পাকিস্তান থেকে যেন পণ্য না আসে, কড়া নজরদারি ভারতের
Published: 17th, May 2025 GMT
ভারত এখন সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), ইরানসহ অন্যান্য উপসাগরীয় দেশ এবং কিছু ট্রানশিপমেন্ট (জাহাজ পরিবর্তন) হাব বা কেন্দ্রের মাধ্যমে আমদানি করা পণ্যে কড়া নজর রাখছে। লক্ষ্য একটাই, পাকিস্তান থেকে যেন কোনো পণ্য পরোক্ষভাবে ভারতের বাজারে না আসে।
সরকারি কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, এসব দেশের পণ্যের লেবেল ও উৎপত্তি ভালোভাবে যাচাই করা হচ্ছে। এর আগে ভারত ইউএইকে জানিয়েছিল, পাকিস্তানের খেজুর ইউএইয়ের নাম ব্যবহার করে ভারতে প্রবেশ করছে। এটা ভারতের সঙ্গে ইউএইর সেপা চুক্তির অপব্যবহার বলে মনে করছে দিল্লি।
২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত পাকিস্তানের সব ধরনের পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। শুধু সরাসরি নয়, তৃতীয় দেশের মাধ্যমেও পাকিস্তানি পণ্য ঢুকতে দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়েছে। পাকিস্তানও ভারত ও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে সব বাণিজ্য স্থগিত করেছে।
ভারতের এক ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, ‘ইউএইসহ কয়েকটি ট্রানশিপমেন্ট হাব থেকে আসা পণ্যগুলো যাচাই করে দেখা হচ্ছে, এর কোনো অংশ পাকিস্তান থেকে এসেছে কি না। রুলস অব অরিজিন বা পণ্যের উৎস বিধি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একধরনের মানদণ্ড। এটা দিয়ে বোঝা যায়, কোনো পণ্যের উৎস আসলে কোন দেশ, এর ওপর নির্ভর করে শুল্ক ছাড় বা বাণিজ্যসুবিধা দেওয়া হয়।
পরিসংখ্যান কী বলছে
২০২৪-২৫ অর্থবছরে আরব আমিরাতে রপ্তানি হয়েছে ৩৬ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৬৬৩ কোটি ডলারের ভারতীয় পণ্য। দেশটি থেকে আমদানি করেছে ৬৩ দশমিক ৪২ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ৩৪২ কোটি ডলারের পণ্য। এ সময়ের (এপ্রিল-ফেব্রুয়ারি) মধ্যে ভারত মোট ২৭০ দশমিক ৪ মিলিয়ন বা ২৭ কোটি ৪ লাখ ডলারের খেজুর আমদানি করেছে। এর মধ্যে ১২৩ দশমিক ৮২ মিলিয়ন বা ১২ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের খেজুর এসেছে আরব আমিরাত থেকে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত শুকনা ও তাজা খেজুর আমদানি করেছে মোট ২৭৭ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ২৭ কোটি ৭২ লাখ ডলারের।
এদিকে পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে পাকিস্তান থেকে ইউএইতে রপ্তানিতে বেড়েছে ২৮ শতাংশ। অর্থের পরিমাণে তা ১ দশমিক ২ বিলিয়ন বা ১২০ কোটি ডলার।
মূল্য সংযোজন ও নতুন ঝুঁকি
ভারত সরকার ২ মে এক নির্দেশনায় জানায়, পাকিস্তানে উৎপাদিত কিংবা পাকিস্তান থেকে রপ্তানি করা সব ধরনের পণ্য, তা সরাসরি হোক বা অন্য দেশের মাধ্যমে, ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের ভাষায়, ‘জাতীয় নিরাপত্তা ও জনস্বার্থের কারণে এ নিষেধাজ্ঞা। এর ব্যতিক্রম করতে হলে সরকারের অনুমোদন লাগবে।’
কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছু বাস্তব সমস্যা আছে। পণ্য যদি পুরোপুরি একটি দেশে তৈরি হয়, তাহলে উৎস নির্ধারণ সহজ হয়। সমস্যা হয় তখন, যখন সেই পণ্যে ‘মূল্য সংযোজন’ হয়। সে ক্ষেত্রে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে হয়। এক কর্মকর্তা জানান, ‘এমনকি ট্রানজিটের পণ্যও এখন নজরদারির আওতায়। সরকার যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়নি—ট্রানজিটে থাকা পণ্যগুলো এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে কি না।’
২০২৪-২৫ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভারত পাকিস্তান থেকে মোট ২ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন বা ২৮ লাখ ৮০ হাজার ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে আছে গাছপালা ও বীজ, খেজুর, ডুমুর ও মল্টের নির্যাস। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য অনেক আগে থেকেই কমছে। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলার পর ভারত পাকিস্তানি পণ্যে ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে।
তথ্যসূত্র অনুযায়ী, ভারত ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানকে এমএফএন বা সবচেয়ে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত দেশের স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান ভারতকে সেই সম্মান দেয়নি।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
শুল্কছাড়েও দেশি বিনিয়োগ নেই কনটেইনার পরিবহন খাতে
কনটেইনার পরিবহনের ব্যবসায় নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে দুই বছর আগে সরকার কনটেইনার আমদানিতে শুল্কছাড়ের সুবিধা দিয়েছিল। তবে গত দুই বছরে এক টাকাও বিনিয়োগ হয়নি এই খাতে। অথচ বাংলাদেশে সমুদ্রপথে নিয়মিত কনটেইনার পরিবহন বাড়ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২২ লাখ ৩৭ হাজার একক কনটেইনারে আমদানি–রপ্তানি পণ্য পরিবহন করা হয়েছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে পরিবহন করা হয়েছিল ২০ লাখ ৬৯ হাজার একক কনটেইনার। এক বছরের ব্যবধানে কনটেইনার পরিবহনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ শতাংশ।
কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের জন্য দরকার কনটেইনারবাহী জাহাজ। কনটেইনারবাহী জাহাজে দেশি বিনিয়োগকারী কোম্পানি রয়েছে একটি। ২০২০ সাল থেকে কর্ণফুলী গ্রুপ এই খাতে বিনিয়োগ করে আসছে। বর্তমানে গ্রুপটির বহরে আটটি কনটেইনার জাহাজ রয়েছে। তবে কনটেইনার জাহাজ থাকলেও কনটেইনার খাতে দেশি কোনো উদ্যোক্তা তৈরি হয়নি। দেশি বিনিয়োগ না থাকায় এ ব্যবসার পুরোটাই চলে গেছে বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোর হাতে।
কাদের হাতে এ ব্যবসাশিপিং কোম্পানি ও বন্দরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩৪১টি কোম্পানি কনটেইনার খাতে ব্যবসা করেছে। এসব কোম্পানির সব কটিই বিদেশি। বাংলাদেশে সরাসরি ও এজেন্টের মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিগুলো এ ব্যবসা পরিচালনা করছে।
কনটেইনার খাতে বিশ্বের শীর্ষ কোম্পানিগুলো বাংলাদেশেও শীর্ষ স্থানে রয়েছে। মূলত তিনটি কোম্পানির হাতে রয়েছে এ খাতের বড় ব্যবসা। কোম্পানি তিনটি হলো ডেনমার্কভিত্তিক মায়ের্সক লাইন, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মেডিটেরানিয়ান কোম্পানি (এমএসসি) ও ফ্রান্সভিত্তিক সিএমএ–সিজিএম। এ ছাড়া জার্মানির হ্যাপাগ লয়েড, জাপানের ওশেন নেটওয়ার্ক এক্সপ্রেস বা ওয়ান, চীনের কসকো, হংকংয়ের এসআইটিসি কনটেইনার লাইন ও ওরিয়েন্ট ওভারসিস কনটেইনার লাইন।
সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে বহুমুখী ব্যবসার একটি হলো কনটেইনার খাত। এই খাতে তিনভাবে ব্যবসা করছে বিদেশি কোম্পানিগুলো। প্রথমত, শুধু শিপিং কোম্পানিগুলোর কাছে কনটেইনার ভাড়া দেওয়া। প্রতি কনটেইনারে (২০ ফুট লম্বা) দিনে আড়াই থেকে পাঁচ ডলারের মতো আয় হয়। দ্বিতীয়ত, নিজস্ব কনটেইনারের পাশাপাশি ভাড়া নিয়ে কনটেইনার পরিচালনা। সে ক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানিকারকের প্রতিনিধির কাছ থেকে পণ্য পরিবহনের জন্য ভাড়া নিয়ে ওই কনটেইনারে করে পণ্য গন্তব্যে পৌঁছে দেয় এসব কোম্পানি। এ জন্য নিজেরাই জাহাজ ঠিক করার কাজটিও করে। শিপিংয়ের ভাষায় এসব কোম্পানি ‘নন–ভেসেল অপারেটিং কমন ক্যারিয়ার (এনভিওসিসি)’ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে এ রকম ৩০ থেকে ৩৫টি বিদেশি কোম্পানি ব্যবসা করছে। তৃতীয়ত, কনটেইনার জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলোর নিজেদের জাহাজে নিজেদের কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের ব্যবসা, অর্থাৎ কনটেইনার ও জাহাজ—দুটিই এসব কোম্পানির। এ ক্ষেত্রে পরিবহনভাড়ার পুরোটাই এ ধরনের কোম্পানি পেয়ে থাকে। শিপিংয়ের ভাষায় এ ধরনের কোম্পানি ‘মেইন লাইন অপারেটর’ হিসেবে পরিচিত।
জাহাজ ও কনটেইনার ভাড়া নিয়েও অনেকে এ খাতে ব্যবসা পরিচালনা করে। শীর্ষস্থানীয় শিপিং কোম্পানি মায়ের্সক ও এমএসসির নিজস্ব জাহাজ ও কনটেইনার রয়েছে। বাংলাদেশে কনটেইনারের পাশাপাশি জাহাজ পরিচালনা করছে এমন বিদেশি কোম্পানির সংখ্যা ১২।
শুল্কছাড়, ফলাফল শূন্যকনটেইনার পরিবহন খাতে দেশি উদ্যোক্তা তৈরি করতে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে কনটেইনার আমদানিতে শুল্কছাড় সুবিধা দিয়েছিল সরকার। যেমন সাধারণ কনটেইনার আমদানিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট করভার ছিল ৩৭ শতাংশ। সেটি কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। আবার হিমায়িত পণ্যের কনটেইনারের আমদানি শুল্ক ৩১ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়।
শুল্কছাড় দেওয়ার পর গত ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ৫১৭টি কনটেইনার আমদানি করা হয়। গত অর্থবছরে আমদানি হয় ৬৭৮টি কনটেইনার। এসব কনটেইনার আমদানি হয়েছে মূলত উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে ব্যবহারের জন্য। ভারী যন্ত্রপাতি বা বিশেষায়িত পণ্য পরিবহনের সুবিধার জন্য পণ্যসহ কনটেইনার কিনে আনা হয় উন্নয়ন প্রকল্পে, অর্থাৎ ব্যবসার জন্য একটি কনটেইনারও আমদানি করা হয়নি।
হারিয়ে গেল দেশি উদ্যোক্তাবাংলাদেশে কনটেইনারের ব্যবসা একসময় ছিল শুধু চট্টগ্রামের কিউসি গ্রুপের হাতে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে জানান, গত শতকের নব্বই দশকের শেষে কনটেইনার জাহাজের পাশাপাশি কনটেইনার পরিচালনা ব্যবসাও শুরু করে গ্রুপটি। ২০০৫ সালে গ্রুপটির বহরে থাকা আটটি কনটেইনার জাহাজের সব কটিই বিক্রি করে দেওয়া হয়। কনটেইনারের ব্যবসাও সে সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
২০২০ সালের জুনে দেশি কোম্পানি কর্ণফুলী লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এইচআর লাইনসের হাত ধরে কনটেইনার জাহাজ পরিচালনার ব্যবসা আবার শুরু হয় এই দেশে। এইচআর লাইনস এখন আটটি ফিডার জাহাজ পরিচালনা করছে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি জাহাজে কনটেইনার রাখার জায়গা (স্লট) ভাড়া দিচ্ছে।
বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ফাইয়াজ খন্দকার বলেন, শিপিং খাতে বাংলাদেশের বড় উদ্যোক্তারা যুক্ত হয়েছেন। আবার শিপিং ও লজিস্টকস খাতে বিশ্বের বহু কোম্পানিতে বাংলাদেশি দক্ষ জনবল রয়েছে। ফলে এই খাতে দেশি উদ্যোক্তারা যুক্ত হলে তাতে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে, তেমনি দেশের অর্থ দেশেই থাকবে।