জুলাই ঘোষণাপত্র: জন-আকাঙ্ক্ষা এবং রাষ্ট্রের অভিপ্রায়
Published: 8th, August 2025 GMT
এই যে এত বড় একটা আন্দোলন হলো, দেশে বড় রকমের একটা ওলটপালট ঘটে গেল, এ দেশের শত বছরের গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে এটি ছিল অনন্য। এর একটি রাষ্ট্রীয় বয়ান থাকা জরুরি। রাজনীতির ভেতরে ও বাইরে সবার একটা চাওয়া ছিল, একটা নাগরিক ঘোষণাপত্র থাকা দরকার, যেখানে আন্দোলনের পটভূমি এবং জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকবে। এ নিয়ে বেশ একটা হাইপ তৈরি হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছিল, এত দেরি হচ্ছে কেন?
আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন তার গতি-প্রকৃতি ছিল এক রকম। তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনের চরিত্র ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাতে থাকে এবং একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে এটি সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ঘটনার আকস্মিকতায় তখন মনে হয়নি, এর একটি সুস্পষ্ট কর্মসূচি বা দলিল থাকতে হবে, যেমনটি ছিল উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে ১১ দফা দাবির মধ্যে।
উনসত্তরেও আমরা এমন দেখেছিলাম। শুরুতে ছিল এটা ছাত্র আন্দোলন। পরে এটি গণজোয়ারে রূপ নেয়। একেকটি মৃত্যু যেমন ওই পরিবারটিকে পঙ্গু করে দেয়, একই সঙ্গে আন্দোলনের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটায় লাখো-কোটি মানুষের।
মনে আছে, ১৪৪ ধারা ভাঙার মধ্য দিয়ে ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৭ জানুয়ারি। ২০ জানুয়ারি আসাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এটি আন্দোলনকে করে আরও বেগবান। ২৪ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে স্কুলছাত্র মতিউরসহ কয়েকজনের মৃত্যু হলে আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
চারদিকে শুধু মিছিল আর মিছিল, স্লোগান আর স্লোগান। সারা শহরের মানুষ যেন ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে পথে। মতিউরকে রূপক করে আল মাহমুদ লেখেন অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তিমালা:
ট্রাক ট্রাক ট্রাক
শুয়োরমুখো ট্রাক এসেছে দুয়োর বেঁধে রাখ
ট্রাক ট্রাক ট্রাক
ট্রাকের মুখে আগুন দিতে মতিউরকে ডাক।
একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখেছি চব্বিশের জুলাই মাসে। ট্রাক, লরি, জলকামান, হেলিকপ্টার উপেক্ষা করে পিঁপড়ার মতো দলে দলে মানুষ পথে বেরিয়েছে আর মরেছে। এত গুলি, এত রক্ত, এত মৃত্যু একাত্তরের আগে-পরে আমরা দেখিনি।
আরও পড়ুনজুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে যা যা থাকা উচিত১৯ এপ্রিল ২০২৫মানুষ কী চেয়েছিল? মানুষের তো একটাই চাওয়া—শান্তি, স্বস্তি আর আনন্দে জীবন কাটানো। সে জন্য চাই অনুকূল বাতাবরণ, একটা সহায়ক আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা। যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তার অপমৃত্যু হয়েছিল যাত্রা শুরুর সময়েই। তারপর বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। অনেক সরকার এসেছে, আবার বিদায়ও হয়েছে। কিন্তু একটা টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থার পত্তন হয়নি।
চব্বিশের আন্দোলনে গণমানুষ সম্পৃক্ত হয়েছিল একটা মুক্ত পরিবেশে নিশ্বাস নেবে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও কাজকর্ম করবে, এ আশায়। এ এক চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা। অতীতে বারবার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে, মানুষ বারবার প্রতারিত হয়েছে। এবার একটা চূড়ান্ত ফয়সালা হোক।
মানুষ চেয়েছে রাষ্ট্র এমন একটা অঙ্গীকার করুক, যেখানে এই আকাঙ্ক্ষা, এই স্বপ্নের প্রতিফলন থাকবে। সে জন্যই দরকার ছিল একটি নাগরিক ঘোষণাপত্রের। শেষমেশ এটি আমরা পেলাম এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে গত মঙ্গলবার। সংবিধানে আছে, রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। আমরা ভেবেছিলাম, জুলাই ঘোষণাপত্র হবে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’, নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব শ্রেণির, সব পেশার মানুষের রাষ্ট্রমালিকানার একটা দলিল। আমরা দেখলাম, স্পটলাইট ছিল প্রধান উপদেষ্টা আর রাজনৈতিক দলের নেতাদের ওপর। রাজনৈতিক দলের বাইরেও যে বিপুল জনগোষ্ঠী আছে, তাদের হয়ে কথা বলবে কে?
ঘোষণাপত্র উত্থাপিত হওয়ার পরপর এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। রাজনৈতিক ঐকমত্যের ওপর জোর দেওয়া হলেও, রাজনৈতিক দলগুলো তো পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী, কখনো কখনো একে অপরের শত্রু। সবারই আছে নিজ দলের এজেন্ডা, ইতিহাস নিয়ে দলীয় বয়ান। ঘোষণাপত্রে এটা নেই কেন, ওটা নেই কেন, এ নিয়ে আহাজারি। অনেকেই বুঝতে চান না যে এ ধরনের ঘোষণাপত্র কোনো শ্বেতপত্র নয়।কী আছে এই ঘোষণাপত্রে? পটভূমি আর যৌক্তিকতা বোঝাতে ১ হাজার ৬৮ শব্দের এই দলিলে এসেছে ২১ বার ‘যেহেতু’ আর ৫ বার ‘সেহেতু’। বাকি দুবার সিদ্ধান্ত। বোঝা যায়, এটি লেখা হয়েছে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে পাঠ করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আলোকে। কাঠামোটা অবিকল এক, তবে বক্তব্য আলাদা। ২৮টি অনুচ্ছেদে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, তার সারমর্ম হলো:
১.
২. স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বিধৃত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার।
৩. ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন পদ্ধতি, এর কাঠামোগত দুর্বলতা ও অপপ্রয়োগের ফলে মুক্তিযুদ্ধের জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা।
৪. ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশে সিপাহি-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতির পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রবর্তন।
আরও পড়ুনজুলাই ঘোষণা, জুলাই সনদ এবং গণমাধ্যম০৩ জুলাই ২০২৫৫. সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ বছর ছাত্র-জনতার অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পুনর্বহাল।
৬. এক-এগারোর ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা, আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদের পথ খুলে যাওয়া।
৭. হাসিনার নেতৃত্বে একটি চরম গণবিরোধী, একনায়কতান্ত্রিক ও মানবাধিকার হরণকারী শক্তি দ্বারা বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিবাদী, মাফিয়া এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রের রূপ দেওয়া।
৮. জনসাধারণের তীব্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ থেকে পলায়ন।
৯. সুপ্রিম কোর্টের মতামতের আলোকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন।
১০. একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ গঠন ও প্রতিশ্রুত প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি–শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়।
আরও পড়ুনজুলাই অভ্যুত্থান যেসব কারণে পূর্বপরিকল্পিত নয়১২ জানুয়ারি ২০২৫শেষে বলা হয়েছে, এই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকবে এবং ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকার সংবিধানের তফসিলে এ ঘোষণাপত্র যুক্ত করবে। ঘোষণাপত্রে বর্তমান সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের নাম একবার এবং সাবেক সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার নাম একাধিকবার উল্লেখিত হয়েছে। এটা এড়ানো যেত। আমরা তো শুধু ব্যক্তির পরিবর্তন চাই না। আমরা চাই কাঠামোর পরিবর্তন। এ ধরনের ঘোষণাপত্র হতে হয় নৈর্ব্যক্তিক, যদি আমরা এটি বছরের পর বছর, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম প্রাসঙ্গিক রাখতে চাই।
ঘোষণাপত্র উত্থাপিত হওয়ার পরপর এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। রাজনৈতিক ঐকমত্যের ওপর জোর দেওয়া হলেও, রাজনৈতিক দলগুলো তো পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী, কখনো কখনো একে অপরের শত্রু। সবারই আছে নিজ দলের এজেন্ডা, ইতিহাস নিয়ে দলীয় বয়ান। ঘোষণাপত্রে এটা নেই কেন, ওটা নেই কেন, এ নিয়ে আহাজারি। অনেকেই বুঝতে চান না যে এ ধরনের ঘোষণাপত্র কোনো শ্বেতপত্র নয়।
আরও পড়ুনজুলাই গণ-অভ্যুত্থান: কোথায় ব্যর্থ, কোথায় সফল০১ জুলাই ২০২৫দ্বিতীয়ত, সংবিধানে ঢুকিয়ে দিলেই যে দেশে দুধ আর মধুর নহর বয়ে যাবে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক সুবিচার—এই শব্দগুলো জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু বাস্তবে দেশ হেঁটেছে উল্টো পথে। আমরা শব্দ নিয়ে মাতম করি, নিজেদের খাসলত বদলাই না।
ঘোষণাপত্রের শব্দচয়ন ও ভাষা দেখে দুটো কথা মনে জাগে। এক. আওয়ামী লীগ এখানে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ হয়ে গেছে। সমস্যা যে শুধু সাড়ে ১৫ বছরের নয়, এটা যে ৫৪ বছরের পুঞ্জীভূত জঞ্জাল, সেটি স্পষ্টভাবে উঠে আসেনি। দুই. সাংবিধানিক সংস্কার যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, রাজনৈতিক দলের সংস্কার ততটা গুরুত্ব পায়নি। রাজনৈতিক দলগুলো হচ্ছে পরিবর্তনের অনুঘটক। তারা যদি না বদলায়, রাজনীতির মানুষগুলোর আচরণ ও চরিত্র যদি না পাল্টায়, তাহলে সংবিধানে যত সুবচন থাকুক না কেন, অবস্থার হেরফের হবে না। গত ৫৪ বছরে আন্দোলন তো কম হলো না। আবার যে হবে না, তার কী নিশ্চয়তা আছে?
আমাদের দরকার একটি টেকসই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। এর জন্য সবার আগে বদলাতে হবে নিজেদেরই। মানুষ তাকিয়ে আছে রাজনীতিবিদদের দিকে। তারা আছে আশা-নিরাশার দোলাচলে।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব ধ নত ব যবস থ হয় ছ ল র একট বছর র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ওষুধের খরচ থেকে সুরক্ষা দিতে পারে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি
দেশের নগরগুলোর মাত্র ২২ শতাংশ শিশু টিকা পায়। শহরের বস্তির শিশুদের ২৪ শতাংশ খর্বকায়। কিছু ক্ষেত্রে শহরের হাসপাতালগুলোতে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ পাওয়া যায় না। ওষুধের খরচ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পৃথক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রণয়ন করা দরকার।
গতকাল সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘নগর স্বাস্থ্য ও বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে অর্থনীতিবিদ, জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য–গবেষকেরা এ কথা বলেছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট এবং বাংলাদেশ আরবান হেলথ নেটওয়ার্ক যৌথভাবে এ সংলাপের আয়োজন করে। এতে সহায়তা করে ইউনিসেফ ও সুইডিশ দূতাবাস।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান সাম্প্রতিক একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, দেশের ৫২ শতাংশ পরিবারে দীর্ঘস্থায়ী রোগের রোগী আছে। এসব পরিবারকে দীর্ঘদিন ওষুধ কিনে যেতে হবে। এ ধরনের পরিবারকে ওষুধের খরচ থেকে সুরক্ষা দিতে তিনি সামাজিক কর্মসূচি প্রবর্তনের সুপারিশ করেন। তিনি বলেন, অন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মতো স্বাস্থ্য খাতে নিরাপত্তা কর্মসূচি দরকার। এতে মানুষের ওষুধের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নসহ দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রে গতির ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ধীরগতিতে। এটা বিলাসিতার মতো। এই সময়ের চাহিদা হচ্ছে দ্রুতগতির। সেই চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ৪০ শতাংশ যে শূন্য পদ আছে, তাতে জনবল নিয়োগ দিলেই স্বাস্থ্য খাতে গতি আসবে। এর জন্য কোনো সংস্কারের প্রয়োজন নেই।
শহরে স্বাস্থ্যসেবা তত ভালো নয়অনুষ্ঠানে প্রথম উপস্থাপনায় এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম হায়দার তালুকদার বলেন, নগরস্বাস্থ্যের উন্নতিতে
ভারত, কেনিয়া ও থাইল্যান্ডে সাফল্য আছে। বাংলাদেশে নগরস্বাস্থ্যে ঘাটতি আছে। তিনি
বলেন, দেশের নগর ও শহরের ৬৬ শতাংশ শিশু আরোগ্য সেবা পায়, গ্রামে পায় ৯৫ শতাংশ শিশু। গ্রামের ৯৩ শতাংশ শিশু টিকা পায়, শহরে পায় মাত্র ২২ শতাংশ শিশু। অন্যদিকে গ্রামের ৮৩ শতাংশ শিশু পরিবার পরিকল্পনা সেবার আওতায়, শহরে তা মাত্র ৩৯ শতাংশ।
দ্বিতীয় উপস্থাপনায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য আহমেদ এহসানূর রহমান বলেন, দেশের বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্য খারাপ, কোনো কোনো সূচকে তা গ্রামের মানুষের চেয়েও খারাপ। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, সর্বশেষ জাতীয় জরিপ অনুযায়ী পাঁচ বছরের কম বয়সী গ্রামের ২২ শতাংশ শিশুর উচ্চতা বয়সের তুলনায় কম। শহরের বস্তিতে তা ৩৪ শতাংশ।
শহরের হাসপাতালগুলোতে ওষুধের প্রাপ্যতা নিয়ে তথ্য উপস্থাপনের সময় আহমেদ এহসানূর রহমান বলেন, সর্বশেষ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান জরিপে ২৭ শতাংশ জেলা হাসপাতালে মায়ের জীবন রক্ষায় ব্যবহৃত ওষুধ অক্সিটসিন পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে শিশুদের নিউমোনিয়া চিকিৎসায় এমোক্সিসিলিন পাওয়া গিয়েছিল শহরের ৩৯ শতাংশ হাসপাতালে এবং গ্রামের ৯৫ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
শামীম হায়দার তালুকদার ও আহমেদ এহসানূর রহমানের উপস্থাপনায় বোঝানের চেষ্টা হয় যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের কিছু সূচকে শহরের পরিস্থিতি খারাপ। কিছু সূচকে গ্রামের চেয়ে শহরের বস্তির অবস্থা বেশ খারাপ।
স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানোর দাবি জানিয়ে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের সভাপতি অধ্যাপক সায়েবা আক্তার বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছি না। এটা দুঃখজনক।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক পুষ্টিবিশেষজ্ঞ জিয়াউদ্দীন হায়দার বলেন, দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য একক স্বাস্থ্য কার্ড প্রবর্তনের কথা চিন্তা করছে বিএনপি।
মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বেশ কয়েকজন বক্তা অভিযোগ করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বোঝাপড়ার ঘাটতি থাকার কারণে শহর এলাকায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি খারাপ। কেউ বলেন, ক্লিনিক্যাল মাইন্ড সেট দিয়ে জনস্বাস্থ্য সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। কেউ বলেন, শহরে স্বাস্থ্যসেবার পুরো কর্তৃত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকা উচিত। আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে বাদ দিয়ে নগরে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব নয়।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল অনুষদের ডিন শাখাওয়াত হোসেন, সুইডিশ দূতাবাসের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা জহিরুল ইসলাম এবং স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক সৈয়দ আকরাম হোসেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নাগরিক সংগঠন সুস্বাস্থ্যের বাংলাদেশের আহ্বায়ক কাজী
সাইফুদ্দিন বেননূর।