আশুলিয়ায় থানার সামনে ৬ লাশ পোড়ানোর পর কেউ সেগুলো মসজিদের সামনে রেখে আসে
Published: 23rd, September 2025 GMT
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানার সামনে ছয়জনের লাশ পোড়ানো হয় বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন ভাঙারি ব্যবসায়ী মতিবর রহমান (বুইদ্দা)। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, কেউ রাতের বেলায় বাইপাইল মসজিদের সামনে পোড়া লাশগুলো রেখে আসে।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মতিবর রহমান জবানবন্দি দিয়েছেন। আজ মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ ষষ্ঠ সাক্ষী হিসেবে তিনি এ জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে মতিবর রহমান বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট বেলা দুইটার পর যখন আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করে, তখন ছেলেরা মিছিল বের করে। আশুলিয়া থানার সামনে দিয়ে মিছিল যাওয়ার সময় পুলিশ গুলি করে। এরপর গুলিতে নিহত ব্যক্তিদের লাশগুলো (একজন জীবিত ছিলেন) থানার সামনে পুলিশের গাড়িতে রেখে গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। বিকেল চারটা পর্যন্ত গুলি চলতে থাকে। পরে সাড়ে চারটার দিকে পুলিশ গুলি করতে করতে সেনাবাহিনীর গাড়ি দিয়ে চলে যায়।
সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই জায়গাতেই (আশুলিয়া থানা) ছিলেন বলেও জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন মতিবর রহমান। তিনি বলেন, রাতের বেলা তিনি বাসায় চলে যান। এই লাশগুলো থানার সামনেই পোড়ানো হয় এবং কেউ রাতের বেলায় বাইপাইল মসজিদের সামনে রেখে আসে।
পরদিন ৬ আগস্ট দুপুর ১২টার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আসেন এবং বেলা দুইটার সময় সেনাবাহিনী আসে বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন মতিবর রহমান। তিনি বলেন, ‘ছয়টি লাশ গাড়ি থেকে বের করে পলিথিনে প্যাকেট করি এবং জানাজা পড়ানো হয়।’
এর মধ্যে চারজনের মোবাইল নম্বর পাওয়া যায় এবং তাঁদের অভিভাবকদের ফোন করা হলে তাঁরা এসে লাশ নিয়ে যান বলে জানান মতিবর রহমান। তিনি বলেন, ‘দুটি লাশের অভিভাবকদের পাওয়া যায়নি। সেগুলো আমতলা কবরস্থানে দাফন করা হয়। একদিন পর আবুলের স্ত্রী হলুদ গেঞ্জি ও লুঙ্গি পড়া কোনো লাশ দাফন করেছি কি না, জিজ্ঞাসা করলে আমি বলি যে হলুদ গেঞ্জি ও লুঙ্গি পড়া একটি লাশ পেয়েছি এবং দাফন করেছি।’
আরও পড়ুনআশুলিয়ায় ৬ জনের লাশ পোড়ানো: রাজসাক্ষী হলেন সাবেক এসআই আবজালুল২১ আগস্ট ২০২৫সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুল ছাত্র-জনতার ওপর হামলা করেন
এ মামলায় সপ্তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন বাইপাইলের বাঘাবাড়ি বাজারের ফল ব্যবসায়ী মো.
আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীকে পোড়ানোর ঘটনায় হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে ঘটনার বিবরণে বলা হয়, গত বছরের ৫ আগস্ট বেলা তিনটার দিকে আশুলিয়া থানার সামনে পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এর বাইরে আরও একজন গুলিতে গুরুতর আহত হন। একজনকে জীবিত ও পাঁচজনকে মৃত অবস্থায় প্রথমে একটি ভ্যানে তোলা হয়। সেখান থেকে পুলিশের একটি গাড়িতে তোলে পুলিশ। পুলিশের গাড়িতে এই ছয়জনকে (যাঁর মধ্যে একজন জীবিত) আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় পুলিশ।
এ মামলায় মোট ১৬ জন আসামি। এর মধ্যে আট আসামি গ্রেপ্তার আছেন। আজ তাঁদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তাঁরা হলেন সাভার সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শহিদুল ইসলাম, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) উত্তরের সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার সাবেক উপপরিদর্শক আবদুল মালেক, আরাফাত উদ্দীন, কামরুল হাসান ও শেখ আবজালুল হক এবং সাবেক কনস্টেবল মুকুল চোকদার। তাঁদের মধ্যে শেখ আবজালুল হক ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী হিসেবে পরিচিত) হয়েছেন।
আরও পড়ুনভ্যানে লাশের স্তূপ করছে পুলিশ, ভাইরাল ভিডিও নিয়ে যা জানা গেল৩১ আগস্ট ২০২৪উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: থ ন র স মন ল ইসল ম ৫ আগস ট র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
প্রকাশ্য থেকে গুপ্ত: ভেতর থেকে দেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৫-৯৬ সেশনে ভর্তি হই। চার বছরের বিবিএ ও এক বছরের এমবিএ করতে সাত বছর লেগে যায়। কারণ সেশনজট, যার উৎপত্তি ছিল মূলত রাজনীতি।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম দিন থেকেই আমাকে হলে থাকতে হয়েছে, যদিও প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বৈধভাবে হলে থাকার বিধান ছিল না। প্রায় সাত বছরের হল–জীবনে আমার সুয়োগ হয়েছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, দুই আমলের ছাত্ররাজনীতি প্রত্যক্ষ করার। ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ যা করেছে, তার মধ্যে ভালো কাজের উদাহরণ একেবারেই কম।
জোরপূর্বক মিছিলে নিয়ে যাওয়া ছিল অতি স্বাভাবিক। আমাকেও অনেকবার যেতে হয়েছে। মিছিলের আগে হলের প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিত এবং সবাইকে গেটে একত্র করে মিছিলে নিয়ে যেত। মিছিলে না গেলে অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটত। আমারও একদিন মিছিলে যোগ দিতে দেরি হওয়ায় এক নেতার মুখ থেকে গালি শুনতে হয়েছে। একবার মিছিলে গিয়ে পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গাস থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাই। এ রকম ঘটনার মুখোমুখি হয়ে মাঝেমধ্যে হলের ছাদে গিয়ে কান্না করতাম।
ছাত্রনেতারা তাদের সিটে একা থাকত অথচ অন্যদের কক্ষে জোরপূর্বক ডাবলার উঠিয়ে দিত। হলের ক্যানটিনে ফাও খাওয়া ছিল একেবারেই স্বাভাবিক। বড় নেতাদের রুমে ক্যানটিন থেকে খাবার পৌঁছে দিতে হতো। তারা কখনো ক্যানটিনে খেতে এলে তাদের টেবিলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বসতে সাহস পেত না।
আমাদের সময়ে এক হলের সঙ্গে আরেক হলের মারামারি ও হল দখলের ঘটনাও ছিল স্বাভাবিক। হলগুলো দখলে রাখতে সারা রাত অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিতে হতো। যেসব শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষে রাজনৈতিকভাবে হলে উঠত, তারাই মূলত এসব কাজ করত। তাদের মিছিলে যাওয়াও ছিল বাধ্যতামূলক। হলে ডাবলার হওয়ার বিনিময়ে অনেককেই তাদের প্রথম বর্ষের অনেকটা সময় এসব কাজ করে কাটাতে হয়েছে। এ কারণে অনেকেই প্রথম বর্ষে অকৃতকার্য হয়েছে কিংবা ভালো ফল নিয়ে পাস করতে পারেনি। এই রাজনীতি করেই আমাদের কয়েকজন ক্লাসমেট অকৃতকার্য হয়েছে। তাদের মধ্যে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া শিক্ষার্থীও ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রতিটি বিভাগের পাঠ্যসূচি এমনভাবে তৈরি করা, যাতে একজন শিক্ষার্থীকে মোটামুটিভাবে পাস করতে হলেও দৈনিক চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পড়াশোনা করতে হয়। অনেকগুলো বিভাগে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চাপ এতই কম যে তারা মাসেও একবার বই ছুঁয়ে দেখে না। এসব শিক্ষার্থী তাহলে বাকি সময়ে কী করবে?যখন হলে বৈধ সিট পাই, আমি আমার সিটে একা থাকতে পারিনি। আগে থেকেই একজন আমার সিটে থাকত এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে ডাবলার হিসেবে নিয়েছি। দুই সিটের রুমের অন্য সিটে একজন ছাত্রনেতা থাকত। ওই নেতার কারণেই আমাকে ডাবলার নিতে হয়েছে। আমার ডাবলার হওয়ার বিনিময়ে সে ওই নেতার ফুটফরমাশ খাটত। পরবর্তী সময়ে সে বড় সাংবাদিক হয়েছে এবং বর্তমানে বিদেশে থাকে।
আমার রুমে নেতা থাকার কারণে পাতি নেতারা এসে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে আমার পড়ার ব্যাঘাত ঘটাত। অল্প সময়ের ব্যবধানে সিঙ্গেল রুমের জন্য আবেদন করি। এইচএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করায় ও এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলের কারণে তৃতীয় বর্ষের শুরুতেই সিঙ্গেল রুম পেয়ে যাই। সিঙ্গেল রুম পেলেও কখনোই একা থাকতে পারিনি। জোর করে উঠিয়ে দেওয়া ডাবলার নিয়েই হল–জীবন কাটিয়ে দিতে হয়েছে।
এই নেতারা কেউ কেউ আবার সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দিত না। পরবর্তী জীবনে ব্যাংকের বড় ঋণখেলাপি হওয়ার হাতেখড়ি এখানেই হয়ে যেত। তাদের জন্য রুমমেটের সাবান, টুথপেস্ট, টাওয়েল ব্যবহার ছিল প্রায় অধিকারের মতো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যখন হল ছাড়ি, তখন মনে হয়েছে, এই পাপিষ্ঠদের হাত থেকে বোধ হয় মুক্তি মিলেছে।
এরপর ২০০৬ সালের প্রথম দিকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে অল্প সময়ের জন্য বিএনপি ও দীর্ঘ সময়ের জন্য আওয়ামী লীগের শাসন দেখেছি। যে বেতনে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি, তাতে ক্যাম্পাসের বাইরে ভাড়া বাসায় থেকে জীবনযাপন কঠিন বিধায় হাউস টিউটর হওয়ার জন্য আবেদন করি। কারণ, হাউস টিউটর হলে একটু কম ভাড়ায় হলের বাসায় থাকা যায়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা আবেদন করতে থাকি, কিন্তু হাউস টিউটর হতে পরিনি। তারপর পিএইচডি করে বিদেশ থেকে এসে আবার ২০১২ সাল থেকে আবেদন করতে থাকি। আমার আর হাউস টিউটর হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। সাদা দলের (বিএনপি) কাছে আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ স্পষ্ট ছিল না। আর নীল দল (আওয়ামী লীগ) বলেছে, আমার কথাবার্তা সরকার ও উন্নয়নবিরোধী।
আরও পড়ুনকুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের নামে এ কোন রাজনীতি১৭ এপ্রিল ২০২৫ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জন্য কিছু কম মানসম্পন্ন বাসা আছে। এগুলো সাইজে একটু ছোট এবং ভাড়াও কম। একজনকে দুই বছরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। সঠিক নিয়মে বরাদ্দ হলে চাকরিজীবনে সবারই ওই বাসা পাওয়ার কথা। কিন্তু অনেকের মতো আমিও পাইনি। তাহলে অন্যরা কীভাবে পেয়েছেন? রাজনৈতিক বিবেচনাই ছিল প্রধান। নামকরা অনেক শিক্ষকও এসব বাসায় থেকেছেন। বরাদ্দ পেয়ে দুই বছরের মধ্যে বাসা ছেড়ে দিয়েছেন—এ রকম উদাহরণ বিরল।
অনুষদের ডিন একটি নির্বাচিত পদ। একজন ডিন তাঁর পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ নিরঙ্কুশ করার জন্য অনেক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ কারণেই গত দুই দশকে অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় বিভাগ খুলে সেখানে প্রচুর ভোটার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো অনুষদে ডিন জার্নালের প্রধান সম্পাদকও। তাই জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ডিনের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকে। শিক্ষকদের পদন্নোতির বিষয়টিও তাঁর মাধ্যমে করা হয় বলে তিনি এ ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করতে পারেন। আবার পদোন্নতির বোর্ডেও তিনি একজন সদস্য। সব মিলিয়ে এ রকম একজন রাজনৈতিক ডিনের কাছে শিক্ষকদের নতজানু হওয়ার অনেক কারণ থাকে।
শিক্ষকদের রাজনৈতিক দলাদলি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বেশির ভাগ শিক্ষক তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের শিক্ষকদের সঙ্গেই মেশেন। শিক্ষক লাউঞ্জ বা ক্লাবে শিক্ষকদের বসার অবস্থা দেখেই এ বিভাজন স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের সময় ভোট শেষে যে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়, তা–ও বিতরণ করা হতো দুটি ভিন্ন জায়গা থেকে—একটি নীল দলের, অন্যটি সাদা দলের। এভাবে খাবার আনতে যাওয়া খুব বিব্রতকর হওয়ায় কেউ কেউ খাবার না নিয়েই চলে যেতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ–উপাচার্য, ট্রেজারার পদগুলোয় সরাসরি রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টরসহ অন্যান্য প্রশাসনিক পদেও একই বিবেচনায় নিয়োগ হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেপুটেশনে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশিন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হয়, তা–ও হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। শিক্ষকদের কমনওয়েলথ বৃত্তির জন্য যে প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়া হয়, সেটাও রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে নয়।
ক্লাসে কম যাওয়া, ফলাফল দেরিতে প্রকাশ করা, এমনকি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা শিক্ষকদের একটা বড় অংশ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ আবার শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত খণ্ডকালীন শিক্ষক এবং পূর্ণকালীন রাজনীতিবিদ হিসেবে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি না, তা নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। আমার ছাত্রজীবনেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি খুন হয়েছিল। হলগুলোয় বসবাসের ও শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ছিল না। খাবার ছিল নিম্নমানের।
এ সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানেরা হলে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে না। যারা একসময় হলে রাজনীতি করত, তাদের সন্তানেরা এখানে পড়াশোনা করলেও কেউ হলে থাকে না। এমনকি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানদেরও হলে থেকে পড়াশোনা করার নজির নেই বললেই চলে। যদি ছাত্ররাজনীতি এতই পরিশীলিত হতো, তাহলে আমাদের নেতা ও শিক্ষকেরা তাঁদের সন্তানদের হলে রেখে রাজনীতির চর্চা করিয়ে ভবিষ্যতের নেতা বানাতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি হল দ্বারাই বেশির ভাগ পরিচালিত হয়। এর যত মন্দ দিক আছে, তার প্রায়ই সবই হলের শিক্ষার্থীদেরই আঘাত করে। যাদের সন্তানেরা হলে থাকে না, তারা হলের শিক্ষার্থীদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি জারি রাখতে চায়। হলের শিক্ষার্থীদের এ ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কারণ, হলগুলোয় আবার আগের ধারার রাজনীতি শুরু হলে তারাই প্রথম এর শিকার হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য যে দীর্ঘ রাজনীতিচর্চার দরকার হয় না, তার প্রমাণ আমরা ২০২৪ সালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্ররাজনীতিহীন শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেখেছি।
যাঁরা অক্সফোর্ড কিংবা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির কথা তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্ররাজনীতি চালু রাখার পক্ষে কথা বলেন, তাঁরা হয়তো জানেন না, ওদের রাজনীতির ধরন কেমন। আমাদের মতো দলীয় ও লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি সেখানে নেই। তারা পড়াশোনা ও গবেষণায় বেশি ব্যস্ত থাকে। আমাদের এখানকার মতো পড়াশোনাকে গৌণ করে রাজনীতি করে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রতিটি বিভাগের পাঠ্যসূচি এমনভাবে তৈরি করা, যাতে একজন শিক্ষার্থীকে মোটামুটিভাবে পাস করতে হলেও দৈনিক চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পড়াশোনা করতে হয়। অনেকগুলো বিভাগে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চাপ এতই কম যে তারা মাসেও একবার বই ছুঁয়ে দেখে না। এসব শিক্ষার্থী তাহলে বাকি সময়ে কী করবে?
জন্মের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি নিয়েই এগিয়েছে। রাজনীতির কারণেই এ ক্যাম্পাসে অনেকগুলো খুন হয়েছে, শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে, শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন বেড়েছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোকে পাঁচ বছর প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতির বাইরে রেখে দেখা যেতে পারে; সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকরাজনীতিও। যদি ভালো ফল না আসে, তাহলে এই রাজনীতি আবার ফিরে আসুক। একই রকম পরীক্ষা (কয়েক বছরের জন্য রাজনীতি বন্ধ রাখা) সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে।
মো. মাইন উদ্দিন অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(মতামত লেখকের নিজস্ব)