জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে একের পর এক ইস্যু তৈরি করে পরিস্থিতি ক্রমে ঘোলাটে করা হচ্ছে। বিভিন্ন দল নিজেদের ইচ্ছেমতো শর্ত দিয়ে নির্বাচনকে আটকে দিতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। অহেতুক অপ্রয়োজনীয় আলাপ শুরু করা হচ্ছে। এমন সব বিষয় আলোচনায় আনা হচ্ছে, যা অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। এমনই একটি বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনে ভোটের সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির প্রয়োগ করা। আসনভিত্তিক নির্বাচনপদ্ধতির পরিবর্তে এ পদ্ধতির কথা সম্প্রতি ইসলামপন্থী দলগুলোর সমাবেশে বলা হয়েছে। এর আগে জামায়াতে ইসলামী ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (জানাপা) বিভিন্ন সময় এ পদ্ধতির পক্ষে বলেছে।

এ দাবির পক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে, ভবিষ্যতে যেকোনো দলের কর্তৃত্ববাদী হওয়া ঠেকানো, সংখ্যালঘু দলের সরকার গঠন ঠেকানো, সব দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।

তাদের এসব যুক্তিতে ত্রুটি আছে। প্রথম ত্রুটি হচ্ছে ভোটের হিসাব করে কর্তৃত্ববাদী ঠেকানো সম্ভব নয়। ইরান, তুরস্ক বা রাশিয়ায় নিয়মিত নির্বাচন হয়। তাদের নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি অনিয়মের তথ্য পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। আবার একই সঙ্গে এই তিন দেশে কর্তৃত্ববাদ ঠেকানো সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য তুরস্কে সংসদ গঠিত হয় সংখ্যানুপাতিক পার্টি লিস্ট পদ্ধতিতে; কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা রয়েছে। তাই এই পদ্ধতির সংসদের খুব বেশি গুরুত্ব নেই। তুরস্কে এখন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানই শেষ কথা, ইরানের আয়াতুল্লা আলী খামেনি বা রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের মতো।

দ্বিতীয়ত আসনভিত্তিক পদ্ধতিতে সংখ্যালঘুর সরকার গঠিত হয় না। যেমন ১৯৯১ সালে বিএনপি ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। তাদের আসন সংখ্যা ছিল ১৪০। আর আওয়ামী লীগ মোট ভোট পেয়েছিল প্রদত্ত ভোটের ৩০ দশমিক ১ শতাংশ; কিন্তু তাদের আসন ছিল ৮৮টি। আবার ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯৩ আসনে জয়ী হয়। আর আওয়ামী লীগ ৪০ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়ে মাত্র ৬২ আসনে জয়ী হয়। এ পদ্ধতিতে দেশকে বিভিন্ন নির্বাচনী আসনে বিভাজিত করে স্থানীয় জনসাধারণের চাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। মতামতের একধরনের বিকেন্দ্রিকতা এই পদ্ধতিতে লক্ষ্য করা যায়। তাই সর্বোচ্চ আসন পাওয়া দলটি সরকার গঠন করে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবি প্রথম এসেছে আওয়ামী লীগের মিত্রদের কাছ থেকে। ’৯০ দশকে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের মিত্র কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবির তরফ থেকে প্রথম সংখ্যানুপাতিক আসন বণ্টনের কথা বলা হয়। এরপর আরেক আওয়ামী মিত্র জাতীয় পার্টি এ বিষয়ে আলাপ তুলে। এরপর আওয়ামী লীগের নেতারাও বিভিন্ন সময় এর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। এসব তথ্য পাওয়া খুব কঠিন বিষয় নয়। ইন্টারনেট ঘাঁটলেই এসব তথ্য বেরিয়ে আসবে।

আমাদের দেশে এ ধরনের শক্তিশালী ও স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নেই। আমাদের সবকিছু কেন্দ্রীয় সরকার শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত। এ অবস্থায় সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। সব থেকে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে পতিত আওয়ামী লীগ ভিন্ন পরিচয়ে সংসদে ফিরে আসতে পারে।

আগামী নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের জুতায় পা গলিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, জানাপা ও ইসলামপন্থী দলগুলো। আওয়ামী লীগ ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বিএনপির কাছাকাছি ভোট পেয়েও সরকার গঠন করতে পারেনি প্রয়োজনীয় আসন জিততে না পারায়। আবার জামায়াত ও ইসলামপন্থী দলগুলো এককভাবে কখনোই আসনভিত্তিক নির্বাচনে ভালো করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে জামায়াত এককভাবে নির্বাচন করে তিনটি আসনে জিতেছিল। আর ইসলামী ঐক্য জোট এক বা দুটি আসনে জিতেছে।

বর্তমানেও তাদের অবস্থার হেরফের হয়নি। জনসমর্থন এমনভাবে বাড়েনি, যাতে তারা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসনে জয়ী হতে পারবে। আর নতুন দল হিসাবে জানাপার অবস্থাও খুব বেশি আশাব্যঞ্জক না। এ অবস্থায় তারা হিসাব কষছে ভোটের সংখ্যানুপাতিক হিসাব হলে সংসদে বেশি আসন পাবে। যেমন জামায়াত এককভাবে নির্বাচন করে সর্বোচ্চ তিনটি আসন পেয়েছে। অনেকেই ১৯৯১ সালের নির্বাচনের হিসাব সামনে আনতে পারেন; কিন্তু ওই সময় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের অঘোষিত সমঝোতার কারণে ১৮টি আসনে জিতেছিল। যেমন ১৯৯১ সালে পাবনার একটি আসন থেকে জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী ৫৫ হাজার ৭০৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন; কিন্তু ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এককভাবে অংশ নিয়ে তিনি তৃতীয় স্থানে ছিলেন।

২০০১ সালে আবার বিএনপির সঙ্গে জোট করে তিনি জিতে আসেন। ফলে বোঝা যাচ্ছে, জোটবিহীন অবস্থায় তিনি জয়ী হতে পারেননি। ১৯৯৬ নির্বাচনে জামায়াতের ভোট ছিল প্রদত্ত ভোটের ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। সংখ্যানুপাতিক আসন বণ্টন হলে ওই সংসদে জামায়াতের আসন থাকত ২৭টি। তাহলে মতিউর রহমান নিজামী ১৯৯৬ সালের সংসদ সদস্য হতে পারতেন। আবার এ পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে খুব ভালো না করা বর্তমান আমির শফিকুর রহমান সংসদ সদস্য হতে পারবেন। মূলত এ কারণেই জামায়াত সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জানাপাসহ কয়েকটি দলও জামায়াতর সঙ্গে গলা মিলিয়েছে। যেহেতু এই দলগুলোর জনপ্রিয়তা কম, তাই আসনভিত্তিক নির্বাচনে বেশি আসন পাওয়ার সুযোগ কম। তাই তারা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির দাবি করছে কিছু আসন পাওয়ার আশায়।

সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সব দলের প্রতিনিধিত্বের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে সংসদে তাদের সবার উপস্থিতি থাকে না। সংসদে আসন পাওয়ার জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক ভোট পেতে হয়। যেমন মিশ্রপদ্ধতির নির্বাচন হলেও জার্মানিতে কমপক্ষে ৫ শতাংশ ভোট না পেলে সংসদে কোনো আসন পাওয়া যায় না। কোনো দেশে কমপক্ষে ৭ শতাংশ ভোট পেতে হয়। আবার কোনো দেশে ২.

৫ শতাংশ পেতে হয়। এটা মূলত জনসংখ্যা, রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ও ভোটার সংখ্যার ওপর নির্ভর করে।

সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির সব থেকে বড় ত্রুটি এতে সরাসরি জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা যায় না। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দল নির্বাচিত করা হয়। দু–একটি দেশে ব্যতিক্রম ছাড়া এ পদ্ধতি অনুসরণ করা বেশির ভাগ দেশেই পার্টির লিস্ট অনুসারে প্রতিনিধি নির্ধারিত হয়। এতে দলের বা দলীয় প্রধানের কর্তৃত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। দল বা দলীয় প্রধান যাঁকে চাইবেন, সে–ই কেবল সংসদে যেতে পারবেন। অনেক সময় আসনভিত্তিক নির্বাচনে স্থানীয় জনপ্রিয়তার কথা বিবেচনা করে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে এই সুযোগ কমে আসে। দলগুলো স্থানীয় ভোটারের মতামতের গুরুত্ব দেয় না। এতে ক্ষমতা আরও কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। ভোটারদের ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে যায়।

এ পদ্ধতির কারণে উগ্রবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংসদে অনুপ্রবেশের শঙ্কা থাকে। ভোটারদের মধ্যে গোষ্ঠী কেন্দ্রীকতা বা ধর্মকেন্দ্রীকতার রাজনীতির প্রসার ঘটে। কট্টর জাতিবাদিতার বিকাশ ঘটতে পারে। একটি রাষ্ট্র বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীতে বিভাজিত হতে পারে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে পারে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।

এতে দেশে দুর্বল ও অস্থিতিশীল সরকার গঠিত হবে। সরকার বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে। বিভিন্ন অগ্রহণযোগ্য বিষয়ে সমঝোতা করতে বাধ্য হবে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে। এতে সাংবিধানিক স্থবিরতা সৃষ্টি হতে পারে।

এ পদ্ধতিতে ভোটারদের কাছে জবাবদিহি কমে যায়। সংসদ সদস্যরা এ কারণে স্থানীয় বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন না। স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।

এসবের বাইরে ভোটারদের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ কমে যেতে পারে। তখন কেবল দলের প্রতি অনুগতরাই ভোট দিয়ে থাকেন। সুইং ভোটারদের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ কমে যেতে পারে।

এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলো ধর্তব্যের মধ্যে আনলে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নিম্নকক্ষ, উচ্চকক্ষ কোনো কক্ষেই এ পদ্ধতি প্রয়োগের সুযোগ নেই। নিম্নকক্ষে আসনভিত্তিক নির্বাচন করে উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক বণ্টন রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রের কোনো পরিবর্তন আনবে না। অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বিষয়ে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টা এমন যে ঠিক আছে দাবি মেনে নিয়ে কয়েকটি দলকে উচ্চকক্ষে কিছু আসন দিয়ে দিলাম। রাষ্ট্র পরিচালনা কোনো ছেলেখেলার বিষয় নয়। এখানে বুদ্ধি ও বিবেচনা প্রয়োগ করতে হয়।

এখন প্রশ্ন হতে পারে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে কেন এই পদ্ধতির প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর প্রথম কারণ হচ্ছে ইউরোপের এই দেশগুলোর বেশির ভাগেই প্রাদেশিক ও নগর সরকার পদ্ধতির শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা আছে। এই স্থানীয় সরকারগুলো পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত। এরা নিজেদের উন্নয়ন পরিকল্পনা নিজেরাই তৈরি করে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন, ব্যবসা–বাণিজ্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব স্থানীয় সরকারের অধীন থাকে।

কেন্দ্রীয় সরকার কেবল আইন ও নীতি তৈরি করে দেয়। স্থানীয় সরকারগুলো সেই আইন ও নীতি যথাযথভাবে অনুসরণ করছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করে। কেবল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতির কাজগুলো পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে। এই দুই বিষয় ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত স্থানীয় সরকারগুলো অমান্য করে নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এ ছাড়া অনেক দেশেই রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা রয়েছে।

আমাদের দেশে এ ধরনের শক্তিশালী ও স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নেই। আমাদের সবকিছু কেন্দ্রীয় সরকার শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত। এ অবস্থায় সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। সব থেকে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে পতিত আওয়ামী লীগ ভিন্ন পরিচয়ে সংসদে ফিরে আসতে পারে।

সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে, আমাদের দেশ কোনোভাবেই সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত না। এখানে এ পদ্ধতির প্রয়োগ সম্ভবও নয়। তবে জোর করে প্রয়োগ করা হতে পারে; কিন্ত এই পদ্ধতি সার্বিকভাবে দেশকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে। কোনো কোনো ছোট দল নিজদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে চাইছে। সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির গণ্ডি থেকে তারা বের হতে পারছে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়।

ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ক ন দ র য় সরক র স থ ন য় সরক র কর ত ত ব অবস থ য় এককভ ব র জন ত আম দ র ইসল ম দশম ক দলগ ল ব এনপ আওয় ম প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

শিক্ষা আন্দোলনের চেতনা বনাম রাষ্ট্রের নীরবতা

পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলনের ওপর দাঁড়িয়ে ইতিহাস আমাদের প্রভূত জাতীয়তাবাদী শক্তি দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পুরোনো ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ নতুন মোড়ক জন্ম দিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ, যা তাঁরা ১৯০৫-১৯১১ সাল পর্যন্ত গ্রহণ করেননি; কিন্তু ১৯৪৮ সালের পর সেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে গ্রাহ্য করা জরুরি ছিল।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠল পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক ‘ডমিনেন্ট হেজিমনি’র বিপরীতে নিপীড়িত জাতিসত্তার কণ্ঠস্বর। এই প্রভাব বাংলাদেশকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে জন্ম দিলেও ভাষা আন্দোলন আমাদের পাঠ্যপুস্তকীয় ইতিহাসে শুধু ‘বায়ান্ন’ ও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’তে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এটা রাষ্ট্রই সুচারুভাবে গড়ে তুলেছে। কেননা, এতে তার তথাকথিত উদারবাদী রাজনীতির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা সহজ হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত করা যায় প্রতিরোধের রাজনীতিকে।

রাষ্ট্রের এই রাজনীতির সবচেয়ে বড় বলি হয়েছে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন, মুখ্যত বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে এ রাষ্ট্রে, শিক্ষা আন্দোলন প্রসঙ্গে তার সিকিভাগ বিদ্যায়তনিক মনোযোগও দেওয়া হয়নি। অথচ ভিন্ন আলাপ তুললে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন মূলত ভাষা আন্দোলনের যে প্রতিরোধ, সেটিরই একটি পরিবর্ধিত রূপ এবং প্রাথমিক পূর্ণতার জন্মদাতা।

আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এই গৌরবগাথার বয়ান পাবেন মাত্র এক অনুচ্ছেদ। এই দ্বিচারিতার পেছনেও অন্য এক রাজনীতি আছে। সত্য এই যে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান হয়ে বাংলাদেশ অর্জন পর্যন্ত; কিন্তু নতুন দেশে শিক্ষাব্যবস্থা যতটা সর্বজনীন ও বি–উপনিবেশিত করা উচিত ছিল, সেদিকে রাষ্ট্র ও সরকারগুলোর যথাযথ আগ্রহ আজও নেই।

কেন হয়েছিল শিক্ষা আন্দোলন

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার পথ ধরেছিল পাকিস্তানের সামরিক আমলাতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রী শাসকগোষ্ঠী। ঔপনিবেশিক মনোজগৎ নিয়েই ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি গঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের সচিব এস এম শরীফের নেতৃত্বাধীন শিক্ষা কমিশন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাবাদর্শে শিক্ষাকে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষায় শরীফ শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন জমা দেয়। মাত্র আট মাসে প্রস্তুত সেই প্রতিবেদন প্রত্যাঘাতের ভয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। প্রকাশিত হওয়ার পরপরই পূর্ববঙ্গ আবার ফুঁসে ওঠে। ভেঙে ফেলে আইয়ুব শাহির রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকা সময়ের কঠিন-কঠোর মার্শাল ল। কেন? এর গুরুত্বটা অনুধাবন করা প্রয়োজন।

প্রতিবেদনের সুপারিশে শরীফ কমিশন প্রথমত বলেছিল, উর্দু হবে পাকিস্তানের শিক্ষার ভাষা, ইংরেজি হবে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বাধ্যতামূলক আর বাংলা বর্ণমালার বদলে চালু হবে রোমান হরফ (রোমান হরফে ইউরোপীয় বহু দেশ তাদের ভাষাকে লিখিতভাবে প্রকাশ করে)।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষাকে পণ্য ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্র শিক্ষার দায়িত্ব নেবে না বলে কমিশন সুপারিশ করে। অর্থাৎ যাঁর টাকা আছে, শিক্ষার অধিকার তাঁরই, এটাই ছিল এই সুপারিশের মূলকথা।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক (ফ্রি) না করার পরিপূর্ণ পাঁয়তারা ছিল এই সুপারিশে। পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই পূর্ববঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছিল। কমিশনের সুপারিশ তাতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে উঠল। গ্রাম-অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গে বরাবরই কৃষক ও শ্রমিকেরা ছিল সংখ্যাগুরু। ভাষা ও অর্থের মারণাস্ত্র প্রয়োগ করলে এই বিশাল মেহনতি শ্রমজীবী শ্রেণির সন্তানেরা শিক্ষিত হবে কীভাবে?

এই যে দুটি বিপদ, এগুলো নতুন নয়, পুরোনোই। ১৮৩৫ সালে দেওয়া ম্যাকওলে নীতিরই নতুন সংস্করণ। প্রথমে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি চাপিয়ে দেওয়া; তারপর ইংরেজি না জানলে চাকরি না পাওয়ার আতঙ্ক ঢোকানো ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতি। ঠিক একই খড়্‌গ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আবারও নেমে এল ১৯৬২ সালে।

শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরোধিতা ও মাতৃভাষায় শিক্ষার দাবিতে রাজপথে নামলেন। লম্বা সে লড়াইয়ের ইতিহাস। সে ইতিহাস গৌরবেরও, চাঞ্চল্যেরও। লম্বা সময় ধরে লড়াই করার পর ১৭ সেপ্টেম্বর হরতাল ডাকা হলো, যার মূল কুশীলব ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মোহাম্মদ ফরহাদ ও ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান।

সেই হরতালের মিছিলে গুলি চলল। শহীদ হলেন মোস্তফা, বাবুল ও ওয়াজিউল্লাহ। টঙ্গীতে সুন্দর আলী। সেই থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘শিক্ষা দিবস’। কিন্তু সেটি নামে, মর্মে-কর্মে অতলান্ত বিস্মৃতির ছাপ।

ভাষার প্রশ্নটি শিক্ষা ও কর্মসংস্থানেরও প্রশ্ন

শিক্ষার প্রশ্নটি যে ভাষার সঙ্গে যুক্ত ছিল, তা শরীফ কমিশনের সুপারিশ থেকেই স্পষ্ট। কিন্তু একে শুধু ১৯৫২ বা ১৯৬২ সালের ঘটনাবলি দিয়ে মোটেও বোঝা যাবে না। যেতে হবে ইতিহাস ও রাজনীতির আরও গভীরে।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আট বছরের সংগ্রাম তাতে আপাত সফল হয়; কিন্তু এই সাফল্যের চেয়েও বড় অর্জন আছে।

ভাষার প্রশ্নটিকে পূর্ববঙ্গের উদয়োন্মুখ (অ্যাসপায়েরিং) শিক্ষিত মধ্যবিত্ত (শিক্ষার্থী ও বুদ্ধিজীবীরা) যে আর্থসামাজিক বয়ান দিয়ে মোকাবিলা করেছিলেন, তার তুল্য বিচার হতে পারে ১৮৫৭ সালের প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধে সিপাহি বিদ্রোহের সঙ্গে। সেই প্রতিরোধকে ঔপনিবেশিক বিদ্যায়তনিক ভাষায় ক্ষুদ্রার্থে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ বলা হলেও আদতে তা ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক উৎপাদন সম্পর্ক তথা সার্বিকভাবে উৎপাদন পদ্ধতিকে নাকচ করে পুরো ভারতবর্ষে প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়েছিল।

ভাষা আন্দোলনের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য প্রকট। ভাষার সঙ্গে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সম্পর্ককে সামনে আনা হয়েছিল। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভারতের মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হিসেবে গড়ে তোলার যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছিল, তা মুসলিম লীগ ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহই প্রথম নাকচ করে প্রতারণা করেন। সেই স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গের জমিনে সব আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে।

ভাষা হিসেবে বাংলাকে নাকচ করে দেওয়ার সঙ্গে এই স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষাকে ভূলুণ্ঠিত করার সম্পর্ক আছে। পূর্ববঙ্গ স্বায়ত্তশাসন পেলে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করেই তার গঠন তৈরি হতো। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতাকাঠামো তার ওপর চাপিয়ে দিতে চাইল উর্দু, যা পূর্ববঙ্গের আমজনতার কাছে ‘ভিনদেশি’ ভাষাই ছিল মুখ্যত। এমতাবস্থায় শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই সামনে এসে গেছে।

শিক্ষার মাধ্যম (মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন) ও চাকরির পরীক্ষার ভাষা উর্দু হলে বাঙালি সেই ভার বহন করতে পারত না। মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানিরা উর্দুকে শুধু একক রাষ্ট্র ভাষাই বানাতে চায়নি, পঞ্চাশের দশকে বাংলা লিখতে বলেছিল ফার্সি-আরবি প্রভাবিত নাস্তালিক হরফে, যে হরফে পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষাগুলো লিখিত।

নৌবাহিনীর পরীক্ষা উর্দুতে নেওয়ার প্রতিবাদ এ জন্যই হয়েছিল। নদীমাতৃক পূর্ববঙ্গকে পশ্চিমা উর্দুভাষী রেজিমেন্ট দ্বারা চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলার এই প্রবণতা খেয়াল করার মতো। মনে রাখতে হবে, এই প্রবণতা পঞ্চাশের দশকের শুরুর প্রবণতা, একাত্তরের গণহত্যা যার চূড়ান্ত পরিণতি। ভাষাকেন্দ্রিক লড়াই তাই শুধু ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সীমিত ছিল না। এর সঙ্গে একটি প্রতারিত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিকভাবে বিকাশের সম্পর্ক জড়িত। জড়িত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইও।

আর অন্তরে ছিল এমন একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীকে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা, যারা ১৮৫৭ সালের মতোই প্রথাগত উৎপাদন–সম্পর্ক ও উৎপাদনপদ্ধতিকে সমূলে উৎপাটন করে আপামর জনগোষ্ঠীর কথা ঊর্ধ্বে তুলে ধরবে। যুক্ত হয়েছিল ভূমিব্যবস্থা বদলে ফেলতে চাওয়া বিখ্যাত তেভাগা আন্দোলনের লড়াইয়ের স্পিরিট, যার প্রভাবে ১৯৫০ সালের জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হয়।

১৯৫০ সালে রাজশাহীর জেলে সংঘটিত হয় কুখ্যাত ‘খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড’, যেখানে রাজবন্দী বামপন্থী নেতা-কর্মীদের মধ্যে ৭ জন নিহত হন, আহত হন ৩০ জনের বেশি। ১৯৫৪ সালে আদমজী ও কর্ণফুলী কারখানায় বাঙালি শ্রমিকদের ওপর অবাঙালি মালিকগোষ্ঠীর লেলিয়ে দেওয়া দানবীয় হত্যাকাণ্ডে নিহত হন ৯০ জন, আহত হন ২৫০ জনের বেশি শ্রমিক। ভাষা আন্দোলন এসব নির্মমতার বিরুদ্ধেও প্রতিরোধের অপর নাম।

সবিশেষে এই আন্দোলন এমন কিছু আর্থসামাজিক বিষয় সামনে এনেছিল, যা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের মেহনতি মানুষের দুর্দশা লাঘবের বড় মঞ্চ হয়ে উঠেছিল, স্বপ্ন দেখিয়েছিল উৎপাদন-সম্পর্ক বদলের। এ কারণেই এটি একটি আন্দোলন মাত্র ছিল না, ছিল অভিজাত ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে একেকটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ‘অনন্য অভ্যুত্থান’।

শরীফ শিক্ষা কমিশন বাতিল হয় শিক্ষার্থীদের আত্মবলিদানের শক্তিতেই। মনে রাখতে হবে, রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল; লড়াইটা তাই মূল ভাষা আন্দোলনের চেয়েও কঠিন ছিল; কিন্তু এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে হলে রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলে ফেলার প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন ছিল। নতুন রাষ্ট্র অভিজাত শ্রেণির বিপক্ষে যেতে চায়নি। তাই ভাষা আন্দোলনের পরম্পরা হিসেবে শিক্ষা আন্দোলনের যে চেতনা তৈরি হয়েছিল, তা লোপাট হয়ে গেছে।ভাষা ও ‘শিক্ষার মাধ্যম’ অঙ্গাঙ্গি ছিল

নতুন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এ প্রসঙ্গ মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ভারত ভাগ হওয়ার আগপর্যন্ত বারবার এড়িয়ে গেছেন। পূর্ববঙ্গের নেতারাও সেটি অনুভব করেননি। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক পরিষদে শিক্ষার অধিকার প্রসঙ্গে যে ইশতেহার তুলে ধরেন, তাতে ভাষার প্রসঙ্গটি স্থান পায়নি। ছাত্র-যুবা ও বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু ঠিকই আলাপটা তুলেছিলেন। তবে সেটি শুধু রাষ্ট্রভাষার প্রসঙ্গে নয়, এর সঙ্গে তাঁরা শিক্ষার মাধ্যম নিয়েও কথা বলেছেন।

১৯৪৭ সালের জুলাইয়ে গণ আজাদী লীগ, ১৯৪৭ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গণতান্ত্রিক যুবলীগ, ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা—বাংলা না উর্দু শীর্ষক পুস্তিকায় তমদ্দুন মজলিস বাংলাকে পূর্ববঙ্গের দাপ্তরিক ভাষা করার পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবি তোলেন। গণতান্ত্রিক যুবলীগ তো অবৈতনিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষারও দাবি জানায়।

মোদ্দাকথা, শুধু রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেই ভাষার অধিকার বাস্তবায়িত হয় না। এর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত হয় মূলত শিক্ষায়, সরকারি দপ্তরে ও চাকরির পরীক্ষায়; কিন্তু ১৯৫৬ সালে সাংবিধানিক স্বীকৃতির তথাকথিত ভণিতা ছাড়া বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি পাকিস্তানিদের মনোভাব কখনোই বদলায়নি। সেই মনোভাবেরই প্রতিফলন শরীফ শিক্ষা কমিশন। এ জন্যই শিক্ষা আন্দোলন নিয়ে আমাদের বয়ান ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি।

শিক্ষা ও আজকের বাংলাদেশ

শরীফ শিক্ষা কমিশন বাতিল হয় শিক্ষার্থীদের আত্মবলিদানের শক্তিতেই। মনে রাখতে হবে, রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল; লড়াইটা তাই মূল ভাষা আন্দোলনের চেয়েও কঠিন ছিল; কিন্তু এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে হলে রাষ্ট্রের খোলনলচে বদলে ফেলার প্রচেষ্টা থাকা প্রয়োজন ছিল। নতুন রাষ্ট্র অভিজাত শ্রেণির বিপক্ষে যেতে চায়নি। তাই ভাষা আন্দোলনের পরম্পরা হিসেবে শিক্ষা আন্দোলনের যে চেতনা তৈরি হয়েছিল, তা লোপাট হয়ে গেছে।

যে কারণে রাষ্ট্রীয় শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে বারবার শিক্ষার্থীদের নামতে হয়েছে। এরশাদের আমলে মজিদ খান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা জীবন দিয়েছেন, যে দিনটি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস নামে স্বীকৃত হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের করতে হয়েছে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে হয়েছে বর্ধিত ফি–বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন।

বিস্ময়কর বটে, বর্তমান শিক্ষার্থীদের অনেকেই হয়তো জানেনই না শিক্ষা দিবস কী ও কেন! ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বর সম্পর্কে জানেন; কারণ, পাঠ্যপুস্তকে এগুলো স্বাভাবিক মহিমায় প্রকাশিত হয়েছে। ১৭ সেপ্টেম্বর নিয়ে সেটি করতে গেলে রাষ্ট্রকে সরাসরি শিক্ষা সংকোচন নীতি ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে; কিন্তু রাষ্ট্র সেটি করবে না।

সেটি করলে রাষ্ট্রের তথাকথিত উদার অর্থনীতি ও ব্যক্তিমালিকানায় শিক্ষাকে সোপর্দ করার সব নকশা শিক্ষার্থী সমাজের কাছে উন্মোচিত হয়ে যাবে।

শিক্ষার্থীরা তখন প্রশ্ন করবেন, ‘এ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে শিক্ষাক্ষেত্রে আমি বৈষম্যের শিকার কেন হচ্ছি? কেন রাষ্ট্র দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক হলেও, দেশের টাকা বিদেশে পাচার করতে দিলেও যেকোনো স্তরে আমার শিক্ষার ভার বহন করবে না?’

এসব প্রশ্নের উত্তর পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোয় চলতে চাওয়া রাষ্ট্রের কাছে নেই। শিক্ষা দিবসের দুর্দমনীয় চেতনা তাই শুধু কাগজের কালিতেই লেখা আছে; মর্মে নেই, কর্মে তো নেই-ই।

ড. সৌমিত জয়দ্বীপ, সহকারী অধ্যাপক, স্কুল অব জেনারেল এডুকেশন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ