৮২ বছর বয়সেও প্রতিদিন ২২ কিমি হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন রবীন্দ্র মিত্র
Published: 7th, July 2025 GMT
চোখেমুখে বয়সের ছাপ, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ আর হাতে ছাতা—তবে শরীরে নেই ক্লান্তির ছাপ। নাম রবীন্দ্র লাল মিত্র। চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দা এ মানুষটি প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েন পত্রিকা বিলি করতে। হাঁটেন প্রায় ২২ কিলোমিটার, কখনো রোদের মধ্যে, কখনো ঝুম বৃষ্টিতে। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী (এনআইডি) তাঁর বয়স ৮২ বছর। তবে বয়স্ক ভাতার বই অনুযায়ী আরও বেশি। তিনি নিজে বলেন, এনআইডির তথ্যে ভুল আছে, তাঁর প্রকৃত বয়স ৯৩ বছর।
রবীন্দ্র মিত্রর জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের দক্ষিণ সমুরা গ্রামে। তাঁর আট বছর বয়সে বাবা নিরঞ্জন লাল মিত্রকে হারান। বাবা না থাকার পরও কোনো রকমে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্য তিনি দ্বিতীয়। বড় ভাই পরিমল লাল মিত্র চট্টগ্রামের কে সি দে রোডে পত্রিকা বিক্রি করতেন। তাঁকেও কাজে লেগে পড়তে হয় কিশোর বয়সেই। চট্টগ্রামের একটি প্রেসে চাকরি নেন মাত্র পাঁচ টাকা বেতনে। বিয়ে করেন সে সময়ই।
প্রেসের কাজ খুবই কষ্টের ছিল রবীন্দ্র মিত্রর। দীর্ঘ ৪০ বছর সেই চাকরিতে কাটানোর পর বাধ্য হয়ে তা ছেড়ে দেন। এরপর ১৯৬০–এর দশকের শুরুতে পত্রিকার হকার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখন থেকেই শুরু হয় গ্রামে গ্রামে হেঁটে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব।
বৃদ্ধ রবীন্দ্র মিত্র এখন থাকেন চট্টগ্রাম শহরে মেয়ের বাসায়। সেখান থেকে বাস ধরে ছুটে যান পটিয়ায়। এরপর শুরু হয় হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি।
যেভাবে পত্রিকার সঙ্গে
রবীন্দ্র মিত্রর বড় ভাই পরিমল লাল মিত্র চট্টগ্রামের কে সি দে রোডে পত্রিকা বিক্রি করতেন। ভাইয়ের কাছ থেকেই প্রথমে ৩০-৩৫টি পত্রিকা নিয়ে শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে তা বেড়ে একসময় দাঁড়ায় ২৫০টিতে। মাস শেষে তাঁর আয় হতো ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
একসময় ভালো আয় হলেও এখন ছাপা পত্রিকার দুর্দিনে রবীন্দ্র মিত্রর আয় কমেছে। এখন তিনি জাতীয় ও স্থানীয় মিলিয়ে প্রায় ১৫০টি পত্রিকা বিক্রি করেন। কিন্তু মাস শেষে হাতে থাকে মাত্র আট হাজার টাকার মতো। তিনি বলেন, অনলাইন চালু হওয়ায় এখন অনেকে আর পত্রিকা কেনেন না। কিন্তু গ্রামের মানুষ এখনো খাঁটি খবর ছাপা কাগজেই খোঁজে। তাই চট্টগ্রাম শহর থেকে বাস ধরে পটিয়া গিয়ে প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করেন। এটা এখন তাঁর কাছে নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের পথে পথে হাঁটতে ভালো লাগে তাঁর।
চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রতিদিন সকাল সাতটার আগেই পটিয়ার গৈড়লার টেকে পৌঁছান রবীন্দ্র মিত্র। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে গৈড়লা হাই স্কুল, ঘোষের হাট, তেকোটা, মুকুটনাইট, ধলঘাট ক্যাম্প, খানমোহনা হয়ে কেলিশহর ভট্টাচার্য হাট, দারোগাহাট পর্যন্ত অন্তত ২২ কিলোমিটার হাঁটেন।
এক হাতে থাকে পত্রিকা, আরেক হাতে ছাতা—রোদ হোক বা বৃষ্টি। কাঁধে একটি কালো ব্যাগ। পরনে ধূসর হাফ শার্ট ও লুঙ্গি। লম্বা সাদা চুল আর গোঁফ-দাড়ির কারণে মানুষ রবীন্দ্র মিত্রকে ‘সাধু’ বলে ডাকে।
রবীন্দ্র মিত্রর পাঁচ মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। স্ত্রী বেলু মিত্র তিন বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে মেজ মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। রবীন্দ্র মিত্র থাকেন তৃতীয় মেয়ের বাসায়, চট্টগ্রাম শহরে। প্রতিদিন সেখান থেকে উঠে কে সি দে রোড থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করে ছুটে যান পটিয়ায়।
রবীন্দ্র মিত্র বলেন, ‘মেয়েরা বাবার খোঁজ রাখে। কিন্তু ওদেরও সংসারে ব্যস্ততা আছে। আমার যত দিন শরীর চলবে, তত দিন পত্রিকা বিক্রি করে নিজের খাবারটুকু নিজেই জোগাড় করব।’
খবরের কাগড়ের প্রতি একটা আলাদা টান আছে রবীন্দ্র মিত্রর। পত্রিকা বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে প্রতিটি সংবাদপত্র তিনি উল্টে দেখেন। কত রকমের খবর সেখানে। মানুষের কাছে সেই খবর পৌঁছে দিতে পেরে ভালো লাগে ভীষণ। তবে মুঠোফোনের কারণে এখন বেশির ভাগ মানুষ পত্রিকা কেনেন না। তিনি বলেন, ‘পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ার আনন্দ এখন আর পায় না মানুষ।’
বয়স্ক ভাতায় চলে না
পটিয়ার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা ছালামত উল্লাহ মল্লর সহায়তায় বয়স্ক ভাতার তালিকায় নাম ওঠে রবীন্দ্র মিত্রর। বলেন, ‘ভাতা পাই ৬০০ টাকা। এতে এক সপ্তাহও চলে না। সরকার যদি অন্তত এক হাজার টাকার মতো ভাতা দিত, তবে হয়তো এতটা কষ্ট করে পথ হাঁটতে হতো না।’
রবীন্দ্র মিত্রর নিজ গ্রামে থাকা ভাঙাচোরা ঘরটি নিয়েও আক্ষেপ করেন। বলেন, ‘আমি বাড়িতে না থাকায় যে যার মতো করে জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। এখন আর নিজের বলতে তেমন কিছু নেই।’
পল্লী চিকিৎসক অনিল কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমি ৫০ বছর ধরে দেখছি, উনি প্রতিদিন পত্রিকা বিলি করেন। কখনো গাড়িতে দেখিনি। বরাবরই হাঁটেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের কমে না।’
হকার্স কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম বলেন, ‘এই বয়সেও উনি যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, সেটা নতুনদের জন্য অনুপ্রেরণা। উনি আমাদের গর্ব।’
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: রব ন দ র ম ত র র বয়স
এছাড়াও পড়ুন:
৮২ বছর বয়সেও প্রতিদিন ২২ কিমি হেঁটে পত্রিকা বিলি করেন রবীন্দ্র মিত্র
চোখেমুখে বয়সের ছাপ, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ আর হাতে ছাতা—তবে শরীরে নেই ক্লান্তির ছাপ। নাম রবীন্দ্র লাল মিত্র। চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দা এ মানুষটি প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েন পত্রিকা বিলি করতে। হাঁটেন প্রায় ২২ কিলোমিটার, কখনো রোদের মধ্যে, কখনো ঝুম বৃষ্টিতে। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী (এনআইডি) তাঁর বয়স ৮২ বছর। তবে বয়স্ক ভাতার বই অনুযায়ী আরও বেশি। তিনি নিজে বলেন, এনআইডির তথ্যে ভুল আছে, তাঁর প্রকৃত বয়স ৯৩ বছর।
রবীন্দ্র মিত্রর জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের দক্ষিণ সমুরা গ্রামে। তাঁর আট বছর বয়সে বাবা নিরঞ্জন লাল মিত্রকে হারান। বাবা না থাকার পরও কোনো রকমে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্য তিনি দ্বিতীয়। বড় ভাই পরিমল লাল মিত্র চট্টগ্রামের কে সি দে রোডে পত্রিকা বিক্রি করতেন। তাঁকেও কাজে লেগে পড়তে হয় কিশোর বয়সেই। চট্টগ্রামের একটি প্রেসে চাকরি নেন মাত্র পাঁচ টাকা বেতনে। বিয়ে করেন সে সময়ই।
প্রেসের কাজ খুবই কষ্টের ছিল রবীন্দ্র মিত্রর। দীর্ঘ ৪০ বছর সেই চাকরিতে কাটানোর পর বাধ্য হয়ে তা ছেড়ে দেন। এরপর ১৯৬০–এর দশকের শুরুতে পত্রিকার হকার হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখন থেকেই শুরু হয় গ্রামে গ্রামে হেঁটে পত্রিকা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব।
বৃদ্ধ রবীন্দ্র মিত্র এখন থাকেন চট্টগ্রাম শহরে মেয়ের বাসায়। সেখান থেকে বাস ধরে ছুটে যান পটিয়ায়। এরপর শুরু হয় হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিলি।
যেভাবে পত্রিকার সঙ্গে
রবীন্দ্র মিত্রর বড় ভাই পরিমল লাল মিত্র চট্টগ্রামের কে সি দে রোডে পত্রিকা বিক্রি করতেন। ভাইয়ের কাছ থেকেই প্রথমে ৩০-৩৫টি পত্রিকা নিয়ে শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে তা বেড়ে একসময় দাঁড়ায় ২৫০টিতে। মাস শেষে তাঁর আয় হতো ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
একসময় ভালো আয় হলেও এখন ছাপা পত্রিকার দুর্দিনে রবীন্দ্র মিত্রর আয় কমেছে। এখন তিনি জাতীয় ও স্থানীয় মিলিয়ে প্রায় ১৫০টি পত্রিকা বিক্রি করেন। কিন্তু মাস শেষে হাতে থাকে মাত্র আট হাজার টাকার মতো। তিনি বলেন, অনলাইন চালু হওয়ায় এখন অনেকে আর পত্রিকা কেনেন না। কিন্তু গ্রামের মানুষ এখনো খাঁটি খবর ছাপা কাগজেই খোঁজে। তাই চট্টগ্রাম শহর থেকে বাস ধরে পটিয়া গিয়ে প্রতিদিন হেঁটে হেঁটে পত্রিকা বিক্রি করেন। এটা এখন তাঁর কাছে নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের পথে পথে হাঁটতে ভালো লাগে তাঁর।
চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রতিদিন সকাল সাতটার আগেই পটিয়ার গৈড়লার টেকে পৌঁছান রবীন্দ্র মিত্র। সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে গৈড়লা হাই স্কুল, ঘোষের হাট, তেকোটা, মুকুটনাইট, ধলঘাট ক্যাম্প, খানমোহনা হয়ে কেলিশহর ভট্টাচার্য হাট, দারোগাহাট পর্যন্ত অন্তত ২২ কিলোমিটার হাঁটেন।
এক হাতে থাকে পত্রিকা, আরেক হাতে ছাতা—রোদ হোক বা বৃষ্টি। কাঁধে একটি কালো ব্যাগ। পরনে ধূসর হাফ শার্ট ও লুঙ্গি। লম্বা সাদা চুল আর গোঁফ-দাড়ির কারণে মানুষ রবীন্দ্র মিত্রকে ‘সাধু’ বলে ডাকে।
রবীন্দ্র মিত্রর পাঁচ মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। স্ত্রী বেলু মিত্র তিন বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে মেজ মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। রবীন্দ্র মিত্র থাকেন তৃতীয় মেয়ের বাসায়, চট্টগ্রাম শহরে। প্রতিদিন সেখান থেকে উঠে কে সি দে রোড থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করে ছুটে যান পটিয়ায়।
রবীন্দ্র মিত্র বলেন, ‘মেয়েরা বাবার খোঁজ রাখে। কিন্তু ওদেরও সংসারে ব্যস্ততা আছে। আমার যত দিন শরীর চলবে, তত দিন পত্রিকা বিক্রি করে নিজের খাবারটুকু নিজেই জোগাড় করব।’
খবরের কাগড়ের প্রতি একটা আলাদা টান আছে রবীন্দ্র মিত্রর। পত্রিকা বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে প্রতিটি সংবাদপত্র তিনি উল্টে দেখেন। কত রকমের খবর সেখানে। মানুষের কাছে সেই খবর পৌঁছে দিতে পেরে ভালো লাগে ভীষণ। তবে মুঠোফোনের কারণে এখন বেশির ভাগ মানুষ পত্রিকা কেনেন না। তিনি বলেন, ‘পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ার আনন্দ এখন আর পায় না মানুষ।’
বয়স্ক ভাতায় চলে না
পটিয়ার সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা ছালামত উল্লাহ মল্লর সহায়তায় বয়স্ক ভাতার তালিকায় নাম ওঠে রবীন্দ্র মিত্রর। বলেন, ‘ভাতা পাই ৬০০ টাকা। এতে এক সপ্তাহও চলে না। সরকার যদি অন্তত এক হাজার টাকার মতো ভাতা দিত, তবে হয়তো এতটা কষ্ট করে পথ হাঁটতে হতো না।’
রবীন্দ্র মিত্রর নিজ গ্রামে থাকা ভাঙাচোরা ঘরটি নিয়েও আক্ষেপ করেন। বলেন, ‘আমি বাড়িতে না থাকায় যে যার মতো করে জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। এখন আর নিজের বলতে তেমন কিছু নেই।’
পল্লী চিকিৎসক অনিল কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘আমি ৫০ বছর ধরে দেখছি, উনি প্রতিদিন পত্রিকা বিলি করেন। কখনো গাড়িতে দেখিনি। বরাবরই হাঁটেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আমাদের কমে না।’
হকার্স কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম বলেন, ‘এই বয়সেও উনি যেভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, সেটা নতুনদের জন্য অনুপ্রেরণা। উনি আমাদের গর্ব।’