কারবালার ঘটনা মুসলিম ইতিহাসের একটি হৃদয়বিদারক অধ্যায়। ৬১ হিজরির মহররম মাসের আশুরার দিনে সংঘটিত এ ঘটনায় নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হোসাইন (রা.)–সহ আহলে বাইতের ২৩ জন সদস্য শাহাদাত বরণ করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/৩৫৩)
এ নিবন্ধে কারবালার প্রেক্ষাপট, ঘটনাপ্রবাহ এবং পরবর্তী ঘটনাবলি ইতিহাসের আলোকে সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি বাইয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগের নির্দেশ দেন, যা ইতিহাসবিদদের মতে তার প্রথম রাজনৈতিক ভুল ছিল।ঘটনার প্রেক্ষাপট৫৬ হিজরিতে আমির মুয়াবিয়া (রা.
তবে হোসাইন ইবনে আলি (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.), আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.) এবং আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বাইয়াত দিতে অস্বীকার করেন, অন্যদের বাইয়াতে বাধাও দেননি। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/১৬২)
৬০ হিজরির রজব মাসে মুয়াবিয়া (রা.) ইন্তেকাল করলে ইয়াজিদ দামেস্কে শাসনভার গ্রহণ করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/২২৬)
তিনি বাইয়াত প্রত্যাখ্যানকারীদের ওপর কঠোর চাপ প্রয়োগের নির্দেশ দেন, যা ইতিহাসবিদদের মতে তার প্রথম রাজনৈতিক ভুল ছিল (তারিখে উম্মতে মুসলিমা, ৬/২৪)।
ইয়াজিদের নির্দেশে মদিনার প্রশাসক ওয়ালিদ ইবনে উতবা হোসাইন (রা.) ও আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর (রা.)-কে বাইয়াতের জন্য তলব করেন। তারা বাইয়াত প্রত্যাখ্যান করে মদিনা ছেড়ে মক্কায় চলে যান। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/৩০৬)
ইতিহাসবিদদের মতে, তাঁদের এই প্রত্যাখ্যানের কারণ ছিল রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত করে খোলাফায়ে রাশিদিনের শুরাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। (তারিখে উম্মতে মুসলিমা, ৬/২৩)
আরও পড়ুনমদিনা থেকে কারবালা১১ অক্টোবর ২০১৬ইতিহাসবিদদের মতে, তাঁদের এই প্রত্যাখ্যানের কারণ ছিল রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত করে খোলাফায়ে রাশিদিনের শুরাভিত্তিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা।ইরাক যাত্রামক্কায় অবস্থানকালে হোসাইন (রা.) কুফাবাসীর কাছ থেকে বারবার চিঠি পান, যাঁরা তাঁকে সেখানে যেতে অনুরোধ করেন। মুসলিম ইবনে আকিল ১১ জিলকদ ৬০ হিজরিতে কুফার সন্তোষজনক পরিস্থিতির উল্লেখ করে চিঠি পাঠান। (তারিখুত তাবারি, ৫/৩৪৮)
এই চিঠি হোসাইন (রা.)-এর কাছে পৌঁছাতে তিন-চার সপ্তাহ লাগে। এ সময়ে কুফার পরিস্থিতি বদলে যায়। ইয়াজিদ নুমান ইবনে বাশির (রা.)-কে কুফার গভর্নর পদ থেকে সরিয়ে উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে দায়িত্ব দেন। ইবনে জিয়াদের নির্দেশে মুসলিম ইবনে আকিলকে হত্যা করা হয়, যা হোসাইন (রা.)-এর অজানা ছিল। (তারিখুত তাবারি, ৫/৩৯১-৩৯২)
৬০ হিজরির জিলহজ মাসে হোসাইন (রা.) পরিবার-পরিজনসহ ৬০ জন সঙ্গী নিয়ে মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশে রওনা হন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/৩১২-৩১৩)
আরও পড়ুনশিয়া-সুন্নি বিভাজনের নেপথ্যে১৪ জুলাই ২০২৩চিঠি হোসাইন (রা.)-এর কাছে পৌঁছাতে তিন-চার সপ্তাহ লাগে। এ সময়ে কুফার পরিস্থিতি বদলে যায়।কারবালার যুদ্ধইরাক যাত্রার পথে হোসাইন (রা.) মুসলিম ইবনে আকিলের হত্যার সংবাদ পান। এ সময় তাঁর অনেক সঙ্গী তাকে ছেড়ে চলে যান, কেবল মক্কা থেকে আগত কিছু সঙ্গী তাঁর সঙ্গে থাকেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/৩১৮)
৬১ হিজরির মহররম মাসের ২ তারিখে তিনি কারবালায় পৌঁছান, যেখানে তাঁর সঙ্গে ছিলেন ৪৫ জন অশ্বারোহী ও ১০০ জন পদাতিক যোদ্ধা। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/৩৬৬)
১০ মহররম, আশুরার দিন, উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের সেনাপতি উমর ইবনে সাদের নেতৃত্বে ইয়াজিদের সেনাবাহিনী হোসাইন (রা.)-এর মুখোমুখি হয়। হোসাইন (রা.) তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন—মক্কায় ফিরে যাওয়া, ইয়াজিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, অথবা সীমান্তে জিহাদের সুযোগ। ইবনে জিয়াদ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বাইয়াতের শর্ত আরোপ করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/৩৬৭)
হোসাইন (রা.) তা অস্বীকার করে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই যুদ্ধে তিনি তাঁর শিশুপুত্রসহ ৭২ জন সঙ্গীর সঙ্গে শাহাদাত বরণ করেন (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/৩৫৩)।
আরও পড়ুনআশুরার দর্শন২২ অক্টোবর ২০১৫হোসাইন (রা.) তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন—মক্কায় ফিরে যাওয়া, ইয়াজিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, অথবা সীমান্তে জিহাদের সুযোগ।পরবর্তী ঘটনাবনু মাজহিজের এক ব্যক্তি হোসাইন (রা.)–কে হত্যা করেন এবং দেহ থেকে তাঁর মাথা বিচ্ছিন্ন করে ইবনে জিয়াদের কাছে নিয়ে যায়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/৩৬৭)
ইয়াজিদ এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেন এবং বলেন, তিনি হোসাইন (রা.)-কে হত্যার পক্ষে ছিলেন না। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/৩৫৭)
তিনি আহলে বাইতের নারী ও শিশুদের সম্মানের সঙ্গে মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন নুমান ইবনে বাশিরের তত্ত্বাবধানে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/৩৬৩)
কারবালার ঘটনা মুসলিম ইতিহাসে ন্যায় ও সত্যের জন্য আত্মত্যাগের এক অমর প্রতীক। হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত শুধু একটি ট্র্যাজেডিই নয়; বরং ন্যায়বিচার ও সত্যের পথে দাঁড়ানোর প্রেরণা।
আরও পড়ুনকারবালার ইতিহাস ও শিক্ষা২০ আগস্ট ২০২১উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক শ সনব যবস থ আবদ ল ল হ ইবন দ ল ল হ ইবন ক রব ল র আল ব দ য ব যবস থ হ স ইন ন ইবন
এছাড়াও পড়ুন:
আশুরার ফজিলত ও কারবালার তাৎপর্য
ইসলামি বর্ষপঞ্জির সূচনালগ্নেই আগমন ঘটে এক মহিমান্বিত মাসের। সেটি হলো মহররম। আর মহররম মাসের দশম দিন ‘আশুরা’ নামে পরিচিত। এটি ইসলামের ইতিহাসে একদিকে যেমন বরকত, রহমত ও বিজয়ের নিদর্শন, অন্যদিকে তেমনি এক হৃদয়বিদারক আত্মত্যাগের স্মারক।
আরবিতে ‘আশারা’ অর্থ ১০। সেখান থেকেই মহররমের ১০ তারিখকে ‘আশুরা’ বলা হয়। এটি শুধু একটি নির্দিষ্ট দিনের নাম নয়—এটি ইতিহাস, শিক্ষা, আদর্শ ও আত্মিক বিপ্লবের এক অনন্য প্রতীক।
আল্লাহ তাআলা এই দিনটিকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মাধ্যমে বিশেষ মর্যাদা দান করেছেন। আশুরার দিনই আল্লাহ হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন। এই দিনেই তিনি নুহ (আ.)-এর জাহাজকে মহাপ্লাবনের পর নিরাপদে ‘জুদি’ পর্বতে স্থির করেন। হজরত ইব্রাহিম (আ.) এই দিন আগুন থেকে মুক্তি লাভ করেন, ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে উদ্ধার পান, আইয়ুব (আ.) রোগমুক্ত হন, সুলাইমান (আ.) রাজত্ব ফিরে পান এবং হজরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন ও আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়। এই দিনই ইয়াকুব (আ.) তাঁর বহুদিনের হারানো সন্তান ইউসুফ (আ.)-কে ফিরে পান। আশুরা তাই নবী-রাসুলদের বিজয়, মুক্তি ও করুণার দিন হিসেবেও বিবেচিত।
আশুরার রোজা ইসলামের প্রারম্ভিক যুগ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মক্কাজীবনেও রাসুলুল্লাহ (সা.) আশুরার রোজা রাখতেন এবং তা মুসলমানদের জন্য ফরজ ছিল। কিন্তু হিজরি দ্বিতীয় বর্ষে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল হিসেবে রয়ে যায়। তবে নফল রোজার মধ্যে এটি সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ।
হাদিসে এসেছে, আশুরার রোজা এক বছর আগের গুনাহ মোচনের কারণ হয়। (মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
কারবালার শিক্ষা হলো জুলুমের কাছে মাথা নত না করা, সত্যের জন্য দৃঢ় থাকা, অন্যায়ের প্রতিবাদে ভয় না পাওয়ামদিনায় হিজরতের পর রাসুল (সা.) লক্ষ করেন, ইহুদিরাও আশুরার রোজা রাখে। কারণ, এই দিনেই আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.)-কে ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্তি দেন এবং বনি ইসরাইলকে রক্ষা করেন। নবী করিম (সা.) ইহুদিদের অনুসরণের চিহ্ন মুছে দিতে সাহাবায়ে কেরামকে নির্দেশ দেন যেন তাঁরা আশুরার আগের দিন (৯ তারিখ) অথবা পরের দিন (১১ তারিখ) মিলিয়ে দুটি রোজা রাখেন। তিনি বলেন, ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি, তবে ৯ তারিখেও রোজা রাখব।’ (মুসলিম)
রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিনে তার পরিবারের জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে, আমি আশাবাদী আল্লাহ তাআলা পুরো বছর তার রিজিকে বরকত দেবেন।’ (আবুদাউদ, তিরমিজি)
আশুরা কেবল অতীত নবী-রাসুলদের ঘটনার স্মরণ নয়; এই দিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এক অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগ—কারবালার প্রান্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত।
৬১ হিজরি, ১০ মহররম, শুক্রবার। ইতিহাসের সেই কালো দিন। মদিনা থেকে কুফাবাসীর আমন্ত্রণে হজরত হোসাইন (রা.) পরিবার-পরিজন নিয়ে রওনা দেন। তাঁরা ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মানতে রাজি ছিলেন না, কারণ ইয়াজিদের চরিত্র ও শাসনব্যবস্থা ইসলামের আদর্শবিরুদ্ধ ছিল। কুফার হাজারো চিঠির আশ্বাসে হোসাইন (রা.) রওনা হলেও বাস্তবে সেখানে ছিল প্রতারণা ও ষড়যন্ত্র। তাঁকে কুফায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি; পরিবারসহ তাঁকে আটকে রাখা হয় কারবালার প্রান্তরে। পানির অধিকারও ছিনিয়ে নেওয়া হয় তাঁদের কাছ থেকে।
এই ভয়াবহ অবরোধ ও নিপীড়নের মধ্যেই ঘটে যায় ইতিহাসের এক মর্মন্তুদ ঘটনা। হোসাইন (রা.)-এর একটি ছোট শিশু তৃষ্ণায় কাতর, নারীরা অশ্রুসিক্ত, সাহচর্যশূন্য তাঁবুতে মৃত্যুর প্রতীক্ষা আর হোসাইন (রা.) নিজে দৃঢ়চিত্তে প্রস্তুত শহীদের পথে। তিনি একে একে পরিবারের সদস্যদের বিদায় জানান আর শেষে নিজেও আল্লাহর পথে আত্মত্যাগ করেন।
কারবালার আত্মত্যাগ শুধু কাঁদার জন্য নয়, এটি শিক্ষা নেওয়ার জন্য। হোসাইন (রা.) তাঁর ভাষণে বলেন, ‘যে শাসক আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করে, সুন্নাহবিরোধী কাজ করে, জুলুম চালায়—তার বিরুদ্ধে যারা রুখে দাঁড়ায় না, তাদের প্রতিও আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন।’
কারবালার শিক্ষা হলো জুলুমের কাছে মাথা নত না করা, সত্যের জন্য দৃঢ় থাকা, অন্যায়ের প্রতিবাদে ভয় না পাওয়া। আশুরা আমাদের শেখায় অন্যায় ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সত্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার পথে প্রয়োজনে জীবন দিতেও পিছপা না হওয়া।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]