পাঁচ ব্যাংক একীভূতকরণ: বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বিএসইসির চি
Published: 12th, October 2025 GMT
দুর্বল ও তারল্য সঙ্কটে ভুগতে থাকা পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। যেখানে আমানতকারীদের সম্পূর্ণ সুরক্ষার কথা বলা হলেও ব্যাংকগুলোর শেয়ারহোল্ডার সাধারণ বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এ কারণে পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
গত সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে এ বিষয়ে একটি চিঠি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ অনুযায়ী, একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না। নতুন ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে। তবে সেখানে ওই পাঁচ ব্যাংকের বিনিয়োগকারীদের কোনো শেয়ার থাকবে না। এসব ব্যাংকের শেয়ার নতুন করে ইস্যু করা হবে।
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকের বর্তমান অবস্থার জন্য সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দায় নেই। এ জন্য দায়ী ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তা ও পরিচালকেরা এবং তারা চিহ্নিত। তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা দরকার বলে তারা মনে করছেন। তারা বলছেন, যেহেতু এখানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দায় নেই, তাহলে তাদের শেয়ার কেন বাজেয়াপ্ত করা হবে? এ কারণে পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণ বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি। তাদের দাবি, সরকার ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের সুরক্ষার বিষয়টি যেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখছে, একই রকমভাবে শেয়ারহোল্ডারদের বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত।
এদিকে পাঁচটি দুর্বল শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক একীভূত করার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে সমস্যাগ্রস্ত থাকা নয়টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ১৪টি প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। অর্থাৎ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এর সঙ্গে যুক্ত। তবে পাঁচ ব্যাংক একীভূত করা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে পরামর্শ করেনি। উল্লেখ্য, ব্যাংক একীভূতকরণ বাস্তবায়নের জন্য অর্থমন্ত্রণালয়ের ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস ডিভিশন (এফআইডি) আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। সেখানেও বিএসইসি’র প্রতিনিধি নেই। এমনকি সংশ্লিষ্ট তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য পায়নি। তারা শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগকারীদের জানাতে মূল্যসংবেদনশীল তথ্য প্রকাশের সুযোগও পায়নি। ফলে, লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এখনো জানেন না তাদের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ কী?
গভর্নরকে দেওয়া চিঠিতে বিএসইসি জানিয়েছে, একীভূত করতে যাওয়া পাঁচটি ব্যাংক; ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি এবং এক্সিম ব্যাংক পিএলসির বর্তমান এই অবস্থার জন্য কোনোভাবেই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা দায়ী নন। ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ-২০২৫ এর ধারা-৭৭ এ বর্ণিত দায়ী ব্যক্তিগণ ব্যাংকগুলোর এই অবস্থার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী, যা বাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশে স্বীকৃত। উক্ত পাঁচটি ব্যাংকের একীভূতকরণের ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সংরক্ষণে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করার কথা জানিয়েছে বিএসইসি।
১.
২. ব্যাংকগুলোর ব্যালেন্স শিটে প্রদর্শিত সম্পদ মূল্যায়নের পাশাপাশি ব্যাংক প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে সংরক্ষিত জামানত এবং দায়ী ব্যক্তিপণের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে আদায়যোগ্য অর্থ বিবেচনায় নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ নির্ধারণ করা।
৩. ধারা-৭৭ এ বর্ধিত দায়ী ব্যক্তিগণ কর্তৃক ধারণকৃত শেয়ার ব্যাতীত অন্যান্য সাধারণ শেয়ারহোল্ডারগণ বা সাধারণ বিনিয়োগকারী কর্তৃক বিনিয়োগকৃত অর্থ সাধারণ বিনিয়োগকারীর ন্যূনতম স্বার্থ মূল্য বিবেচনা করে একীভূতকরণের অনুপাত নির্ধারণ করা।
৪. উপরিউক্ত মূল্যায়ন বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংক পাঁচটির সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ মূল্য অনুপাতে ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা। এবং ব্যাংকগুলোতে সাধারণ বিনিয়োগকারীর স্বার্থ মূল্য অনুপাত নির্ধারণ ও তা ঘোষণা না করে অথবা সাধারণ বিনিয়োগকারী কর্তৃক ধারণকৃত শেয়ারের এক্যুইজেশন মূল্য নির্ধারণ এবং তা ঘোষণা না করে স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে তালিকাচ্যুত না করার কথাও গভর্নরকে দেওয়া চিঠিতে বিএসইসি জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে শরিয়াহভিত্তিক এই পাঁচটি ব্যাংক চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ব্যাংকগুলোর ঋণের বেশিরভাগই খেলাপি হয়ে থাকায় গ্রাহক আমানত ফেরত পাচ্ছেন না। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরই ধরাবাহিকতায় ব্যাংক খাতে সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা, জবাবদিহি নিশ্চিতকরণসহ সামগ্রিক আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করে একটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ। গত ৯ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এর নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। নতুন এ ব্যাংকের দুটি নাম প্রস্তাব করা হয়েছে- ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ ও ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’। ব্যাংকটি বাণিজ্যিকভাবে ও পেশাদারির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে বলেও জানানো হয়েছে।
একীভূত করার ফলে কেউ চাকরি হারাবেন না এবং কোনো আমানতকারী আমানত হারাবেন না। প্রাথমিকভাবে নতুন ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা ও পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। পাঁচ ব্যাংকের সব দায় ও সম্পত্তি গ্রহণ করে নতুন ব্যাংকটি তার কার্যক্রম পরিচালনা করবে। পরিশোধিত মূলধনের মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা সরকার দেবে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে নগদ, বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা সুকুক বন্ড ছাড়ার মাধ্যমে সংগ্রহ করা হবে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের শেয়ার দিয়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা মূলধনে রূপান্তর করা হবে বেইল-ইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। পরে আবার রেজল্যুশন পরিকল্পনা অনুযায়ী তা পরিশোধ করা হবে আমানতকারীদের। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমানতকারী ও অন্যান্য পাওনাদারের ঋণের একাংশ বাতিল হয়ে শেয়ারে রূপান্তরিত হয়, সেটাই হচ্ছে বেইল-ইন। নতুন ব্যাংকটি প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন হবে। পরে পর্যায়ক্রমে মালিকানা বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হবে। নতুন ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে।
এছাড়া ইসলামি ধারার যে পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলোতে শিগগিরিই প্রশাসক বসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা একীভূত প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবেন। প্রশাসক হিসেবে এক্সিম ব্যাংকের দায়িত্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. শওকত উল আলম, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বে নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ বদিউল আলম দিদা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বে মো. সালাহ উদ্দীন ইউনিয়ন ব্যাংকের দায়িত্বে পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হাসেম ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বে মকসুদুল আলমকে নিযুক্ত করা হবে। তাদের সহায়তা করার জন্য প্রত্যেক ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও চারজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। এর মাধ্যমে পাঁচ ব্যাংক মিলে ইসলামি ধারার একটি ব্যাংক গড়ে উঠবে। চলতি সপ্তাহের মধ্যে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের আলোকে প্রতিটি ব্যাংকে প্রশাসকদের দায়িত্ব নেওয়ার কথা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “পাঁচটি বেসরকারি ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অধিকার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। একজন সাধারণ শেয়ায়হোল্ডারের যত ধরনের অধিকার পাওয়ার বিষয়টি আইনে বলা হয়েছে তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে বলা হয়েছে।”
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান ও পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার দরকার ছিল। ব্যাংকগুলোকে পরিচালনা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। তারপরেও ব্যাংকগুলো ঠিক মতো পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি এবং তাদের সংকটও কাটেনি। চোর-বাটপাররা আমনতকারীদের টাকা নিয়ে গেছে, তাই সরকার ব্যাংকগুলোর দায়িত্ব নিয়েছে। আমি তো মনে করি, ব্যাংকগুলোর আমানতকারীরা ভাগ্যবান। ব্যাংকগুলোর নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি) পজিটিভ থাকলে শেয়ারহোল্ডাররা কিছু পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। তবে এনএভি নেতিবাচক থাকলে কিছুই পাওয়ার কথা না। তারপরেও, সরকার চাইলে সাধারণ বা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কথা বিবেচনা করতে পারে। কারণ ব্যাংকগুলোর এমন পরিণতির জন্য আমানতকারী ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের দোষ দেওয়া যাবে না।”
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্যানুযায়ী, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের (এসআইবিএল) প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৬৯.২০ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.৮৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৭.৯২ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৫২.৯৬ শতাংশ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩১.৬১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২৮.৬২ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.২৭ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৬৫.১৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। এক্সিম ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ২৭.৬৫ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.৬৩ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩৯.২৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ইউনিয়ন ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ১৩.৬৯ শতাংশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে ০.০১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩১.৮১ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
ঢাকা/এনটি/তারা
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর য় রহ ল ড র শ য় রহ ল ড স ক উর ট নত ন ব য ল ইসল ম ক প এলস ব এসইস স রক ষ র জন য পর চ ল ম লধন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
মহড়াসহ সব প্রস্তুতি নেওয়া হলো, কিন্তু ‘দরিয়া–ই–নূর’ হীরার প্যাকেট খোলা হলো না
এবারও আটকে গেছে সোনালী ব্যাংকের ভল্টে থাকা ঢাকার নবাব পরিবারের ‘দরিয়া–ই–নূর’ হীরার প্যাকেট খোলার উদ্যোগ। হীরা যাচাইয়ে গঠিত কমিটির চলতি সপ্তাহে সোনালী ব্যাংকের ভল্ট পরিদর্শন করার কথা থাকলেও তা স্থগিত করা হয়েছে। তবে কী কারণে স্থগিত করা হলো, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কমিটির সদস্যরা। এতে হীরা থাকা না থাকা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে সংশয় চলে আসছে, তা আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
ভূমি সংস্কার বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ১১ অক্টোবর (রোববার) মন্ত্রিপরিষদ সচিব আব্দুর রশীদের নেতৃত্বে গঠিত একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটির সোনালী ব্যাংকের ভল্টে থাকা দারিয়া-ই-নূর পরিদর্শন এবং উন্মুক্তকরণে যাওয়ার কথা ছিল। তবে কোনো কারণ না জানিয়েই ৯ অক্টোবর এই কার্যক্রম স্থগিত করে ভূমি সংস্কার বোর্ড। কী কারণে স্থগিত করা হয়েছে জানতে চাইলে ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান এ জে এম সালাহউদ্দীন নাগরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারণ আমি ঠিক বলতে পারব না। এটা ওপর থেকে ডিসিশন (সিদ্ধান্ত) হয়েছে।’ কোনো আইনগত জটিলতা রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনগত কোনো জটিলতা নেই।
১১৭ বছর ধরে অন্ধকার কুঠুরিতে পড়ে আছে ঢাকার নবাব পরিবারের ১০৯ ধরনের রত্ন। ব্রিটিশ ভারতে যার মূল্য ধরা হয়েছিল ১০ লাখ ৯ হাজার ৮৩৫ টাকা। তবে ১৯০৮ সালের পর থেকে ‘কোহিনূর হীরার আত্মীয়’ হিসেবে খ্যাত দরিয়া-ই-নূর হীরার অবস্থান এক রহস্যের জালে বন্দী। সরকারি নথি অনুযায়ী, দরিয়া-ই-নূরের বর্তমান অবস্থান হওয়ার কথা সোনালী ব্যাংকের ভল্ট। তবে বাস্তবে এর অস্তিত্ব নিয়ে আছে ঘোর অনিশ্চয়তা। ভল্টে হীরা আছে কি না, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা। হীরা পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি সরকারের ভূমি সংস্কার বোর্ডও। এ নিয়ে চলতি বছরের ১২ মে একটি সংবাদ প্রকাশ করে প্রথম আলো। এরপর ২৬ মে দরিয়া-ই-নূরসহ নবাব পরিবারের মোট ১০৯ ধরনের রত্নালংকার উন্মুক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সভাপতি করে গঠিত কমিটির তথ্য জানিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন শাখা। কমিটির সদস্যসচিব করা হয় ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যানকে। কমিটির বাকি ৯ সদস্য হলেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নর, জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক, সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও একজন রত্নবিশেষজ্ঞ।
কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কমিটি ঢাকা নওয়াব এস্টেটের অস্থাবর সম্পত্তি দরিয়া-ই-নূরসহ ১০৯ ধরনের রত্নের তালিকা তৈরি করবে এবং সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত যত্নসহকারে রক্ষণাবেক্ষণের নির্দেশনা দেবে।
এরপর বেশ কয়েক মাস কমিটির কোনো কার্যক্রম না থাকলেও সম্প্রতি তারা দুটি বৈঠক করে। বৈঠকের পর কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, তারা প্যাকেটটি খুলে দেখবে এবং জাতির সামনে সত্য প্রকাশ করা হবে। ১১ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে হীরার প্যাকেট উন্মুক্ত করার তারিখ নির্ধারণ করা হয়। রত্নবিশেষজ্ঞ হিসেবে ফাহাদ কামাল নামে একজনকে কমিটিতে যুক্ত করা হয়।
কমিটির একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, যেহেতু এটি স্পর্শকাতর এবং ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া, তাই ৫ অক্টোবর সোনালী ব্যাংকে ছয় সদস্যের একটি উপকমিটি মহড়া চালায়, যাতে মূল পরিদর্শনের সময় কোনো গাফিলতি না হয়। সূত্র আরও জানায়, পুরো প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য পুরো প্রক্রিয়াটি ক্যামেরায় রেকর্ড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে না। আর গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে শুধু বিটিভিকে রাখা হবে এবং অন্য গণমাধ্যমগুলোকে পরবর্তী সময়ে ব্রিফ করা হবে।
আরও পড়ুনঢাকার নবাবদের ‘দরিয়া-ই-নূর’ হীরা কি সোনালী ব্যাংকের ভল্টে আছে১২ মে ২০২৫তবে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হলেও গত বৃহস্পতিবার ভূমি সংস্কার বোর্ডের এক চিঠির মাধ্যমে হঠাৎ সেই কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘আগামী ১১ অক্টোবর ২০২৫ খ্রি. তারিখে কোর্ট অব ওয়ার্ডস ঢাকা নওয়াব এস্টেটের অস্থাবর সম্পত্তি দরিয়া-ই-নূর ও অন্যান্য মূল্যবান গয়নাসামগ্রীর সেফ ডিপোজিটসমূহ উন্মুক্তকরণ কার্যক্রম অনিবার্য কারণবশত নির্দেশক্রম স্থগিত করা হলো।’
জানতে চাইলে ওই কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিবের ওই দিন উপস্থিত থাকার কথা ছিল। তবে তাঁর হঠাৎ ব্যস্ততার কারণে ওই তারিখে কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে হীরা যাচাই কমিটির সভাপতি মন্ত্রিপরিষদ সচিব আব্দুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কয়েকজন সদস্য ঢাকার বাইরে মিটিংয়ে গিয়েছিলেন বলে ওটা স্থগিত করা হয়েছে।’ দ্রুত পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আরও পড়ুন'দরিয়া-এ নূর' ও নবাব সলিমুল্লাহর দেনার দায়২৯ জানুয়ারি ২০১৮