ব্যক্তি পর্যায়ে মুঠোফোন সিমের ব্যবহার আরও কমাচ্ছে সরকার
Published: 24th, June 2025 GMT
ব্যক্তি পর্যায়ে মুঠোফোন সিমের ব্যবহার আরও কমিয়ে ১০টি থেকে ৫টি করতে যাচ্ছে সরকার। আজ মঙ্গলবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের দশম সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বৈঠকে এক বছর পরপর সিম নবায়নের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ব্যক্তি পর্যায়ে সিমের ব্যবহার কমানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আলোচনা হয়। এতে বলা হয়, এক ব্যক্তির নামে বেশি সিম নিবন্ধনের সুযোগ থাকায় ওই সিম দিয়ে নানা ধরনের অনিয়ম হচ্ছে। চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে।
বৈঠকে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে নিয়োগের সময় উপদেষ্টাদের নাম ব্যবহার করে তদবির করা হচ্ছে, অথচ উপদেষ্টারা তা জানেন না। আবার দেশের বিভিন্ন স্থানে জেলা প্রশাসক (ডিসি) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সরকারি চাকরিজীবীদের মুঠোফোন নম্বর ক্লোন করে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। সে কারণে একজন গ্রাহকের নামে সিম নিবন্ধন ১০টি থেকে পাঁচটি করার সিদ্ধান্ত হয়। বিটিআরসিকে এটি বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
এখন একজন গ্রাহক নিজের নামে সর্বোচ্চ ১০টি সিম নিতে পারেন। এর আগে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), ড্রাইভিং লাইসেন্স, জন্মনিবন্ধন সনদ ও পাসপোর্ট দিয়ে সব অপারেটর মিলিয়ে ১৫টি সিম নেওয়া যেত। বিটিআরসি গত মাসে এই সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
বিটিআরসির হিসাবে, দেশে সিমের নিবন্ধিত প্রকৃত গ্রাহকের সংখ্যা ৬ কোটি ৭৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৪৫। এর মধ্যে ৮০ দশমিক ৩২ শতাংশ গ্রাহকের নামে পাঁচটি বা তার কম সিম রয়েছে। ৬ থেকে ১০টি সিম রয়েছে ১৬ দশমিক ২৩ শতাংশ গ্রাহকের কাছে। ১১ থেকে ১৫টি সিম ব্যবহারকারী গ্রাহক মাত্র ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
সিম নবায়নের বিষয়ে বৈঠকে বলা হয়, প্রতিবছর সিম নবায়ন করলে অনিয়মের মাত্রা অনেক কমে যাবে। কারণ, অনেকে মারা গেলে তাঁর সিম অন্য কেউ ব্যবহার করেন। অনলাইন জুয়া নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। বৈঠকে জানানো হয়, এখন পর্যন্ত ২৬টি জুয়ার ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে অন্য ওয়েবসাইটও বন্ধ করা হবে।
বৈঠকে একজন উপদেষ্টা বলেন, সাইবার বুলিংয়ের শিকার নারীরা থানায় গেলে অনেক ক্ষেত্রে মামলা নিতে চায় না। এ ধরনের ঘটনায় কেউ থানায় মামলার জন্য গেলে যাতে হয়রানি না করা হয় এবং মামলা নেওয়া হয়, সে বিষয়ে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুনএক ব্যক্তির নামে ১০টির বেশি মুঠােফোন সিম দেওয়া হবে না২৫ মে ২০২৫.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র হক র উপদ ষ ট ব ট আরস ব যবহ র ন বন ধ
এছাড়াও পড়ুন:
আট উপদেষ্টার সমালোচনায় সাবেক সচিব
অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার ‘সীমাহীন দুর্নীতি’র প্রমাণ নিজের কাছে রয়েছে বলে দাবি করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার। অবসরপ্রাপ্ত এই সচিব বলেছেন, এই উপদেষ্টাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হয় না, বদলিও হয় না।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে এক সেমিনারে এ অভিযোগ করেন আব্দুস সাত্তার। তবে তিনি উপদেষ্টাদের নাম বলেননি।
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তা বর্তমানে অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি।
‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা ও আগামী দিনের জনপ্রশাসন’ শীর্ষক সেমিনারটি আয়োজন করে প্রশাসন ক্যাডারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। বিকেল চারটায় সেমিনার শুরু হয়ে শেষ হয় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। সেমিনারে প্রশাসন ক্যাডারের শীর্ষ পদের প্রায় সব কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
আব্দুস সাত্তার তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমি খুবই হতাশ। আমলাদের চরিত্র না হয় খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের রক্তের ওপর দিয়ে চেয়ারে বসা অন্তত আটজন উপদেষ্টার সীমাহীন দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ দিতে পারব। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে আট উপদেষ্টার দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না’। এ সময় উপস্থিত কর্মকর্তারা ‘ঠিক ঠিক’ বলে হাততালি দেন।
সাবেক এই সচিব বলেন, কষ্ট লাগে একজন উপদেষ্টার এপিএসের অ্যাকাউন্টে ২০০ কোটি টাকা পাওয়া গেলেও তাঁর বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তিনি প্রশ্ন করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো একটি মন্ত্রণালয় নূরজাহান বেগম চালাতে পারেন? স্থানীয়
সরকার মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মতো দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় একজন অনভিজ্ঞ উপদেষ্টা দিয়ে চালানো ঠিক হচ্ছে?
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত এক বছরে দুর্নীতি না কমে বরং অতীতের চেয়ে বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, এক সহকারী কমিশনার (ভূমি) একটি স্কুলের জমির নামজারিতে ৩০ লাখ টাকা চেয়েছেন। ঢাকার আশপাশের একজন ইউএনও একটি কারখানার লে আউট পাশ করতে ২০ লাখ টাকা চেয়েছেন।
আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘আমি একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে বসি। গত বছর ৫ আগস্টের পর ওই অফিসে হাজার হাজার কর্মকর্তা–কর্মচারী ভিড় করছেন। আমার বস তারেক রহমান ডেকে বললেন, “কী হচ্ছে? এরা কারা। তাঁরা এখানে কী জন্য আসে।” আমি বলেছি, এরা সবাই বঞ্চিত। এরা গত ১৫ বছর হাসিনার আমলে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। হাসিনার পতনের পর উচ্ছ্বাসে ছুটে এসেছেন ন্যায়বিচার পেতে। উনি বলেছেন, “দলীয় অফিসে ইন–সার্ভিস কর্মকর্তারা আসা ভালো লক্ষণ নয়। আপনি তাদের অফিসে আসতে নিষেধ করে দেন।” আমি অফিসের গেটে নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছি। ইন–সার্ভিস কোনো কর্মকর্তা অফিসে আসতে পারবেন না। যদি কোনো সমস্যা থাকে অফিসার্স ক্লাবে আসবেন।’
আব্দুস সাত্তারের এ বক্তব্যের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (বিপিএটিসি) রেক্টর এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একজন দায়িত্বশীল মানুষ। তথ্যউপাত্ত ছাড়া কথা বলা লোক নন তিনি। নিশ্চয়ই তাঁর কাছে প্রমাণ রয়েছে। তাঁর এই বক্তব্যকে বিবেচনায় নিয়ে সরকারের চিহ্নিত করা উচিত, ওই আট উপদেষ্টা কারা। উপদেষ্টারা এসব করলে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দোষ দিয়ে লাভ কী।
সেমিনারে সাড়ে তিন ঘণ্টার আলোচনায় বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নানা অনিয়ম–দুর্নীতির বিষয় উঠে আসে। কর্মকর্তারা কীভাবে বিগত সরকারের হাতিয়ার হয়ে কাজ করেছেন, সে প্রশ্ন তোলেন কেউ কেউ। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা আগামীতে যাতে কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ না করেন, সে আহ্বান করা হয়েছে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া। মুখ্য আলোচক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কানিজ মওলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দা লাসনা কবির, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক শাফিউল ইসলাম।
আরও বক্তব্য দেন জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ, শহীদ আবু সাঈদের ভাই রমজান আলী, শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী এবং শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের মা সানজিদা খান দ্বীপ্তি।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সরকারি কর্মকমিশনের সচিব সানোয়ার জাহান ভূঁইয়া। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নজরুল ইসলাম।
সূচনা বক্তব্যে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর মানুষের যে প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা পূরণ হয়নি। বাতাসে কান পাতলে অনেক কথা শোনা যায়। গত ১৫ বছরে কর্মকর্তাদের অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা। অবিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে দেওয়া।
সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী বলেন, অতীতে কর্মকর্তারা আওয়ামী লীগ সরকারের হয়ে কাজ করেছেন। শেখ হাসিনাকে খুনি, ফ্যাসিস্ট করার পেছনে কর্মকর্তাদেরও ভূমিকা ছিল। ভবিষ্যতে কর্মকর্তারা যেন রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ না করেন সে অনুরোধ থাকবে।
সানজিদা খান বলেন, তাঁর ছেলে বাসা থেকে বের হওয়ার আগে যে চিঠি লিখে গেছে,সেটি যেন আগামী বছর থেকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারণ, এই চিঠির মধ্যে দায়িত্ববোধ, দেশপ্রেম ও ধর্মীয় অনুভূতি স্পষ্ট। আগামী প্রজন্মের মানুষ জানুক স্বৈরাচার হটাতে কীভাবে মানুষ রাস্তায় নেমেছে।
মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বলেন, মুগ্ধ মারা যায় ১৮ আগস্ট। এরপর সরকারের কাছ থেকে সহায়তার জন্য গণভবনে যেতে তাঁদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। এমনকি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নেতা–কর্মী নিয়ে তাঁদের বাসায় গিয়ে গণভবনে যেতে চাপ দেন। তবু তাঁরা গণভবনে যাননি।
সেমিনারে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, কর্মকর্তাদের যতই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তাতে কাজ হচ্ছে না। কারণ, সাহসের ঘাটতি। দেশে এখন যত আইন আছে তা যথেষ্ট। আইনের আর দরকার নেই। এখন দরকার আইনের প্রয়োগ।
শহীদ শাহরিয়ার খানের চিঠি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানান মোখলেস উর রহমান। আগামী বছর থেকে এটি কার্যকর করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, বিগত সরকারের সময় রাজনীতিবিদেরা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাড়ে ১২টা বাজিয়েছে। ভালো কর্মকর্তাদের কোনঠাসা করে ফেলা হয়েছে। ৫ আগস্টের পর মানুষ প্রশ্ন করতে শিখে গেছে। এখন কেউ কিছু করতে চাইলেও পারবে না। প্রশাসনকে কীভাবে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা যায় সে পথ বের করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব বলেন, ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রতিফলন ঘটে জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে। গত ১৬ বছরে রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভঙ্গুর করে দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে তাঁরা কোন পথে যাবেন। এত বছর যে পথে হেঁটেছেন সেদিকে? নাকি নতুন যে পথ তৈরি হয়েছে, সে পথে যাবেন।