ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে প্রায়ই তরুণদের দেখা যায় সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে ভুগতে। ফলে অনেক সময় যথেষ্ট মেধা, আগ্রহ ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা ক্যারিয়ারে ভালো করতে পারেন না। তরুণদের সঠিক দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা জোগাতে প্রথম আলো ডটকম ও প্রাইম ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত পডকাস্ট শো: লিগ্যাসি উইথ এমআরএইচ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হকের সঞ্চালনায় ষষ্ঠ পর্বে অতিথি হিসেবে অংশ নেন ওরাকলের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর রুবাবা দৌলা। আলোচনার বিষয় ছিল ‘উদ্দেশ্যনির্ভর ক্যারিয়ার গঠন, নেতৃত্ব ও রূপান্তর’।

‘নীতিবোধ আর মূল্যবোধ নড়বড়ে হলে চলবে না। এই দুটি সব সময় শক্ত রাখতে হবে। যখন আপনার নীতিবোধ আর মূল্যবোধ শক্ত থাকবে, তখন আপনাকে কেউ থামাতে পারবে না।’ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তরুণদের উদ্দেশে এ পরামর্শ দেন রুবাবা দৌলা। পডকাস্ট শোর এবারের পর্বটি গত শনিবার প্রথম আলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রচার হয়।

সঞ্চালক মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হক পডকাস্টের শুরুতেই জানতে চান, পড়াশোনা শেষ করার পর আপনার ক্যারিয়ার ভাবনা ঠিক কেমন ছিল?

উত্তরে রুবাবা দৌলা বলেন, ‘আমার বাবা আমাকে বলতেন, তোমাকে ইনডিপেনডেন্ট হতে হবে। এটি আমার মাথায় সব সময় ছিল। আমি পড়াশোনা করেছি মার্কেটিং নিয়ে। পড়াশোনা শেষ করে ভেবেছি ইনডিপেনডেন্ট হতে হলে আমার নিজের ক্যারিয়ার নিজেকেই শুরু করতে হবে। আর এমন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হবে, যেখানে আমি যা শিখেছি, তা কাজে লাগাতে পারব। সেই ভাবনা থেকে টেলিকম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ শুরু করি।’

প্রসঙ্গক্রমে মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হক জানতে চান, ‘আপনি যখন টেলিকম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ শুরু করেন, এই ইন্ডাস্ট্রি ছিল একেবারেই নতুন। তখন কি ভেবেছিলেন এই ইন্ডাস্ট্রিতে একদিন এমন বিপ্লব ঘটবে?’

রুবাবা দৌলা বলেন, ‘আমি ১৯৯৮ সালে গ্রামীণফোনে যোগ দিয়েছিলাম। সে সময়ে টেলিযোগাযোগব্যবস্থা নিয়ে আমাদের কারোরই তেমন কোনো ধারণা ছিল না। তখন মুঠোফোন একটি বিলাসসামগ্রীই ছিল। গুটিকয় মানুষের হাতে মুঠোফোন ছিল। এগুলো ছিল সব পোস্টপেইড।’ তিনি বলেন, ‘আমরা কেউই জানতাম না এই ইন্ডাস্ট্রি কোন দিকে যাবে। কিন্তু আমার নতুন কিছু করার এবং নতুন কিছুর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা ছিল। সেখান থেকেই মূলত আমি গ্রামীণফোনের সঙ্গে কাজ শুরু করি। তবে আমরা চেয়েছিলাম পুরো দেশের যোগাযোগব্যবস্থাকে সহজ করতে। এটিই তখন আমাদের মূল উদ্দ্যেশ্য ছিল।’

গ্রামীণফোনে মার্কেট রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে কাজ করতেন উল্লেখ করে রুবাবা দৌলা বলেন, ‘গ্রাহকদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে আমাকে বস্তি থেকে শুরু করে মাঠে–ঘাটে সব জায়গায় যেতে হয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ কীভাবে বাড়ানো যায়। সেই সঙ্গে আমাদের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, তা হলো সবার মধ্যে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেমন একজন কৃষক যা উৎপাদন করছেন, সেই সময়ে তাঁর ধারণাই থাকত না, এই পণ্য আসলে তাঁর হাত থেকে নিয়ে পরবর্তী সময়ে ঠিক কত দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে বেশির ভাগ সময় তাঁদের ঠকে যেতে হতো। আমরা চেয়েছি প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত সবার কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে।’

মাঠে-ঘাটে গিয়ে কাজ করার এই উদ্যম কীভাবে এল? সঞ্চালক জানতে চাইলে রুবাবা দৌলা বলেন, ‘গ্রাহকদের বুঝতে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, গ্রাহকেরা কী চাচ্ছেন, সে অনুযায়ীই আমাদের প্রোডাক্ট ডিজাইন করতে হয়। যেমন সে সময়ে শুধু পোস্টপেইড সেবা চালু ছিল। মাস শেষে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজারের মতো টাকা গ্রাহকদের দিতে হতো।’ তিনি বলেন, ‘মার্কেট রিসার্চ করেই আমরা বুঝি, এটি স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য একেবারেই সামর্থ্যের বাইরে। এরপরেই আমরা স্ক্র্যাচ কার্ড সেবা চালু করি। এতে সবাই নিজের সামর্থ্যের মধ্যেই টেলিযোগাযোগব্যবস্থার সুবিধা নিতে পারে।’

রুবাবা দৌলা যখন গ্রামীণফোনে কাজ শুরু করেন, সে সময়ে করপোরেট জগতে নারীদের অংশগ্রহণ খুবই কম ছিল। মোহাম্মদ রিদওয়ানুল হক জানতে চান, নারী হিসেবে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তাঁকে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে কি না?

উত্তরে রুবাবা দৌলা বলেন, ‘নারী হওয়ার জন্য আমাকে কখনোই কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়নি। এ ব্যাপারে আমি খুবই ভাগ্যবান ছিলাম বলে মনে করি। আর আমি শুধুই কাজের দিকেই মনোনিবেশ করেছিলাম, তা বাদে আর কিছু নিয়ে তেমন একটা মাথা কখনোই ঘামাইনি।’

গ্রামীণফোনের পরে আপনি রবিতে যোগ দেন। এই দুটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, এগুলো ‘ওরাকল’-এ যোগ দেওয়ার পর কীভাবে কাজে লেগেছে?

সঞ্চালকের এমন প্রশ্নের উত্তরে রুবাবা দৌলা বলেন, ‘এখন আমি ওরাকলে যে কাজ করছি কিংবা যে পদে আছি, সেখান পর্যন্ত আসতে আমার আগের প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের অভিজ্ঞতা খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। শুধু অভিজ্ঞতা নয়, ব্যর্থতা থেকেও আমি জীবনে অনেক কিছুই শিখেছি। যেগুলো পরবর্তী সময়ে অনেক কাজে লেগেছে।’

আপনি ওরাকলের বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে আছেন। টেক সেক্টরে বাংলাদেশের বাজার ঠিক কেমন?

এ প্রসঙ্গে রুবাবা দৌলা বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশ একটি ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের টেক সেক্টর দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে।’

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন অনেক বড় একটি বিষয়। এটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন? সঞ্চালক জানতে চাইলে রুবাবা দৌলা বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন আর ফিউচারিস্টিক কোনো বিষয় নয়, এটি এখন সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে এখন শুধু প্রযুক্তি হিসেবে দেখলেই হবে না, এটি মানসিকতার পরিবর্তন। তিনি বলেন, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের ব্যবসা, প্রতিযোগিতা ও চিন্তার ধরন বদলে দিচ্ছে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ডেটা। তাই ডেটা গভর্ন্যান্স ও ম্যানেজমেন্ট এখন খুবই জরুরি।’

আলোচনার শেষ পর্যায়ে পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশে রুবাবা দৌলা বলেন, ‘প্রথমত, জীবনে বড় কিছু করতে হলে অবশ্যই বড় ঝুঁকি নিতে জানতে হবে। দ্বিতীয়ত, শেখার প্রক্রিয়াকে চলমান রাখতে হবে। জীবনে যত ডিগ্রিই অর্জন করেন না কেন, নতুন কিছু শেখা বন্ধ করা যাবে না। চারপাশে কী হচ্ছে, নতুন কী ঘটছে, এগুলো সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে। আরেকটি জিনিস হলো, আমাদের মূল্যবোধ আর নৈতিকতা সব সময় শক্ত রাখতে হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক ত র ম ব দ ধ মত ত ইন ড স ট র নত ন ক উদ দ শ আম দ র ক জ কর গ র হক ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

সম্পদ ও সন্তান লাভের জন্য প্রার্থনা

জীবনের এমন অনেক মুহূর্ত আসে যখন মনে হয়, সবকিছু যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। আয়ের উৎস শুকিয়ে যাওয়া, পরিবারের উদ্বেগ বাড়তে থাকা বা জীবনে বরকতের অভাব—এসব চাপে মানুষের মন ভারী হয়ে ওঠে। ইসলামে এমন সময়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

এমন একটি দোয়া মহানবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর সেবক আনাস ইবনে মালিক (রা.)-এর জন্য করেছিলেন। এই দোয়া শুধু ধন-সম্পদ ও সন্তানের বৃদ্ধি চায় না, বরং সবকিছুতে আল্লাহর বরকত কামনা করে।

দোয়ার উৎস ও প্রেক্ষাপট

হাদিসে বর্ণিত, আনাস (রা.)-এর মা উম্মে সুলাইম নবীজিকে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনার এই সেবক আনাসের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।’ তখন নবীজি (সা.) দোয়া করেন: ‘আল্লাহুম্মা আকসির মালাহু ওয়া ওয়ালাদাহু, ওয়া বারিক লাহু ফীমা আ'তাইতাহু।’

এই দোয়ার ফলাফল অবিশ্বাস্য: আনাস (রা.) ১০৩ বছর বেঁচে ছিলেন এবং পৌত্রাদি মিলিয়ে তিনি ১২০-এরও বেশি সন্তান লাভ করেন। তাঁর জীবন ছিল বরকতের জীবন্ত উদাহরণ।আরও পড়ুনতাকওয়া মুমিনের সবচেয়ে বড় সম্পদ৩০ জুন ২০২৫

অর্থাৎ, হে আল্লাহ! তার ধন-সম্পদ ও সন্তান বাড়িয়ে দাও এবং তুমি যা দান করেছ, তাতে তার জন্য বরকত দান করো। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৩৪৪)

আনাস (রা.) তখন মাত্র দশ বছরের একটি ছেলে, যিনি নবী (সা.)-এর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। এই দোয়ার ফলাফল অবিশ্বাস্য: আনাস (রা.) ১০৩ বছর বেঁচে ছিলেন এবং তাঁর তিনি পৌত্রাদি মিলিয়ে ১২০-এরও বেশি সন্তান লাভ করেন (সহিহ মুসলিম থেকে বর্ণিত)। তাঁর জীবন ছিল বরকতের জীবন্ত উদাহরণ।

দোয়ার উদ্দেশ্য শুধু ধন নয়, বরকত

এই দোয়ার সৌন্দর্য এতে যে এটি ধন-সম্পদের পাশাপাশি বরকতের জন্য প্রার্থনা করে। ইসলামে ধনকে শুধু সঞ্চয় নয়, বরং আল্লাহর নেয়ামত হিসেবে দেখা হয়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘ধন বেড়ে গেলেও যদি বরকত না থাকে, তাহলে তা ধুলোর মতো উড়ে যায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৪৩৯)

আরও পড়ুনসন্তান প্রতিপালনে ধর্মের দাবি১৯ মে ২০২৫ধন বেড়ে গেলেও যদি বরকত না থাকে, তাহলে তা ধুলোর মতো উড়ে যায়।’সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৪৩৯

আধুনিক জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা আরও বেশি। অর্থনৈতিক সংকট, চাকরির অনিশ্চয়তা বা পরিবারের চাপে অনেকে কষ্ট পান। কিন্তু এই দোয়া স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সত্যিকারের সমৃদ্ধি আল্লাহর রহমতে। সন্তানের ক্ষেত্রেও তাই—সন্তান লাভের সঙ্গে তাদের সুস্থতা, শান্তি ও ইমানের বরকত চাওয়া জরুরি।

আজকের দিনে, যখন পরিবারের আকার ছোট হচ্ছে এবং অর্থের চাপ বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধর্মীয় অনুশীলন (যেমন দোয়া) মানসিক চাপ কমায় এবং জীবনে ইতিবাচকতা বাড়ায়। ইসলামি ঐতিহ্যে এই দোয়া শুধু ব্যক্তিগত নয়, পরিবারের জন্যও ব্যবহার করা যায়।

দোয়ার সঙ্গে সদকা দেওয়া, কোরআন তিলাওয়াত এবং হালাল উপার্জনের চেষ্টা করুন—এগুলো বরকতের দরজা খোলে।

আরও পড়ুনসন্তান প্রতিপালনে মহানবী (সা.)-এর ১০টি নির্দেশনা২০ আগস্ট ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ