আশির দশকের শেষ দিকে ঢাকার উত্তর শাহজাহানপুরে থাকতাম। কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান থাকতেন রাজারবাগের উত্তর পাশে, ১ মোমেনবাগে। আমি কাজ করতাম সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। অফিস ছিল মতিঝিলে দৈনিক বাংলা ভবনে। শওকত ওসমান আসতেন বিচিত্রায়। তখনকার তরুণ কথাশিল্পী মঈনুল আহসান সাবেরের লেখা পছন্দ করতেন তিনি। বিচিত্রা অফিসে এলে সাবেরের টেবিলে বসতেন
শওকত ওসমান।
প্রায়ই বিকেলে দেখতাম, রাজারবাগের আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন শওকত ওসমান। অনেক দিন তাঁকে পেয়েছি এলিফ্যান্ট রোডে শহীদজননী জাহানারা ইমামের বাসায়। সেখানে নানা বিষয়ে তাঁরা আলাপ করতেন।
দেশভাগের আগের বছর, ১৯৪৬ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় শওকত ওসমানের প্রথম উপন্যাস বণী আদম ছাপা হয়েছিল। সেটিই ছিল সম্ভবত কোনো বাংলা দৈনিকের প্রথম ঈদসংখ্যা। আজাদ বেরোত কলকাতা থেকে। পত্রিকাটির জন্য উপন্যাসটির অলংকরণ করেছিলেন শিল্পী জয়নুল আবেদিন। গত শতকের আশির দশকের শেষ দিকে শওকত ওসমান আজাদ–এর সেই পুরোনো ঈদসংখ্যাটি খুঁজে পান, তখন পত্রিকাটির জীর্ণদশা। তিনি একদিন আমাকে বিচিত্রার জন্য অলংকরণের কাজ করতে দেখে বললেন, ‘বাহে, আমি তোমাকে জয়নুলের ইলাস্ট্রেশনের কাজ এনে দেখাব।’
এরপর শওকত ওসমান সত্যি সত্যিই একদিন আমার বাসায় পলিথিনে প্যাঁচানো পত্রিকাটি নিয়ে এলেন। অনেক পুরোনো একটি পত্রিকায় অসাধারণ ইলাস্ট্রেশনের কাজ। আমার মনে হলো, এটা আমার সম্পাদক বিচিত্রার শাহাদত চৌধুরীকে দেখানো উচিত। দেখার পর শাহাদত চৌধুরী বললেন, ‘আরে, এটার তো একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে।’ সেই মূল্য বিবেচনায়ই বিচিত্রার পরবর্তী ঈদসংখ্যায় একটি বিশেষ ভূমিকা এবং জয়নুল আবেদিনের করা সেই অলংকরণগুলোসহ পুরো বণী আদম উপন্যাসটি ছাপা হয়।
১৯৯৬ সালে আমি জনকণ্ঠ পত্রিকার চিত্রশিল্পী। সাহিত্য সাময়িকীতে শওকত ওসমান লিখছেন ধারাবাহিক উপন্যাস রাহনামা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখছেন খোয়াবনামা, শওকত আলী লিখছেন দলিল। দলিল ইলাস্ট্রেশন করতেন উত্তম সেন।
আমি ছবি আঁকছি খোয়াবনামা ও রাহনামার। প্রায়ই লেখা নিয়ে আসতেন এই তিন লেখক। বসতেন ফিচার সম্পাদক এখলাস ভাইয়ের (এখলাসউদ্দিন আহমদ) কক্ষে। পাশেই একটি টেবিলে গাদাগাদি করে বসতাম আমরা চারজন—শাকিল রিয়াজ, ইমতিয়ার শামীম, উত্তম সেন ও আমি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত ওসমান ও শওকত আলী স্যাররা এলে আমরা গিয়ে দেখা করতাম।
তিনজনকে অনেকবার দেখেছি এখলাস ভাইয়ের সামনে। রাজনৈতিক মতভেদের কারণেই কি না জানি না, কুশলবিনিময়ের পর তাঁদের কথাবার্তা বেশি দূর এগোত না। শওকত ওসমান উঠে চলে যেতেন।
জীবনের শেষের দিকে শওকত ওসমান একা থাকতেন তাঁর বাসার নিচতলার একটি কক্ষে। নিজে রান্না করে খেতেন। তাঁর শরীর খারাপ তখন। শওকত ভাইয়ের জনকণ্ঠ পত্রিকায় লেখার সম্মানী নিয়ে গেছি তাঁর বাসায়। কখনো লেখা আনতে গেছি। একবার গিয়ে দেখি, তিনি মাছ কাটছেন।
কলকাতার প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষ পদ্মা নদীর মাঝির শুটিং করতে এলেন। তিনি দেখা করতে চাইছিলেন শওকত ওসমানের সঙ্গে। গৌতম ঘোষের বাবার বন্ধু ছিলেন শওকত ওসমান। কথাটা তাঁর বাসায় গিয়ে জানালাম। তিনি বললেন, ‘বাসায় অসুবিধা আছে, আমি গিয়ে গৌতমের সঙ্গে দেখা করব।’
গৌতমদা এ কথা শুনে বললেন, ‘উনি কেন আসবেন, আমি যাব।’
আমি ও অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ সমস্যাটা বললাম গৌতম ঘোষকে। পরে শওকত ওসমানকে শাহজাহানপুরে হোটেল আশরাফিতে গৌতম ঘোষের কাছে নিয়ে যাই। সেখানে পদ্মা নদীর মাঝির শুটিং ইউনিট উঠেছে। দেখা হলো দুজনের। শওকত ওসমানের প্রতি গৌতম ঘোষের ভক্তি আমাকে আপ্লুত করল।
সকালে মাঝেমধ্যেই আমার বাসায় আসতেন শওকত ভাই। ‘ভ্রাত মাসুক, বাসায় আছ তো? তোমার তো চায়ের ব্যবস্থা আছে। করো তো, একটু চা করো। আড্ডা দেব। আফলাতুনকে আসতে বলো।’
আমার বাসার পাশে থাকতেন দৈনিক বাংলার ‘সাত ভাই চম্পা’র সম্পাদক বিখ্যাত আফলাতুন ভাই। তাঁকে খবর দিলে আসতেন। বেশিক্ষণ বসতে চাইতেন না শওকত ওসমান। বলতেন, ‘বাহে মাসুক, তোমার কাজের অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
২৭ বছর হলো প্রয়াত হয়েছেন শওকত ওসমান। আমার দরজায় আর ঠকঠক করে বলবেন না, ‘বাহে আছ, দরজাটা খোলো।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: উপন য স ঈদস খ য বলল ন আসত ন
এছাড়াও পড়ুন:
এ বছর লতিফুর রহমান পুরস্কার পেলেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন
প্রথম আলোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মিডিয়াস্টার লিমিটেড ও ট্রান্সকম গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নামে চালু করা বর্ষসেরা সাংবাদিকতার পুরস্কার এ বছর পেয়েছেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন।
প্রথম আলোর ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আজ শনিবার রাজধানীর পাঁচ তারকা র্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেলে আয়োজিত সুধী সমাবেশে সাংবাদিক শওকত হোসেনের হাতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। নানা শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজনদের নিয়ে চলছে এই অনুষ্ঠান। সেখানে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা, ক্রেস্ট ও সনদ দেওয়া হয়। শওকত হোসেনের হাতে পুরস্কার তুলে দেন প্রথম আলোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মিডিয়াস্টার লিমিটেড ও ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান এবং প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান।
সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০২১ সাল থেকে ট্রান্সকম গ্রুপের প্রয়াত চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নামে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এবার নিয়ে পঞ্চমবার এই পুরস্কার দেওয়া হলো। প্রথমবার এই পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি রোজিনা ইসলাম। দ্বিতীয়বার প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, তৃতীয়বার প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি শিশির মোড়ল এবং গত বছর প্রথম আলোর উপসম্পাদক এ কে এম জাকারিয়া এ পুরস্কার পেয়েছিলেন।
এ বছর পুরস্কারজয়ী শওকত হোসেন ২০০৪ সাল থেকে প্রথম আলোতে কর্মরত। অর্থনীতিবিষয়ক স্বনামধন্য রিপোর্টার ও কলামিস্ট শওকত হোসেন এখন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথম আলোর বার্তাকক্ষের ডিজিটাল রূপান্তরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। এসব কারণে তিনি এবার এই পুরস্কার পেলেন। এর আগে তিনি প্রথম আলোয় বাণিজ্য সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, হেড অব রিপোর্টিংসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।
শওকত হোসেন পুরস্কার পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমার ৩২ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে ২১ বছরের বেশি সময় কাটছে প্রথম আলোয়। এই লম্বা সময়ের মধ্যে আজকেই আমি সবচেয়ে বেশি সম্মানিত বোধ করছি লতিফুর রহমান বর্ষসেরা সাংবাদিকতার পুরস্কার পেয়ে। অনেক শ্রদ্ধা প্রয়াত চেয়ারম্যানের প্রতি, ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের পরিচালনা বোর্ডকে।’
স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্র তৈরিতে লতিফুর রহমানের অবদান তুলে ধরে শওকত হোসেন বলেন, ‘আর প্রথম আলোর সম্পাদক স্বাধীন, সৎ ও সুসাংবাদিকতার চর্চা করতে প্রতিনিয়তই শিখিয়ে যাচ্ছেন। আমার ও আমাদের অনেক সৌভাগ্য যে মতি ভাইয়ের (প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান) মতো একজন সম্পাদকের নেতৃত্বে কাজ করতে পারছি।’
সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা জানিয়ে শওকত হোসেন বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে থেকে আরও ভালো সাংবাদিকতা করে যেতে হবে, আজকের পুরস্কার আমাকে এই অনুপ্রেরণাই দিচ্ছে। স্বাধীন ও সৎ সাংবাদিকতা সহজ নয়। ধরনও প্রতিনিয়ত বদল হচ্ছে। আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা সবাই এগিয়ে যাব, পুরস্কার হাতে নিয়ে এই প্রত্যয়ের কথাই জানালাম।’