পরিসংখ্যান ব্যুরো কতটা ‘স্বাধীন’ হলো?
Published: 15th, May 2025 GMT
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের (এসআইডি) অধীন একটি দপ্তর। ফলে পরিসংখ্যান প্রকাশে সরকারের প্রভাবের সরাসরি ঝুঁকি রয়েছে– এটি পরিষ্কার। যদিও সংস্থাটির অধিকাংশ কর্মী পেশাদার পরিসংখ্যানবিদ। এ তথ্যের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে কোনো স্পষ্ট আইন বা আলাদা পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষ কখনও ছিল না।
একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশাদার সংস্থা হিসেবে বিবিএসের আন্তর্জাতিক মানের আচরণবিধি অনুসরণ করার ঘোষণা থাকলেও, তা বাধ্যতামূলক প্রয়োগ বা পর্যবেক্ষণের স্বাধীন কাঠামো এখনও নেই। তাই প্রকৃতপক্ষে পরিসংখ্যানের প্রকাশনা কখনও বিলম্বিত হয় এবং সরকারের সিদ্ধান্ত বা উদ্বেগের ওপর নির্ভর করে থাকতে হতো এত দিন। সম্ভবত এ অবস্থার অবসান ঘটতে চলেছে।
গত ৮ মে অন্তর্বর্তী সরকার ‘তথ্য প্রকাশনীতি’ ও ‘পরিসংখ্যান প্রতিবেদননীতি’ নামে দুটি পৃথক নীতি প্রণয়ন করেছে। সেখানে বিবিএসের মহাপরিচালককে জিডিপি ও মূল্যস্ফীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে কোনো মন্ত্রী বা সরকারের শীর্ষ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই নতুন গঠিত কারিগরি কমিটির সঙ্গে পরামর্শ সাপেক্ষে এ তথ্য প্রকাশ করা হবে। তবে এই দুই নীতি নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়।
প্রথমত, দলীয় সরকারের অধীনে এই কারিগরি কমিটি কীভাবে তৈরি হবে? তখন যদি সরকারের আজ্ঞাবহ, তথাকথিত বিশেষজ্ঞ প্যানেল নিয়ে এটি গঠিত হয় তাহলে সরিষার মধ্যে ভূত রেখে বিবিএসের এই স্বাধীনতা কোনো কাজে আসবে না।
তা ছাড়া ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান আইনে সরকারি তথ্য প্রকাশ নিয়ে ১৬ ধারায় দুটি উপধারা রয়েছে। নতুন নীতিমালা ওই আইনের ১৬ ধারা ছাড়াও অন্য কিছু ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সে কারণে আমার ধারণা, ২০১৩ সালের পরিসংখ্যান আইন পরিমার্জন না করে তা হুবহু বিদ্যমান রেখে ‘তথ্য প্রকাশনীতি’ ও ‘পরিসংখ্যান প্রতিবেদননীতি’ সম্পূর্ণভাবে কার্যকর নাও হতে পারে।
ভালো হতো, এই সুন্দর উদ্যোগটি যদি আরও ভেবেচিন্তে সময় নিয়ে যুক্তরাজ্যের মডেলের মতো অথবা অন্যান্য উন্নত বিশ্বের দেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে তৈরি করা হতো। তখন সত্যিকারের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তথ্য প্রকাশের ক্ষমতা বিবিএস পেত।
যুক্তরাজ্যের পরিসংখ্যান কর্তৃপক্ষ (ইউকেএসএ) একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, যা সরাসরি সংসদের কাছে দায়বদ্ধ; সরকারের কাছে নয়। অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস (ওএনএস) হলো ইউকেএসের নির্বাহী দপ্তর। সরকার ওএনএসের পরিসংখ্যান পরিবর্তন, বিলম্ব বা প্রকাশে বাধা দেওয়ার কোনো অধিকার রাখে না। প্রকাশনার সময়সূচি আগেই ঘোষণা করা হয় এবং এটি পরিসংখ্যান আচরণবিধির অধীনে কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়।
যুক্তরাজ্যের বিদ্যমান পরিসংখ্যান প্রকাশের ব্যবস্থার সঙ্গে বহুলাংশে মিল রয়েছে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার নীতিমালার। বাংলাদেশ চাইলে সেখান থেকেও শিক্ষা নিতে পারে।
‘স্ট্যাটিসটিকস কানাডা (স্ট্যাটক্যান)’ কানাডার একটি স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ পরিসংখ্যান সংস্থা। আইন অনুযায়ী সরকার এর কোনো প্রতিবেদন প্রকাশে বাধা দিতে পারে না। অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা অস্ট্রেলিয়ান ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসও (এবিএস) স্বাধীনভাবে কাজ করে অস্ট্রেলিয়ান ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস অ্যাক্ট ১৯৭৫-এর আওতায়। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান গভর্নর জেনারেলের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং তার কার্যক্রমে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। সরকার এবিএস প্রকাশিত পরিসংখ্যান পরিবর্তন, বিলম্বিত বা বন্ধ করতে পারে না। এটি জাতিসংঘের মৌলিক পরিসংখ্যান নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণবিধি অনুসরণ করে। একাডেমিক স্বাধীনতা ও প্রকাশে স্বচ্ছতা বজায় রাখা হয়। এবিএস সরাসরি অস্ট্রেলিয়ার সংসদের কাছে জবাবদিহি করে; কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীন নয়।
যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি পরিসংখ্যান ব্যবস্থা কিছুটা বিকেন্দ্রীকৃত। যেমন ইউএস সেনসাস ব্যুরো, ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকস (বিএলএস) এবং ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাটিসটিকস (এনসিএইচএস) বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে (যেমন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় ইত্যাদি)। অর্থাৎ যুক্তরাজ্যের মতো সরাসরি সংসদের অধীনে এদের জন্য কোনো স্বাধীন কাঠামো নেই। তবে এ সংস্থাগুলোর মধ্যে পেশাগত স্বাধীনতা বজায় থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে এমন কোনো আইন নেই, যা সরকারকে প্রকাশনা বিলম্বিত, সংশোধন বা থামানো থেকে সরাসরি নিষেধ করে। সাংবিধানিক নীতি, সংস্থার সংস্কৃতি ও পেশাগত মানদণ্ডের কারণে এ ধরনের হস্তক্ষেপ সাধারণত দেখা যায় না। প্রকাশনার সময়সূচি সাধারণত সংস্থাগুলো নিজেরা নির্ধারণ এবং এটি অনুসরণ করে। এদের পরিসংখ্যান সংক্রান্ত সমন্বয় করে অফিস অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বাজেট (ওএমবি), কিন্তু তারা পরিসংখ্যানের বিষয়বস্তুতে হস্তক্ষেপ করে না। যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি পরিসংখ্যান উৎপাদনে বস্তুনিষ্ঠতা (অবজেকটিভিটি) এবং বৈজ্ঞানিক সততা (সায়েন্টিফিক ইন্টেগ্রিটি) গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের এই পদ্ধতি গ্রহণ করলেও তা টেকসই হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবারও সরাসরি সরকারের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থেকে যাবে।
এই উপমহাদেশের বৃহত্তম দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর কাঠামোগত সরাসরি মিল পাওয়া যায়। তাই ভারতের বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ আমি দেখছি না। মিনিস্ট্রি অব স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশনের আওতাধীন ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিস (এনএসও) হলো ভারতের প্রধান পরিসংখ্যান সংস্থা। এটি সরকারি বিভাগ হিসেবে কাজ করে। সেখানে জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনের সুপারিশে এর পেশাগত স্বাধীনতা উন্নয়নের চেষ্টা চললেও এটি এখনও পূর্ণ স্বাধীন হয়নি। বাংলাদেশের মতো সেখানেও সরকারের হস্তক্ষেপের আশঙ্কা মাঝেমধ্যে প্রকাশ পায়। রিপোর্ট প্রকাশে বিলম্ব কিংবা শিরোনাম পরিবর্তনের অভিযোগ গণমাধ্যমে এসেছে। সংসদীয় কমিটিতে জবাবদিহি করতে হয়, তবে পরিসংখ্যানের প্রকাশ সরাসরি সংসদের অধীনে নয়।
জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অনেকটা ধরে রেখে কাজ করে এই উপমহাদেশের আরেকটি দেশ শ্রীলঙ্কা। ডিপার্টমেন্ট অব সেনসাস অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস (ডিসিএস) সরকারি পরিসংখ্যান সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য নির্ধারিত একমাত্র কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান। শ্রীলঙ্কা সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও পরিসংখ্যান প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এটি পেশাগত স্বাধীনতা বজায় রাখে। এর কার্যক্রম পরিচালিত হয় স্ট্যাটিসটিকস অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, যা পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু আইনি সুরক্ষা প্রদান করে। ডিসিএসের নিজস্ব কোড অব এথিকস এবং কোয়ালিটি অ্যাশিউরেন্স ফ্রেমওয়ার্ক আছে, যা আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখে। মন্ত্রণালয়ের ওপর প্রশাসনিক নির্ভরতা আছে, তবে সরকারি হস্তক্ষেপ তুলনামূলক কম। ডেটা প্রকাশে নির্ধারিত সময়সূচি মানার একটি প্রবণতা রয়েছে।
বাংলাদেশের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যবস্থায় স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ঘাটতি পূরণে সরকার যে ‘তথ্য প্রকাশনীতি’ ও ‘পরিসংখ্যান প্রতিবেদননীতি’ প্রণয়ন করেছে, সেগুলোর দীর্ঘস্থায়ী ও কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য একটি শক্তিশালী সাংবিধানিক কাঠামো প্রয়োজন, যা শুধু প্রশাসনিক নির্দেশনাভিত্তিক নয়, বরং আইন দ্বারা সংরক্ষিত হবে। একটি নিরপেক্ষ কারিগরি কমিটি গঠনের বিষয়টিও বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার, যাতে তা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে প্রকৃত অর্থে পেশাগত স্বাধীনতা বজায় রেখে কাজ করতে পারে।
যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশের স্বাধীন পরিসংখ্যান কাঠামো ও আইন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে বাংলাদেশে একটি স্বাধীন ও সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনও গঠন করা যেতে পারে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্টেও এ সংক্রান্ত একটি কমিশনের কথা বলা হয়েছে। একটি স্থায়ী আইন পাসের মাধ্যমে কমিশন করে বিবিএসের নির্বাহী ক্ষমতা ও জবাবদিহির সীমারেখা নির্ধারণ করা যেতে পারে, যাতে তা কোনো মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে সংসদের কাছে জবাবদিহি করে। এ ধরনের পদক্ষেপ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের তথ্য-নির্ভরতা, উন্নয়ন নীতিনির্ধারণ এবং গবেষণার মান বাড়াতে সহায়তা করবে।
পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়। এটি একটি জাতির বিবেক। তাই এর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও অঙ্গীকার হওয়া উচিত।
ড.
হাসিনুর রহমান খান: অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান এবং ডেটা সায়েন্স পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
hasinur@du.ac.bd
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব ব এস পর স খ য ন ব য র পর স খ য ন পর স খ য ন স পর স খ য ন প পর স খ য ন ক ন ব যবস থ ব ব এস র সরক র র মন ত র ক জ কর
এছাড়াও পড়ুন:
প্যাসিফিক জিনস চালু হচ্ছে কাল, বন্ধের প্রভাব পোশাক রপ্তানিতে
দেশের শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের সাতটি কারখানা আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে আবার খুলছে। ‘কারখানায় হামলা ও কর্মপরিবেশ না থাকায়’ ১৬ অক্টোবর এসব কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। প্যাসিফিক জিনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীরের সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
কারখানাগুলো হলো প্যাসিফিক জিনস, জিনস ২০০০, ইউনিভার্সেল জিনস, এনএইচটি ফ্যাশন, প্যাসিফিক অ্যাকসেসরিজ, প্যাসিফিক ওয়ার্কওয়্যার ও প্যাসিফিক অ্যাটায়ার্স। এর মধ্যে প্যাসিফিক জিনসের কারখানা দুটি ও ইউনিভার্সেল জিনসের ইউনিট চারটি। এসব কারখানায় প্রায় ৩৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন।
তবে আগামীকাল কারখানা খুললেও শ্রমিকদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিয়ে সতর্ক রয়েছে শিল্প পুলিশ ও বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। গত এক বছরে এই কারখানায় অন্তত তিনবার শ্রমিক সংঘর্ষ হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকেও বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত চলছে। দেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানটিতে বহিরাগতদের কোনো ইন্ধন আছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
কারখানা বন্ধ থাকায় পোশাক রপ্তানিতে কোনো প্রভাব পড়েছে কি না, সে সম্পর্কে প্যাসিফিক জিনসের এমডি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীরের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। কারখানাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্যমতে, গত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্যাসিফিক গ্রুপ মোট ৪০ কোটি ৬০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। কারখানা বন্ধের সময় রপ্তানি চালান (শিপমেন্ট) আটকে ছিল, সেগুলো এখন পাঠানো হবে।
এ থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে কোথাও সমস্যা হলে তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় প্রশাসনকে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বর্তমানে দেশে ‘মব’ সংস্কৃতির কারণে আরও বেশি সতর্ক থাকা দরকার, যাতে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সুযোগ নিতে না পারে।এস এম আবু তৈয়ব, পরিচালক, বিজিএমইএ।এ ঘটনা পোশাক খাতে প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এ থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে কোথাও সমস্যা হলে তাৎক্ষণিকভাবে স্থানীয় প্রশাসনকে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বর্তমানে দেশে ‘মব’ সংস্কৃতির কারণে আরও বেশি সতর্ক থাকা দরকার, যাতে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সুযোগ নিতে না পারে।
বাংলাদেশ থেকে প্রথম জিনস রপ্তানির নেপথ্য কারিগর ছিলেন চট্টগ্রামের উদ্যোক্তা প্রয়াত এম নাসির উদ্দিন। তিনি প্যাসিফিক জিনস প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে জিনসের পাশাপাশি নিট ও কাজের পোশাক (ওয়ার্কওয়্যার) রপ্তানি করছে তারা। গ্রুপটির রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ৯১ শতাংশই জিনস প্যান্ট। বিশ্বের ৪৪টি দেশে তাদের পোশাক রপ্তানি হয়। প্যাসিফিক জিনসের বড় ক্রেতা জাপানের বহুজাতিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইউনিক্লো।
প্যাসিফিকে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয় চলতি বছরের জানুয়ারিতে। তখন নিজেদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ করেন প্যাসিফিকের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকেরা। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে শিল্প পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় শিল্প পুলিশ বাদী হয়ে নগরের ইপিজেড থানায় একটি মামলা করে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় প্যাসিফিকের ৬০–৭০ জনসহ মোট ৩২০ জনকে।
গত কয়েক মাসে এই মামলার তদন্ত করে শিল্প পুলিশ। এতেই ক্ষিপ্ত হন শ্রমিকেরা। শ্রমিকদের দাবি, মামলা দিয়ে তাঁদের হয়রানি করা হচ্ছে। এ জন্য ৯ অক্টোবর কর্মবিরতি শুরু করেন জিনস ২০০০ লিমিটেডের শ্রমিকেরা। এর আগে তিন দিন ধরে প্যাসিফিক জিনসের শ্রমিকেরাও কারখানার ভেতরে বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন।
সর্বশেষ ১৬ অক্টোবর এনএইচটি ফ্যাশনের সামনে শ্রমিকদের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এরপর ‘সংঘর্ষে দুই শ্রমিক নিহত’ দাবি করে একটি ভিডিও শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওটি দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে অন্য কারখানাগুলোর শ্রমিকেরা হামলা ও ভাঙচুর চালান। মারধরের শিকার হন কারখানার শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তারা। সেদিন রাতেই সাতটি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
শ্রমিকদের অসন্তোষ ও বর্তমান অবস্থা জানতে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (সিইপিজেড) নির্বাহী পরিচালক আবদুস সোবহানের মুঠোফোনে কয়েক দফা চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
শিল্প পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংঘর্ষের দিন সেখানে বহিরাগত কয়েকজন ব্যক্তি প্রবেশ করেন। সংস্কারকাজের জন্য সিইপিজেডের মূল গেট ভেঙে ফেলা হয়েছে। ফলে বহিরাগতরা ভেতরে প্রবেশের সুযোগ পান। এ নিয়ে শ্রমিকদের দাবি, বহিরাগতরা তাঁদের মারধর করেছেন। অন্যদিকে কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, বহিরাগতরা শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে কারখানায় হামলা করতে বাধ্য করেছেন।
এদিকে প্যাসিফিক গ্রুপের অন্তত সাতজন শ্রমিক ও আশপাশের কয়েকটি কারখানার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঝুট কাপড়ের ব্যবসা নিয়ে ইপিজেড এলাকায় কয়েকটি পক্ষ সক্রিয়। আগে প্যাসিফিকের ঝুট বাইরে বিক্রি হতো, এখন প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব রিসাইক্লিং ইউনিটে তা ব্যবহার করা হয়। এই ব্যবসা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে প্রভাবশালী একটি মহল শ্রমিকদের উসকানি দিচ্ছে।
এদিকে গত শুক্রবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক শ্রমিকের একটি অডিও ছড়িয়ে পড়ে। অডিওতে কারখানা খোলার পর সেখানে বিশৃঙ্খলা করার পরিকল্পনার কথা বলতে শোনা যায়। ওই শ্রমিক বলেন, ‘বুঝাইতে হবে যে আমরা ভালো হয়ে গেছি। ভালোভাবে অভিনয় করতে হবে। তা ছাড়া আর কিছু না। তারপরে তো যা করা তো করাই যাবে।’
তবে ওই শ্রমিকের নাম–পরিচয় জানা যায়নি। চট্টগ্রাম শিল্প পুলিশের সুপার আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, ‘শ্রমিক নিহত হওয়ার দাবি করা ভিডিওটি ভুয়া। এটি পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়েছে। যাঁরা এটি করেছেন তাঁদের আমরা চিহ্নিত করেছি। তাঁদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব।’