গরিবকে ভালোবাসা ইসলামের অনন্য শিক্ষা
Published: 5th, July 2025 GMT
ইসলামের দৃষ্টিতে গরিবকে ভালোবাসা কেবল মানবতা নয়; বরং এটি একটি ইবাদত। কোরআন-সুন্নাহ আমাদের শিখিয়েছে, অভাবীর মুখে হাসি ফোটানোই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সেরা উপায়। এতিমদের প্রতি দয়া, দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রমাণ হিসাবে রাসুল (সা.) জান্নাতে এমন নিকটত্ব ও ঘনিষ্ঠতার আশ্বাস দিয়েছেন, যা অন্য কোনো সাধারণ ইবাদতের মাধ্যমে পাওয়া কঠিন।
রাসুল (সা.
আজকের সমাজে অর্থ ও ভোগবিলাসের প্রতিযোগিতায় আমরা অনেক সময় গরিবদের ভুলে যাই। অথচ ইসলামের চোখে তারাই আমাদের রিজিক ও বরকতের অন্যতম মাধ্যম।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়ার কোনো দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেন, আল্লাহ তাআলা কেয়ামত দিবসে তাঁর দুঃখ–কষ্ট দূর করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো সংকটে পড়া লোকের ওপর পরিস্থিতি সহজ করে, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতের পথ তার জন্য সহজ করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের গোপন দোষ আড়ালে রাখেন, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তাঁর দোষ আড়ালে রাখবেন। আর আল্লাহ বান্দার সাহায্যে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে নিয়োজিত থাকেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৬৯৯)
প্রখ্যাত সাহাবী সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস (রা.) মনে করতেন, তাঁর অন্যদের চেয়ে কিছুটা শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। তখন রাসুল (সা.) তাঁকে বললেন, ‘তোমরা কি সাহায্য পাওয়া এবং রিজিক লাভ করো না তোমাদের দুর্বলদের মাধ্যমে?’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৮৯৬)
রাসুল (সা.) এ হাদিসে একটি মহান সত্য শিক্ষা দিয়েছেন, তা হলো, সমাজের যেসব মানুষ দুর্বল, অসহায়, গরিব বা প্রতিবন্ধী, তাদের উপস্থিতি এবং তাদের দোয়ার কারণে মহান আল্লাহ গোটা সমাজে রহমত বর্ষণ করেন। অনেক সময় আমরা গরিবদের অবহেলা করি, অথচ তাঁদের দোয়াই আমাদের বিজয় ও বরকতের মূল কারণ হয়। তাঁরা সমাজের বোঝা নয়; বরং রহমতের মাধ্যম।
আরও পড়ুনকেনা জমিতে খুঁড়ে পাওয়া গেল সোনা২৩ অক্টোবর ২০২৩আল্লাহ বলবেন, ‘আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিলাম; কিন্তু তুমি আমাকে খাওয়াওনি।’ সে বলবে, ‘আমার প্রতিপালক, আপনি তো সকল সৃষ্টির প্রতিপালক, আমি কীভাবে আপনাকে খাওয়াব?’হাদিসে কুদসিতে আছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, ‘আদম সন্তান, আমি অসুস্থ ছিলাম, অথচ তুমি আমার খোঁজ নাওনি।’ সে বলবে, ‘আমার প্রতিপালক, আপনি তো সমস্ত জগতের প্রতিপালক, আমি কীভাবে আপনার খোঁজ নেব?’ আল্লাহ বলবেন, ‘আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল, তুমি তার খোঁজ করোনি। যদি তুমি তার খোঁজ নিতে, তাহলে তুমি আমাকে তার নিকটে পেতে।’
আবার আল্লাহ বলবেন, ‘আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিলাম; কিন্তু তুমি আমাকে খাওয়াওনি।’ সে বলবে, ‘আমার প্রতিপালক, আপনি তো সকল সৃষ্টির প্রতিপালক, আমি কীভাবে আপনাকে খাওয়াব?’ আল্লাহ বলবেন, ‘আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল, তুমি তাকে খাওয়াওনি। যদি তুমি তাকে খাওয়াতে, তাহলে তুমি তা আমার নিকটে পেতে।’
আল্লাহ আবার বলবেন, ‘আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম; কিন্তু তুমি আমাকে পানি দাওনি।’
সে বলবে, আমার প্রতিপালক, ‘আমি কীভাবে আপনাকে পানি দেব, অথচ আপনি তো সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক?’ আল্লাহ বলবেন, ‘আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, তুমি তাকে পানি দাওনি। যদি তুমি তাকে দিতে, তাহলে তুমি তা আমার নিকটে পেতে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৫৬৯)
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আমাদের উচিত, প্রিয় বস্তু ও প্রিয় সম্পদ দিয়ে তাঁর পথে খরচ করা এবং অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা কখনোই পূর্ণ নেকি লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করবে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯২)
নিজে পছন্দ করা সত্ত্বেও তারা খাদ্য দান করে গরিব, এতিম ও বন্দীদের।সুরা দাহর, আয়াত: ৮আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘নিজে পছন্দ করা সত্ত্বেও তারা খাদ্য দান করে গরিব, এতিম ও বন্দীদের।’ (সুরা দাহর, আয়াত: ৮)
আজকের সমাজে ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েই চলছে। অথচ ইসলাম এই ব্যবধান ঘোচাতে চায়—ভালোবাসা, দয়া ও দায়িত্ববোধের মাধ্যমে। গরিবদের প্রতি ভালোবাসা শুধু মানবতা নয়; বরং জান্নাতের পথ।
আসুন, ইসলামের মহান এ আদর্শ বাস্তব জীবনে বাস্তবায়ন করি। গরিব, এতিম, মিসকিনদের ভালোবাসি, সাহায্য করি। তবেই দুনিয়া হবে শান্তির, আখিরাত হবে মুক্তির।
লেখক: খতিব, টোলারবাগ কেন্দ্রীয় মসজিদ
আরও পড়ুনসালামে ছোট–বড় ধনী–গরিব ভেদ নেই১৩ মার্চ ২০২৩উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আল ল হ ত আল আল ল হ ব ইসল ম র আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
আশুরা: শোক, শিক্ষা ও আত্মত্যাগের চিরন্তন প্রতীক
স্মৃতি যখন রক্তাক্ত হয়, ইতিহাস তখন থমকে দাঁড়ায়। তেমনি এক গভীর শোক, শিক্ষা ও আত্মত্যাগের নাম আশুরা। হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররম, আর এই মাসের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরা। এটি মুসলিম উম্মাহর কাছে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও হৃদয়বিদারক দিন।
আশুরার স্মৃতি শুধু শোকের নয়, এটি আদর্শ, আত্মত্যাগ এবং ন্যায়ের প্রতীক। এদিন মুসলমানদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়, সত্যের জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করা যাবে না।
আশুরার তাৎপর্য বহুমাত্রিক। এটি যেমন নবীদের নানা বিজয় ও রহমতের দিন, তেমনি ইমাম হুসাইন (রা.)-এর নেতৃত্বে সংঘটিত কারবালার হৃদয় বিদারক আত্মত্যাগের স্মৃতি বহন করে। আশুরা আমাদের শেখায়, কীভাবে ধৈর্য, সাহস ও ঈমানের শক্তিকে ধারণ করে কঠিন সময়েও সত্যের পথে অটল থাকা যায়। এই দিনে রক্ত ঝরেছে, কিন্তু মাথা নোয়ানো হয়নি।
আরো পড়ুন:
সিকৃবির প্রধান ফটকের নাম ‘জুলাই ৩৬’
পাবিপ্রবিতে মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজমবিষয়ক কর্মশালা
হাদিস ও ইসলামী ইতিহাস অনুযায়ী, আশুরার দিনে বহু ঐশী ঘটনা ঘটেছে। মহান আল্লাহ এই দিনে বহু নবী ও উম্মতের প্রতি অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষণ করেছেন। এই দিনে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- হযরত আদম (আ.)-এর তওবা কবুল হয়, ৪০ দিনের মহাপ্লাবনের পর হযরত নূহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে থেমে যায়, হযরত ইদ্রিস (আ.) আসমানে জীবন্তভাবে উত্তীর্ণ হন, হযরত ইব্রাহিম (আ.)–কে আগুনে ফেলার পর এই দিনে আগুন ঠান্ডা হয়ে যায়, হযরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘ রোগভোগের পর এই দিনে সুস্থ হন, হযরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান, হযরত দাউদ (আ.)–এর তওবা কবুল হয়, হযরত ইউসুফ (আ.) কূপ থেকে উদ্ধার হন, হযরত মূসা (আ.) বনি ইসরাইলকে লোহিত সাগর পার করান এবং ফেরাউন তার বাহিনীসহ সাগরে ডুবে যায়, হযরত ঈসা (আ.)–কে আসমানে উত্তোলন করা হয় ইত্যাদি।
এসব ঘটনাই আশুরার পবিত্রতা ও গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলে। এটি একদিকে রহমতের দিন, অন্যদিকে প্রতিবাদের দিন।
আশুরার সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ও গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হলো কারবালার যুদ্ধ। হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম, ইরাকের কারবালা প্রান্তরে ঘটেছিল ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ও আদর্শিক সংঘর্ষ। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রা.) ও তার পরিবার সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে রুখে দাঁড়ান অত্যাচারী শাসক ইয়াজিদের বিরুদ্ধে। ইয়াজিদ ছিল এক নিষ্ঠুর, অবৈধ ও ইসলামবিরোধী শাসক। তার জুলুম ও অবিচারের বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন (রা.) মাথানত না করে সত্য ও ইনসাফের পক্ষে অবস্থান নেন।
তিনি মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হলে কারবালায় সঙ্গীদেরসহ তাকে অবরুদ্ধ করা হয়। পানির পথ বন্ধ করে তাদের তৃষ্ণার্ত করে তোলা হয়। অবশেষে, আশুরার দিনে শুরু হয় ভয়ংকর যুদ্ধ। মাত্র ৭২ জন সাহসী সঙ্গী নিয়ে ইমাম হুসাইন (রা.) হাজার হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। একে একে সবাই শহীদ হন। শিশু, নারী, যুবক কেউ রেহাই পাননি।
৬ মাস বয়সী শিশু আলী আসগর পর্যন্ত তীরের আঘাতে প্রাণ হারায়। ইমাম হুসাইন (রা.) নিজেও শাহাদত বরণ করেন। এই ইতিহাস কোনো সাধারণ যুদ্ধের নয়, এটি আদর্শের, ঈমানের ও আত্মত্যাগের যুদ্ধ। সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোই মুসলমানের পরিচয়, আর আত্মত্যাগই সেই ঈমানের পরিপূর্ণতা। ইমাম হুসাইন (রা.) প্রমাণ করে গেছেন—সত্যের পথে মৃত্যুও গৌরবের।
আশুরার অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো এ দিনে রোজা রাখা। হিজরতের পূর্বেও রাসুলুল্লাহ (সা.) কুরাইশদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আশুরার রোজা পালন করতেন। হিজরতের পর মদিনায় এসে তিনি দেখতে পান, ইহুদিরাও এদিন রোজা রাখে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা জানায়, এদিন হযরত মূসা (আ.) ফেরাউন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তাই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তারা রোজা রাখে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “আমি তোমাদের অপেক্ষা মূসার অধিক নিকটবর্তী।” (সহীহ বুখারী: ২০০৪)
এরপর থেকে তিনি এ দিনে রোজা পালন করেন এবং সাহাবীদেরও পালনের নির্দেশ দেন। পরে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইচ্ছা প্রকাশ করেন, ইহুদিদের রীতি থেকে ভিন্নতা আনতে পরের বছর মহররমের ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ রোজা রাখাবেন। কিন্তু তিনি পরের বছর ইন্তেকাল করেন।
তাই ইসলামী ফিকহবিদরা বলেন, আশুরার রোজা একদিন হলেও রাখা জায়েয। তবে ইহুদিদের অনুকরণ না করতে চাইলে ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ দুইদিন রোজা রাখা উত্তম।
রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আশুরার দিন আল্লাহর কাছে আমি আশা করি, এদিনের রোজার মাধ্যমে গত বছরের গোনাহগুলো মাফ হয়ে যায়।” (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২) এই হাদিসে দেখা যায় যে, আশুরার রোজা রাখা অত্যন্ত শুভ ও পুণ্যের কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, এই রোজা মানবিক পাপের মোচন ঘটায়। অর্থাৎ, যিনি আশুরার রোজা রাখবেন, আল্লাহ তাকে অতীত বছরের সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি দান করবেন।
আশুরার রোজা শুধু গোনাহ মাফের সুযোগই নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধির এক বিরাট মাধ্যম। এ দিনে রোজা রেখে মানুষ যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে, তেমনি আগের বছরের ভুল, পাপ ও গাফিলতির জন্য অনুশোচনা করে এবং নতুনভাবে জীবনে ভালো কিছু করার অঙ্গীকার করে। তাই এ রোজা শুধু ইবাদত নয়, বরং নিজেকে সংশোধনের এক মোক্ষম সুযোগ।
তাই আশুরার শিক্ষা হোক আমাদের জীবনের চালিকাশক্তি। আমরা যেন ইমাম হুসাইন (রা.)-এর মতো সাহসিকতা, ধৈর্য ও ত্যাগের আদর্শ ধারণ করে সমাজে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি—এটাই হোক আশুরার প্রকৃত শিক্ষা ও প্রতিজ্ঞা।
(লেখক: শিক্ষার্থী, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়)
ঢাকা/মেহেদী