চোখেমুখে বয়সের ছাপ, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ আর হাতে ছাতা—তবে শরীরে নেই ক্লান্তির ছাপ। নাম রবীন্দ্র লাল মিত্র। চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দা এ মানুষটি প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েন পত্রিকা বিলি করতে। হাঁটেন প্রায় ২২ কিলোমিটার, কখনো রোদের মধ্যে, কখনো ঝুম বৃষ্টিতে। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী (এনআইডি) তাঁর বয়স ৮২ বছর। তবে বয়স্ক ভাতার বই অনুযায়ী আরও বেশি। তিনি নিজে বলেন, এনআইডির তথ্যে ভুল আছে, তাঁর প্রকৃত বয়স ৯৩ বছর।

রবীন্দ্র মিত্রর জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের দক্ষিণ সমুরা গ্রামে। তাঁর আট বছর বয়সে বাবা নিরঞ্জন লাল মিত্রকে হারান। বাবা না থাকার পরও কোনো রকমে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্য তিনি দ্বিতীয়। বড় ভাই পরিমল লাল মিত্র চট্টগ্রামের কে সি দে রোডে পত্রিকা বিক্রি করতেন। তাঁকেও কাজে লেগে পড়তে হয় কিশোর বয়সেই। চট্টগ্রামের একটি প্রেসে চাকরি নেন মাত্র পাঁচ টাকা বেতনে। বিয়ে করেন সে সময়ই।

প্রেসের কাজ খুবই কষ্টের ছিল রবীন্দ্র মিত্রর। দীর্ঘ ৪০ বছর সেই চাকরিতে কাটানোর পর বাধ্য হয়ে তা ছেড়ে দেন। এরপর ১৯৬০–এর দশকের শুরুতে পত্রিকার হকার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখন থেকেই শুরু হয় গ্রামে গ্রামে হেঁটে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব।

বৃদ্ধ রবীন্দ্র মিত্র এখন থাকেন চট্টগ্রাম শহরে মেয়ের বাসায়। সেখান থেকে বাস ধরে ছুটে যান পটিয়ায়। এরপর শুরু হয় হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি।

যেভাবে পত্রিকার সঙ্গে

রবীন্দ্র মিত্রর বড় ভাই পরিমল লাল মিত্র চট্টগ্রামের কে সি দে রোডে পত্রিকা বিক্রি করতেন। ভাইয়ের কাছ থেকেই প্রথমে ৩০-৩৫টি পত্রিকা নিয়ে শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে তা বেড়ে একসময় দাঁড়ায় ২৫০টিতে। মাস শেষে তাঁর আয় হতো ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা।

একসময় ভালো আয় হলেও এখন ছাপা পত্রিকার দুর্দিনে রবীন্দ্র মিত্রর আয় কমেছে। এখন তিনি জাতীয় ও স্থানীয় মিলিয়ে প্রায় ১৫০টি পত্রিকা বিক্রি করেন। কিন্তু মাস শেষে হাতে থাকে মাত্র আট হাজার টাকার মতো। তিনি বলেন, অনলাইন চালু হওয়ায় এখন অনেকে আর পত্রিকা কেনেন না। কিন্তু গ্রামের মানুষ এখনো খাঁটি খবর ছাপা কাগজেই খোঁজে। তাই চট্টগ্রাম শহর থেকে বাস ধরে পটিয়া গিয়ে প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করেন। এটা এখন তাঁর কাছে নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের পথে পথে হাঁটতে ভালো লাগে তাঁর।

চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রতিদিন সকাল সাতটার আগেই পটিয়ার গৈড়লার টেকে পৌঁছান রবীন্দ্র মিত্র। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে গৈড়লা হাই স্কুল, ঘোষের হাট, তেকোটা, মুকুটনাইট, ধলঘাট ক্যাম্প, খানমোহনা হয়ে কেলিশহর ভট্টাচার্য হাট, দারোগাহাট পর্যন্ত অন্তত ২২ কিলোমিটার হাঁটেন।

এক হাতে থাকে পত্রিকা, আরেক হাতে ছাতা—রোদ হোক বা বৃষ্টি। কাঁধে একটি কালো ব্যাগ। পরনে ধূসর হাফ শার্ট ও লুঙ্গি। লম্বা সাদা চুল আর গোঁফ-দাড়ির কারণে মানুষ রবীন্দ্র মিত্রকে ‘সাধু’ বলে ডাকে।

রবীন্দ্র মিত্রর পাঁচ মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। স্ত্রী বেলু মিত্র তিন বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে মেজ মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। রবীন্দ্র মিত্র থাকেন তৃতীয় মেয়ের বাসায়, চট্টগ্রাম শহরে। প্রতিদিন সেখান থেকে উঠে কে সি দে রোড থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করে ছুটে যান পটিয়ায়।

রবীন্দ্র মিত্র বলেন, ‘মেয়েরা বাবার খোঁজ রাখে। কিন্তু ওদেরও সংসারে ব্যস্ততা আছে। আমার যত দিন শরীর চলবে, তত দিন পত্রিকা বিক্রি করে নিজের খাবারটুকু নিজেই জোগাড় করব।’

খবরের কাগড়ের প্রতি একটা আলাদা টান আছে রবীন্দ্র মিত্রর। পত্রিকা বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে প্রতিটি সংবাদপত্র তিনি উল্টে দেখেন। কত রকমের খবর সেখানে। মানুষের কাছে সেই খবর পৌঁছে দিতে পেরে ভালো লাগে ভীষণ। তবে মুঠোফোনের কারণে এখন বেশির ভাগ মানুষ পত্রিকা কেনেন না। তিনি বলেন, ‘পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ার আনন্দ এখন আর পায় না মানুষ।’

বয়স্ক ভাতায় চলে না

পটিয়ার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা ছালামত উল্লাহ মল্লর সহায়তায় বয়স্ক ভাতার তালিকায় নাম ওঠে রবীন্দ্র মিত্রর। বলেন, ‘ভাতা পাই ৬০০ টাকা। এতে এক সপ্তাহও চলে না। সরকার যদি অন্তত এক হাজার টাকার মতো ভাতা দিত, তবে হয়তো এতটা কষ্ট করে পথ হাঁটতে হতো না।’

রবীন্দ্র মিত্রর নিজ গ্রামে থাকা ভাঙাচোরা ঘরটি নিয়েও আক্ষেপ করেন। বলেন, ‘আমি বাড়িতে না থাকায় যে যার মতো করে জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। এখন আর নিজের বলতে তেমন কিছু নেই।’

পল্লী চিকিৎসক অনিল কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমি ৫০ বছর ধরে দেখছি, উনি প্রতিদিন পত্রিকা বিলি করেন। কখনো গাড়িতে দেখিনি। বরাবরই হাঁটেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের কমে না।’

হকার্স কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম বলেন, ‘এই বয়সেও উনি যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, সেটা নতুনদের জন্য অনুপ্রেরণা। উনি আমাদের গর্ব।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: রব ন দ র ম ত র র বয়স

এছাড়াও পড়ুন:

নাম–ঠিকানা বদলে এনআইডি–পাসপোর্ট, উড়াল দেওয়ার আগেই ধরা সাজাপ্রাপ্ত দুই ভাই

শাহিনুর রহমান ওরফে সুমন (৪৮) ও সাদিকুর রহমান (৪৫)—দুই ভাই। তাঁরা একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি। বাড়ি রাজশাহী নগরের কেশবপুর ভেড়ীপাড়া এলাকায়। ঠিকানা পাল্টে তাঁরা জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেছেন। নিজেদের নামও পরিবর্তন করেছেন। নতুন নাম-ঠিকানা দিয়ে পাসপোর্টও করেছেন। এবার শুধু উড়ে যাওয়া বাকি। এমন সময় খবর পায় র‌্যাব-৫। বুধবার সকালে নগরের শাহ মখদুম থানার চকপাড়া বড় বনগ্রাম এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তার দুজনের বিরুদ্ধে ২০০৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা করেছিলেন শফিকুল ইসলাম নামে পাবনার একজন ট্রাকচালক। মামলায় তাঁকে (চালকের) গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যাচেষ্টা ও তাঁর সহকারী মো. আনজুকে হত্যার অভিযোগ করা হয়েছিল। ওই মামলায় দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। সাজা এড়াতে তাঁরা জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে বিদেশে পালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন।

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০০৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বিকেলে দুই যুবক এসে পাবনার দাসুড়িয়ায় কালো পাথর নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাকচালক শফিকুল ইসলামের ট্রাকটি ভাড়া করেন। গাড়ির ভাড়া মেটানো হয় ৬ হাজার ৩০০ টাকা। পথিমধ্যে আরও ১০০ বস্তা সিমেন্ট তোলার কথা হয়। কিছু দূর এসে তাঁদের সঙ্গে আরও একজন গাড়িতে ওঠেন। তাঁদের কথাবার্তায় একজনের নাম সুমন বলে জানতে পারেন চালক। কিছু দূর যাওয়ার পর তাঁরা দুজন নারী ও মুখে দাড়িওয়ালা ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে গাড়িতে তোলেন। সুমন জানান, বয়স্ক ব্যক্তিটি তাঁর বাবা, দুই নারীর একজন তাঁর মা ও অন্যজন তাঁর বোন। তাঁরা রাজশাহীতে যাবেন। সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে এসে তাঁরা পাশের এক বাড়িতে নেমে কী যেন সলাপরামর্শ করেন। রাত প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে তাঁরা রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা দেন। গোদাগাড়ীর ডাইংপাড়ার মোড়ে ট্রাক থামিয়ে তাঁরা পেপসি কেনেন। তাঁকে খেতে দিলে সন্দেহবশত তিনি সামান্য একটু খান। এরপর ফাঁকা রাস্তায় আসতেই তাঁর পাশে বসা বয়স্ক দাড়িওয়ালা লোকটি তাঁর গলায় দড়ি দিয়ে ফাঁস দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বাঁ হাত দিয়ে দড়ি ছাড়িয়ে কৌশলে ডান দিকে লাফ দিয়ে ধানখেতে পালিয়ে যান। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁরা তাঁকে হত্যা করে অন্য কোনো অপরাধ সংঘটন করবেন। তিনি ভোরে বের হয়ে এসে গোদাগাড়ীর বিজয়নগর এলাকায় এসে ট্রাকটি পান। সেখানে পুলিশ উপস্থিত ছিল। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, তাঁর সহকারী আনজুমকে গলায় ফাঁস ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে তাঁরা নির্মমভাবে হত্যা করে চলে গেছেন।

র‍্যাব সূত্র জানায়, ২০০৪ সালের ৮ মে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই রেজাউল ইসলাম আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। ২০১১ সালের ১৫ নভেম্বর ২৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। মামলার পরপরই পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করে। আসামি দুই ভাই পাঁচ বছর জেলে থাকার পর ২০১০ সালে জামিনে মুক্তি পেয়ে পালিয়ে যান। আদালত আসামিদের অনুপস্থিতিতে তাঁদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন। আসামিরা নিজেদের নাম পরিবর্তন করে নতুন এনআইডি কার্ড বানিয়ে সাজা এড়াতে বিদেশে যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করেন। তাঁরা ঢাকায় গাড়ি মেরামত ও বেচাকেনার কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নাম–ঠিকানা বদলে এনআইডি–পাসপোর্ট, উড়াল দেওয়ার আগেই ধরা সাজাপ্রাপ্ত দুই ভাই