সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফেরার শঙ্কা যেখানে
Published: 7th, July 2025 GMT
জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে একের পর এক ইস্যু তৈরি করে পরিস্থিতি ক্রমে ঘোলাটে করা হচ্ছে। বিভিন্ন দল নিজেদের ইচ্ছেমতো শর্ত দিয়ে নির্বাচনকে আটকে দিতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। অহেতুক অপ্রয়োজনীয় আলাপ শুরু করা হচ্ছে। এমন সব বিষয় আলোচনায় আনা হচ্ছে, যা অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। এমনই একটি বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনে ভোটের সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির প্রয়োগ করা। আসনভিত্তিক নির্বাচনপদ্ধতির পরিবর্তে এ পদ্ধতির কথা সম্প্রতি ইসলামপন্থী দলগুলোর সমাবেশে বলা হয়েছে। এর আগে জামায়াতে ইসলামী ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (জানাপা) বিভিন্ন সময় এ পদ্ধতির পক্ষে বলেছে।
এ দাবির পক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে, ভবিষ্যতে যেকোনো দলের কর্তৃত্ববাদী হওয়া ঠেকানো, সংখ্যালঘু দলের সরকার গঠন ঠেকানো, সব দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
তাদের এসব যুক্তিতে ত্রুটি আছে। প্রথম ত্রুটি হচ্ছে ভোটের হিসাব করে কর্তৃত্ববাদী ঠেকানো সম্ভব নয়। ইরান, তুরস্ক বা রাশিয়ায় নিয়মিত নির্বাচন হয়। তাদের নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি অনিয়মের তথ্য পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। আবার একই সঙ্গে এই তিন দেশে কর্তৃত্ববাদ ঠেকানো সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য তুরস্কে সংসদ গঠিত হয় সংখ্যানুপাতিক পার্টি লিস্ট পদ্ধতিতে; কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা রয়েছে। তাই এই পদ্ধতির সংসদের খুব বেশি গুরুত্ব নেই। তুরস্কে এখন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানই শেষ কথা, ইরানের আয়াতুল্লা আলী খামেনি বা রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের মতো।
দ্বিতীয়ত আসনভিত্তিক পদ্ধতিতে সংখ্যালঘুর সরকার গঠিত হয় না। যেমন ১৯৯১ সালে বিএনপি ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। তাদের আসন সংখ্যা ছিল ১৪০। আর আওয়ামী লীগ মোট ভোট পেয়েছিল প্রদত্ত ভোটের ৩০ দশমিক ১ শতাংশ; কিন্তু তাদের আসন ছিল ৮৮টি। আবার ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯৩ আসনে জয়ী হয়। আর আওয়ামী লীগ ৪০ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়ে মাত্র ৬২ আসনে জয়ী হয়। এ পদ্ধতিতে দেশকে বিভিন্ন নির্বাচনী আসনে বিভাজিত করে স্থানীয় জনসাধারণের চাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। মতামতের একধরনের বিকেন্দ্রিকতা এই পদ্ধতিতে লক্ষ্য করা যায়। তাই সর্বোচ্চ আসন পাওয়া দলটি সরকার গঠন করে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবি প্রথম এসেছে আওয়ামী লীগের মিত্রদের কাছ থেকে। ’৯০ দশকে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের মিত্র কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবির তরফ থেকে প্রথম সংখ্যানুপাতিক আসন বণ্টনের কথা বলা হয়। এরপর আরেক আওয়ামী মিত্র জাতীয় পার্টি এ বিষয়ে আলাপ তুলে। এরপর আওয়ামী লীগের নেতারাও বিভিন্ন সময় এর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। এসব তথ্য পাওয়া খুব কঠিন বিষয় নয়। ইন্টারনেট ঘাঁটলেই এসব তথ্য বেরিয়ে আসবে।
আমাদের দেশে এ ধরনের শক্তিশালী ও স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নেই। আমাদের সবকিছু কেন্দ্রীয় সরকার শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত। এ অবস্থায় সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। সব থেকে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে পতিত আওয়ামী লীগ ভিন্ন পরিচয়ে সংসদে ফিরে আসতে পারে।আগামী নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের জুতায় পা গলিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, জানাপা ও ইসলামপন্থী দলগুলো। আওয়ামী লীগ ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বিএনপির কাছাকাছি ভোট পেয়েও সরকার গঠন করতে পারেনি প্রয়োজনীয় আসন জিততে না পারায়। আবার জামায়াত ও ইসলামপন্থী দলগুলো এককভাবে কখনোই আসনভিত্তিক নির্বাচনে ভালো করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে জামায়াত এককভাবে নির্বাচন করে তিনটি আসনে জিতেছিল। আর ইসলামী ঐক্য জোট এক বা দুটি আসনে জিতেছে।
বর্তমানেও তাদের অবস্থার হেরফের হয়নি। জনসমর্থন এমনভাবে বাড়েনি, যাতে তারা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসনে জয়ী হতে পারবে। আর নতুন দল হিসাবে জানাপার অবস্থাও খুব বেশি আশাব্যঞ্জক না। এ অবস্থায় তারা হিসাব কষছে ভোটের সংখ্যানুপাতিক হিসাব হলে সংসদে বেশি আসন পাবে। যেমন জামায়াত এককভাবে নির্বাচন করে সর্বোচ্চ তিনটি আসন পেয়েছে। অনেকেই ১৯৯১ সালের নির্বাচনের হিসাব সামনে আনতে পারেন; কিন্তু ওই সময় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের অঘোষিত সমঝোতার কারণে ১৮টি আসনে জিতেছিল। যেমন ১৯৯১ সালে পাবনার একটি আসন থেকে জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী ৫৫ হাজার ৭০৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন; কিন্তু ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এককভাবে অংশ নিয়ে তিনি তৃতীয় স্থানে ছিলেন।
২০০১ সালে আবার বিএনপির সঙ্গে জোট করে তিনি জিতে আসেন। ফলে বোঝা যাচ্ছে, জোটবিহীন অবস্থায় তিনি জয়ী হতে পারেননি। ১৯৯৬ নির্বাচনে জামায়াতের ভোট ছিল প্রদত্ত ভোটের ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। সংখ্যানুপাতিক আসন বণ্টন হলে ওই সংসদে জামায়াতের আসন থাকত ২৭টি। তাহলে মতিউর রহমান নিজামী ১৯৯৬ সালের সংসদ সদস্য হতে পারতেন। আবার এ পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে খুব ভালো না করা বর্তমান আমির শফিকুর রহমান সংসদ সদস্য হতে পারবেন। মূলত এ কারণেই জামায়াত সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জানাপাসহ কয়েকটি দলও জামায়াতর সঙ্গে গলা মিলিয়েছে। যেহেতু এই দলগুলোর জনপ্রিয়তা কম, তাই আসনভিত্তিক নির্বাচনে বেশি আসন পাওয়ার সুযোগ কম। তাই তারা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির দাবি করছে কিছু আসন পাওয়ার আশায়।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সব দলের প্রতিনিধিত্বের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে সংসদে তাদের সবার উপস্থিতি থাকে না। সংসদে আসন পাওয়ার জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক ভোট পেতে হয়। যেমন মিশ্রপদ্ধতির নির্বাচন হলেও জার্মানিতে কমপক্ষে ৫ শতাংশ ভোট না পেলে সংসদে কোনো আসন পাওয়া যায় না। কোনো দেশে কমপক্ষে ৭ শতাংশ ভোট পেতে হয়। আবার কোনো দেশে ২.
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির সব থেকে বড় ত্রুটি এতে সরাসরি জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা যায় না। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দল নির্বাচিত করা হয়। দু–একটি দেশে ব্যতিক্রম ছাড়া এ পদ্ধতি অনুসরণ করা বেশির ভাগ দেশেই পার্টির লিস্ট অনুসারে প্রতিনিধি নির্ধারিত হয়। এতে দলের বা দলীয় প্রধানের কর্তৃত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। দল বা দলীয় প্রধান যাঁকে চাইবেন, সে–ই কেবল সংসদে যেতে পারবেন। অনেক সময় আসনভিত্তিক নির্বাচনে স্থানীয় জনপ্রিয়তার কথা বিবেচনা করে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে এই সুযোগ কমে আসে। দলগুলো স্থানীয় ভোটারের মতামতের গুরুত্ব দেয় না। এতে ক্ষমতা আরও কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। ভোটারদের ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে যায়।
এ পদ্ধতির কারণে উগ্রবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংসদে অনুপ্রবেশের শঙ্কা থাকে। ভোটারদের মধ্যে গোষ্ঠী কেন্দ্রীকতা বা ধর্মকেন্দ্রীকতার রাজনীতির প্রসার ঘটে। কট্টর জাতিবাদিতার বিকাশ ঘটতে পারে। একটি রাষ্ট্র বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীতে বিভাজিত হতে পারে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে পারে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।
এতে দেশে দুর্বল ও অস্থিতিশীল সরকার গঠিত হবে। সরকার বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে। বিভিন্ন অগ্রহণযোগ্য বিষয়ে সমঝোতা করতে বাধ্য হবে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে। এতে সাংবিধানিক স্থবিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
এ পদ্ধতিতে ভোটারদের কাছে জবাবদিহি কমে যায়। সংসদ সদস্যরা এ কারণে স্থানীয় বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন না। স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
এসবের বাইরে ভোটারদের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ কমে যেতে পারে। তখন কেবল দলের প্রতি অনুগতরাই ভোট দিয়ে থাকেন। সুইং ভোটারদের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ কমে যেতে পারে।
এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলো ধর্তব্যের মধ্যে আনলে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নিম্নকক্ষ, উচ্চকক্ষ কোনো কক্ষেই এ পদ্ধতি প্রয়োগের সুযোগ নেই। নিম্নকক্ষে আসনভিত্তিক নির্বাচন করে উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক বণ্টন রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রের কোনো পরিবর্তন আনবে না। অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বিষয়ে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টা এমন যে ঠিক আছে দাবি মেনে নিয়ে কয়েকটি দলকে উচ্চকক্ষে কিছু আসন দিয়ে দিলাম। রাষ্ট্র পরিচালনা কোনো ছেলেখেলার বিষয় নয়। এখানে বুদ্ধি ও বিবেচনা প্রয়োগ করতে হয়।
এখন প্রশ্ন হতে পারে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে কেন এই পদ্ধতির প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর প্রথম কারণ হচ্ছে ইউরোপের এই দেশগুলোর বেশির ভাগেই প্রাদেশিক ও নগর সরকার পদ্ধতির শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা আছে। এই স্থানীয় সরকারগুলো পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত। এরা নিজেদের উন্নয়ন পরিকল্পনা নিজেরাই তৈরি করে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন, ব্যবসা–বাণিজ্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব স্থানীয় সরকারের অধীন থাকে।
কেন্দ্রীয় সরকার কেবল আইন ও নীতি তৈরি করে দেয়। স্থানীয় সরকারগুলো সেই আইন ও নীতি যথাযথভাবে অনুসরণ করছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করে। কেবল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতির কাজগুলো পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে। এই দুই বিষয় ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত স্থানীয় সরকারগুলো অমান্য করে নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এ ছাড়া অনেক দেশেই রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা রয়েছে।
আমাদের দেশে এ ধরনের শক্তিশালী ও স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নেই। আমাদের সবকিছু কেন্দ্রীয় সরকার শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত। এ অবস্থায় সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। সব থেকে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে পতিত আওয়ামী লীগ ভিন্ন পরিচয়ে সংসদে ফিরে আসতে পারে।
সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে, আমাদের দেশ কোনোভাবেই সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত না। এখানে এ পদ্ধতির প্রয়োগ সম্ভবও নয়। তবে জোর করে প্রয়োগ করা হতে পারে; কিন্ত এই পদ্ধতি সার্বিকভাবে দেশকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে। কোনো কোনো ছোট দল নিজদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে চাইছে। সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির গণ্ডি থেকে তারা বের হতে পারছে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়।
ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক ন দ র য় সরক র স থ ন য় সরক র কর ত ত ব অবস থ য় এককভ ব র জন ত আম দ র ইসল ম দশম ক দলগ ল ব এনপ আওয় ম প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফেরার শঙ্কা যেখানে
জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে একের পর এক ইস্যু তৈরি করে পরিস্থিতি ক্রমে ঘোলাটে করা হচ্ছে। বিভিন্ন দল নিজেদের ইচ্ছেমতো শর্ত দিয়ে নির্বাচনকে আটকে দিতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। অহেতুক অপ্রয়োজনীয় আলাপ শুরু করা হচ্ছে। এমন সব বিষয় আলোচনায় আনা হচ্ছে, যা অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। এমনই একটি বিষয় হচ্ছে, নির্বাচনে ভোটের সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির প্রয়োগ করা। আসনভিত্তিক নির্বাচনপদ্ধতির পরিবর্তে এ পদ্ধতির কথা সম্প্রতি ইসলামপন্থী দলগুলোর সমাবেশে বলা হয়েছে। এর আগে জামায়াতে ইসলামী ও নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (জানাপা) বিভিন্ন সময় এ পদ্ধতির পক্ষে বলেছে।
এ দাবির পক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে, ভবিষ্যতে যেকোনো দলের কর্তৃত্ববাদী হওয়া ঠেকানো, সংখ্যালঘু দলের সরকার গঠন ঠেকানো, সব দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।
তাদের এসব যুক্তিতে ত্রুটি আছে। প্রথম ত্রুটি হচ্ছে ভোটের হিসাব করে কর্তৃত্ববাদী ঠেকানো সম্ভব নয়। ইরান, তুরস্ক বা রাশিয়ায় নিয়মিত নির্বাচন হয়। তাদের নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি অনিয়মের তথ্য পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। আবার একই সঙ্গে এই তিন দেশে কর্তৃত্ববাদ ঠেকানো সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য তুরস্কে সংসদ গঠিত হয় সংখ্যানুপাতিক পার্টি লিস্ট পদ্ধতিতে; কিন্তু সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা রয়েছে। তাই এই পদ্ধতির সংসদের খুব বেশি গুরুত্ব নেই। তুরস্কে এখন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানই শেষ কথা, ইরানের আয়াতুল্লা আলী খামেনি বা রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের মতো।
দ্বিতীয়ত আসনভিত্তিক পদ্ধতিতে সংখ্যালঘুর সরকার গঠিত হয় না। যেমন ১৯৯১ সালে বিএনপি ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। তাদের আসন সংখ্যা ছিল ১৪০। আর আওয়ামী লীগ মোট ভোট পেয়েছিল প্রদত্ত ভোটের ৩০ দশমিক ১ শতাংশ; কিন্তু তাদের আসন ছিল ৮৮টি। আবার ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯৩ আসনে জয়ী হয়। আর আওয়ামী লীগ ৪০ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়ে মাত্র ৬২ আসনে জয়ী হয়। এ পদ্ধতিতে দেশকে বিভিন্ন নির্বাচনী আসনে বিভাজিত করে স্থানীয় জনসাধারণের চাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। মতামতের একধরনের বিকেন্দ্রিকতা এই পদ্ধতিতে লক্ষ্য করা যায়। তাই সর্বোচ্চ আসন পাওয়া দলটি সরকার গঠন করে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের দাবি প্রথম এসেছে আওয়ামী লীগের মিত্রদের কাছ থেকে। ’৯০ দশকে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের মিত্র কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবির তরফ থেকে প্রথম সংখ্যানুপাতিক আসন বণ্টনের কথা বলা হয়। এরপর আরেক আওয়ামী মিত্র জাতীয় পার্টি এ বিষয়ে আলাপ তুলে। এরপর আওয়ামী লীগের নেতারাও বিভিন্ন সময় এর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। এসব তথ্য পাওয়া খুব কঠিন বিষয় নয়। ইন্টারনেট ঘাঁটলেই এসব তথ্য বেরিয়ে আসবে।
আমাদের দেশে এ ধরনের শক্তিশালী ও স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নেই। আমাদের সবকিছু কেন্দ্রীয় সরকার শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত। এ অবস্থায় সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। সব থেকে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে পতিত আওয়ামী লীগ ভিন্ন পরিচয়ে সংসদে ফিরে আসতে পারে।আগামী নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের জুতায় পা গলিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, জানাপা ও ইসলামপন্থী দলগুলো। আওয়ামী লীগ ১৯৯১ ও ২০০১ সালে বিএনপির কাছাকাছি ভোট পেয়েও সরকার গঠন করতে পারেনি প্রয়োজনীয় আসন জিততে না পারায়। আবার জামায়াত ও ইসলামপন্থী দলগুলো এককভাবে কখনোই আসনভিত্তিক নির্বাচনে ভালো করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে জামায়াত এককভাবে নির্বাচন করে তিনটি আসনে জিতেছিল। আর ইসলামী ঐক্য জোট এক বা দুটি আসনে জিতেছে।
বর্তমানেও তাদের অবস্থার হেরফের হয়নি। জনসমর্থন এমনভাবে বাড়েনি, যাতে তারা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসনে জয়ী হতে পারবে। আর নতুন দল হিসাবে জানাপার অবস্থাও খুব বেশি আশাব্যঞ্জক না। এ অবস্থায় তারা হিসাব কষছে ভোটের সংখ্যানুপাতিক হিসাব হলে সংসদে বেশি আসন পাবে। যেমন জামায়াত এককভাবে নির্বাচন করে সর্বোচ্চ তিনটি আসন পেয়েছে। অনেকেই ১৯৯১ সালের নির্বাচনের হিসাব সামনে আনতে পারেন; কিন্তু ওই সময় বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের অঘোষিত সমঝোতার কারণে ১৮টি আসনে জিতেছিল। যেমন ১৯৯১ সালে পাবনার একটি আসন থেকে জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী ৫৫ হাজার ৭০৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন; কিন্তু ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এককভাবে অংশ নিয়ে তিনি তৃতীয় স্থানে ছিলেন।
২০০১ সালে আবার বিএনপির সঙ্গে জোট করে তিনি জিতে আসেন। ফলে বোঝা যাচ্ছে, জোটবিহীন অবস্থায় তিনি জয়ী হতে পারেননি। ১৯৯৬ নির্বাচনে জামায়াতের ভোট ছিল প্রদত্ত ভোটের ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। সংখ্যানুপাতিক আসন বণ্টন হলে ওই সংসদে জামায়াতের আসন থাকত ২৭টি। তাহলে মতিউর রহমান নিজামী ১৯৯৬ সালের সংসদ সদস্য হতে পারতেন। আবার এ পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে খুব ভালো না করা বর্তমান আমির শফিকুর রহমান সংসদ সদস্য হতে পারবেন। মূলত এ কারণেই জামায়াত সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জানাপাসহ কয়েকটি দলও জামায়াতর সঙ্গে গলা মিলিয়েছে। যেহেতু এই দলগুলোর জনপ্রিয়তা কম, তাই আসনভিত্তিক নির্বাচনে বেশি আসন পাওয়ার সুযোগ কম। তাই তারা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির দাবি করছে কিছু আসন পাওয়ার আশায়।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সব দলের প্রতিনিধিত্বের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে সংসদে তাদের সবার উপস্থিতি থাকে না। সংসদে আসন পাওয়ার জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক ভোট পেতে হয়। যেমন মিশ্রপদ্ধতির নির্বাচন হলেও জার্মানিতে কমপক্ষে ৫ শতাংশ ভোট না পেলে সংসদে কোনো আসন পাওয়া যায় না। কোনো দেশে কমপক্ষে ৭ শতাংশ ভোট পেতে হয়। আবার কোনো দেশে ২.৫ শতাংশ পেতে হয়। এটা মূলত জনসংখ্যা, রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ও ভোটার সংখ্যার ওপর নির্ভর করে।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির সব থেকে বড় ত্রুটি এতে সরাসরি জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করা যায় না। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দল নির্বাচিত করা হয়। দু–একটি দেশে ব্যতিক্রম ছাড়া এ পদ্ধতি অনুসরণ করা বেশির ভাগ দেশেই পার্টির লিস্ট অনুসারে প্রতিনিধি নির্ধারিত হয়। এতে দলের বা দলীয় প্রধানের কর্তৃত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। দল বা দলীয় প্রধান যাঁকে চাইবেন, সে–ই কেবল সংসদে যেতে পারবেন। অনেক সময় আসনভিত্তিক নির্বাচনে স্থানীয় জনপ্রিয়তার কথা বিবেচনা করে নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে এই সুযোগ কমে আসে। দলগুলো স্থানীয় ভোটারের মতামতের গুরুত্ব দেয় না। এতে ক্ষমতা আরও কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। ভোটারদের ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে যায়।
এ পদ্ধতির কারণে উগ্রবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সংসদে অনুপ্রবেশের শঙ্কা থাকে। ভোটারদের মধ্যে গোষ্ঠী কেন্দ্রীকতা বা ধর্মকেন্দ্রীকতার রাজনীতির প্রসার ঘটে। কট্টর জাতিবাদিতার বিকাশ ঘটতে পারে। একটি রাষ্ট্র বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীতে বিভাজিত হতে পারে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে পারে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।
এতে দেশে দুর্বল ও অস্থিতিশীল সরকার গঠিত হবে। সরকার বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে। বিভিন্ন অগ্রহণযোগ্য বিষয়ে সমঝোতা করতে বাধ্য হবে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে। এতে সাংবিধানিক স্থবিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
এ পদ্ধতিতে ভোটারদের কাছে জবাবদিহি কমে যায়। সংসদ সদস্যরা এ কারণে স্থানীয় বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন না। স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
এসবের বাইরে ভোটারদের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ কমে যেতে পারে। তখন কেবল দলের প্রতি অনুগতরাই ভোট দিয়ে থাকেন। সুইং ভোটারদের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ কমে যেতে পারে।
এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলো ধর্তব্যের মধ্যে আনলে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নিম্নকক্ষ, উচ্চকক্ষ কোনো কক্ষেই এ পদ্ধতি প্রয়োগের সুযোগ নেই। নিম্নকক্ষে আসনভিত্তিক নির্বাচন করে উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক বণ্টন রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রের কোনো পরিবর্তন আনবে না। অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার বিষয়ে সমঝোতার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টা এমন যে ঠিক আছে দাবি মেনে নিয়ে কয়েকটি দলকে উচ্চকক্ষে কিছু আসন দিয়ে দিলাম। রাষ্ট্র পরিচালনা কোনো ছেলেখেলার বিষয় নয়। এখানে বুদ্ধি ও বিবেচনা প্রয়োগ করতে হয়।
এখন প্রশ্ন হতে পারে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে কেন এই পদ্ধতির প্রয়োগ করা হচ্ছে। এর প্রথম কারণ হচ্ছে ইউরোপের এই দেশগুলোর বেশির ভাগেই প্রাদেশিক ও নগর সরকার পদ্ধতির শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা আছে। এই স্থানীয় সরকারগুলো পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসিত। এরা নিজেদের উন্নয়ন পরিকল্পনা নিজেরাই তৈরি করে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন, ব্যবসা–বাণিজ্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব স্থানীয় সরকারের অধীন থাকে।
কেন্দ্রীয় সরকার কেবল আইন ও নীতি তৈরি করে দেয়। স্থানীয় সরকারগুলো সেই আইন ও নীতি যথাযথভাবে অনুসরণ করছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করে। কেবল প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতির কাজগুলো পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকে। এই দুই বিষয় ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত স্থানীয় সরকারগুলো অমান্য করে নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। এ ছাড়া অনেক দেশেই রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা রয়েছে।
আমাদের দেশে এ ধরনের শক্তিশালী ও স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নেই। আমাদের সবকিছু কেন্দ্রীয় সরকার শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত। এ অবস্থায় সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। সব থেকে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে পতিত আওয়ামী লীগ ভিন্ন পরিচয়ে সংসদে ফিরে আসতে পারে।
সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে, আমাদের দেশ কোনোভাবেই সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত না। এখানে এ পদ্ধতির প্রয়োগ সম্ভবও নয়। তবে জোর করে প্রয়োগ করা হতে পারে; কিন্ত এই পদ্ধতি সার্বিকভাবে দেশকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে। কোনো কোনো ছোট দল নিজদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে চাইছে। সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির গণ্ডি থেকে তারা বের হতে পারছে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়।
ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক