শতবর্ষী করচের জলাবনে যেতে যেতে কত কী চোখে পড়ে
Published: 7th, July 2025 GMT
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাদিপুর গ্রামে সকালটা অন্য রকমভাবে আসে। এটি কাউয়াদিঘি হাওরপারের একটি গ্রাম। ওই গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে গেলে সামনে পড়ে অন্তেহরি, এটি রাজনগর উপজেলার আরেকটি গ্রাম। অন্তেহরিও কাউয়াদিঘি হাওরের কোল ঘেঁষে শত বছর ধরে প্রাণ-প্রকৃতির অংশ হয়ে গেছে। বর্ষায় হাওরের উত্তাল ঢেউ সামলে এই গ্রামে মানুষের বাস। যত দূর চোখ যায় অবারিত রুপালি জলের ভাঁজ করা শীতলপাটি।
শীতে আরেক প্রকৃতি। দিগন্তজুড়ে শুধু বিস্তীর্ণ সবুজ। উড়ে যায় পরিযায়ী পাখির ঝাঁক। এই অন্তেহরি গ্রামকে ছুঁয়ে শত বছরের পুরোনো করচগাছে নীরবে-নিভৃতে তৈরি হয়েছে এক টুকরা ‘জলাবন’। ওখানে জলে শরীর ডুবিয়ে পুরো বর্ষাটাই পার করে এই গাছেরা।
মৌলভীবাজার শহরতলির মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কের চাঁদনীঘাট থেকে উত্তর দিকে একাটুনা-জগৎপুর হয়ে অন্তেহরির দিকে গেছে একটি পাকা সড়ক। অন্তেহরির ওই জলাবনের দিকে ‘যেতে যেতে পথে’ কাদিপুরে তখন মৌসুমি মাছের হাট জমে গেছে। এখানে হাটের মানুষ, ঘাটের মানুষ খুব বেশি না হলেও একরকমের প্রাণ আছে। কেউ রাতে কাউয়াদিঘি হাওর থেকে ধরা মাছ নিয়ে এখানে এসেছেন। কেউ এসেছেন পাইকারি দরে মাছ কিনে শহরে নিয়ে যেতে, কেউ গ্রামে গ্রামে ফেরি দিয়ে ওই মাছ বিক্রি করবেন। কিছু ক্রেতাও আছেন, যাঁরা হাওরের টাটকা মাছ কিনতে এখানে ছুটে এসেছেন।
একটা স্বল্পস্থায়ী হাট জমে কাদিপুরের ওই স্থানে। কারও ডোলায় চিংড়ি মাছ, কারও ডোলায় পুঁটি–টেংরাসহ বারো জাতের মাছ। কারও ডোলায় শিং-মাগুর, চ্যাং, কৈ, ভেদা, নানা রকম গুঁড়া মাছ।
ডোলায়–পাত্রে রাখা হাওরের নানা জাতের মাছ। মৌলভীবাজারের কাউয়াদিঘি হাওরপারের কাদিপুরে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হ ওর র
এছাড়াও পড়ুন:
শতবর্ষের শিক্ষালয়
উপমহাদেশে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৬৪ বছরের মধ্যে (১৮৫৭-১৯২১) প্রতিষ্ঠিত ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপমহাদেশে ১২তম, অবিভক্ত বাংলায় দ্বিতীয় আর পূর্ববঙ্গে প্রথম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ভারতভাগ পর্যন্ত আরও অন্তত ২৬ বছর ব্রিটিশরা শাসন করে। এই ২৬ বছরে (১৯২২-১৯৪৭) তারা আরও চারটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন করে। সব শেষ প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় চারটি হলো: দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় (দিল্লি ১৯২২), নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয় (মহারাষ্ট্র ১৯২৩), অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয় (বিশাখাপত্তম, অন্ধ্রপ্রদেশ ১৯২৬) ও আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় (উত্তরপ্রদেশ ১৯২৭)।
ঢাকা ছাড়া ব্রিটিশ আমলে পূর্ববঙ্গে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন ঘটেনি, এমনকি পাকিস্তান অঞ্চলেও না। সর্বশেষ আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার (১৯২৭) পর ইংরেজ শাসন আরও ২০ বছর স্থায়ী হয়। এ সময়ে (১৯২৭-১৯৪৭) রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অন্য সবকিছুর তুলনায় স্বরাজ-স্বায়ত্তশাসন-স্বাধীনতার প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠে। আন্দোলন-সংগ্রামের নানা কর্মসূচিতে সরকারও থাকে ব্যতিব্যস্ত। ভারতকে ভাগ করে কীভাবে পৃথক দুই নেতৃত্বের হাতে তুলে দিয়ে সসম্মানে বিদায় হওয়া যায়, এটি তাদের ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হয়। তা না হলে ইংরেজ শাসনের শেষের দিনগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এমন ছেদ পড়ার কথা নয়।
এ বিশ্ববিদ্যালয় এই ভূখণ্ডে বহু ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনকারী হলেও এটি নিজেই এখনও বিভিন্ন কাঠামোগত সংকট, রাজনৈতিক দলীয়করণ, আবাসন সংকট ও প্রশাসনিক অদক্ষতার মতো মৌলিক সমস্যায় জর্জরিত। বিশেষ করে এ প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ও গবেষণাভিত্তিক উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রে রূপ দেওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা, তার বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের ১ হাজার ৩৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকার বাজেটে গবেষণায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যা মোট বাজেটের মাত্র ২ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। শিক্ষার্থীদের মতে, এই বরাদ্দ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যতের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
গত ১ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ উপলক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান গবেষণা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বৃহত্তর অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে গবেষণা খাতকে সমৃদ্ধ করতে চাই। বাজেট বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক মানের গবেষক তৈরিসহ গবেষণাকে প্রাধান্য দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।’ তিনি ‘পঠন-পাঠন ও গবেষণাকে রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে রাখতে’ চান। ‘শিক্ষার্থীদের রাজনীতি থাকবে, তবে সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে, কোনো বহিঃপ্রভাব নয়’, বলেছেন তিনি। উপাচার্য আরও বলেন, ‘আমরা বৈষম্যহীন অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরি করতে চাই। বহু মানুষের রক্তের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি। দেশের এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দেশপ্রেমিক প্রজন্ম উপহার দিয়ে জাতির দায় এড়াতে চাই।’
শিক্ষার্থীরাও মনে করছেন, একটি মুক্ত, সৃজনশীল এবং গবেষণাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে। তাদের প্রত্যাশা– আধুনিক ল্যাব, মানসম্মত আবাসন, সময়োপযোগী পাঠদান ও গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ হোক। তাদের মত, ‘রাজনীতির ভয় নয়, জ্ঞানের আধিপত্য চাই। গেস্টরুম কিংবা গণরুমের পরিবর্তে গ্রন্থাগার হোক আমাদের নির্ভরতার জায়গা।’
সেই ব্রিটিশ আমলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ অভিধায় ভূষিত হয়। নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির এগিয়ে চলা। চলার পথে অনেক ক্ষেত্রে গতিও হারিয়েছে কখনও কখনও। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস নয়, এটি একটি জাতির আত্মবিকাশের কাহিনি। প্রধানত এই প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা লোকেরাই বাংলাদেশ চালাচ্ছে। বিশেষত পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক আমলে এ বিশ্ববিদ্যালয় বাতিঘরের ভূমিকা পালন করেছে। শুধু তা কেন, সর্বশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থানসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও একই ভূমিকা রেখেছে গর্বের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিমল সরকার: অবসরপ্রাপ্ত
কলেজ শিক্ষক