ভারত-পাকিস্তান ‘যুদ্ধ’ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া যখন সরগরম, তখন বাংলাদেশ সীমান্তে বলতে গেলে নীরবে ‘পুশইন’ বা কিছু মানুষকে শূন্যরেখায় ঠেলে দেওয়া শুরু করেছে নয়াদিল্লি। গত এক সপ্তাহে কুড়িগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দুই শতাধিক মানুষকে এভাবে ঠেলে দিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এদের কেউ কেউ ভোরবেলা বিভিন্ন সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভেতরে ঘোরাঘুরির সময় স্থানীয়রা তাদের বিজিবি’র হাতে তুলে দিয়েছে। আবার কাউকে কাউকে সুন্দরবনের মতো জনবিরল এলাকায় ফেলে রেখে গিয়েছে বিএসএফ। এই আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না যে, আরও অনেকে স্থানীয় অধিবাসী, সীমান্তরক্ষী, পুলিশ বা মাঠ প্রশাসনের নজর এড়িয়ে জনারণ্যে মিশে গেছে।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নয়াদিল্লির এমন মানবাধিকারবিরোধী কৌশল নেহাত নতুন নয়; অন্তত আড়াই দশক পুরোনো। ১৯৯৮ সালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চলছিল। তবে ২০০২-০৩ সালে তুঙ্গে উঠেছিল। মনে আছে, সেই সময় ভারতের এই অমানবিক প্রক্রিয়া ‘পুশইন’ নাম পায়; আর এসব মানুষকে পুনরায় ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয় ‘পুশব্যাক’। দুই পক্ষের ঠেলাঠেলিতে নারী, শিশুসহ এসব অসহায় মানুষ শূন্যরেখায় অবস্থান নিতে বাধ্য হতো। খাদ্য-পানীয় ও প্রাকৃতিক ক্রিয়াদির সংকট নিয়ে শীত, গরম, রোদ, বৃষ্টিতে শূন্যরেখায় এসব মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে তখন বাংলাদেশ-ভারত ছাড়াও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বিবৃতি দিয়েছিল। 
২০০৪ সালে নয়াদিল্লিতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে তথাকথিত পুশইন অবশ্য কমে গিয়েছিল। ২০১৪ সালে এনডিএ জোট যদিও আবার ক্ষমতায় এসেছিল, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে ‘সুবর্ণ অধ্যায়’ বিবেচনায় সম্ভবত পুশইন আগের মাত্রায় ছিল না। অবশ্য ২০১৬ সাল থেকে বিজেপি আসামের রাজ্য সরকার গঠন করার পর থেকে ওই সীমান্তে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে থাকে। লক্ষণীয়, গত বছর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে থাকে। ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্কের অবনতির ডামাডোলে হয়তো বাংলাদেশের মিডিয়ার চোখ এড়িয়ে গেছে; দীর্ঘ বিরতির পর আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে ফের ‘পুশইন’ শুরু হয়েছিল। সেই দফায় অন্তত ৪ জনকে ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে সীমান্তের এপাশে ঠেলে দেওয়া হয়। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা স্বয়ং এ নিয়ে ‘টুইট’ করেন (দ্য হিন্দু, ২০ আগস্ট ২০২৪)।

সর্বসাম্প্রতিক পুশইন পরিস্থিতে যোগ হয়েছে কিছু নতুন মাত্রা। আগে সাধারণত ভারতের বাংলাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে সীমান্তের এপাশে ঠেলে দেওয়া হতো। এবার দেখা যাচ্ছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। কুড়িগ্রামের দুই উপজেলা রৌমারী ও ভুরুঙ্গামারী সীমান্তে যে ৪৪ জনকে ‘পুশইন’ করা হয়েছে, তাদের ৩৫ জনই মিয়ানমারের নাগরিক (দ্য ডেইলি স্টার, ৮ মে ২০২৫)। তার মানে, কেবল ভারতীয় বাংলাভাষী মুসলিম নয়, আরাকানি মুসলিমদেরও বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে নয়াদিল্লি!

এবারের ‘পুশইন’ স্পষ্টত ভারতের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অংশ; বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ বা আসামের রাজ্য সরকার বা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নয়। খাগড়াছড়িতে আটকদের কাছ থেকেও জানা গেছে যে, তাদের গুজরাট থেকে বিমানে করে ত্রিপুরায় এনে ঘণ্টাখানেক হাঁটিয়ে সীমান্ত পার করে দিয়েছে বিএসএফ (বিবিসি বাংলা, ৮ মে ২০২৫)। 

মনে আছে, সম্প্রতি ভারতের গুজরাটে ‘বাংলাদেশি’ আটকের নামে মূলত বাংলাভাষী ভারতীয় মুসলিম ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের আটক করা হয়েছিল। পরিস্থিতি কেমন ছিল, পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় বাংলা সংবাদপত্রেও খবর হয়েছে এভাবে– “বাংলাদেশি সন্দেহে গুজরাত পুলিশের হাতে আটক পশ্চিমবঙ্গের তিন যুবক। তাঁদের দু’জনের বাড়ি বীরভূম এবং একজন পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দা। পরিবারের দাবি, সমস্ত নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও তিনজনকে আটক করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যের পুলিশ। তার পর থেকে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না তিনজনের সঙ্গে। এ বিষয়ে ‘দিদিকে বলো’-তে ফোন করে অভিযোগ জানিয়েছে তারা” (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ এপ্রিল ২০২৫)।
এখন দেখা যাচ্ছে, গুজরাটে আটক বাংলাভাষী ভারতীয় মুসলমানদেরই বাংলাদেশ সীমান্তের এপাশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ভারত দ্বিগুণ মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। একদিকে তারা আটক এইসব মানুষের মানবাধিকারের তোয়াক্কা করছে না, অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে গায়ের জোর দেখাচ্ছে। এসব মানুষের কেউ কেউ যদি সত্যিকার অর্থেই বৈধ নথিপত্রহীন বাংলাদেশি হয়েও থাকে, তাদের ‘ডিপোর্ট’ করার জন্য সুনির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন ও রেওয়াজ রয়েছে। আর যারা রোহিঙ্গা, স্পষ্টতই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী, তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার অর্থ পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাধানো ছাড়া কিছু নয়।

এবারের ‘পুশইন’ পরিস্থিতিতে আরেকটি নতুন মাত্রা হচ্ছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সন্দেহজনক নীরবতা। ২০০২-০৩ সালে যখন ভারত একই অন্যায় করছিল, তখন সেদেশের সংবাদমাধ্যম ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকরা এই অন্যায্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। এবার দেখছি, বিষয়টি নিয়ে যেমন সংবাদমাধ্যম সুনসান, তেমনই নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও স্পিকটি নট!
এই নিবন্ধ যেদিন লিখছি, ১০ মে ২০২৫, সেদিনই ভারতীয় ইংরেজি সংবাদপত্র ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ খবর দিয়েছে যে, দেশটির মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তে যথাক্রমে ‘নাইট কারফিউ’ ও ‘হাই অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তেও এমন পরিস্থিতি দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন মাত্রার এই ‘পুশইন’ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী করতে পারে? আগেরবার যদিও ‘পুশব্যাক’ করার চেষ্টা চলেছিল, সেটা কাজে দেয়নি। ভারত যেহেতু সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নিয়ে এভাবে মানুষকে অমানবিক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়ে থাকে, দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কড়া পাহারা পেরিয়ে তাদের ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। সেবার অসহায় মানুষগুলো শূন্যরেখায় অপেক্ষমাণ অবস্থাতেই একজন দু’জন করে অন্তর্ধান হয়েছিল। বেশির ভাগই যে বাংলাদেশেই অনুপ্রবেশ করেছিল, সেটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এবার ‘পুশইন’ ঠেকাতে অতি অবশ্যই সীমান্তে কড়া পাহারা ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। সীমান্তের ওপাশে কোথায় কোথায় লোকজন জড়ো করা হয়েছে, সেই অনুসন্ধান কঠিন হলেও অসম্ভব হতে পারে না। 

এদিকে, বাংলাদেশে, অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড.

খলিলুর রহমান বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন যে, ভারত থেকে এভাবে পুশইন সঠিক প্রক্রিয়া নয়; এ বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে (সমকাল অনলাইন, ৭ মে ২০২৫)। এর পরে এই বিষয়ে কী ঘটেছে, সে ব্যাপারে কোনো তথ্য সংবাদমাধ্যমে পেলাম না এই নিবন্ধ রচনাকাল পর্যন্ত।
আমার মতে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানানো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংবাদমাধ্যমকে জানানোর ক্ষেত্রেও দেরি করা যাবে না। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকেও জানানো দরকার। বিশেষত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ধরে ভারত যেভাবে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাচ্ছে, তা যে কোনো মানদণ্ডে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন।
বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের বিদ্যমান অবস্থায় পুশইন নিয়ে আগের মতো দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ ও আলোচনার ভরসায় বসে থাকা আর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুকের মতো ‘দেখি না কী হয়’ ভেবে বসে থাকা সমান কথা।

শেখ রোকন: লেখক ও নদী-গবেষক
skrokon@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: নত ন ম ত র পর স থ ত নয় দ ল ল সরক র র হয় ছ ল প শইন

এছাড়াও পড়ুন:

আজ টিভিতে যা দেখবেন (২৬ জুন ২০২৫)

কলম্বো টেস্টের দ্বিতীয় দিন আজ। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপে রাতে জুভেন্টাসের মুখোমুখি ম্যানচেস্টার সিটি।

কলম্বো টেস্ট-২য় দিন

বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা
সকাল ১০-৩০ মি., টি স্পোর্টস

ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ

ইন্টার মিলান-রিভার প্লেট
সকাল ৭টা, ডিএজেডএন ওয়েবসাইট ও অ্যাপ

উরাওয়া-মন্তেরই
সকাল ৭টা, ডিএজেডএন ওয়েবসাইট ও অ্যাপ

জুভেন্টাস-ম্যান সিটি
রাত ১টা, ডিএজেডএন ওয়েবসাইট ও অ্যাপ

উইদাদ-আল আইন
রাত ১টা, ডিএজেডএন ওয়েবসাইট ও অ্যাপ

ব্রিজটাউন টেস্ট-২য় দিন

ওয়েস্ট ইন্ডিজ–অস্ট্রেলিয়া
রাত ৮টা, টি স্পোর্টস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বেকারত্বের বাধা ডিঙাতে প্রয়োজন...
  • অস্ট্রেলিয়ান হায়ার এডুকেশন রোড-শো সোমবার
  • ঢাকায় হলিউডের চার সিনেমা
  • ফের পেছাল জাকসু নির্বাচন 
  • আজ টিভিতে যা দেখবেন (২৭ জুন ২০২৫)
  • ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠক
  • ক্রিকেটের যেসব নিয়ম বদলে গেল এবার
  • জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ, প্রথম মেধাতালিকায় ২ লাখ ৬৫ হাজার ৩৬৪
  • বেক্সকার নতুন প্রেসিডেন্ট গোলাম রাব্বানি ও সেক্রেটারি জেনারেল শাহরিয়ার সাদাত
  • আজ টিভিতে যা দেখবেন (২৬ জুন ২০২৫)