হজ পবিত্র ধর্মীয় আচার হলেও ইতিহাসে এটি বারবার মহামারির কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। আরব উপদ্বীপের হেজাজ অঞ্চল, বিশেষ করে মক্কা ও মদিনায়, বিভিন্ন সময়ে সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যার মধ্যে কলেরা ছিল অন্যতম। এই মহামারিগুলো রোধে কোয়ারেন্টিন বা সঙ্গনিরোধ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মক্কায় মহামারি
মক্কায় মহামারির প্রথম লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় ইবনে কাসিরের আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে। ৯৬৮ সালে ‘আল-মাশরি’ নামক একটি মহামারি মক্কায় আঘাত হানে, যার ফলে অসংখ্য হজযাত্রী এবং তাঁদের বহনকারী উটের মৃত্যু হয়। এমনকি যাঁরা হজ পালন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁরাও অল্প সময়ের মধ্যে মারা যান। এ ঘটনা মক্কার ইতিহাসে মহামারির প্রাথমিক প্রভাবের একটি উদাহরণ।
কলেরার প্রাদুর্ভাব
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে হজযাত্রা আরও সহজ ও ব্যাপক হয়। বাষ্পীয় জাহাজের প্রচলনের কারণে অধিক সংখ্যক হজযাত্রী স্বল্প সময়ে মক্কায় পৌঁছাতে শুরু করেন। তবে এটি সংক্রামক রোগের দ্রুত বিস্তারের সুযোগও তৈরি করে। এই সময়ে কলেরা বিশ্বব্যাপী মহামারি হিসেবে আবির্ভূত হয়, এবং হেজাজ অঞ্চলও এর প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল না।
কলেরা প্রথম ১৮১৭ সালে বাংলার যশোর অঞ্চলে (বর্তমান বাংলাদেশ) দেখা দেয় এবং দ্রুত ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৩৩ সালের মধ্যে এটি এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকায় মহামারি হিসেবে প্রভাব ফেলে, যার ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আরব উপদ্বীপে কলেরার প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে ১৮২১ সালে। ১৮৩১ সালে মক্কায় এই রোগ প্রথম আঘাত হানে, যার ফলে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ বা অন্তত ২০ হাজার হজযাত্রীর মৃত্যু হয়। এই মহামারি ভারতীয় হজযাত্রীদের মাধ্যমে মক্কায় ছড়ায় এবং অভূতপূর্ব দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ করে। পরবর্তী সময়ে ১৮৪১, ১৮৪৭, ১৮৫১, ১৮৫৬-৫৭ ও ১৮৫৯ সালে কলেরা মক্কায় বহু হজযাত্রীর প্রাণ কেড়ে নেয়।
আরও পড়ুনবদর যুদ্ধক্ষেত্রে একটি দিন২০ জুলাই ২০২৩কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা
তৎকালীন ওসমানিয়া সাম্রাজ্য, যারা হেজাজ অঞ্চলের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে ছিল, কলেরার বিস্তার রোধে ১৮৪০ সাল থেকে কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা প্রয়োগ শুরু করে। হেজাজের সীমান্ত এবং মক্কা ও মদিনার বিভিন্ন স্থানে কোয়ারেন্টিন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হতো এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করা হতো।
ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আগত হজযাত্রীদের জন্য কোয়ারেন্টিন প্রক্রিয়া বিশেষভাবে কঠোর ছিল। এডেনে যাত্রাবিরতির পর, হজযাত্রীদের ইয়েমেনের উপকূলীয় কামারান দ্বীপে কোয়ারেন্টিন ক্যাম্পে নামানো হতো। স্বাস্থ্য পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে কোয়ারেন্টিনের সময়সীমা এক সপ্তাহ থেকে এক মাস পর্যন্ত হতে পারত। কোয়ারেন্টিন শেষে জাহাজ জেদ্দায় পৌঁছাত এবং পথে ইয়ালামলাম নামক স্থানে হজযাত্রীরা ইহরাম বাঁধতেন, যা ভারতীয় উপমহাদেশের মিকাত (হজের নিয়ত ও ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত স্থান) হিসেবে পরিচিত।
আন্তর্জাতিক কলেরা সম্মেলন
কলেরা মহামারির বিশ্বব্যাপী বিস্তার এবং ব্যাপক প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে ১৮৬৬ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো একটি আন্তর্জাতিক স্যানিটারি কনফারেন্সের আয়োজন করে, যা পরে ‘কলেরা কনফারেন্স’ নামে পরিচিত হয়। এই কনফারেন্সে ভারতীয় উপমহাদেশকে কলেরার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারত থেকে আগত হজযাত্রীদের ওপর কঠোর স্বাস্থ্য নজরদারি ও কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা আরোপ করা হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলেরা মক্কায় ব্যাপক প্রাণহানির কারণ হলেও ওসমানীয় সালতানাতের কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতীয় উপমহাদেশের হজযাত্রীদের মাধ্যমে কলেরার বিস্তার হলেও কোয়ারেন্টিন ক্যাম্প এবং স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগের মাধ্যমে এর প্রভাব কমানোর চেষ্টা করা হয়।
আরও পড়ুনবিরে শিফা: একটি অলৌকিক কুয়ার গল্প০৫ মে ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক য় র ন ট ন ব যবস থ হজয ত র দ র কল র র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
ব্রিটিশ ভারত থেকে হজযাত্রা
ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশে হজযাত্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক ঘটনা ছিল, যা বাষ্পীয় জাহাজের আগমনের সঙ্গে আরও সংগঠিত ও নিরাপদ রূপ লাভ করে। ব্রিটিশ সরকার এই যাত্রার ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা শুধু ধর্মীয় নয়, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
বাষ্পীয় জাহাজে
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাষ্পীয় জাহাজের বাণিজ্যিক চলাচল শুরু হলে হজযাত্রা আরও সহজ ও দ্রুততর হয়। ব্রিটিশ সরকার হজযাত্রী পরিবহনের দায়িত্ব দেয় সে সময়ের বিখ্যাত পর্যটন কোম্পানি টমাস কুককে। বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং মুসলিমদের ধর্মীয় ভ্রমণ নিরাপদ করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ প্রশাসন হজ এবং ইরাকের কারবালায় ভ্রমণের জন্য নিরাপদ জাহাজ ব্যবস্থার উদ্যোগ নেয়।
১৯২৭ সালে হজযাত্রার দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) পুলিশ কমিশনারের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি হজ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি হজযাত্রীদের জন্য পরিবহন, থাকা-খাওয়া এবং অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করে।
মোগল শিপিং লাইনস ও হজযাত্রী পরিবহন
ভারতীয় সমুদ্রবন্দর থেকে হজযাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ‘মোগল শিপিং লাইনস’-এর। এই কোম্পানি, যার পূর্বনাম ছিল ‘বোম্বে অ্যান্ড পার্শিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি’, ১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাণিজ্যিক কার্যক্রমের পাশাপাশি এটি হজযাত্রীদের জেদ্দায় পরিবহনের দায়িত্ব পালন করে। ১৯২৭ সালে মোগল শিপিং লাইনস ২০ হাজার থেকে ৩৬ হাজার হজযাত্রী পরিবহন করে, এবং ১৯৩০ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় ৭০ শতাংশ হজযাত্রী তাদের জাহাজে ভ্রমণ করে। বছরের ছয় থেকে সাত মাস ধরে এই কোম্পানির জাহাজ বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের হজযাত্রীদের লোহিত সাগরের জেদ্দা ও এডেন বন্দরে নিয়ে যেত।
বোম্বে থেকে জেদ্দায় যাত্রায় বাষ্পীয় জাহাজগুলো সাধারণত ১০-১২ দিন সময় নিত, যদিও অশান্ত সমুদ্র প্রায়ই যাত্রাকে চ্যালেঞ্জিং করে তুলত। এই জাহাজে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আশপাশের দেশের হজযাত্রীরাও ভ্রমণ করতেন।
আরও পড়ুনমদিনার হজ কার্যালয় যেন 'বাংলাদেশ'২২ জুন ২০২৪মোগল শিপিং লাইনস তাদের একচেটিয়া ব্যবসার কারণে আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং কলকাতা বন্দর থেকে হজযাত্রী পরিবহন বন্ধ করতে ভারত সরকারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এর প্রতিক্রিয়ায়, বিশেষ করে বাঙালি মুসলিমরা বিকল্প হিসেবে ভারতীয় মালিকানাধীন ‘সিন্ধিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি’কে পৃষ্ঠপোষকতা করে। সিন্ধিয়ার জাহাজ ‘আল মদিনা’ হজযাত্রীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়।
মোগল শিপিং লাইনস এবং সিন্ধিয়ার মধ্যে হজযাত্রী পরিবহন নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। উভয় কোম্পানি টিকিটের মূল্য কমিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চেষ্টা করে। সিন্ধিয়া প্রায় বিনা মূল্যে হজযাত্রী পরিবহন করে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অন্যদিকে মোগল শিপিং লাইনস বিনা মূল্যে পরিবহনের পাশাপাশি হজযাত্রীদের ছাতা এবং জমজমের পানি বহনের জন্য কনটেইনার উপহার দিত। এই প্রতিযোগিতা তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক মহলে আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে।
প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব স্যার মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খানের উদ্যোগে দুই কোম্পানির মধ্যে একটি সমঝোতা হয়, যেখানে হজযাত্রীপ্রতি সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ১১৫ রুপি। তবে মোগল শিপিং লাইনস এই সমঝোতা মেনে চলেনি এবং সিন্ধিয়ার তুলনায় কম ভাড়ায় হজযাত্রী পরিবহন অব্যাহত রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে হজযাত্রী পরিবহন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
আরও পড়ুনহজ করতে গিয়ে মক্কা মদিনায় হারিয়ে গেলে কী করবেন০৮ মে ২০২৪ব্রিটিশ শাসনের পরে
১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ভারত সরকার বিভিন্ন জাহাজ কোম্পানিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করে, এবং ১৯৬২ সালে মোগল শিপিং লাইনস ভারত শিপিং করপোরেশনের অংশ হয়ে যায়। ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রই হজযাত্রীদের জন্য পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলে।
পাকিস্তান সরকার ১৯৫৮ সালে হজযাত্রী পরিবহনের জন্য ‘এম্পায়ার অরওয়েল’, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘সারধানা’, এবং মোগল লাইনসের ‘ইসলামি’ ও ‘মুহাম্মদি’ জাহাজ ভাড়া করে। এর মধ্যে ‘সারধানা’ চট্টগ্রাম ও করাচি বন্দর থেকে জেদ্দায় হজযাত্রী পরিবহন করত। ১৯৬০ সালে প্যান ইসলামিক স্টিমশিপ কোম্পানি চট্টগ্রাম ও করাচি থেকে হজযাত্রী পরিবহনের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
আরও পড়ুনমদিনার হজ কার্যালয় যেন 'বাংলাদেশ'২২ জুন ২০২৪সমুদ্রপথ থেকে বিমানে
ভারত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বোম্বে-জেদ্দা রুটে ইন্ডিয়া শিপিং করপোরেশনের জাহাজ সার্ভিস ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত চলে। এর পর থেকে বিমান হজযাত্রার প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। বিমানযাত্রার সহজলভ্যতা ও দ্রুততার কারণে সমুদ্রপথে হজযাত্রা ক্রমেই বিলুপ্ত হয়।
ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশে হজযাত্রা ছিল ধর্মীয়, সামাজিক ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। টমাস কুকের মতো এজেন্ট, হজ কমিটি এবং মোগল শিপিং লাইনসের মতো জাহাজ কোম্পানিগুলো এই যাত্রাকে সংগঠিত ও নিরাপদ করতে অবদান রাখে। মোগল শিপিং লাইনস এবং সিন্ধিয়ার প্রতিযোগিতা হজযাত্রীদের জন্য ভাড়া কমালেও ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণ হয়। কালের পরিক্রমায় সমুদ্রপথের পরিবর্তে বিমানযাত্রা হজযাত্রার প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে, তবে ব্রিটিশ আমলের এই ঐতিহ্য ইতিহাসের একটি অমূল্য অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে।
আরও পড়ুনবিরে শিফা: একটি অলৌকিক কুয়ার গল্প০৫ মে ২০২৫