ইবিএল ও মাস্টারকার্ড আনল বায়োমেট্রিক মেটাল ক্রেডিট কার্ড
Published: 5th, July 2025 GMT
ছবি: ইবিএলের সৌজন্যে
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মুরাদনগরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে সামাজিক অস্থিরতা
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসন থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা হওয়া আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বাড়িও এই উপজেলায়। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এই দু’জনের অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ বাড়ছে।
এরই মধ্যে বিএনপির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) স্থানীয় নেতাকর্মীর পাল্টাপাল্টি মিছিল-বক্তব্য, মামলা, সংবাদ সম্মেলন ঘিরে মুরাদনগরে উত্তাপ বাড়ছে। এই বিরোধ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন পড়েছে বেকায়দায়। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, দুই থানার পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন উপদেষ্টার কথার বাইরে কোনো কাজ করে না। তাই এলাকার মানুষ ন্যায়বিচার বঞ্চিত হচ্ছে। এলাকায় অপরাধ বাড়ছে।
পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, গত ১১ মাসে এ উপজেলায় ১০টি খুন এবং ৩০টি ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এ দুইজনের অনুসারীদের বিরোধ প্রভাব ফেলছে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর। স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া, কিছু দিন পরপর পাল্টাপাল্টি ঘটনা, দোষারোপ রাজনীতির পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতাকে উস্কে দিচ্ছে। নৃশংস ঘটনাও বাড়ছে।
সম্প্রতি মুরাদনগরে একজন নারীকে ঘরে ঢুকে ধর্ষণ ও তাঁর ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সপ্তাহ না পেরোতেই অপবাদ দিয়ে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয় দুই সন্তানসহ এক মাকে। ফলে প্রশ্ন জেগেছে, একটি এলাকায় কেন বারবার এমন ঘটনা ঘটছে।
পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি
২২টি ইউনিয়ন নিয়ে কুমিল্লার বৃহৎ উপজেলা মুরাদনগর। এর মধ্যে মুরাদনগর থানায় ১২টি ইউনিয়ন এবং বাঙ্গরা বাজার থানায় ১০টি ইউনিয়ন। এ আসনে আওয়ামী লীগ ছিল দুই ভাগে বিভক্ত। সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন এবং জাহাঙ্গীর আলম সরকার গত ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে যান। সব মামলায় খালাস পেয়ে ১৩ বছর পর গত ২৮ ডিসেম্বর সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরেন কায়কোবাদ। তিনি এখন সক্রিয়।
অন্যদিকে, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ এনসিপির কোনো পদে নেই। তবে দলটির স্থানীয় নেতারা জানান, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এলাকার বিভিন্ন স্থাপনায় সরকারি অনুদান ও উন্নয়নকাজ করে যাচ্ছেন এ উপদেষ্টা। আগামীতে সংসদ নির্বাচনে আসিফের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা আছে।
থানা পুলিশ জানায়, বিভিন্ন ইস্যুতে উভয় দলের নেতাকর্মীরা প্রায়ই উপজেলা সদরে পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ মিছিল করে। নানা ইস্যুতে উত্তেজনা ছড়ায়।
ধর্ষণের ঘটনায় পরস্পরকে দোষারোপ
গত ২৬ জুন এক নারীর ঘরে ঢুকে ধর্ষণ ও পরে তাঁকে মারধরের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হলে তা সারাদেশের মানুষকে স্তম্ভিত করে। এ ঘটনায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘একজন উপদেষ্টা (আসিফ মাহমুদ) নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মুরাদনগরে ক্রমাগত ক্ষমতার অপব্যবহার করে যাচ্ছেন। উপদেষ্টা যদি জনসেবার চেয়ে আত্মসেবাতে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে এলাকায় শান্তি বিঘ্নিত হবে। মুরাদনগরের বাসিন্দা উপদেষ্টা হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের এমপিদের মতো এলাকায় আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারে ব্যস্ত রয়েছেন।’
দু’দিন পর গত মঙ্গলবার নির্যাতিত নারীকে সমবেদনা জানাতে যান কায়কোবাদ। স্থানীয় বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘মুরাদনগরে ধর্ষণকাণ্ডের ঘটনাটি বিএনপির ওপর দায় চাপাতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত তথ্য এখন বেরিয়ে এসেছে। এ ঘটনায় বিএনপির কোনো কর্মী সম্পৃক্ত নয়। থানার ওসি আর আমাদের উপদেষ্টা (আসিফ মাহমুদ) আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের পুনর্বাসন করছেন।’
পুলিশ হেফাজতে বিএনপি কর্মীর মৃত্যু
গত ১৯ জুন ৭০টি ইয়াবাসহ বাঙ্গরা বাজার থানা পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে শেখ জুয়েল (৪৫) পুলিশ হেফাজতে মারা গেছেন। নিহত জুয়েলের বাড়ি বাঙ্গরা গ্রামে। এলাকায় তাঁর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবসা ছিল। তিনি বিএনপি কর্মী ছিলেন বলে জানিয়েছেন মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন অঞ্জন। তাঁর ভাই বাঙ্গরা পূর্ব ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক।
পরিবারের অভিযোগ, পুলিশের নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে জুয়েলের। পুলিশ দাবি করে, জুয়েল অসুস্থ ছিলেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
ক্ষেপিয়ে তুলে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সকালে বাঙ্গরা বাজার থানার কড়ইবাড়ী গ্রামে একটি মোবাইল ফোন চুরি ও মাদক কারবারের অভিযোগে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতরা হচ্ছেন– ওই গ্রামের জুয়েল মিয়ার স্ত্রী রোকসানা আক্তার রুবি (৫৮), তাঁর ছেলে মো. রাসেল (৩৫) ও মেয়ে জোনাকি আক্তার (৩২)। হামলায় আহত হয়েছেন রুবির আরেক মেয়ে রুমা আক্তার (২৫)। সংকটাপন্ন অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে। এ ঘটনার পর থেকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে এলাকা অনেকটা পুরুষশূন্য। মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ।
১১ মাসে ১০ খুন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন
মুরাদনগর ও বাঙ্গরা বাজার থানা পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে গত শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় ৫৯৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে মুরাদনগর থানায় প্রায় ৪০০ মামলা হয়েছে। এর সাতটি হত্যা, ২০টি ধর্ষণ, পর্নোগ্রাফি ও নারী নির্যাতন আইনের মামলা। আলোচিত ঘটনা ছিল থানায় হামলা, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, নারীকে ধর্ষণ ও ভিডিও ভাইরাল মামলা।
বাঙ্গরা বাজার থানায় ১৯৬ মামলার মধ্যে ১০টি ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও পর্নোগ্রাফি আইনে এবং তিনটি খুনের। সর্বশেষ এ থানা এলাকায় তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
থানায় হামলা ও মামলা
গত ১২ এপ্রিল মুরাদনগরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা স্ট্যান্ডে চাঁদাবাজির অভিযোগে আবুল কালামকে আটক করে পুলিশ। তিনি নবীপুর ইউনিয়ন শ্রমিক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক। পুলিশের অভিযোগ, কালামকে ছাড়িয়ে নিতে উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ রানার নেতৃত্বে থানায় হামলা হয়। এ সময় থানায় থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীর ওপরও হামলার অভিযোগ করা হয়। এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়। কায়কোবাদের কয়েকজন অনুসারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়।
উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘৫ আগস্ট দেবিদ্বার, তিতাস থানা ও ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে থানা আক্রান্ত হয়। তখন কায়কোবাদের নির্দেশে সবাইকে মুরাদনগর থানায় আশ্রয় দিয়ে দল থেকে দুই সপ্তাহ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। পরে আমাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও থানায় হামলার মিথ্যা মামলা এবং নেতাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ আমাদের সেই প্রতিদান দিচ্ছে। মিছিল করতে গেলে পুলিশ আমাদের লোকজনের ব্যানার ছিনিয়ে নেয়।’ তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এখন এনসিপির সঙ্গে মিলেমিশে এলাকায় মাদক, জুয়া ও বালুর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মুরাদনগর শাখার আহ্বায়ক ওবায়দুর রহমান সিদ্দিকী সমকালকে বলেন, মুরাদনগরে মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও বালু ব্যবসায় বিএনপির লোকজন জড়িত। কিন্তু উপদেষ্টার (আসিফ) কারণে সব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিএনপি নেতারা এখন বেসামাল হয়ে গেছেন।
মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব মোল্লা মজিবুল হক বলেন, কায়কোবাদ ও আমাদের বিরুদ্ধে উপদেষ্টা আসিফ ও তাঁর লোকজন অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা দুই থানার পুলিশকে ব্যবহার করছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ সমকালকে বলেন, ‘মুরাদনগরের প্রশাসন এখন এনসিপিকে খুশি করতে ব্যস্ত; তারা অপরাধ দমনে ব্যস্ত নয়। তাই এলাকায় সব অপরাধ বেড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশে দল বলতে দুটিই আছে– বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। ইনশাআল্লাহ, বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। তাই বিএনপির কেউ দল ছেড়ে এনসিপিতে যাচ্ছে না। এনসিপিতে কোনো কর্মী নেই। তাই তারা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে দলে নিচ্ছে। এলাকার অনৈতিক কর্মকাণ্ডে তারাই জড়িত, বিএনপি নয়।’
মুরাদনগর থানার ওসি জাহিদুর রহমান বলেন, এনসিপিকে পুলিশ বিশেষ কোনো সুবিধা দিচ্ছে না। বিএনপির অভিযোগ সঠিক নয়। তিনি বলেন, ধর্ষণ ও ভিডিও ভাইরালের ঘটনায় জড়িত আসামিদের এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার মোবাইল ফোনে কল করে এবং হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।