কোরবানির সময় ট্যানারিতে আসা ৯৮ শতাংশ কাঁচা চামড়া দাগযুক্ত ছিল: সিপিডির গবেষণা
Published: 23rd, June 2025 GMT
দেশে পশুর চামড়ার বাজারমূল্য কম হওয়ার অন্যতম কারণ, চামড়ার গুণগত মানের অবনতি। বিশেষ করে কোরবানির সময় দক্ষ লোক দিয়ে পশু জবাই না করায় ও দেরীতে লবণ যুক্ত করায় চামড়ার মান খারাপ হয়ে যায়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার হেমায়েতপুরে অবস্থিত ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো গত কোরবানির সময় যে চামড়া সংগ্রহ করেছিল তার মধ্যে প্রায় ৯৮ শতাংশ চামড়াই ছিল কমবেশি দাগযুক্ত। এ ছাড়া ৬৮ শতাংশ চামড়ায় ছোট-বড় কাটা ছিল।
আজ সোমবার রাজধানীর ঢাকা ক্লাবে ‘বাংলাদেশের চামড়া সরবরাহ শৃঙ্খল: কাঁচা চামড়ার মান ও মূল্য নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক ওই জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়।
সিপিডি বলেছে, সঠিক উপায়ে জবাই না করলে এবং চামড়া ছাড়ানো না হলে চামড়ায় কাটা দাগ পড়ে, ছিঁড়ে যায় বা গঠনগত ক্ষতিসাধন হয়। এতে চামড়ার মান ভালো থাকে না; বরং অনেক ক্ষেত্রেই নিম্নমানের বা অকেজো হয়ে যায়। এ ছাড়া প্রাকৃতিক কারণেও মান কমে যায়। যেমন, ট্যানারিগুলো যেসব চামড়া সংগ্রহ করেছিল, তার মধ্যে ২৩ শতাংশ চামড়া গরমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘ সময় লবণ না দিয়ে রাখায় এমনটা হয়েছে। এসব চামড়ার মধ্যে ১৮ শতাংশ শেষ পর্যন্ত পচে গেছে।
৭ জুন দেশে ঈদ উল আজহা বা কোরবানির ঈদ উদ্যাপিত হয়। তখন ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, নাটোর ও ময়মনসিংহ—এই পাঁচ জেলায় জরিপটি পরিচালনা করে সিপিডি। এতে কাঁচা চামড়ার সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ৭৬৮ অংশীজনের কাছ থেকে থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন কোরবানিদাতা, মাদ্রাসা ও এতিমখানার প্রতিনিধি, স্থানীয় মৌসুমি ব্যবসায়ী, ব্যাপারী, আড়তদার ও ট্যানারিমালিক।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান লেদার বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (এলএসবিপিসি) যৌথভাবে অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান। আরও বক্তব্য দেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও বিটিএ চেয়ারম্যান মো.
অনুষ্ঠানে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, চামড়ার মূল্য নির্ধারণে লবণসহ ও লবণছাড়া উভয় ধরনের দাম রাখা উচিত। আগামী বছর থেকেই এটি হতে পারে। লবণসহ চামড়ার দাম এতটা বেশি রাখা উচিত যেন তা চামড়ায় লবণ লাগানোর বিষয়ে উৎসাহ তৈরি করে। এ ছাড়া কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুযোগ অব্যাহত রাখা উচিত বলে জানান তিনি। চামড়া খাতে বিদেশি বিনিয়োগ নেই। চামড়া শিল্প নগরীতে বিদেশি কেউ জমি কিনতে পারে না। এসব জায়গায় শিথিলতা আনা প্রয়োজন।
৫২ শতাংশ গরু জবাই হয় রাস্তাঘাটে
সিপিডির জরিপে উঠে এসেছে, চলতি বছরের কোরবানি ঈদে ৫২ শতাংশ গরু জবাই করা হয়েছে রাস্তাঘাটে। এ ছাড়া খোলা মাঠে ২৬ শতাংশ, বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গায় সাড়ে ৮ শতাংশ ও বাগানের মধ্যে প্রায় ৯ শতাংশ গরু জবাই করা হয়েছে। এর বাইরে মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশ গরু স্লটারহাউসে (পশু জবাইখানা) এবং ১ দশমিক ৬ শতাংশ পশু সরকার নির্ধারিত স্থানে জবাই করা হয়েছে।
দেশে ঈদ মৌসুমে গবাদিপশু জবাই ও চামড়া ছাড়ানোর কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ কসাইয়ের অভাব রয়েছে বলে জানায় সিপিডি। ঢাকায় ২০ লাখের বেশি গরু কোরবানি হলেও এ জেলায় প্রশিক্ষিত কসাইয়ের সংখ্যা মাত্র ১১ হাজার ৬০০।
জরিপে উঠে আসে, চলতি বছর ঈদুল আজহায় সময় প্রায় ৮২ শতাংশ পশু কোরবানি হয়েছে মাদ্রাসা বা মসজিদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই প্রশিক্ষিত নন। এ ছাড়া ১৩ শতাংশের বেশি পশু জবাই করেছেন কোরবানিদাতা নিজেই। মাত্র ৪ দশমিক ৮ শতাংশ পশু পেশাদার কসাইয়ের মাধ্যমে জবাই করা হয়েছে।
দক্ষ লোক দিয়ে কাজ না করানোয় এবারের ঈদে অন্তত ২১ শতাংশ কোরবানিদাতার গরুর চামড়ায় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গভীর কাটা–ছেঁড়া (ফ্লে কাট) হয়েছে। ফলে এসব চামড়ার তেমন দামই পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া সিপিডির জরিপকারীরা কোরবানির সময় সরেজমিনে গিয়ে কাটা ও ছেঁড়া চামড়া ফেলে দেওয়া অবস্থায় দেখতে পেয়েছেন।
কাঁচা চামড়ায় লবণ দিতে অনীহা
কোরবানির পর (লবণ দেওয়ার আগে) দ্রুত চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও অবহেলার চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ৪৬ শতাংশ কোরবানিদাতা পশু জবাইয়ের পর চামড়া খোলা স্থানে ফেলে রেখেছিলেন। এ ছাড়া চামড়া সংগ্রহ করা মাদ্রাসা প্রতিনিধি ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ৩৬ শতাংশ এবং ১৪ শতাংশ আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ী দীর্ঘ সময় চামড়া খোলা জায়গায় সংরক্ষণ করেছেন। এ কারণে বৃষ্টি, সূর্যের অত্যধিক তাপ, ধুলাবালু ও রোগজীবাণুর সংক্রমণে অনেক চামড়ার গুণগত মান নষ্ট হয়েছে।
এদিকে সরকার প্রতিবছর লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেয়, কিন্তু কাঁচা চামড়া প্রতিবারই অনির্ধারিত দামেই বেচাকেনা হয়। কোরবানিদাতা, মৌসুমি ব্যবসায়ীসহ যে কেউ লবণযুক্ত করে চামড়া সংরক্ষণ করতে পারলেও এ কাজে তাঁদের মধ্যে অনীহা দেখা গেছে।
জরিপমতো কোনো কোরবানিদাতাই নিজে চামড়ায় লবণ যুক্ত করেননি। ৮৩ শতাংশ মৌসুমি ব্যবসায়ী ও ৩৭ শতাংশ মাদ্রাসা লবণ দেওয়া ছাড়াই চামড়া বিক্রি করেছে। অথচ এবারের ঈদুল আজহার সময় স্থানীয় পর্যায়ে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের জন্য সরকার বিনা মূল্যে ২০ কোটি টাকার লবণ সরবরাহ করেছিল। প্রায় ১১ হাজার ৫৭১ টন লবণ দেশের সব কটি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এতিমখানা, মাদ্রাসা ও লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে বিতরণ করা হয়।
সিপিডি বলেছে, চলতি বছর কোরবানির পশুর চামড়ায় লবণ বিতরণকে ঘিরে বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। যেমন অনেক মাদ্রাসা, এতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং সরকারি বরাদ্দের লবণ পায়নি। আবার যারা পেয়েছে, তাদের অনেকেই চামড়ায় লবণ না দিয়ে কাঁচা চামড়া ও লবণ আলাদাভাবে বিক্রি করেছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক রব ন দ ত ব যবস য় লবণ দ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করেন যবিপ্রবি শিক্ষার্থী সুজা
কেউ কেউ শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে যায়, আবার কেউ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে ছুটে চলে অদম্য সাহসে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী বি এম সুজা উদ্দিন সেই অদম্য সাহসী মানুষদের একজন।
পরিবারে অভাব ছিল না, কারণ বাবা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কিন্তু সুজার মনে বাসা বেঁধেছিল ভিন্ন এক তৃষ্ণা; স্বপ্ন নিজের কিছু গড়ে তোলার, উদ্যোক্তা হওয়ার। তাই তো ২০২০ সালে অনার্স চতুর্থ বর্ষে থাকা অবস্থায় মাত্র ৩ হাজার টাকা মূলধন দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা।
আরো পড়ুন:
১০ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে অকৃতকার্য ইবি উপাচার্য
চাকসু নির্বাচনের তারিখ পেছানো নিয়ে যা জানা গেল
একজন বন্ধুর কাছে দেড় হাজার এবং এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া দেড় হাজার টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু হয় অনলাইনে ফেসবুক পেজ ও গ্রুপের মাধ্যমে, আজ অরগানিক ও স্বাস্থ্যকর খাবারের বিশ্বস্ত মাধ্যমে রূপ নিয়েছে।
গত ৪ বছর ধরে শুধু অনলাইনেই চলেছে এই পথচলা। এরপর একদিন সাহস করে ক্যাম্পাসের ভেতরে একটি টেবিলে কয়েকটি পণ্য সাজিয়ে বসেন তিনি। সেই টেবিলই হয়ে উঠল তার স্বপ্নের অফলাইন রূপ। আজ সেটা সবার কাছে পরিচিত ‘সুজাস ফুড হেভেন’ নামে।
শুরুতে তার পড়াশোনা আর ব্যবসা সামলানো ছিল অনেক কঠিন। অর্ডার হাতে পেলে ক্লাস বা পরীক্ষা না থাকলে নিজেই ডেলিভারি দিতেন যশোর শহর ও ক্যাম্পাসে। অন্য জেলায় পাঠাতেন কুরিয়ারে। ধীরে ধীরে দোকানে অংশীদার ও কর্মচারী যুক্ত হয়, তাতে কিছুটা স্বস্তি আসে তার। তবে স্বপ্ন পূরণের টানে পড়াশোনার প্রতি আগের মতো সিরিয়াস হওয়া সম্ভব না হলেও নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে গেছেন। কারণ তিনি জানতেন, ফলাফলে কিছুটা ঘাটতি হলেও স্বপ্ন পূরণের পথে অভিজ্ঞতা অর্জনই বড় সম্পদ।
বন্ধুদের সহযোগিতা তার পথচলায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এর বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও পেয়েছেন প্রেরণা। ক্যাম্পাসে স্টল বসানোর সুযোগ কিংবা উদ্যোক্তা মেলায় অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা তাকে করেছে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
মাসে ১৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করে আজ তিনি নিজের খরচ মেটাচ্ছেন, কর্মচারীর বেতন দিচ্ছেন এবং নতুন করে বিনিয়োগ করছেন ব্যবসায়। যদিও এখনো অর্থনৈতিক চাপ পুরোপুরি কাটেনি, তবে সুজা উদ্দিন দৃঢ় বিশ্বাসী- এই চাপই তাকে আরো শক্ত করবে এবং সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
সুজা বলেন, “আমার পথচলা একেবারে সহজ ছিল না। প্রথম দিকে আমার দোকানে বসতে লজ্জা লাগত, কখনো কখনো বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখিও হয়েছি। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে সবকিছু জয় করে এখন আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি- আলহামদুলিল্লাহ, আমি আমার কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট। গ্রাহকদের ভালোবাসা ও সম্মান আমার আত্মবিশ্বাসকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।”
তার স্বপ্ন নিরাপদ খাদ্যের আউটলেট গড়ে তোলা এবং ভবিষ্যতে আরো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। ইতোমধ্যে একজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরে তিনি মনে করেন, এটাই তার সবচেয়ে বড় সাফল্যের সূচনা।
অন্য শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে করে তিনি বলেন, “যদি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন থাকে, তাহলে পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর সময়ে ছোট পরিসরে কাজ শুরু করুন। এমন প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করুন, যা সম্পর্কে আপনি জানেন, ভালো সোর্স রয়েছে এবং যেটা নিয়ে কাজ করতে আপনি আনন্দ পান। এতে সময় সঠিকভাবে কাজে লাগবে, অভিজ্ঞতাও বাড়বে। পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর সহজেই বড় পরিসরে শুরু করতে পারবেন।”
সুজা উদ্দিন হয়তো বড় ব্যবসায়ী নন, কিন্তু তার গল্প বড়। তিনি প্রমাণ করেছেন শুধু চাকরির স্বপ্ন দেখলেই জীবন বদলায় না। স্বপ্ন দেখতে হয় ভিন্নভাবে, সাহস করে শুরু করতে হয় ছোট থেকে। এটি তার সাহসের গল্প, স্বপ্নের গল্প, নিজেকে গড়ে তোলার গল্প।
‘সুজাস ফুড হেভেন’ শুধু একটি খাবারের দোকান নয়, এটি একটি প্রমাণ। চাইলে স্বপ্ন সত্যি হয়, যদি লড়াই করার সাহস থাকে।
ঢাকা/মেহেদী