo:
2025-09-23@09:04:14 GMT

‘আমার তর্পণে সেই পরম ব্রহ্ম..’

Published: 23rd, September 2025 GMT

মহালয়ার তাৎপর্যের দিকে তাকালে বোঝা যায় কতটা বৈশ্বিক ও মানবিক দর্শন যেকোনো ধর্মবিশ্বাস আমাদের উপহার দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই ‘মহালয়া’ পদটি মূলত আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথির অপর নাম।

এই মহালয়া তিথিতে আমরা মূলত আমাদের ছয় উর্ধ্বতন পিতৃপুরুষের স্মৃতি, কাজ, করে যাওয়া কর্তব্যের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা জানাই। এই ছয় পিতৃপুরুষ হচ্ছেন বাবা, ঠাকুর্দা, ঠাকুর্দার বাবা; মায়ের বাবা, মায়ের বাবার বাবা, মায়ের বাবার ঠাকুর্দা।

তবে এখানের মন্ত্রে ‘পিতরঃ’ শব্দের অর্থে মা, ঠাকুর্মা, দিদাও চলে আসে। কারণ সংস্কৃতে ‘পুত্রাঃ’ দিয়ে কিন্তু শুধু ছেলে না, ছেলে-মেয়ে উভয়কে বোঝায়। পুত্রা মানে বাংলাতে যাই হোক, সংস্কৃতে ‘সন্তান’। তেমনি এই ‘পিতরঃ’ শব্দটি। অর্থাৎ, পিতৃপক্ষ মানে কোন পুরুষতান্ত্রিকতা না।

মহালয়া তিথিতে আমরা মূলত আমাদের ছয় উর্ধ্বতন পিতৃপুরুষের স্মৃতি, কাজ, করে যাওয়া কর্তব্যের উদ্দেশ্যে কৃতজ্ঞতা জানাই।

মাতৃগণের জন্যও এমন নিয়ম আছে, সেটি সুবিস্তারে আরো সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গে বলব। আপাতত বলি, মহালয়ার পরের পনেরটি তিথি তো ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা’র জন্যই রাখা

আর যাদের বাবা মা জীবিত আছেন, বুঝতেই পারছেন, আপনাদের তর্পন করার দরকার নেই।

তো এই কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য প্রতীক হচ্ছে তিল, যব, চাল প্রদান, পণ্ডিত ব্যক্তি ও দরিদ্র ব্যক্তিদের সহায়তা করা ইত্যাদি। এই সমস্ত ব্যাপারকে ‘তর্পণ’ বলে।

আরও পড়ুনমহালয়া: পূর্বপুরুষদের স্মরণ ও শ্রদ্ধার তিথি২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এই যে তর্পণটা করা হয়, তা শুধু নিজের পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যেই করে কিন্তু কেউ ছাড় পাবে না। এগুলোর সঙ্গে দেবতর্পণ, মানুষ তর্পন, যম তর্পন এবং ঋষিতর্পণও করতে হয়। দেবতর্পণের মন্ত্রে তো উদ্ভিদকুল, সরীসৃপ, পাখি, পশু সবার অবদানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়।

আবার রামতর্পণ ও লক্ষ্মণতর্পণে এসে ত্রিভুবনের সমস্ত প্রয়াতকে জল তর্পণ করে শ্রদ্ধা জানাতে হয়। সে যে ধর্ম, যে জাতি, যে মতবাদের হোক না কেন। এমনকি তাঁদের উদ্দেশেও তর্পণ করা হয়, জন্ম-জন্মান্তরে যাঁদের আত্মীয়-বন্ধু কেউ কোথাও নেই।

কী সুন্দর এই মন্ত্রটি:

ওঁ নমঃ যে বান্ধবা অবান্ধবা বা, যে অন্য জন্মনি বান্ধবাঃ।

তে তৃপ্তিং অখিলাং যান্ত, যে চ অস্মৎ তোয়-কাঙ্খিণঃ।।

অনুবাদ: যাঁরা আমাদের বন্ধু ছিলেন এবং যাঁরা বন্ধু নন, যাঁরা অন্য কোন জন্মে আমাদের বন্ধু ছিলেন (বা ছিলেন না), যাঁহারা আমাদের কাছ থেকে জলের (শ্রদ্ধার) প্রত্যাশা করেন , তাঁরা সম্পূর্ণরূপে তৃপ্তিলাভ করুন।

তাহলে বাঙালি হিন্দুদের মহালয়া নিয়ে এত আবেগ কেন? এর পেছনে আছেন মহাত্মা শ্রীবীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও রেডিওতে তাঁর পরিবেশিত শ্রীশ্রী চণ্ডীপাঠের অনুষ্ঠান ‘মহালয়া’।

মানে অনেক লোকের হয় না, নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যায়? বা পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মারা যায়.

..গণহত্যা জাতীয় ব্যাপারে এমন কত হয়, পরিবার জানেও না বেঁচে আছে না মরে গেছে, বা এমন কোনো সংস্কৃতিতে তার জন্ম যারা এসব করে না, কিন্তু সেই পরমাত্মার অংশ হিসেবে তারও তো এতে সমান ভাগ, তাই আমরা তাকেও বাদ দিচ্ছি না।

তাই তো মন্ত্রে বলে ‘আব্রহ্মস্তম্ভ পর্যন্তং জগত্‍ তৃপ্যতু...’। মানে আমার তর্পনে সবকিছু যিনি ধারণ করে আছেন সে ব্রহ্ম তৃপ্ত যেন হন, আবার নিজের স্বরূপ সম্পর্কে জানে না, জগতের এমন সব সত্তা, এমনকি সামান্য স্তম্ভ.. অর্থাৎ তৃণ-ঘাস, যাকে মাড়িয়ে আমি হয়তো একরকম জীবননাশই করি, তার সত্ত্বাও তৃপ্তি পাক।

তো এই সমস্ত কিছুর বিরাট এই সমাবেশটা, আলয়টাই মহালয়া। যার পরেই দেবীপক্ষের সূচনা। এখন ব্যাপারটার সঙ্গে মৃতরা জড়িয়ে তো, মৃত্যু মানেই তো মনে শোক জন্ম নেয়, তাই কথার মারপ্যাঁচে শুভ মহালয়া বলা গেলেও, ইংরেজি অনুবাদে ‘হ্যাপি’ মহালয়া বলা আসলেই যায় না। বরং একটু স্থির মনে পূর্বজদের কথা ভাবলে বিনয়ী ব্যক্তি বিষাদগ্রস্তই হন নিজের দিকে তাকিয়ে।

আরও পড়ুনমনসা: বাংলার লোকপ্রকৃতির দেবী১৬ জুলাই ২০২৫

তাহলে বাঙালি হিন্দুদের মহালয়া নিয়ে এত আবেগ কেন?

এর পেছনে আছেন মহাত্মা শ্রীবীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও রেডিওতে তাঁর পরিবেশিত শ্রীশ্রী চণ্ডীপাঠের অনুষ্ঠান ‘মহালয়া’। এটির জনপ্রিয়তা এতই বেশি যে অনেকে এটি একরকম ধর্মীয় অনুষঙ্গই মনে করেন। মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে উচ্চারিত স্তোত্র পাঠ না শুনলে মায়ের আগমনী সুরটা যেন ঠিক বেজে উঠে না।

প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী সঙ্গীতালেখ্য ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ জনপ্রিয় প্রভাতী বাংলা বেতার আকাশবাণীর সর্বাধিক কাল ধরে প্রচারিত একটি অনুষ্ঠানের নাম। ১৯৩১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি মহালয়ায় এই অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়। তবে তখন মহালয়াতে না, বরং ষষ্ঠী তিথিতে ষষ্ঠ্যাদিকল্পারম্ভ সময়ে এটির সম্প্রচার করা হতো।

অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ দুর্গা সপ্তশতী থেকে দেবী চন্ডীর স্তোত্রপাঠ, বাংলা ভক্তিগীতি, ধ্রুপদীসঙ্গীত এবং বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর নাট্যরূপ। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক এবং গ্রন্থনা ও স্তোত্র পাঠ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।

এই আবেগপ্রবণতা থেকেই মূলত বাঙালি ব্যাকরণে অশুদ্ধ রেখেও শুভ মহালয়া বলতে চায়। তবে এটার বিরোধিতা করা মানেও এই না যে মহালয়া অশুভ।

পঙ্কজ কুমার মল্লিক সমগ্র কলকাতায় খুঁজে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে নির্বাচন করেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র প্রথম রেকর্ড ধারণের আগে টানা তিন দিন উপবাস থেকে মাতৃভাবনায় আত্মনিমগ্ন ছিলেন যার কারণে তাঁর অন্তরে এমন ভাবের উদয় হয়েছিল যে তাঁর সেই স্তোত্রপাঠ কালজয়ী হয়েছে সকল বাঙালির হৃদয়ে।

১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানটি সরাসরি প্রচারিত হতো। এরপর থেকে নানা কারণে ১৯৬৬ সালের রেকর্ডটি বাজানো হয়। ১৯৭৬ সালে সরকারমহলের চাপে আকাশবাণী মহিষাসুরমর্দিনীর পরিবর্তে ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্‌’ নামে একটি ভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করেন। যেখানে শ্লোকপাঠ করেন উত্তমকুমার এবং সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিবর্তে অন্য কারো চন্ডীপাঠ মেনে নিতে পারে নি সাধারণ জনগণ। বাধ্য হয়ে পরবর্তীতে দুর্গাষষ্ঠীর দিন পুনরায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে অনুষ্ঠিত পূর্বের মহিষাসুরমর্দ্দিনী সম্প্রচার করা হয়। সম্প্রতি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সম্মানে এই ঘটনাটি নিয়ে ‘মহালয়া’ নামে কলকাতায় একটি সিনেমাও নির্মাণ করা হয়।

এই আবেগপ্রবণতা থেকেই মূলত বাঙালি ব্যাকরণে অশুদ্ধ রেখেও শুভ মহালয়া বলতে চায়। তবে এটার বিরোধিতা করা মানেও এই না যে মহালয়া অশুভ। মহাপুরুষদের দেহত্যাগের দিনকে আমরা তিরোভাব তিথি বলি। সেদিন অনেক ভাল ভাল কাজও করি। কিন্তু সেজন্য যেমন শুভ তিরোধান দিবস বলি না, তেমনি এই মহালয়ার স্মৃতি তর্পণের বিষয়টি।

সায়ন্তন সৈকত রায়: লেখক, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র সমালোচক

আরও পড়ুনমহালয়া কী কেন ১৭ অক্টোবর ২০২৩

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন র উদ দ শ র জন য মন ত র আম দ র র পর ব

এছাড়াও পড়ুন:

ডাকসু–জাকুসতে জিতে কি জামায়াত–শিবির রাজনীতিতে হারল

ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের অভূতপূর্ব ফলের কারণ এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আলোচনার মধ্যেই কিছু প্রশ্ন উঠে আসা জরুরি—স্বল্পমেয়াদি অর্জনের জন্য জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির কি দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি নিল? ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবির জিতল, কিন্তু তারা কি রাজনীতিতে হারল?

ছাত্রশিবির তো নিজ নামে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, তাই তারা যা যা করেছে, সেগুলোর দায় পুরোপুরি ছাত্রশিবিরকে দেওয়া যাবে না—এই নিবন্ধের আলোচনায় এ-জাতীয় অহেতুক আলাপকে বিবেচনায় রাখা হয়নি। 

ডাকসু নির্বাচন সামনে রেখে ছাত্রশিবিরের ৩৬ দফা ইশতেহার মূলত ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক মান বাড়ানোসহ ক্যাম্পাসে ছাত্রদের জন্য নানা রকম কল্যাণমুখী পদক্ষেপকে ভিত্তি করে। অথচ ছাত্রশিবিরের গঠনতন্ত্রের প্রস্তাবনার পুরোটাই ইসলামে বিশ্বাস এবং সেটা প্রতিষ্ঠিত করা-সংক্রান্ত। এ ছাড়া দেখে নেওয়া যাক গঠনতন্ত্রের কিছু অংশ—

আরও পড়ুনডাকসুতে ছাত্রদলের হার—বিএনপিকে যা ভাবতে হবে১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য: এই সংগঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসুল (সা.) প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী মানুষের সার্বিক জীবনের পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।

কর্মসূচি: ১. তরুণ ছাত্রসমাজের কাছে ইসলামের আহ্বান পৌঁছে তাদের মধ্যে ইসলামিক জ্ঞান অর্জন এবং বাস্তব জীবনে ইসলামের পূর্ণ অনুশীলনের দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করা; ২. যেসব ছাত্র ইসলামি জীবনবিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশ নিতে প্রস্তুত, তাদের সংগঠনের অধীন সংঘবদ্ধ করা; ৩. এই সংগঠনের অধীন সংঘবদ্ধ ছাত্রদের ইসলামি জ্ঞান প্রদান এবং আদর্শ চরিত্রবান রূপে গড়ে তুলে জাহেলিয়াতের সমস্ত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মী হিসেবে গড়ার কার্যকর ব্যবস্থা করা; ৪. আদর্শ নাগরিক তৈরির উদ্দেশ্যে ইসলামি মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের দাবিতে সংগ্রাম এবং ছাত্রসমাজের প্রকৃত সমস্যা সমাধানের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান; ৫. অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক গোলামি থেকে মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামি সমাজ বিনির্মাণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো।

বলা বাহুল্য, এসব লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি ইশতেহারে। এটা একেবারেই স্পষ্ট—ছাত্রশিবির তাদের সংগঠনের নামের পাশে থাকা ‘ইসলাম’ নিয়ে অন্তত খুব বেশি ভাবছে না। 

আরও পড়ুনডাকসুর কী প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়তে যাচ্ছে১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের প্রার্থী বাছাই বেশ আলোচিত ছিল। একজন অমুসলিম (চাকমা) প্রার্থী এবং হিজাব করেন না—এমন একজন নারী প্রার্থী অনেকের কাছেই চমক হিসেবে এসেছে। এমনকি একটি সংবাদ সম্মেলনে ভিপি ও জিএস প্রার্থীর মধ্যে সেই নারী প্রার্থীকে বসিয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে।

শুধু তা-ই নয়, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীকে দেখা গেছে হিজাব পরিধান করছেন না—এমন নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে এমনভাবে চলাফেরা করছেন, যেটা আগে ছাত্রশিবিরের নেতাদের ক্ষেত্রে দেখা যেত না। শুধু সেটাই নয়, পোশাক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ছাত্রশিবিরের কর্মী-সদস্যরা যেভাবে ইসলামের অনুশাসন মেনে চলেন, সেটাও অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

ছাত্রশিবিরের যে গঠনতন্ত্র আছে, তাতে একজন সদস্য এটা করতে পারেন কি না—এ প্রশ্ন আসবেই। গঠনতন্ত্রে সদস্যদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘...তাঁর জীবনে ইসলাম নির্ধারিত ফরজ ও ওয়াজিবসমূহ যথাযথভাবে পালন করেন, কবিরা গুনাহসমূহ থেকে দূরে থাকেন এবং সংগঠনের লক্ষ্য ও কর্মসূচির বিপরীত কোনো সংস্থার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রাখেন, তাহলে তিনি এ সংগঠনের সদস্যপদ লাভ করতে পারেন।’ 

অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলো এমন সব কৌশল অবলম্বন করে, যেটা তাদের দলের নীতি-আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। সেটা গ্রহণ করার একধরনের মানসিকতা আমাদের মতো দেশের নাগরিকদের মধ্যে থাকে। তবে এ কথা অন্য সব রাজনৈতিক দলের জন্য প্রযোজ্য হলেও আদর্শভিত্তিক (বিশেষ করে ইসলামিক) রাজনৈতিক দলের জন্য বিষয়টা এত সরল নয়। 

নানা দিকে ছাত্রশিবিরের এই নির্বাচনী কৌশল খুবই প্রশংসিত হয়েছে। অনেকেই বলছেন, এর মাধ্যমে ছাত্রশিবির অনেকটা লিবারেল রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রদর্শন করেছে, যা স্বাগত জানানো উচিত। নির্বাচন কৌশলের খেলা, সন্দেহ নেই।

অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলো এমন সব কৌশল অবলম্বন করে, যেটা তাদের দলের নীতি-আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। সেটা গ্রহণ করার একধরনের মানসিকতা আমাদের মতো দেশের নাগরিকদের মধ্যে থাকে। তবে এ কথা অন্য সব রাজনৈতিক দলের জন্য প্রযোজ্য হলেও আদর্শভিত্তিক (বিশেষ করে ইসলামিক) রাজনৈতিক দলের জন্য বিষয়টা এত সরল নয়। 

আর সব ধর্মের মতো ইসলামেরও নানা রকম ‘স্কুল অব থট’ আছে। সাংবিধানিক ধারায় রাজনীতি করা ইসলামি দলগুলোর মধ্যেও চিন্তাগত দুস্তর ব্যবধান আছে। এ ছাড়া এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ইসলাম থেকে পুরোপুরি খারিজ করে দেওয়ার প্রবণতাও রয়েছে।

আরও পড়ুনডাকসু-জাকসুতে শিবির জিতেছে, বাকিরা কি জিততে চেয়েছে১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

কিন্তু কোনো একটি ইসলামি দল যখন ধর্মের ব্যাপারে তার অবস্থান নির্দিষ্ট করে ফেলে, তখন সেটা থেকে খুব বেশি বিচ্যুতি বড় প্রশ্ন তৈরি করবে। যেমন জামায়াতে ইসলামীর বক্তব্য অনুযায়ী তাদের মতবাদ মানবরচিত নয়। সুতরাং একটা মানবরচিত মতবাদের দলের গঠনতন্ত্র ও অন্যান্য আচরণ ভাঙা যতটা প্রশ্ন তৈরি করার কথা, ইসলামের অনুশাসনকেই একমাত্র ভিত্তি করে তোলা জামায়াতে ইসলামী কিংবা ছাত্রশিবিরের একই কাজ করা অনেক বেশি কঠোর প্রশ্ন তৈরি করবে।

বাংলাদেশের মানুষের জীবনে ধর্ম একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। অনেক মানুষের মধ্যেই ব্যক্তিজীবনে ইসলামি জীবনবিধান মেনে সচ্চরিত্রবান হবার প্রবণতা খুব বেশি না থাকলেও ধর্মের আচার ও ধর্মের অনুভূতি নিয়ে বেশ সংবেদনশীলতা আছে। সেই বিবেচনায় ইসলামি দলগুলো বাংলাদেশের নির্বাচনে ভালো ফল করার কথা ছিল। কিন্তু যে কারও এ ধরনের যৌক্তিক অনুমানের বিরুদ্ধে গিয়ে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মানুষ এই ধারার রাজনীতিকে বরং প্রত্যাখ্যান করেছে। 

শেখ হাসিনার সময়ে দেশে অন্তত তিনটি নির্বাচন হয়নি। ফলে জনগণের ভোট দেওয়ার প্রবণতা আমরা বুঝতে পারিনি। কিন্তু রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই আলোচনা আছে, এই সময়টাতে দেশের মানুষের ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা বেড়েছে। ফলে ইসলামি রাজনৈতিক দলের ভোট অনেক বাড়বে।

আরও পড়ুনডাকসুতে ছাত্রদলের হার—বিএনপিকে যা ভাবতে হবে১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

যেকোনো বিবেচনায় ডাকসু বা জাকসু নির্বাচন দেশের জাতীয় নির্বাচনের ভোট দেওয়ার প্রবণতার প্রতিনিধিত্ব করে না। তারপরও এই নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় নির্বাচনকে কতটা প্রভাবিত করবে, সেই আলোচনা-বিশ্লেষণ চলমান।

অনেকে অনুমান করছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ভালো ফল অনেককে চমকে দিতে পারে। ওপরে উল্লেখিত দুই ছাত্র সংসদের নির্বাচনের পরপরই ব্যবসায়ী নেতাদের জামায়াতের আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাকে অনেকে এ প্রবণতার পূর্বাভাস হিসেবেই দেখতে চান।

জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী কতটা ভালো বা কতটা খারাপ ফল করবে, সেটা এই নিবন্ধে বিশ্লেষণের বিষয় নয়।

তবে এটা যৌক্তিকভাবেই অনুমান করা যায়, ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফলাফলের পর জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী জনগণের সামনে ছাত্র সংসদগুলোর মতো একই ধরনের কল্যাণমুখী পদক্ষেপকে সামনে নিয়ে আসবে। তাদের ইশতেহার ও প্রচারণায় ধর্ম নিয়ে ‘পবিত্র কোরআন-সুন্নাহর বাইরে কোনো আইন প্রণয়ন হবে না’—এমন দায়সারা গোছের বক্তব্যের (বিএনপি বা আওয়ামী লীগও এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছে) চেয়ে খুব বেশি কিছু থাকবে না।

আরও পড়ুনডাকসু ও জাকসু: জাতীয় নির্বাচনে কী করবে এনসিপি১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

অথচ দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা মাঝেমধ্যেই বলছেন, ক্ষমতায় গেলে তাঁরা শরিয়াহ আইন কায়েম করবেন। মুখে যা-ই বলুন না কেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতারা এটা সম্ভবত বিশ্বাস করেন না, এ নির্বাচনেই তাঁরা জিতে ক্ষমতায় যাবেন। কিন্তু তাঁদের মুখে এমন বক্তব্য এবং এমন শরীরী ভাষা দেখা, যা তাঁদের নির্বাচনে খুবই ভালো করার আত্মবিশ্বাস প্রদর্শন করে।

আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে, এটাই ছিল মোক্ষম সময়, যখন জামায়াতে ইসলামী তাদের শরিয়াহর রূপরেখা জনগণের সামনে আনবে এবং সেটাকেই তাদের প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি করে তুলবে। এখন পর্যন্ত অন্তত সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। 

দুটি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবির অভাবনীয় সাফল্য পেলেও সেটা তাদের রাজনীতির মাধ্যমে হয়নি। তারা তাদের এমনভাবে পরিবর্তন করছে, যেটা আসলে ভোটের মাঠের বাস্তবতা এবং চাহিদা। তারা নির্বাচনে জিতলেও পরাজিত হয়েছে তাদের রাজনীতি। ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলো প্রমাণ করল, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এখনো মধ্যপন্থী কল্যাণমুখী রাজনীতি চায়; ধর্মভিত্তিক পরিচয়বাদী রাজনীতি তারা আগের মতোই প্রত্যাখ্যান করে।

আরও পড়ুনডাকসু নির্বাচন, ফলাফল ও তরুণ মনের চাওয়া১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এই নিবন্ধের আলাপ এখানেই শেষ। কিন্তু একটা নতুন প্রশ্ন করে রাখতে চাই পরবর্তী আলোচনার জন্য। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি দেখলে মনে হয়, তাদের গঠনতন্ত্রে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, তারা বেশ খানিকটা বিএনপি হয়ে উঠছে। তাহলে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কেমন হওয়া উচিত বিএনপির রাজনীতি?

জাহেদ উর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

* মতামত লেখকের নিজস্ব

[২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে প্রথম আলোর ছাপা সংস্করণে এ লেখা ‘ডাকসুতে জিতে কি জামায়াত–শিবির আদতে হারল’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ডাকসু–জাকুসতে জিতে কি জামায়াত–শিবির রাজনীতিতে হারল