‘মব’ মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর দৃষ্টান্ত, সরকারের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই
Published: 23rd, June 2025 GMT
কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে বা তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলে দেশের প্রচলিত আইনে তাঁর বিচার করতে হবে। বিচার ব্যতিরেকে ‘মব’ সৃষ্টি বা জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর দৃষ্টান্ত। এভাবে মব সৃষ্টির ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলে এটি ভবিষ্যতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
আজ সোমবার গণমাধ্যমে আলাদা আলাদা বিবৃতি পাঠিয়ে দুটি মানবাধিকার সংগঠন এসব কথা বলেছে। তারা সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার প্রতি অপমানজনক ও সহিংস আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
সরকারের নীরবতা সহিংস গোষ্ঠীগুলোর অপকর্মে প্রভাব জোগাচ্ছে: আসক
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে বলেছে, কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলে তা নিষ্পত্তির একমাত্র পথ হচ্ছে সংবিধান ও আইনের নির্ধারিত প্রক্রিয়া। বিচারব্যবস্থার বাইরে গিয়ে যেকোনো অপমানজনক ও সহিংস আচরণ শুধু ব্যক্তি–অধিকারকেই লঙ্ঘন করে না, তা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ ধরনের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটানো হলে তা বিচারহীনতার একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত তৈরি করে বলে মনে করে আসক। সংগঠনটি বলছে, এটি আইনের শাসনের পরিবর্তে ‘মব সংস্কৃতি’কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রচ্ছন্ন সংকেত দেয়।
এসব ঘটনায় সরকারের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই বলে মনে করে আসক। বিবৃতিতে সংগঠনটি বলছে, সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের সংঘবদ্ধ সহিংসতার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। আপাতদৃষ্টে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা এসব সহিংস গোষ্ঠীর অপকর্মে পরোক্ষভাবে প্রভাব জোগাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রকে এসব বিষয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে আসক।
অপরাধের বিচার আইন অনুযায়ী হতে হবে, মবের মাধ্যমে নয়: এইচআরএসএস
আরেক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এক বিবৃতিতে বলেছে, কোনো ব্যক্তি অপরাধ সংঘটিত করলে দেশের প্রচলিত আইনে তাঁর বিচার করতে হবে। বিচার ব্যতিরেকে ‘মব’ বা জনতার হাতে আইন তুলে নেওয়ার ঘটনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর দৃষ্টান্ত। এ ধরনের আচরণ দেশের আইনি কাঠামো, মানবিক মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ।
এসব ঘটনার যথাযথ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা এবং ভবিষ্যতে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানায় সংগঠনটি।
প্রসঙ্গত, গতকাল রোববার সাবেক সিইসি নূরুল হুদার উত্তরার বাসায় ‘মব’ তৈরি করে কিছু লোক। এরপর তাঁকে ধরে এনে একটি জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হয়। এক ব্যক্তিকে জুতা দিয়ে তাঁকে আঘাত করতেও দেখা যায়। নূরুল হুদাকে গলায় জুতার মালা পরিয়ে মারধর করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। হেনস্তার পর নূরুল হুদাকে পুলিশে দেওয়া হয়।
নূরুল হুদা প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকাকালে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই ভোটে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার অভিযোগ রয়েছে, যা পরে ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পায়। গতকাল নূরুল হুদাসহ আওয়ামী লীগ আমলে দায়িত্ব পালন করা অপর দুই সিইসির বিরুদ্ধে মামলা করেছে বিএনপি। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ১৯ জনের নাম রয়েছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র ব যবস থ গ র তর
এছাড়াও পড়ুন:
নারীর সম্মানহানি ও সাইবার বুলিংয়ের পেছনের রাজনীতি
বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই আগের বছরের চেয়ে সহিংসতার শিকার হওয়া নারীর সংখ্যা মনে হয় বাড়তে থাকে।
গত ১৩ অক্টোবরে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও বাংলাদেশে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের জরিপ অনুযায়ী, প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন নারী (৭৬ শতাংশ) তাঁদের জীবনে অন্তত একবার জীবনসঙ্গী বা স্বামী কর্তৃক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতা।
এর প্রায় অর্ধেক নারী (৪৯ শতাংশ) গত এক বছরে এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই জরিপে নন-পার্টনার (সঙ্গী নয় এমন ব্যক্তি ও সত্তা) দ্বারা সহিংসতার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ নারী প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত নির্দিষ্ট কিছু জেন্ডারভিত্তিক (লৈঙ্গিক) সহিংসতার (টেকনোলজি-ফ্যাসিলিয়েটেড জেন্ডার-বেজড ভায়োলেন্স) শিকার হয়েছেন, যা যৌন ব্ল্যাকমেল, ছবি নিয়ে অপব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত।
আরও পড়ুনরাজনীতি থেকে কি হারিয়ে যাবেন নারীরা০১ অক্টোবর ২০২৫নির্দ্বিধায় বলা যায়, সমাজের যেকোনো স্তরের, যেকোনো পেশার নারীই বাস্তবে বা অনলাইনে সংঘটিত এ ধরনের জেন্ডারভিত্তিক আক্রমণের শিকার হয়ে থাকেন। সাম্প্রতিক কালে একজন নারী গণমাধ্যমকর্মীর আত্মহত্যার ঘটনায় একই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘বাজে আচরণের’ মতো গুরুতর অভিযোগ আনেন তাঁদেরই সহকর্মী। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষকও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন কিছুদিন ধরে।
শারীরিকভাবে আঘাত না করেও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে নারীদের সম্মানহানি ও বুলিং করার এই প্রবণতাকে বিক্ষিপ্ত কোনো ঘটনা হিসেবে দেখলে চলবে না; বরং এর পেছনের রাজনৈতিক অর্থনীতিকে বুঝতে হবে। ফরাসি নারীবাদী ও সমাজতাত্ত্বিক সিমোন দ্য বোভোয়ারের ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত দ্য সেকেন্ড সেক্স বইটি আধুনিক নারীবাদী চিন্তার অন্যতম মৌলিক গ্রন্থ, যা নারী-পুরুষ সম্পর্কের সামাজিক, ঐতিহাসিক ও দার্শনিক ভিত্তি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানায়।
একটু চিন্তা করলেই অনুধাবন করা সম্ভব যে সৌন্দর্যের কোনো সর্বজনীন মানদণ্ড নেই। কিন্তু বর্তমান সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি কেবল নির্দিষ্ট ওজন, চেহারা, বয়স, ও ত্বকের রংকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে বহু বছর ধরে। বহু নারী সেই মানদণ্ড পূরণের চেষ্টায় সময়, অর্থ ও শক্তি ব্যয় করেন, যার ফলে তাঁরা প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টার পরিবর্তে নিজের দেহকে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ ও সংশোধনের বস্তুতে পরিণত করে ফেলে নিজের অজান্তেই।বইটির কেন্দ্রীয় তত্ত্ব হলো ‘কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, বরং নারী হয়ে ওঠেন।’ অর্থাৎ নারী-পুরুষের পার্থক্য কেবল জৈবিক নয়, বরং সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের দ্বারা সেটি নির্মিত হয়ে থাকে। সব জায়গায় পুরুষকে ‘মানুষ’ বা ‘সর্বজনীন সত্তা’ হিসেবে দেখা হয়েছে; আর নারীকে দেখা হয়েছে সেই পুরুষের তুলনায় ‘অন্য’, ‘অধীন’ বা ‘বিচ্যুত’ সত্তা হিসেবে। তিনি লিখেছেন: ‘হি ইজ দ্য সাবজেক্ট, হি ইজ দ্য অ্যাবসলিউট—শি ইজ দ্য আদার’ (পুরুষ হলেন কর্তা, পুরুষ হলেন পরম—নারী হলেন অপর)। এর কারণ হলো, শৈশব থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় কীভাবে ‘নারীসুলভ’ হতে হয়—কোমলতা, আনুগত্য ও সংবেদনশীলতার মাধ্যমে।
অপর দিকে ছেলেদের শেখানো হয় কীভাবে ‘পুরুষালি’ হতে হয় রাগ, আত্মনির্ভরতা ও কর্তৃত্বশীলতার মাধ্যমে। অথচ একজন নারীর যেমন স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন, একজন পুরুষের তেমনি সংবেদনশীল হওয়া ততটাই জরুরি। কিন্তু তার পরিবর্তে ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’ বা ‘বিষাক্ত ব্যাটাগিরি’র দুষ্ট চক্রে যেমন পুরুষদের আবদ্ধ করে ফেলে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, তেমনি নারীদের জীবনের ব্রতও হয়ে ওঠে ‘অন্যের জন্য বাঁচা’।
এই অসম সামাজিক প্রক্রিয়ায় পুরুষ নিজেকে ‘সাবজেক্ট’ (কর্তাসত্তা) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, আর নারীকে করে ‘অবজেক্ট’ (অধীন সত্তা) হিসেবে। এই সামাজিকীকরণের ফলে মেয়েরা নিজেদের অস্তিত্বকে পুরুষের দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতে শেখেন, যা তাঁদের আত্মচেতনার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে বোভোয়ারের মূল তত্ত্ব হলো ‘অস্তিত্ববাদী স্বাধীনতা’, অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষ নিজের জীবনের অর্থ নিজেই নির্ধারণ করবে এবং নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করবে, যা মূলত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, শিক্ষা ও সামাজিক সমান সুযোগ ছাড়া অসম্ভব।
সিমোন দ্য বোভোয়ার যেমন সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নারী-পুরুষের জৈবিক পার্থক্যকে ব্যবহার করে নারীকে গৃহে আবদ্ধ করে রাখার কৌশলের কথা বলেছেন, পরবর্তী সময় ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ–বিশ্লেষক সিলভিয়া ওয়ালবিও তাঁর থিওরাইজিং প্যাটরিয়ার্কি (১৯৯০) বইয়ে পিতৃতন্ত্রকে (প্যাটরিয়ার্কি) কেবল নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য নয়; বরং একটি জটিল সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখিয়েছেন, যা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্মিত ও কার্যকর হয়ে থাকে। তিনি বলেন, নারীর ওপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ একক নয়; বরং এটি ছয়টি পরস্পর-সংযুক্ত কাঠামো বা সিক্স প্যাটরিয়ার্কাল স্ট্রাকচারসের মাধ্যমে বজায় থাকে, যা পিতৃতন্ত্রকে অর্থনীতি, পরিবার, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত একটি বহুস্তরীয় সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকে। ছয়টি কাঠামোর মধ্যে রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি কীভাবে পিতৃতান্ত্রিকতাকে ধারণ ও পুনরুৎপাদন করে, সেটি ব্যাখ্যা করা যাক।
ওয়ালবি যুক্তি দেন, রাষ্ট্রের আইন, নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোও পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধে গঠিত। অর্থাৎ এগুলো দেখতে ‘সাধারণ’ বা ‘সবার জন্য’ মনে হলেও বাস্তবে পিতৃতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার বা নারীদের অধীন অবস্থায় রাখার প্রয়াস চলমান থাকে। যেমন গত ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ পুলিশের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এক তরুণীকে পোশাক নিয়ে হেনস্তা করা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। একই সঙ্গে পোস্টটিতে ‘কারও পোশাক দৃষ্টিকটু লাগলে যথাস্থানে অভিযোগ জানাতে’ আহ্বান জানানো হয়েছে। এমনকি কিছুদিন আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে উত্ত্যক্তকারী হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে থানায় ঢুকে যেভাবে ভিডিও–সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে ও জামিন লাভের পর পুলিশের সামনেই তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে, সেটা রাষ্ট্রের জন্য চরম লজ্জার, আমাদের জন্য হতাশার।
আরও পড়ুনপোশাক বদলালেই কি বদলে যাবে দৃষ্টিভঙ্গি২৬ জুলাই ২০২৫ওয়ালবি একে বলেন ‘দ্বৈত রাষ্ট্রীয় চরিত্র’ (ডুয়েল ক্যারেক্টার অব দ্য স্টেট)। অপর দিকে গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানও পিতৃতন্ত্রকে পুনরুৎপাদন করে থাকে বলে ওয়ালবি আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, পিতৃতন্ত্রকে সবচেয়ে সূক্ষ্মভাবে টিকিয়ে রাখে এই সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। কারণ, এটি মানুষের চিন্তা, মান ও আচরণের ভেতরে পুরুষ আধিপত্যকে ‘স্বাভাবিক’ করে তোলে। আমরা যদি বাংলাদেশের মিডিয়া, বিশেষত টেলিভিশন, সিনেমা, বিজ্ঞাপনগুলো পর্যবেক্ষণ করি, সেখানে দেখব—নারীর শরীর, আবেগ ও ভূমিকাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেখানে নরম, কোমলতা আর আনুগত্যের মিশেলে ‘আদর্শ’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’ নারীকেও যেমন বারবার চিত্রায়ণ করা হয়।
অপর দিকে নারীর সক্রিয় বা ক্ষমতাধর ভূমিকাগুলোকে প্রায়ই ‘অস্বাভাবিক’ বা ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে দেখানো হয়। এ ছাড়া ওয়ালবির মতে, সংবাদমাধ্যম কেবল পিতৃতান্ত্রিক বার্তা বহন করে না; বরং তা নিজেই একটি পুরুষনিয়ন্ত্রিত কাঠামো। কেননা বেশির ভাগ মালিকানা, সম্পাদকীয় পদ ও নীতিনির্ধারণী জায়গাগুলো পুরুষের দখলেই থাকে। ফলে সংবাদমাধ্যম নারী-পুরুষের যে গল্প বলে, তা পুরুষের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিকোণ থেকেই মূলত নির্মিত হয়ে থাকে।
সমসাময়িক নারীবাদী লেখকেরাও পরবর্তী সময় দেহরাজনীতি ও সৌন্দর্যবাদ কীভাবে মিডিয়ার মাধ্যমে নারীকে নিয়ন্ত্রণের সামাজিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, সে প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। মার্কিন নারীবাদী লেখক ও সাংবাদিক নাওমি উলফ তাঁর দ্য বিউটি মিথ (১৯৯০) বইয়ে দেখান, আধুনিক সমাজে যখন নারীরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও রাজনৈতিক অধিকারে অগ্রগতি অর্জন করছেন, তখন নতুনভাবে সৌন্দর্যের আদর্শ (বিউটি স্ট্যান্ডার্ডস) তাঁদের ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উলফ বলেন, ‘সৌন্দর্যের মিথ’ হলো এমন একটি সাংস্কৃতিক কৌশল, যা নারীদের নিজের শরীর নিয়ে অনিশ্চয়তা ও অপরাধবোধে ভোগাতে বাধ্য করে।
অথচ একটু চিন্তা করলেই অনুধাবন করা সম্ভব যে সৌন্দর্যের কোনো সর্বজনীন মানদণ্ড নেই। কিন্তু বর্তমান সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি কেবল নির্দিষ্ট ওজন, চেহারা, বয়স, ও ত্বকের রংকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে চলেছে বহু বছর ধরে। বহু নারী সেই মানদণ্ড পূরণের চেষ্টায় সময়, অর্থ ও শক্তি ব্যয় করেন, যার ফলে তাঁরা প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টার পরিবর্তে নিজের দেহকে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ ও সংশোধনের বস্তুতে পরিণত করে ফেলে নিজের অজান্তেই।
যত দিন পরিবারে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী শুধু বাবা হবেন, ছেলেশিশু ও মেয়েশিশুর প্রতি আচরণে জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য হবে, স্কুলগুলো সঠিকভাবে জেন্ডারবিষয়ক শিক্ষা পড়ানো থেকে বিরত থাকবে, তত দিন ন্যূনতম পরিবর্তন ঘটানোও কঠিন হবে।
● উম্মে ওয়ারা সহযোগী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
* মতামত লেখকের নিজস্ব