দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত এক শত্রু এডিস মশা। আর এডিস মশার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া এখন আমাদের জন্য এক কঠিন বাস্তবতা। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে প্রতিবছরই দেশে কমবেশি ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে ২০২৩ সাল ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী। ডেঙ্গু রোগ ও এডিস মশা সম্পর্কে দেশের সরকার ও মানুষ এখন অনেকটাই জানেন। রোগটি কীভাবে ছড়ায়, কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়—এসব তথ্যও আমাদের জানা। এমনকি সরকার, সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য বিভাগ নানা উদ্যোগও নিয়েছে।

তবু প্রশ্ন থেকে যায়, সবকিছু জানার পরও আমরা কেন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি বারবার? এ ব্যর্থতার পেছনে কোথায় ঘাটতি, কাদের দায় আর কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায় এই ঘূর্ণিচক্র—এখন সময় এসেছে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, এ বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ১২ হাজার মানুষ।

সরকারি হিসাবমতে, এরই মধ্যে ৪৫ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০ নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। বাস্তবচিত্র আরও ভয়াবহ। কারণ, অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন বাসায় বা এমন হাসপাতালে, যেগুলোর রিপোর্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে যায় না। এসব পরিসংখ্যান আমাদের সামনে এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যদি তা এখনই মোকাবিলা করা না যায়, তাহলে আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশের অনেক জেলায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

ডেঙ্গু রোগ ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। বিশেষ করে Aedes aegypti ও Aedes albopictus প্রজাতির মশা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে। এডিস মশা সাধারণত সকালে ও বিকেলে বেশি কামড়ায়, তবে দিনে বা রাতে যেকোনো সময়ে এরা কামড়াতে পারে। এসব মশা জমে থাকা স্বচ্ছ বা অস্বচ্ছ পানিতে ডিম পাড়ে ও এদের জীবনচক্র সম্পন্ন করে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নির্দেশক ‘ব্রেটো ইনডেক্স’ ২০-এর ওপরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী, কোনো এলাকায় যদি এই সূচক ২০ ছাড়িয়ে যায়, তাহলে সেই এলাকায় ডেঙ্গুর মতো রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা অত্যন্ত বেশি।

বর্তমানে বরিশাল বিভাগ, বিশেষ করে বরগুনা ও বরিশাল জেলার অবস্থা অত্যন্ত ‘বিপজ্জনক’। আমাদের গবেষণা ফোরকাস্টিং মডেলের ভিত্তিতে বলা যায়, আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বরগুনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, কক্সবাজার, গাজীপুর, পিরোজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁদপুর ও মাদারীপুর জেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক রূপ নিতে পারে। মে মাসের তুলনায় জুনে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পাওয়া এ প্রবণতার ভয়াবহতা নির্দেশ করে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ডেঙ্গু প্রবৃদ্ধি জ্যামিতিক হারে বাড়বে, যা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ যে হারে বেড়ে চলেছে, তা আর কেবল একটি মৌসুমি রোগ হিসেবে সীমাবদ্ধ নেই; বরং এটি একটি জটিল ও বহুমাত্রিক জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিয়েছে।

ডেঙ্গুর বিস্তারের পেছনে একাধিক পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত কারণ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিবর্তন। দেশের শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের মতো এলাকায় অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজের কারণে তৈরি হচ্ছে মশার প্রজননের আদর্শ পরিবেশ।

নির্মাণাধীন ভবনে খোলা ড্রাম, বালতি, পানির ট্যাংক কিংবা পরিত্যক্ত ভবনে দিনের পর দিন জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার না করায় সেখানে অনায়াসে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। বহুতল ভবনগুলোর বেজমেন্টে গাড়ি পার্কিং ও গাড়ি ধোয়ার জায়গায় সৃষ্টি হচ্ছে মশার আদর্শ প্রজননস্থল। কিছু কিছু এলাকায় পানির সংকট থাকার কারণে বৃষ্টি বা সাপ্লাইয়ের পানি ড্রাম, বালতি ও অন্যান্য পাত্রে ধরে রেখে নাগরিকেরা সৃষ্টি করছে মশার অনন্য বাসস্থান।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে লার্ভা ধ্বংস সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলেও দেশে অনেক এলাকায় নিয়মিত মনিটরিং বা লার্ভা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। জনবলের সংকট, প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা ও কার্যকর পরিকল্পনার অভাবে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনগুলো এ কাজে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। এ কারণে অনেক এলাকায় নিভৃতে লার্ভা বেড়ে উঠছে এবং তা ডেঙ্গুর বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে।

বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় ডেঙ্গু সংক্রমণ খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে। একটি ভবনে একজন আক্রান্ত হলে অল্প সময়েই সেই রোগ আশপাশের অনেককে সংক্রমিত করে ফেলে। শহরের বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা বৃষ্টির পানি, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের বোতল, ফুলের টব, ক্যান বা প্যাকেটজাত খাবারের খালি কৌটা—সবই মশার ডিম পাড়ার জন্য যথেষ্ট। নগরজীবনে প্যাকেট ও ক্যানজাত খাবারের ব্যবহার বাড়ায় এ ধরনের জিনিসপত্র যেখানে–সেখানে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, যা মশার বংশবিস্তারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির কারণে তৈরি হওয়া জলাবদ্ধতা ও উচ্চ আর্দ্রতা এডিস মশার জন্য অত্যন্ত উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে। মশা খুব অল্প পানিতেও ডিম পাড়ে ও মাত্র পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যেই সেই ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা জন্মে যায়। এভাবে টানা বৃষ্টি ও অনিয়ন্ত্রিত পানি নিষ্কাশনের অভাব ডেঙ্গুর বিস্তারকে জ্যামিতিক হারে বাড়িয়ে তোলে। পরিকল্পনাহীন নগরায়ণ, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও অকার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে শহরের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় পাত্রে পানি জমে থাকে, যা সময়মতো ধ্বংস না করা হলে মশা নিয়ন্ত্রণের সব উদ্যোগ ব্যর্থ হতে বাধ্য।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে লার্ভা ধ্বংস সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলেও দেশে অনেক এলাকায় নিয়মিত মনিটরিং বা লার্ভা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। জনবলের সংকট, প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা ও কার্যকর পরিকল্পনার অভাবে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনগুলো এ কাজে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। এ কারণে অনেক এলাকায় নিভৃতে লার্ভা বেড়ে উঠছে এবং তা ডেঙ্গুর বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে।

এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবও ডেঙ্গু মোকাবিলায় বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই জানেন না কোথায় মশা ডিম পাড়ে, কীভাবে লার্ভা ধ্বংস করতে হয় কিংবা এডিস মশা কখন কামড়ায়। কেউ কেউ জানলেও দায়িত্ববান আচরণ করেন না। বাড়ির ছাদ, বারান্দা বা আঙিনায় জমে থাকা পানির প্রতি সতর্কতা অবলম্বন করেন না।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, জলবায়ু পরিবর্তন এখন এডিস মশার বিস্তারকে আরও ত্বরান্বিত করছে। অস্বাভাবিক বৃষ্টি, তাপমাত্রার ওঠানামা ও আর্দ্রতার তারতম্য এডিস মশার জীবচক্রে সহায়তা করছে এবং ভাইরাস সংক্রমণ আরও দ্রুত হচ্ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে অল্প সময়ের বৃষ্টিতে যখন বিভিন্ন ছোট–বড় পাত্রে পানি জমে থাকে, তখন তা দ্রুত মশার প্রজননস্থলে রূপ নেয়। অতএব ডেঙ্গুর বর্তমান এই পরিস্থিতি শুধু একটি রোগ নয়, বরং এটি জলবায়ু, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের সম্মিলিত সংকট, যার সমাধান জরুরি। এ সংকট মোকাবিলায় ব্যাপক ও সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া সম্ভব নয়।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রয়োজন একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, বাস্তবসম্মত ও সমন্বিত কৌশল। এটি কেবল ফগিং বা কীটনাশক ছিটানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; বরং এডিস মশার প্রজননচক্র ধ্বংস করাই হতে হবে মূল লক্ষ্য।

এ জন্য প্রথমেই যেটি জরুরি তা হলো, মশার প্রজননস্থল শনাক্ত করে তা ধ্বংস করা। বাড়ির ছাদ, বেজমেন্ট, বারান্দা, আঙিনা, বাথরুম, রান্নাঘর কিংবা আশপাশে যেখানে পানি জমে থাকতে পারে, সেসব স্থান নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। বাড়ির ছাদ বা আঙিনায় রাখা ফুলের টব, বালতি, কৌটা, পানির ড্রাম কিংবা পরিত্যক্ত পাত্রে বৃষ্টির পানি জমা হতে না দেওয়ার বিষয়ে নাগরিকদের দায়িত্বশীল হতে হবে। একই সঙ্গে খোলা জায়গায়, রাস্তার পাশে, নির্মাণাধীন ভবন ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চত্বরে যেন কোথাও পানি জমে না থাকে, তা নিশ্চিত করার জন্য প্রশাসনকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

ডেঙ্গুর হটস্পটগুলো চিহ্নিত করে সেখানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে। যেসব বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে, সেই বাড়িকে কেন্দ্র করে অন্তত ২০০ মিটারের মধ্যে ফগিং, লার্ভিসাইড ছিটানো এবং লার্ভা সার্ভে চালানো আবশ্যক। কারণ, আক্রান্ত ব্যক্তির আশপাশে উড়ন্ত এডিস মশা বেঁচে থাকলে এরা সহজেই অন্যদের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাতে পারে। সে ক্ষেত্রে শুধু আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিলেই চলবে না, তাকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকাকেই মশামুক্ত রাখতে হবে।

এডিস মশা নির্মূলে রাসায়নিকের অতিরিক্ত ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তাই পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ লার্ভিসাইড ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ড, মহল্লা বা ইউনিয়নে নিয়মিত লার্ভা পর্যবেক্ষণ, তথ্য বিশ্লেষণ ও ফলাফলভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় মশার ঘনত্ব, আবহাওয়া ও রোগীর তথ্য সমন্বিতভাবে বিশ্লেষণ করে আগাম পূর্বাভাস ও প্রস্তুতি গ্রহণ করাও একটি সময়োপযোগী কৌশল হতে পারে। প্রয়োজনে বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষকদের এ কাজে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে কেবল সরকারের একক প্রচেষ্টায় সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। এ সমস্যার কার্যকর সমাধানে জনগণের সক্রিয় ও সচেতন অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। প্রত্যেক নাগরিককে নিজ নিজ পরিবার, পাড়া-মহল্লা এবং কর্মস্থলে মশার প্রজননস্থল শনাক্ত ও ধ্বংসে উদ্যোগী হতে হবে।

স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গুবিষয়ক সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। পাশাপাশি, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, কীটতত্ত্ববিদ ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে সমন্বয় আরও জোরদার করতে হবে। কারণ, ডেঙ্গু কোনো একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সমস্যা নয়, এটি একটি জাতীয় সংকট, যার সমাধান একমাত্র সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগের মধ্য দিয়েই সম্ভব।

অধ্যাপক কবিরুল বাশার কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ই–মেইল: [email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ব স ত রক ব শ ষ কর ব যবস থ সমন ব ত ক র যকর আম দ র র জন য পর ব শ সরক র সবচ য় গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

সবার চেয়ে এগিয়ে থাকতে যে ৯টি এআই দক্ষতা আপনার এখনই শেখা উচিত

১. প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং: এআইয়ের সঙ্গে কথা বলুন

চ্যাটজিপিটিকে কিছু জিজ্ঞেস করে হতাশ হয়েছেন? চ্যাটবট আপনাকে এলোমেলো উত্তর দিয়েছে? এটা খুব সাধারণ ব্যাপার। হাল ছেড়ে দেবেন না। কারণ, আপনি এআইয়ের সঙ্গে সঠিকভাবে কথা বলতে পারেননি। তাই আপনাকে চ্যাটবট হতাশ করেছে। ওর থেকে সঠিক উত্তর পাওয়ার একটা গোপন রহস্য আছে। সেটা হলো প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ারিং। মানে এআইয়ের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলুন, যাতে নিখুঁত ও নির্ভুল উত্তর দেয়। বোঝার সুবিধার্তে উদাহরণ দেওয়া যাক।

এআইকে শুরতেই আপনার পেশা জানিয়ে দিন। যেমন আপনি হতে পারেন একজন সেলস মার্কেটার বা আইনজীবী। পেশা জানালে এআই আপনাকে মার্কেটিং এক্সপার্ট বা দক্ষ আইনজীবীর মতো উত্তর দিতে পারবে। তারপর উদাহরণ দিন। পরিষ্কার করে বলুন আপনি কী চান। সবশেষে কোন ফরম্যাটে উত্তর চান, সেটাও উল্লেখ করুন। যেমন বলতে পারেন, ‘আমাকে একটা টেবিল বানিয়ে দাও। টেবিলের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যথাক্রমে ৮ ও ৩ মিটার। টেবিলের ওপর একটা ফুলদানি থাকবে সবুজ রঙের। পাশে থাকবে একটা টিউব লাইট।’ এভাবে বিস্তারিত বলুন।

মানে ভাবুন, আপনি কোনো বন্ধুকে নিজের বাড়ির ঠিকানা দিচ্ছেন। যত ভালোভাবে ঠিকানা বুঝিয়ে দিতে পারবেন, বন্ধু তত সহজে আপনার বাড়ি পৌঁছে যাবে। শুধু যদি বন্ধুকে বলেন, ‘আমার বাড়ি ঢাকা বড় মার্কেটের পাশে’, তাহলে তা খুঁজে পেতে বন্ধুর অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু যদি সড়ক ও বাসা নম্বরসহ বিস্তারিত ঠিকানা দেন, তাহলে সহজে আপনার বাসা খুঁজে পাবে। এটাও অনেকটা সে রকম। সবকিছু স্পষ্টভাবে বলে দিন, তাহলে নিজের পছন্দমতো সঠিক উত্তর পাবেন।

সহজে আরেকটি কাজ করতে পারেন। ধরুন, আপনি চ্যাটবটকে দিয়ে কোনো উত্তর লিখিয়ে নিতে চান। তাহলে জেমিনি বা গ্রকের মতো অন্য কোনো এআই দিয়ে প্রম্পট লিখে নিন। তাহলে আপনার আর বিস্তারিত না লিখলেও চলবে। অন্য একটা এআই আপনার হয়ে কাজটা করে দেবে। অবশ্য এ ধরনের প্রম্পট নিজের হাতে লেখাই ভালো। এতে দক্ষতাও বাড়বে।

২. সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট: কোডিং না জেনেও বানান অ্যাপ

আপনার মাথায় দারুণ সব আইডিয়া আছে, কিন্তু কোডিং করতে পারেন না? কোডিংয়ের কথা শুনলেই মাথার মধ্যে কেমন প্যাচ লেগে যায়? এখন আর এটা কোনো সমস্যা নয়। পাইথন বা জাভাস্ক্রিপ্ট জানারও দরকার নেই। এই সমস্যার সমাধান করে দেবে এআই। এ জন্য আপনাকে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ে আসতে হবে না। রেপলাইট (Replit) বা কার্সর (Cursor)-এর মতো টুল দিয়ে সহজেই কোড লিখিয়ে নেওয়া যায়।

তবে এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো। কোডার না হয়েও আপনি কোডিং করতে পারবেন ঠিকই, কিন্তু ভালো করা মুশকিল হবে। কোডিংয়ের ব্যাপারে আপনাকে দক্ষ হতে হবে, তা-ও বলছি না। অন্তত প্রাথমিক ধারণাটা থাকা চাই। তা না হলে ভবিষ্যতে আপনার বানানো অ্যাপে কোনো সমস্যা হলে তা ধরতেই পারবেন না। তাই এসব ব্যাপারে একটু জ্ঞানার্জন করে নিলে আপনিই হয়ে উঠবেন দক্ষ সফটওয়্যার ডেভেলপার।

ভাবছেন, আপনি শুরু করবেন কোথা থেকে? খুঁজলে দেখবেন, মানুষের হাজারটা সমস্যা আছে। আপনাকে শুধু খুঁজে বের করতে হবে, এর মধ্যে কোন সমস্যায় মানুষ বেশি ভোগে। সমস্যা খুঁজে পেলে এআই দিয়ে সেই সমস্যার সমস্যার সমাধান বানিয়ে বিক্রি করে দিন। দেখবেন, সেসব মানুষ আগ্রহের সঙ্গে কিনছে। এমনকি ঠিকভাবে প্রম্পট দিতে পারলে আপনি নিজেই বানিয়ে নিতে পারবেন চ্যাটজিপিটির মতো একটি চ্যাটবট।

৩. ডিজাইন ও আর্ট: সৃজনশীলতা উন্মোচনের এই তো সময়

আগে এআইয়ের বানানো ছবি দেখতে খুব অদ্ভুত লাগত। তবে এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। এআই এখন নামকরা শিল্পীদের মতো ছবি আঁকতে পারে। আসল ছবি ও এআইয়ের আঁকা ছবি পাশাপাশি রাখলে আসলটা চেনা মুশকিল হয়ে যায়। এআইয়ের সাহায্যে এখন রিয়েলিস্টিক ছবি, লোগো, এমনকি ওয়েবসাইটও ডিজাইন করা যায়। ফটোশপের পরিবর্তে এখন মিডজার্নি, লিওনার্দো বা দাল-ইর মতো টুল দিয়ে নিজেই বানাতে পারবেন পেশাদার ছবি বা লোগো। আপনার হাতে আঁকা স্কেচও এআইয়ের সাহায্যে আরও সুন্দর করে নিতে পারেন।

৪. ভিডিও এডিটিং: ঘণ্টার কাজ শেষ হবে মিনিটে

আগে ভিডিও এডিট করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো। কেটে বাদ দিতে হতো অদরকারি কথা কিংবা অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো। এখন এআই এসব বিরক্তিকর কাজ করে দিতে পারে খুব দ্রুত। রানওয়ে এমএল (Runway ML), পিক্টোরি (Pictory), ডিস্ক্রিপ্ট (Descript)-এর মতো টুল ভিডিও এডিটিংয়ের ভোল পাল্টে দিয়েছে। এসব দিয়ে আপনি অনায়াসে অপ্রয়োজনীয় কথা, বিরতি, ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ মুছে ফেলতে পারবেন। যোগ করতে পারবেন সাবটাইটেল। এমনকি স্ক্রিপ্ট থেকে ভিডিও বানাতে পারবেন রেকর্ডিং ছাড়াই। আপনি কনটেন্ট ক্রিয়েটর হন বা ব্যবসায়ী, এআই এডিটিং টুলগুলো আপনার কাজের সময় ৭০ শতাংশ কমিয়ে দেবে। কাজের মানও থাকবে পেশাদার পর্যায়ে। তাহলে আর দেরি কেন, আজই কাজে লেগে যান!

আরও পড়ুন৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সে যেভাবে ত্বকের যত্ন নেবেন১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫৫. লেখালেখি: নিজের ভাবনাকে রূপ দিন

সবচেয়ে ভালো লেখকদের যে কেবল ভাষায় ভালো দখল থাকে, তা নয়; তাঁরা ভালো আইডিয়াও দেন। এআই আপনাকে সেই আইডিয়া বের করতে সাহায্য করবে। ভাইরাল কনটেন্টের বিষয়ও খুঁজে দেবে। এমনকি আপনার বা আপনার ক্লায়েন্টের লেখার স্টাইলও নকল করতে পারবে।

এআই দিয়ে বেশির ভাগ কাজ করিয়ে নিয়ে নিজে সম্পাদনা করতে পারেন। চ্যাটজিপিটি, জ্যাসপার বা কপি ডটএআই দিয়ে ব্লগ পোস্ট, সেলস কপি বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্যাপশন লিখতে পারবেন। লেখার শিরোনাম বানিয়ে নিতে পারেন এআইয়ের সাহায্যে। লেখার মধ্যে কোনো ভুল আছে কি না, তা-ও এখন এআই বলে দিতে পারে। ২ হাজার শব্দের একটা লেখাকে চাইলে ৫০০ শব্দে সাজিয়ে দিতে পারে এআই।

৬. কনটেন্ট মার্কেটিং: সব জায়গায় থাকুন অনায়াসে

বিখ্যাত মার্কিন অভিনেতা আর্নল্ড শোয়ার্জনেগারের ‘আর্নল্ডস পাম্প ক্লাব’ শুনেছেন? এটা একটা জনপ্রিয় পডকাস্ট। অবাক করা বিষয় হলো, আর্নল্ড নিজে কখনো একটা পর্বও রেকর্ড করেননি। পুরো কাজটা করে দিয়েছে এআই। নিউজলেটার থেকে শুরু করে ভয়েস ক্লোন পর্যন্ত!

আপনিও এটা করতে পারবেন। এআই দিয়ে কনটেন্ট বানান, পুনরায় ব্যবহার করুন, সব প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে দিন। এমনকি এতে আপনার টিমও লাগবে না। সব কাজ এখন করে দেবে এআই। হঠাৎই আপনি নিজেকে দেখতে পাবেন সব জায়গায়।

অনলাইনে এখন ব্র্যান্ডিং হয়ে গেছে সহজ। ব্র্যান্ডিং বিভিন্ন উপাদান তৈরি করতে বড় টিমেরও দরকার নেই। ট্যাপলিও (Taplio), রিপারপাস ডটআইও (Repurpose.io) আর হাইপফিউরির (Hypefury) মতো টুল দিয়ে ব্লগ পোস্টকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উপযোগী কনটেন্টে রূপ দিতে পারবেন। কনটেন্ট শিডিউল করতে পারবেন সব প্ল্যাটফর্মে। এমনকি সাপ্তাহিক নিউজলেটারও অটো জেনারেট করতে পারবেন।

৭. নো-কোড এআই অটোমেশন: ওয়ার্কফ্লোর জাদুকর হয়ে যান

দিনের বেশির ভাগ সময় আপনি কি একই কাজ বারবার করেন? মানে আপনার ম্যানুয়াল কাজ কি বেশি? যেমন ডেটা কপি করা, একই ই-মেইল পাঠানো, এক অ্যাপ থেকে অন্য অ্যাপে যাওয়া। এ ধরনের কাজে প্রচুর সময় নষ্ট হয়। তবে আপনি যদি এআই দিয়ে এসব সমস্যার সমাধান করতে পারেন, তাহলে ‘হিরো’ হয়ে যাবেন। সঙ্গে টাকা তো পাবেনই।

জ্যাপায়ার (Zapier) বা মেক (Make) দিয়ে গুগল শিট বা জিমেইলের মতো পছন্দের অ্যাপগুলো যুক্ত করতে পারেন। চ্যাটজিপিটি প্লাগইনস বা অটোজিপিটি দিয়ে সেসব চেইন তৈরি করে নিজের কাজ সহজ করে নিতে পারেন।

আরও পড়ুনকিনোয়ায় আছে চাল ও গমের চেয়ে বেশি প্রোটিন ০২ জুলাই ২০২৫৮. ডেটা অ্যানালাইসিস: এলোমেলো তথ্যকে সাজিয়ে নিন

সব প্রতিষ্ঠানেই প্রচুর ডেটা থাকে। কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান জানে না সেসব দিয়ে কী করতে হয়। এখানেই আপনার সুযোগ। এআই দিয়ে এলোমেলো স্প্রেডশিট পরিষ্কার করুন, সমৃদ্ধ করুন এবং সেখান থেকে খুঁজে বের করুন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। চ্যাটজিপিটি অ্যাডভান্সড ডেটা অ্যানালাইসিস বা পাওয়ার বি কোপাইলট দিয়ে ফাইল আপলোড করুন। সাধারণ ভাষায় প্রশ্ন করুন। দেখবেন, এআই আপনাকে চার্টসহ তাৎক্ষণিক ফলাফল তৈরি করে দেবে। এভাবে আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানকে স্মার্ট সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারেন। এতে প্রতিষ্ঠানেরও লাভ, আপনারও।

৯. এজেন্ট ডেভেলপমেন্ট: ডিজিটাল কর্মী বানান

এআই এজেন্টের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এরা ২৪/৭ কাজ করে। কখনো অভিযোগ করে না। সব সময় ভালো কাজ করে দেয়। ছুটিও চায় না। আপনি যদি কোনো কাজ এআইকে বোঝাতে পারেন, ট্রেইন করতে পারেন এবং এর পারফরম্যান্স দেখতে পারেন, তাহলে আপনি সফল হবেন। এককথায় রোবট বানিয়ে ভালো অর্থ উপার্জন করতে পারেন। অটোজিপিটি, এজেন্টজিপিটি বা ফ্লোওয়াইস দিয়ে এমন বট বানানো সম্ভব। এসব বট গবেষণা করবে, আপনার ব্যক্তিগত ই-মেইল পাঠাবে, অ্যাপয়েন্টমেন্ট সামলাবে, কাস্টমার সাপোর্টও দেখভাল করবে। উন্নত টুলগুলোতে মেমোরি, এপিআই এবং নির্দেশনা যোগ করতে পারবেন। ফলে এসব ক্রমাগত উন্নতি করতে থাকবে। আপনি শুধু অটোমেট করবেন না, ওকে দায়িত্বও দেবেন।

সহজ কথায়, এআই আপনার বিকল্প হওয়ার আগে আপনিই একটা এআই বানান। আপনার কোনো বিশেষ ডিগ্রি বা কাজের অভিজ্ঞতার দরকার নেই। শুধু কৌতূহল আর চেষ্টা থাকলেই হবে। এআই-বিপ্লব চলছে। তাই আর অপেক্ষা না করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করুন। কিছু বানান। যা শিখছেন, তা ভাগাভাগি করুন।

শুরুতে আপনাকে এই ৯টি দক্ষতা শিখতে হবে না, শুধু একটা শিখুন। এই ৯টির মধ্যে যেটায় আপনি আগ্রহী, সেটা নিয়েই কাজ শুরু করুন। আরও সহযোগিতা পেতে অনলাইনে সার্চ করুন বা এআইকেই জিজ্ঞেস করুন। ইউটিউবে এমন ভিডিও থাকলে, তা-ও একটু দেখে নিতে পারেন। দেখে নিতে পারেন ১০ মিনিটের একটা টিউটরিয়াল। দেখবেন, আপনি প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত শিখছেন। এসব শিখলে আপনি অন্তত ৯৫ শতাংশ মানুষের চেয়ে এগিয়ে থাকবেন।

সূত্র: মিডিয়াম

আরও পড়ুনজয়া আহসানের জন্মদিনে দেখে নিন ১৫ বছরের ১৫টি ছবি ০১ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অসাধু আমদানিকারকদের দৌরাত্ম্য, হুমকির মুখে দেশীয় কসমেটিকস শিল্প
  • বিএনপির পাল্টা শক্তি হতে তৎপর ইসলামি দলগুলো
  • ফেডারেল রিজার্ভের প্রধানকে এখনই পদত্যাগ করতে বলেছেন ট্রাম্প
  • সবার চেয়ে এগিয়ে থাকতে যে ৯টি এআই দক্ষতা আপনার এখনই শেখা উচিত