দেশে পশুর চামড়ার বাজারমূল্য কম হওয়ার অন্যতম কারণ, চামড়ার গুণগত মানের অবনতি। বিশেষ করে কোরবানির সময় দক্ষ লোক দিয়ে পশু জবাই না করায় ও দেরীতে লবণ যুক্ত করায় চামড়ার মান খারাপ হয়ে যায়।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার হেমায়েতপুরে অবস্থিত ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো গত কোরবানির সময় যে চামড়া সংগ্রহ করেছিল তার মধ্যে প্রায় ৯৮ শতাংশ চামড়াই ছিল কমবেশি দাগযুক্ত। এ ছাড়া ৬৮ শতাংশ চামড়ায় ছোট-বড় কাটা ছিল।

আজ সোমবার রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে ‘বাংলাদেশের চামড়া সরবরাহ শৃঙ্খল: কাঁচা চামড়ার মান ও মূল্য নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক ওই জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।

সিপিডি বলেছে, সঠিক উপায়ে জবাই না করলে এবং চামড়া ছাড়ানো না হলে চামড়ায় কাটা দাগ পড়ে, ছিঁড়ে যায় বা গঠনগত ক্ষতিসাধন হয়। এতে চামড়ার মান ভালো থাকে না; বরং অনেক ক্ষেত্রেই নিম্নমানের বা অকেজো হয়ে যায়। এ ছাড়া প্রাকৃতিক কারণেও মান কমে যায়। যেমন, ট্যানারিগুলো যেসব চামড়া সংগ্রহ করেছিল, তার মধ্যে ২৩ শতাংশ চামড়া গরমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘ সময় লবণ না দিয়ে রাখায় এমনটা হয়েছে। এসব চামড়ার মধ্যে ১৮ শতাংশ শেষ পর্যন্ত পচে গেছে।

৭ জুন দেশে ঈদ উল আজহা বা কোরবানির ঈদ উদ্‌যাপিত হয়। তখন ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, নাটোর ও ময়মনসিংহ—এই পাঁচ জেলায় জরিপটি পরিচালনা করে সিপিডি। এতে কাঁচা চামড়ার সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ৭৬৮ অংশীজনের কাছ থেকে থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কোরবানিদাতা, মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রতিনিধি, স্থানীয় মৌসুমি ব্যবসায়ী, ব্যাপারী, আড়তদার ও ট্যানারিমালিক।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান লেদার বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (এলএসবিপিসি) যৌথভাবে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান। আরও বক্তব্য দেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও বিটিএ চেয়ারম্যান মো.

শাহীন আহমেদ। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামিম আহমেদ।

অনুষ্ঠানে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, চামড়ার মূল্য নির্ধারণে লবণসহ ও লবণছাড়া উভয় ধরনের দাম রাখা উচিত। আগামী বছর থেকেই এটি হতে পারে। লবণসহ চামড়ার দাম এতটা বেশি রাখা উচিত যেন তা চামড়ায় লবণ লাগানোর বিষয়ে উৎসাহ তৈরি করে। এ ছাড়া কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ অব্যাহত রাখা উচিত বলে জানান তিনি। চামড়া খাতে বিদেশি বিনিয়োগ নেই। চামড়া শিল্প নগরীতে বিদেশি কেউ জমি কিনতে পারে না। এসব জায়গায় শিথিলতা আনা প্রয়োজন।

৫২ শতাংশ গরু জবাই হয় রাস্তাঘাটে

সিপিডির জরিপে উঠে এসেছে, চলতি বছরের কোরবানি ঈদে ৫২ শতাংশ গরু জবাই করা হয়েছে রাস্তাঘাটে। এ ছাড়া খোলা মাঠে ২৬ শতাংশ, বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গায় সাড়ে ৮ শতাংশ ও বাগানের মধ্যে প্রায় ৯ শতাংশ গরু জবাই করা হয়েছে। এর বাইরে মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশ গরু স্লটারহাউসে (পশু জবাইখানা) এবং ১ দশমিক ৬ শতাংশ পশু সরকার নির্ধারিত স্থানে জবাই করা হয়েছে।

দেশে ঈদ মৌসুমে গবাদিপশু জবাই ও চামড়া ছাড়ানোর কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ কসাইয়ের অভাব রয়েছে বলে জানায় সিপিডি। ঢাকায় ২০ লাখের বেশি গরু কোরবানি হলেও এ জেলায় প্রশিক্ষিত কসাইয়ের সংখ্যা মাত্র ১১ হাজার ৬০০।

জরিপে উঠে আসে, চলতি বছর ঈদুল আজহায় সময় প্রায় ৮২ শতাংশ পশু কোরবানি হয়েছে মাদ্রাসা বা মসজিদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই প্রশিক্ষিত নন। এ ছাড়া ১৩ শতাংশের বেশি পশু জবাই করেছেন কোরবানিদাতা নিজেই। মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ পশু পেশাদার কসাইয়ের মাধ্যমে জবাই করা হয়েছে।

দক্ষ লোক দিয়ে কাজ না করানোয় এবারের ঈদে অন্তত ২১ শতাংশ কোরবানিদাতার গরুর চামড়ায় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গভীর কাটা–ছেঁড়া (ফ্লে কাট) হয়েছে। ফলে এসব চামড়ার তেমন দামই পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া সিপিডির জরিপকারীরা কোরবানির সময় সরেজমিনে গিয়ে কাটা ও ছেঁড়া চামড়া ফেলে দেওয়া অবস্থায় দেখতে পেয়েছেন।

কাঁচা চামড়ায় লবণ দিতে অনীহা

কোরবানির পর (লবণ দেওয়ার আগে) দ্রুত চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও অবহেলার চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ৪৬ শতাংশ কোরবানিদাতা পশু জবাইয়ের পর চামড়া খোলা স্থানে ফেলে রেখেছিলেন। এ ছাড়া চামড়া সংগ্রহ করা মাদ্রাসা প্রতিনিধি ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ৩৬ শতাংশ এবং ১৪ শতাংশ আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ী দীর্ঘ সময় চামড়া খোলা জায়গায় সংরক্ষণ করেছেন। এ কারণে বৃষ্টি, সূর্যের অত্যধিক তাপ, ধুলাবালু ও রোগজীবাণুর সংক্রমণে অনেক চামড়ার গুণগত মান নষ্ট হয়েছে।

এদিকে সরকার প্রতিবছর লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়, কিন্তু কাঁচা চামড়া প্রতিবারই অনির্ধারিত দামেই বেচাকেনা হয়। কোরবানিদাতা, মৌসুমি ব্যবসায়ীসহ যে কেউ লবণযুক্ত করে চামড়া সংরক্ষণ করতে পারলেও এ কাজে তাঁদের মধ্যে অনীহা দেখা গেছে।

জরিপমতো কোনো কোরবানিদাতাই নিজে চামড়ায় লবণ যুক্ত করেননি। ৮৩ শতাংশ মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ৩৭ শতাংশ মাদ্রাসা লবণ দেওয়া ছাড়াই চামড়া বিক্রি করেছে। অথচ এবারের ঈদুল আজহার সময় স্থানীয় পর্যায়ে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের জন্য সরকার বিনা মূল্যে ২০ কোটি টাকার লবণ সরবরাহ করেছিল। প্রায় ১১ হাজার ৫৭১ টন লবণ দেশের সব কটি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এতিমখানা, মাদ্রাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে বিতরণ করা হয়।

সিপিডি বলেছে, চলতি বছর কোরবানির পশুর চামড়ায় লবণ বিতরণকে ঘিরে বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। যেমন অনেক মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং সরকারি বরাদ্দের লবণ পায়নি। আবার যারা পেয়েছে, তাদের অনেকেই চামড়ায় লবণ না দিয়ে কাঁচা চামড়া ও লবণ আলাদাভাবে বিক্রি করেছে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক রব ন দ ত ব যবস য় লবণ দ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ইলিশের দাম নির্ধারণে চিঠি: ব্যবসায়ীদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া, ক্রেতার সাধুবাদ

মৌসুমসহ প্রায় বছরব্যাপীই চাঁদপুর ও দক্ষিণাঞ্চলের ইলিশ পাওয়ার জায়গাগুলোতে চড়া দাম থাকে সুস্বাদু এই মাছের। এ ছাড়া মাছ ব্যবসায়ী ও আড়ৎদারদের সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য তো আছেই। সারা বছর দামের এ ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে এবং সিন্ডিকেট ঠেকাতে ইলিশের দাম নির্ধারণের জন্য মঙ্গলবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছেন চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। 

ডিসির এই চিঠিতে ভোক্তা পর্যায়ে তথা সাধারণ ইলিশ ক্রেতাদের মধ্যে দাম কমে যাওয়ার আশা জাগলেও চাঁদপুরের মাছ ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। তারা বলছেন, পদ্মা, মেঘনায় জাটকা নিধন, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ইলিশ ধরা পড়ছে কম। এরপর দাম কমানো হলে ইলিশ ধরার জেলেরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। 

চাঁদপুর মাছঘাটের মেসার্স আনোয়ার হোসেন জমাদার আড়তের ব্যবসায়ী মনসুর আহমেদ মাহীন বলেন, চাঁদপুরে এখন বড় ইলিশ আসে, ছোট ইলিশ কম। মৌসুমের শুরুর তুলনায় এখন ইলিশের দাম কেজিতে ২/৩শ টাকা কমে এসেছে। ভরা মৌসুমে দাম আরও কমবে। শান্তি ফিস আড়তের মালিক সম্রাট বেপারী বলেন, ‘আমরা শুনলাম চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক দাম নির্ধারণ করার জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। দাম নির্ধারণ করে ইলিশ বিক্রি সম্ভব না।’ কারণ হিসেবে তিনি জানান, খরচ এবং আড়তে ইলিশ সরবরাহের ওপর নির্ভর করে এর দাম। সরবরাহ বেশি থাকলে দামও কমতে থাকে। এখন প্রশাসন যদি দাম নির্ধারণ করে দেয়, তবে ঘাটে মাছ আসা কমে যাবে।

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শবেবরাত সরকার জানান, জেলা প্রশাসন ইলিশের দাম নির্ধারণে মন্ত্রণালয়ে যে চিঠি দিয়েছে তা তাদের কাছে খুবই অযৌক্তিক মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, ইলিশ মাছ কাঁচামাল। এর দাম উঠানামা করে। ভরা মৌসুমে তথা জুলাই-অক্টোবর মাসে এর দাম অনেকটাই কমে আসবে। বর্তমানে বাড়তি দামের কারণ হিসেবে তিনি জানান, এখন প্রতিদিন মাত্র ৮-১০ মণ ইলিশ ঘাটে আসে; যা চাহিদার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। তিনি বলেন, দাম যদি নির্ধারণই করতে হয় তবে সেটি পুরো দেশে করতে হবে। 

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন সমকালকে বলেন, চাঁদপুর ও আশপাশের জেলার গুটিকয়েক ব্যবসায়ী ও আড়তদার নিজেদের ইচ্ছেমতো ইলিশের দাম হাঁকাচ্ছেন; যা একেবারেই ক্রেতার নাগালের বাইরে। 

এর পরিপ্রেক্ষিতে ইলিশের দাম নির্ধারণ করা প্রয়োজন। স্থানীয় মৎস্য সমিতির নেতা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলেও জানান তিনি। জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই ভোক্তার স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। একইসঙ্গে ব্যবসায়ী ও জেলেদের কথাও মাথায় রাখব আমরা।’

সরেজমিন দেখা গেছে, বর্তমানে চাঁদপুর ঘাটে পদ্মা-মেঘনার এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম ২ হাজার টাকার ওপরে। এরচেয়ে কিছুটা বড় সাইজের ইলিশ ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। তবে ৫০০/৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছিল ১২শ থেকে ১৪শ টাকা কেজি দরে। খুচরা বাজারে এই দাম আরও বেশি। 
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইসরায়েলে ৮ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান, বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত
  • চাঁদপুরে এক ইলিশ বিক্রি হলো ১৩ হাজার টাকায়
  • রাজধানীতে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে লোডশেডিং পরিস্থিতি
  • ইরানে মার্কিন হামলা, বিশ্ববাজারে বাড়তে পারে জ্বালানি তেলের দাম
  • গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ কষ্টে আছে
  • আড়াইহাজারে গ্যাস সংকটে দেড় শতাধিক কারখানার উৎপাদন ব্যাহত
  • আড়াইহাজারে শিল্প কারখানায় গ্যাস সংকট সমাধানের আশ্বাস দিলেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান   
  • সরাসরি: ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ
  • ইলিশের দাম নির্ধারণে চিঠি: ব্যবসায়ীদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া, ক্রেতার সাধুবাদ