সীমান্তে পুশইন: নতুন মাত্রায় পুরোনো করণীয়
Published: 10th, May 2025 GMT
ভারত-পাকিস্তান ‘যুদ্ধ’ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া যখন সরগরম, তখন বাংলাদেশ সীমান্তে বলতে গেলে নীরবে ‘পুশইন’ বা কিছু মানুষকে শূন্যরেখায় ঠেলে দেওয়া শুরু করেছে নয়াদিল্লি। গত এক সপ্তাহে কুড়িগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দুই শতাধিক মানুষকে এভাবে ঠেলে দিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এদের কেউ কেউ ভোরবেলা বিভিন্ন সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভেতরে ঘোরাঘুরির সময় স্থানীয়রা তাদের বিজিবি’র হাতে তুলে দিয়েছে। আবার কাউকে কাউকে সুন্দরবনের মতো জনবিরল এলাকায় ফেলে রেখে গিয়েছে বিএসএফ। এই আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না যে, আরও অনেকে স্থানীয় অধিবাসী, সীমান্তরক্ষী, পুলিশ বা মাঠ প্রশাসনের নজর এড়িয়ে জনারণ্যে মিশে গেছে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নয়াদিল্লির এমন মানবাধিকারবিরোধী কৌশল নেহাত নতুন নয়; অন্তত আড়াই দশক পুরোনো। ১৯৯৮ সালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চলছিল। তবে ২০০২-০৩ সালে তুঙ্গে উঠেছিল। মনে আছে, সেই সময় ভারতের এই অমানবিক প্রক্রিয়া ‘পুশইন’ নাম পায়; আর এসব মানুষকে পুনরায় ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার নাম দেওয়া হয় ‘পুশব্যাক’। দুই পক্ষের ঠেলাঠেলিতে নারী, শিশুসহ এসব অসহায় মানুষ শূন্যরেখায় অবস্থান নিতে বাধ্য হতো। খাদ্য-পানীয় ও প্রাকৃতিক ক্রিয়াদির সংকট নিয়ে শীত, গরম, রোদ, বৃষ্টিতে শূন্যরেখায় এসব মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে তখন বাংলাদেশ-ভারত ছাড়াও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও বিবৃতি দিয়েছিল।
২০০৪ সালে নয়াদিল্লিতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে তথাকথিত পুশইন অবশ্য কমে গিয়েছিল। ২০১৪ সালে এনডিএ জোট যদিও আবার ক্ষমতায় এসেছিল, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে ‘সুবর্ণ অধ্যায়’ বিবেচনায় সম্ভবত পুশইন আগের মাত্রায় ছিল না। অবশ্য ২০১৬ সাল থেকে বিজেপি আসামের রাজ্য সরকার গঠন করার পর থেকে ওই সীমান্তে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে থাকে। লক্ষণীয়, গত বছর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে থাকে। ঢাকা-নয়াদিল্লি সম্পর্কের অবনতির ডামাডোলে হয়তো বাংলাদেশের মিডিয়ার চোখ এড়িয়ে গেছে; দীর্ঘ বিরতির পর আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে ফের ‘পুশইন’ শুরু হয়েছিল। সেই দফায় অন্তত ৪ জনকে ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে সীমান্তের এপাশে ঠেলে দেওয়া হয়। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা স্বয়ং এ নিয়ে ‘টুইট’ করেন (দ্য হিন্দু, ২০ আগস্ট ২০২৪)।
সর্বসাম্প্রতিক পুশইন পরিস্থিতে যোগ হয়েছে কিছু নতুন মাত্রা। আগে সাধারণত ভারতের বাংলাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ‘বাংলাদেশি’ আখ্যা দিয়ে সীমান্তের এপাশে ঠেলে দেওয়া হতো। এবার দেখা যাচ্ছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। কুড়িগ্রামের দুই উপজেলা রৌমারী ও ভুরুঙ্গামারী সীমান্তে যে ৪৪ জনকে ‘পুশইন’ করা হয়েছে, তাদের ৩৫ জনই মিয়ানমারের নাগরিক (দ্য ডেইলি স্টার, ৮ মে ২০২৫)। তার মানে, কেবল ভারতীয় বাংলাভাষী মুসলিম নয়, আরাকানি মুসলিমদেরও বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে নয়াদিল্লি!
এবারের ‘পুশইন’ স্পষ্টত ভারতের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অংশ; বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গ বা আসামের রাজ্য সরকার বা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নয়। খাগড়াছড়িতে আটকদের কাছ থেকেও জানা গেছে যে, তাদের গুজরাট থেকে বিমানে করে ত্রিপুরায় এনে ঘণ্টাখানেক হাঁটিয়ে সীমান্ত পার করে দিয়েছে বিএসএফ (বিবিসি বাংলা, ৮ মে ২০২৫)।
মনে আছে, সম্প্রতি ভারতের গুজরাটে ‘বাংলাদেশি’ আটকের নামে মূলত বাংলাভাষী ভারতীয় মুসলিম ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের আটক করা হয়েছিল। পরিস্থিতি কেমন ছিল, পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষস্থানীয় বাংলা সংবাদপত্রেও খবর হয়েছে এভাবে– “বাংলাদেশি সন্দেহে গুজরাত পুলিশের হাতে আটক পশ্চিমবঙ্গের তিন যুবক। তাঁদের দু’জনের বাড়ি বীরভূম এবং একজন পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দা। পরিবারের দাবি, সমস্ত নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও তিনজনকে আটক করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যের পুলিশ। তার পর থেকে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না তিনজনের সঙ্গে। এ বিষয়ে ‘দিদিকে বলো’-তে ফোন করে অভিযোগ জানিয়েছে তারা” (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ এপ্রিল ২০২৫)।
এখন দেখা যাচ্ছে, গুজরাটে আটক বাংলাভাষী ভারতীয় মুসলমানদেরই বাংলাদেশ সীমান্তের এপাশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ভারত দ্বিগুণ মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। একদিকে তারা আটক এইসব মানুষের মানবাধিকারের তোয়াক্কা করছে না, অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে গায়ের জোর দেখাচ্ছে। এসব মানুষের কেউ কেউ যদি সত্যিকার অর্থেই বৈধ নথিপত্রহীন বাংলাদেশি হয়েও থাকে, তাদের ‘ডিপোর্ট’ করার জন্য সুনির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক আইন ও রেওয়াজ রয়েছে। আর যারা রোহিঙ্গা, স্পষ্টতই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অধিবাসী, তাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার অর্থ পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাধানো ছাড়া কিছু নয়।
এবারের ‘পুশইন’ পরিস্থিতিতে আরেকটি নতুন মাত্রা হচ্ছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সন্দেহজনক নীরবতা। ২০০২-০৩ সালে যখন ভারত একই অন্যায় করছিল, তখন সেদেশের সংবাদমাধ্যম ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকরা এই অন্যায্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। এবার দেখছি, বিষয়টি নিয়ে যেমন সংবাদমাধ্যম সুনসান, তেমনই নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও স্পিকটি নট!
এই নিবন্ধ যেদিন লিখছি, ১০ মে ২০২৫, সেদিনই ভারতীয় ইংরেজি সংবাদপত্র ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ খবর দিয়েছে যে, দেশটির মেঘালয় ও আসাম রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তে যথাক্রমে ‘নাইট কারফিউ’ ও ‘হাই অ্যালার্ট’ জারি করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তেও এমন পরিস্থিতি দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন মাত্রার এই ‘পুশইন’ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কী করতে পারে? আগেরবার যদিও ‘পুশব্যাক’ করার চেষ্টা চলেছিল, সেটা কাজে দেয়নি। ভারত যেহেতু সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি নিয়ে এভাবে মানুষকে অমানবিক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়ে থাকে, দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কড়া পাহারা পেরিয়ে তাদের ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। সেবার অসহায় মানুষগুলো শূন্যরেখায় অপেক্ষমাণ অবস্থাতেই একজন দু’জন করে অন্তর্ধান হয়েছিল। বেশির ভাগই যে বাংলাদেশেই অনুপ্রবেশ করেছিল, সেটা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এবার ‘পুশইন’ ঠেকাতে অতি অবশ্যই সীমান্তে কড়া পাহারা ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে হবে। সীমান্তের ওপাশে কোথায় কোথায় লোকজন জড়ো করা হয়েছে, সেই অনুসন্ধান কঠিন হলেও অসম্ভব হতে পারে না।
এদিকে, বাংলাদেশে, অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড.
আমার মতে, বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানানো। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংবাদমাধ্যমকে জানানোর ক্ষেত্রেও দেরি করা যাবে না। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকেও জানানো দরকার। বিশেষত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ধরে ভারত যেভাবে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাচ্ছে, তা যে কোনো মানদণ্ডে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন।
বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের বিদ্যমান অবস্থায় পুশইন নিয়ে আগের মতো দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ ও আলোচনার ভরসায় বসে থাকা আর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুকের মতো ‘দেখি না কী হয়’ ভেবে বসে থাকা সমান কথা।
শেখ রোকন: লেখক ও নদী-গবেষক
skrokon@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: নত ন ম ত র পর স থ ত নয় দ ল ল সরক র র হয় ছ ল প শইন
এছাড়াও পড়ুন:
টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্ব স্বাস্থ্যে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায় আইসিডিডিআরবির ডা. তাহমিদ আহমেদ
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক খ্যাতনামা সাময়িকী ‘টাইম’ তাদের ২০২৫ সালের ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য খাতে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তি’র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ডা. তাহমিদ আহমেদকে।
মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং সীমিত সম্পদের অঞ্চলে স্বাস্থ্য সমস্যার দৃষ্টান্তনির্ভর সমাধানে তাঁর অগ্রণী অবদানকে স্বীকৃতি জানিয়ে এই সম্মান দিয়েছে সাময়িকীটি। তাহমিদ আহমেদের নেতৃত্বে আইসিডিডিআরবি অত্যাধুনিক গবেষণা ও জীবন রক্ষাকারী পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বের লাখো মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দিয়েছে এবং বৈশ্বিক সহযোগিতা সম্পর্ক সুদৃঢ় করেছে।
আজ বৃহস্পতিবার আইসিডিডিআরবির পক্ষ থেকে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ডা. তাহমিদ আহমেদের এই অর্জনের বিষয়টি জানানো হয়।
১৩ মে (মঙ্গলবার) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ‘টাইম ১০০ ইমপ্যাক্ট ডিনার: লিডারস শেপিং দ্য ফিউচার অব হেলথ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে মনোনীত অন্য ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগ দেবেন তাহমিদ আহমেদ। টাইমের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য অনুযায়ী, সেখানে তিনি একটি অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য দেবেন। এই বক্তব্য টাইমের সম্পাদকীয় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মেও প্রচারিত হবে।
এই অসামান্য স্বীকৃতি পাওয়া উপলক্ষে তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘টাইমের ২০২৫ সালের স্বাস্থ্যে ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় থাকা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। এই অর্জন আমার একার নয়, এটি আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী, কর্মী, বৈশ্বিক অংশীদার ও আমাদের সেবা গ্রহণকারীদের সবার। টাইম আমাকে যে স্বীকৃতি ও গুরুত্ব দিয়েছে, তার জন্য আমি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আশা করি, এ ধরনের স্বীকৃতি অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই এবং স্বাস্থ্য গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করবে, যা যুদ্ধ-সংঘাত নয়, বরং ন্যায়, স্বাস্থ্য ও মানুষের মর্যাদার পক্ষে কাজ করবে।’
আইসিডিডিআরবির দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তাহমিদ আহমেদের এই স্বীকৃতি শুধু ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানী ও গবেষকদের জন্যও পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে বাংলাদেশে কাজ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবদান রাখার অনুপ্রেরণা।
এটি টাইমের ২৬ মে ২০২৫ সংখ্যাতেও প্রকাশিত হবে।
টাইমের প্রতিবেদনে ডা. তাহমিদ আহমেদের অবদান সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা হুবহু তুলে ধরা হলো:
ডা. তাহমিদ আহমেদ যখন তাঁর নিজ দেশ বাংলাদেশে মেডিকেল কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে রোগী দেখা শুরু করেন, তখন তিনি এক সমস্যার মুখোমুখি হতে থাকেন বারবার। সেই সমস্যার সমাধান তাঁর চিকিৎসা জ্ঞানে পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব ছিল না। ডা. তাহমিদ বলেন, ‘আমি ডায়রিয়া ও অপুষ্টিতে ভোগা রোগীদের চিকিৎসা করতাম। বিশেষ করে শিশুদের চিকিৎসা করা ছিল খুবই হতাশাজনক। শিশুদের মধ্যে কিছু মারা যেত।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সর্বোত্তম প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খুব বেশি কিছু করার সুযোগ ছিল না।’
তাহমিদ আহমেদ এখন আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক। তিনি যখন এখানে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন, তখন তিনি এই সমস্যার একটি সমাধান খুঁজতে মনস্থ করেন। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডা. জেফরি গর্ডনের সঙ্গে একটি সকালের নাশতার টেবিলে তাঁর দেখা হলে সেখানেই একটি সম্ভাব্য সমাধানের পথ উন্মোচিত হয়। গর্ডন তখন গবেষণা করছিলেন কীভাবে মানুষের অন্ত্রে থাকা ব্যাকটেরিয়া স্থূলতা ও অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের ভিন্নতা তৈরি করে। তাঁরা ভাবতে শুরু করেন—এই অণুজীবগুলো কি অপুষ্টির নতুন চিকিৎসার চাবিকাঠি হতে পারে?
ঢাকার বস্তিতে গবেষণা করতে গিয়ে তাহমিদ ও তাঁর সহকর্মীরা একটি বিস্ময়কর বিভাজন খুঁজে পান: কিছু শিশু ছিল সুস্থ, আর কিছু শিশু অপুষ্টি, অস্বাভাবিক স্থূলতায় ভুগছিল। তাহমিদ দেখতে পান যে সুস্থ শিশুদের মধ্যে পার্থক্য গঠিত হয় তাদের অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম বা জীবাণু গঠনে। আর এসব জীবাণুকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে তাদের খাদ্যাভ্যাস। গর্ডনের সঙ্গে কাজ করে যেসব উপকারী জীবাণু যেগুলো সুস্থ শিশুদের সাহায্য করছিল, তাহমিদ সেগুলো চিহ্নিত করেন। তাহমিদ অনুসন্ধান করে দেখেন—এই জীবাণুগুলোর উৎস ছিল তাদের খাওয়া খাবার। এর মধ্যে আছে তেলাপিয়া মাছ, ছোলা, কাঁচকলা ও চিনাবাদাম।
তবে এই আবিষ্কার বাস্তব সমাধানে রূপ নেয় তখনই, যখন ডা. তাহমিদ একটি স্থানীয় খাদ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় একটি সহজে বিতরণযোগ্য খাদ্যপণ্য তৈরি করলেন। তাঁরা এই খাবারগুলোকে গুঁড়া করে প্রয়োজনীয় ক্ষুদ্র পুষ্টি উপাদানের সঙ্গে মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করেন, যাতে ব্যবহার করা হয় উদ্ভিজ্জ তেল। তাহমিদ এই খাবারের পরীক্ষা চালাচ্ছেন ছয়টি দেশে—বাংলাদেশ, ভারত, তানজানিয়া, মালি, পাকিস্তান ও নাইজারে। প্রাথমিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের যেসব শিশু এই খাবার খাচ্ছে, তারা ওজন ও উচ্চতায় উন্নতি করছে, যাদের সাধারণ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, তাদের তুলনায়।
বিস্তৃত গবেষণার ফলাফল ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতীয় সরকারগুলোকে এই খাদ্যপণ্য অনুমোদন ও ব্যাপকভাবে বিতরণে সহায়তা করবে। তাহমিদ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের দেশে অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের সংখ্যা বিপুল। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় তিন লাখ শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। এসব শিশু সুস্থ শিশুদের তুলনায় ৯ গুণ বেশি মৃত্যুঝুঁকিতে আছে। আমাদের এদের জন্য কিছু করা জরুরি।’