শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যে গাড়ি কেনায় আগ্রহ বেড়েছে। সন্তানদের স্কুল–কলেজে আনা–নেওয়া আর নিজের অফিসে যাতায়াতসহ দৈনন্দিন চলাচলের জন্যই মূলত তাঁরা ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে চান। কষ্টের টাকায় প্রথম গাড়ি কেনার আগে একজন ক্রেতাকে নানা দিক ভাবতে হয়। দেখা যাক, গাড়ি কেনার আগে একজন ক্রেতাকে কোন কোন বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয়।
১.
প্রয়োজন বুঝে গাড়ির ধরন ঠিক করুন
কেন গাড়ি কিনছেন, এটা ভাবতে হবে। দৈনন্দিন অফিস যাতায়াত ও পরিবার নিয়ে ভ্রমণ, নাকি দীর্ঘ দূরত্বে যাওয়া? যদি শহরের ভেতরে ছোট পরিবার নিয়ে চলাফেরা করেন, তাহলে হ্যাচব্যাক বা সেডান শ্রেণির ছোট গাড়ি যথেষ্ট। বড় পরিবার বা ঘন ঘন দূরপাল্লার ভ্রমণের জন্য এসইউভি ধরনের গাড়ি বেছে নিতে পারেন।
২. নতুন না পুরোনো গাড়ি
বাংলাদেশের বাজারে নানা দামের গাড়ি পাওয়া যায়। রিকন্ডিশন্ড বা পুরোনো গাড়ির দাম কিছুটা কম। রিকন্ডিশন্ড গাড়ির মধ্যে সবচেয়ে বড় হিস্যা জাপানি টয়োটা ব্র্যান্ডের। নতুন গাড়ির চেয়ে দামও বেশ কম। পুরোনো গাড়ি কেনার আগে একজন দক্ষ মেকানিকের মাধ্যমে গাড়িটি দেখিয়ে নেওয়া ভালো।
পুরোনো গাড়িতে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কিছুটা বেশি। নতুন গাড়িতে এই খরচ কিছুটা কম। নতুন গাড়ি কিনলে প্রথম কয়েক বছর রক্ষণাবেক্ষণে বড় কোনো খরচ হয় না।
৩. সবকিছুর আগে দাম
গাড়ি কেনার আগে ক্রেতাদের নিজ নিজ সামর্থ্যের কথা ভেবে গাড়ি পছন্দ করতে হয়। সে জন্যই হয়তো সব মিলিয়ে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির দিকেই বাংলাদেশের ক্রেতাদের বেশি ঝোঁক। তবে স্বপ্নের সঙ্গে সামর্থ্যের সংযোগ ঘটাতে না পারলে অনেকে আবার দেশে ব্যবহৃত পুরোনো গাড়ি কেনেন। যা–ই হোক, ব্যক্তিগত গাড়ি হিসেবে ১৫০০ সিসির গাড়িই বেশি পছন্দ ক্রেতাদের।
বর্তমানে ২০০০ সাল থেকে শুরু করে পরের বছরগুলোর মডেলের পুরোনো গাড়ি বেশি বিক্রি হয়। দাম কমবেশি ১০ লাখ টাকা থেকে হয়। অন্যদিকে ১৫০০ সিসির নতুন গাড়ি কিনতে আপনাকে ২৫ লাখ টাকার বেশি বাজেট নিয়ে নামতে হবে।
৪. ঋণ নেবেন কি না, ভাবুন
গাড়ি কেনার আগে টাকার জোগান কীভাবে হবে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা দরকার। গাড়ি কেনার জন্য অনেকেই ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত বা গাড়ির ঋণ নিয়ে থাকেন। আপনার আয় যদি নিয়মিত হয় এবং কিস্তি পরিশোধের সামর্থ্য থাকে, তাহলে গাড়ির ঋণ পাওয়া যায়। তবে মাসিক কিস্তি যেন আপনার মোট আয়ের পাঁচ ভাগের এক ভাগের বেশি না হয়, এটা বিবেচনায় রাখতে হবে। এটা মাথায় রাখুন।
অনেকে নিজের কিছু জমানো টাকার পাশাপাশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েও গাড়ি কেনা ভালো। ধরুন, আপনার নিজের ১০ লাখ টাকা আছে। ব্যাংক থেকে আরও ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে গাড়ি কিনতে পারবেন। এতে ঋণের কিস্তির চাপ কম হবে। বর্তমানে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত গাড়ির ঋণ পাওয়া যায়। হাইব্রিড গাড়ির ক্ষেত্রে দামের ৭০ শতাংশ ঋণ মেলে।
৫. শুধু দাম নয়, খরচও ধরুন
অনেকে শুধুই গাড়ির মূল দাম হিসাব করেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মোট খরচে আছে, যেমন নিবন্ধন ফি, লাইসেন্স ও ফিটনেস খরচ, সার্ভিসিং, চালকের বেতন, মাসিক জ্বালানি খরচ। এসব খরচ চালাতে পারবেন কি না, তা বিবেচনায় রেখে গাড়ি কেনার কথা ভাবুন। এ ছাড়া ইএমআই (ঋণের কিস্তি) থাকলে, সেটাও মাসিক বাজেটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
৬. যন্ত্রাংশের বাজারও গুরুত্বপূর্ণ
শুধু গাড়ি কিনলেই হবে না, গাড়ি কেনার পর যেকোনো সময়ে গাড়ির সমস্যা হতে পারে। নির্দিষ্ট সময় পরপর গাড়ির কিছু যন্ত্র বা যন্ত্রাংশও পাল্টানোর দরকার পড়ে। ওই সব যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ যদি বাজারে না পাওয়া যায় কিংবা সহজলভ্য না হয়, তাহলে তো বিপদ। তাই গাড়ির যন্ত্রাংশ সহজে পাওয়া যায়, এমন গাড়ি কিনতেই বেশি আগ্রহী হন ক্রেতারা।
৭. গাড়ির কাগজপত্র যাচাই করুন
গাড়ির মালিকানা, ফিটনেস সনদ, ইনস্যুরেন্স, করপত্র সব হালনাগাদ আছে কি না, বিশেষ করে পুরোনো গাড়ির ক্ষেত্রে এগুলো অবশ্যই যাচাই করতে হবে।
৮. বিমা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করুন
গাড়ির জন্য তৃতীয় পক্ষের বিমা করা বাধ্যতামূলক। দুর্ঘটনা বা ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক চাপ এড়াতে বিমা থাকা খুবই জরুরি।
৯. বিক্রি করলে দাম কেমন
গাড়ি কেনার সময় বিক্রির কথাও ভাবেন অনেক ক্রেতা। কয়েক বছর ব্যবহারের পরে বিক্রি করতে চাইলে কোন গাড়ির দাম কত পাওয়া যেতে পারে, তা চিন্তা করেও অনেক ক্রেতা কোন কোম্পানির গাড়ি কিনবেন, তা ঠিক করেন। পুরোনো গাড়ি বেচাকেনায় বাংলাদেশে টয়োটা গাড়ির বাজারই সবচেয়ে ভালো। কারণ, দেশের বাজারে এই ব্র্যান্ডের গাড়ির যন্ত্রাংশই অধিকতর সহজলভ্য।
১০. নিজেকে তিনটি প্রশ্ন করুন
গাড়ি কেনার আগে নিজেকে তিনটি প্রশ্ন করেন। প্রথমত, আমি কি এই গাড়ি চালাতে জ্বালানি, রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন খরচে প্রস্তুত? দ্বিতীয়ত, আমার প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত গাড়িটি কি পেয়েছি? তৃতীয়ত, ভবিষ্যতে যদি গাড়িটি বিক্রি করি, তাহলে যথাযথ মূল্য পাব কি? এসব প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে লুকিয়ে আছে আপনার গাড়ির স্বপ্ন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ন র আগ নত ন গ ড় র জন য আপন র
এছাড়াও পড়ুন:
প্রকাশ্য থেকে গুপ্ত: ভেতর থেকে দেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৫-৯৬ সেশনে ভর্তি হই। চার বছরের বিবিএ ও এক বছরের এমবিএ করতে সাত বছর লেগে যায়। কারণ সেশনজট, যার উৎপত্তি ছিল মূলত রাজনীতি।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম দিন থেকেই আমাকে হলে থাকতে হয়েছে, যদিও প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বৈধভাবে হলে থাকার বিধান ছিল না। প্রায় সাত বছরের হল–জীবনে আমার সুয়োগ হয়েছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, দুই আমলের ছাত্ররাজনীতি প্রত্যক্ষ করার। ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ যা করেছে, তার মধ্যে ভালো কাজের উদাহরণ একেবারেই কম।
জোরপূর্বক মিছিলে নিয়ে যাওয়া ছিল অতি স্বাভাবিক। আমাকেও অনেকবার যেতে হয়েছে। মিছিলের আগে হলের প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিত এবং সবাইকে গেটে একত্র করে মিছিলে নিয়ে যেত। মিছিলে না গেলে অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটত। আমারও একদিন মিছিলে যোগ দিতে দেরি হওয়ায় এক নেতার মুখ থেকে গালি শুনতে হয়েছে। একবার মিছিলে গিয়ে পুলিশের ছোড়া কাঁদানে গাস থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাই। এ রকম ঘটনার মুখোমুখি হয়ে মাঝেমধ্যে হলের ছাদে গিয়ে কান্না করতাম।
ছাত্রনেতারা তাদের সিটে একা থাকত অথচ অন্যদের কক্ষে জোরপূর্বক ডাবলার উঠিয়ে দিত। হলের ক্যানটিনে ফাও খাওয়া ছিল একেবারেই স্বাভাবিক। বড় নেতাদের রুমে ক্যানটিন থেকে খাবার পৌঁছে দিতে হতো। তারা কখনো ক্যানটিনে খেতে এলে তাদের টেবিলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বসতে সাহস পেত না।
আমাদের সময়ে এক হলের সঙ্গে আরেক হলের মারামারি ও হল দখলের ঘটনাও ছিল স্বাভাবিক। হলগুলো দখলে রাখতে সারা রাত অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিতে হতো। যেসব শিক্ষার্থী প্রথম বর্ষে রাজনৈতিকভাবে হলে উঠত, তারাই মূলত এসব কাজ করত। তাদের মিছিলে যাওয়াও ছিল বাধ্যতামূলক। হলে ডাবলার হওয়ার বিনিময়ে অনেককেই তাদের প্রথম বর্ষের অনেকটা সময় এসব কাজ করে কাটাতে হয়েছে। এ কারণে অনেকেই প্রথম বর্ষে অকৃতকার্য হয়েছে কিংবা ভালো ফল নিয়ে পাস করতে পারেনি। এই রাজনীতি করেই আমাদের কয়েকজন ক্লাসমেট অকৃতকার্য হয়েছে। তাদের মধ্যে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া শিক্ষার্থীও ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রতিটি বিভাগের পাঠ্যসূচি এমনভাবে তৈরি করা, যাতে একজন শিক্ষার্থীকে মোটামুটিভাবে পাস করতে হলেও দৈনিক চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পড়াশোনা করতে হয়। অনেকগুলো বিভাগে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চাপ এতই কম যে তারা মাসেও একবার বই ছুঁয়ে দেখে না। এসব শিক্ষার্থী তাহলে বাকি সময়ে কী করবে?যখন হলে বৈধ সিট পাই, আমি আমার সিটে একা থাকতে পারিনি। আগে থেকেই একজন আমার সিটে থাকত এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে ডাবলার হিসেবে নিয়েছি। দুই সিটের রুমের অন্য সিটে একজন ছাত্রনেতা থাকত। ওই নেতার কারণেই আমাকে ডাবলার নিতে হয়েছে। আমার ডাবলার হওয়ার বিনিময়ে সে ওই নেতার ফুটফরমাশ খাটত। পরবর্তী সময়ে সে বড় সাংবাদিক হয়েছে এবং বর্তমানে বিদেশে থাকে।
আমার রুমে নেতা থাকার কারণে পাতি নেতারা এসে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে আমার পড়ার ব্যাঘাত ঘটাত। অল্প সময়ের ব্যবধানে সিঙ্গেল রুমের জন্য আবেদন করি। এইচএসসি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করায় ও এসএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলের কারণে তৃতীয় বর্ষের শুরুতেই সিঙ্গেল রুম পেয়ে যাই। সিঙ্গেল রুম পেলেও কখনোই একা থাকতে পারিনি। জোর করে উঠিয়ে দেওয়া ডাবলার নিয়েই হল–জীবন কাটিয়ে দিতে হয়েছে।
এই নেতারা কেউ কেউ আবার সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দিত না। পরবর্তী জীবনে ব্যাংকের বড় ঋণখেলাপি হওয়ার হাতেখড়ি এখানেই হয়ে যেত। তাদের জন্য রুমমেটের সাবান, টুথপেস্ট, টাওয়েল ব্যবহার ছিল প্রায় অধিকারের মতো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যখন হল ছাড়ি, তখন মনে হয়েছে, এই পাপিষ্ঠদের হাত থেকে বোধ হয় মুক্তি মিলেছে।
এরপর ২০০৬ সালের প্রথম দিকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে অল্প সময়ের জন্য বিএনপি ও দীর্ঘ সময়ের জন্য আওয়ামী লীগের শাসন দেখেছি। যে বেতনে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি, তাতে ক্যাম্পাসের বাইরে ভাড়া বাসায় থেকে জীবনযাপন কঠিন বিধায় হাউস টিউটর হওয়ার জন্য আবেদন করি। কারণ, হাউস টিউটর হলে একটু কম ভাড়ায় হলের বাসায় থাকা যায়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা আবেদন করতে থাকি, কিন্তু হাউস টিউটর হতে পরিনি। তারপর পিএইচডি করে বিদেশ থেকে এসে আবার ২০১২ সাল থেকে আবেদন করতে থাকি। আমার আর হাউস টিউটর হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। সাদা দলের (বিএনপি) কাছে আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ স্পষ্ট ছিল না। আর নীল দল (আওয়ামী লীগ) বলেছে, আমার কথাবার্তা সরকার ও উন্নয়নবিরোধী।
আরও পড়ুনকুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের নামে এ কোন রাজনীতি১৭ এপ্রিল ২০২৫ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের জন্য কিছু কম মানসম্পন্ন বাসা আছে। এগুলো সাইজে একটু ছোট এবং ভাড়াও কম। একজনকে দুই বছরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। সঠিক নিয়মে বরাদ্দ হলে চাকরিজীবনে সবারই ওই বাসা পাওয়ার কথা। কিন্তু অনেকের মতো আমিও পাইনি। তাহলে অন্যরা কীভাবে পেয়েছেন? রাজনৈতিক বিবেচনাই ছিল প্রধান। নামকরা অনেক শিক্ষকও এসব বাসায় থেকেছেন। বরাদ্দ পেয়ে দুই বছরের মধ্যে বাসা ছেড়ে দিয়েছেন—এ রকম উদাহরণ বিরল।
অনুষদের ডিন একটি নির্বাচিত পদ। একজন ডিন তাঁর পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ নিরঙ্কুশ করার জন্য অনেক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ কারণেই গত দুই দশকে অনেকগুলো অপ্রয়োজনীয় বিভাগ খুলে সেখানে প্রচুর ভোটার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো অনুষদে ডিন জার্নালের প্রধান সম্পাদকও। তাই জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ডিনের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকে। শিক্ষকদের পদন্নোতির বিষয়টিও তাঁর মাধ্যমে করা হয় বলে তিনি এ ক্ষেত্রেও হস্তক্ষেপ করতে পারেন। আবার পদোন্নতির বোর্ডেও তিনি একজন সদস্য। সব মিলিয়ে এ রকম একজন রাজনৈতিক ডিনের কাছে শিক্ষকদের নতজানু হওয়ার অনেক কারণ থাকে।
শিক্ষকদের রাজনৈতিক দলাদলি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বেশির ভাগ শিক্ষক তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের শিক্ষকদের সঙ্গেই মেশেন। শিক্ষক লাউঞ্জ বা ক্লাবে শিক্ষকদের বসার অবস্থা দেখেই এ বিভাজন স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের সময় ভোট শেষে যে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়, তা–ও বিতরণ করা হতো দুটি ভিন্ন জায়গা থেকে—একটি নীল দলের, অন্যটি সাদা দলের। এভাবে খাবার আনতে যাওয়া খুব বিব্রতকর হওয়ায় কেউ কেউ খাবার না নিয়েই চলে যেতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ–উপাচার্য, ট্রেজারার পদগুলোয় সরাসরি রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টরসহ অন্যান্য প্রশাসনিক পদেও একই বিবেচনায় নিয়োগ হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডেপুটেশনে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশিন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হয়, তা–ও হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। শিক্ষকদের কমনওয়েলথ বৃত্তির জন্য যে প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়া হয়, সেটাও রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে নয়।
ক্লাসে কম যাওয়া, ফলাফল দেরিতে প্রকাশ করা, এমনকি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা শিক্ষকদের একটা বড় অংশ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ আবার শিক্ষার্থীদের কাছে পরিচিত খণ্ডকালীন শিক্ষক এবং পূর্ণকালীন রাজনীতিবিদ হিসেবে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি না, তা নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। আমার ছাত্রজীবনেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি খুন হয়েছিল। হলগুলোয় বসবাসের ও শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ছিল না। খাবার ছিল নিম্নমানের।
এ সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানেরা হলে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে না। যারা একসময় হলে রাজনীতি করত, তাদের সন্তানেরা এখানে পড়াশোনা করলেও কেউ হলে থাকে না। এমনকি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানদেরও হলে থেকে পড়াশোনা করার নজির নেই বললেই চলে। যদি ছাত্ররাজনীতি এতই পরিশীলিত হতো, তাহলে আমাদের নেতা ও শিক্ষকেরা তাঁদের সন্তানদের হলে রেখে রাজনীতির চর্চা করিয়ে ভবিষ্যতের নেতা বানাতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি হল দ্বারাই বেশির ভাগ পরিচালিত হয়। এর যত মন্দ দিক আছে, তার প্রায়ই সবই হলের শিক্ষার্থীদেরই আঘাত করে। যাদের সন্তানেরা হলে থাকে না, তারা হলের শিক্ষার্থীদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি জারি রাখতে চায়। হলের শিক্ষার্থীদের এ ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কারণ, হলগুলোয় আবার আগের ধারার রাজনীতি শুরু হলে তারাই প্রথম এর শিকার হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য যে দীর্ঘ রাজনীতিচর্চার দরকার হয় না, তার প্রমাণ আমরা ২০২৪ সালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্ররাজনীতিহীন শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেখেছি।
যাঁরা অক্সফোর্ড কিংবা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতির কথা তুলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্ররাজনীতি চালু রাখার পক্ষে কথা বলেন, তাঁরা হয়তো জানেন না, ওদের রাজনীতির ধরন কেমন। আমাদের মতো দলীয় ও লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি সেখানে নেই। তারা পড়াশোনা ও গবেষণায় বেশি ব্যস্ত থাকে। আমাদের এখানকার মতো পড়াশোনাকে গৌণ করে রাজনীতি করে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রতিটি বিভাগের পাঠ্যসূচি এমনভাবে তৈরি করা, যাতে একজন শিক্ষার্থীকে মোটামুটিভাবে পাস করতে হলেও দৈনিক চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পড়াশোনা করতে হয়। অনেকগুলো বিভাগে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চাপ এতই কম যে তারা মাসেও একবার বই ছুঁয়ে দেখে না। এসব শিক্ষার্থী তাহলে বাকি সময়ে কী করবে?
জন্মের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি নিয়েই এগিয়েছে। রাজনীতির কারণেই এ ক্যাম্পাসে অনেকগুলো খুন হয়েছে, শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে, শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন বেড়েছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোকে পাঁচ বছর প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতির বাইরে রেখে দেখা যেতে পারে; সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকরাজনীতিও। যদি ভালো ফল না আসে, তাহলে এই রাজনীতি আবার ফিরে আসুক। একই রকম পরীক্ষা (কয়েক বছরের জন্য রাজনীতি বন্ধ রাখা) সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে।
মো. মাইন উদ্দিন অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
(মতামত লেখকের নিজস্ব)