পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতেই হবে। এটা করতে না পারলে সংস্কার করে কোনো লাভ হবে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া পুলিশ বাহিনীর সংস্কার সম্ভব নয়। শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির’ আয়োজনে ‘বাংলাদেশ পুলিশ সংস্কার: প্রেক্ষিত নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। তাঁরা বলেন, সব সংস্কারের উদ্দেশ্য একটাই, দেশে যেন আরেকটা ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে।

জুলাই অভ্যুত্থানের আগে পুলিশ ছিল একটা দানবীয় বাহিনী। পুলিশের এই ভাবমূর্তির জন্য বিদ্যমান ‘সিস্টেম’ বা ব্যবস্থা দায়ী উল্লেখ করে আলোচকেরা বলেন, পুলিশ সদস্যদের একটা বড় অংশ সংস্কার চায়। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাধার কারণে পুলিশ সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না। তাই পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও কিছু আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন।

আলোচকেরা বলেন, শেখ হাসিনা সরকার পুলিশ বাহিনীর ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে দিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়েছিলেন। গুম-খুন ও রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে পুলিশকে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছিলেন। এসব অপরাধে জড়িয়ে পুলিশ আজ আস্থার সংকটে পড়েছে। নৈতিকভাবে দুর্বল হয়েছে। গণতন্ত্র উত্তরণের একমাত্র পথ ‘ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার’ নির্বাচন। বর্তমান পুলিশ দিয়ে সেটি সম্ভব কি না, সেই শঙ্কা প্রকাশে কথা বলেন তাঁরা।

অনুষ্ঠানের মুখ্য আলোচক ছিলেন দৈনিক আমার দেশ–এর সম্পাদক ও প্রকাশক মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ যেন ফিরে না আসে, সে জন্য গণতন্ত্রের উত্তরণ করতে হবে। উত্তরণের রাস্তাটা কী? একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন। ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন যদি করতে হয়, আমি কি পুলিশ ছাড়া করতে পারব? দ্যাটস আ বিগ চ্যালেঞ্জ।’

সস্প্রতি পটিয়া থানা ঘেরাও করে ওসিকে সরাতে বাধ্য করা এবং পাটগ্রাম থানা থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘এ রকম যদি ঘটতে থাকে, আমি এই ডিমোরালাইজ পুলিশ দিয়ে কীভাবে একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন করব?’

ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক ও এর ফলাফল নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন প্রতিদিন মিটিং করছে, আসলে জানি না এটার রেজাল্ট কী হবে। অন্তত একটা তো চাই, আমরা আপনারা একটা নির্বাচনের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেন। আর সেটা তৈরি করতে হলে পুলিশের মনোবল অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে।’

র‍্যাবে সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগের সমালোচনা করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘র‍্যাবে একটা ফান্ডামেন্টাল উইকনেস আছে। র‍্যাবে সামরিক কর্মকর্তা ঢোকানো একটা মিসটেক। এর ফলে দুটি বাহিনীর সর্বনাশ করেছেন আপনারা। আপনারা পুলিশেরও সর্বনাশ করেছেন, সামরিক বাহিনীরও সর্বনাশ করেছেন। সামরিক বাহিনী র‍্যাবে ঢুকে করাপটেড হয়েছে, ক্রিমিনাল হয়েছে। এর ফলে সামরিক বাহিনীতেও রাজনীতিকীকরণ হয়েছে। পুলিশের মধ্যে সামরিক বাহিনী নিয়ে আসা ওয়াজ আ রং কনসেপ্ট।’

অনুষ্ঠানে বিচারপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘এ দেশে পুলিশের ও আমলার সফলতার কোনো শেষ নাই। কিন্তু তাদের বিফলতা অনেক। তারা বছরের পর বছর সফলতা দেখাচ্ছে, কিন্তু গত ১৭ বছর তাদের ভূমিকা ছিল একদলীয়।’

বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সহসভাপতি মো.

আব্দুর রহমান খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন সাবেক আইজিপি আশরাফুল হুদা। তিনি বলেন, ‘পুলিশ সংস্কার কমিশন নিয়ে মানুষের যে আগ্রহ ও কৌতূহল ছিল, তার বাস্তবায়ন তো অনেক দূরের কথা। সেখানে কী হচ্ছে এটাই আমরা জানতে পারছি না।’

মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর বলেন, সেনাবাহিনী ক্ষণিকের জন্য পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে পারে। কিন্তু কোনোমতেই আর্মি সেটা রিপ্লেস করতে পারে না। পুলিশের কাজটা পুলিশকেই করতে হবে। তিনি বলেন, ‘সেনাবহিনী সিভিলিয়ান পাওয়ারে রিপ্লেস হচ্ছে মানে এটা পুলিশের ব্যর্থতা। এটা কখনোই কোনো দেশের জন্য, কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য সুসংবাদ নয়। এভরি টাইম মিলিটারি ডিপ্লয়েড ইন দ্য ফেলিওর অব পুলিশ।’

পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কাজের ধরন আলাদা মন্তব্য করে ফজলে এলাহী বলেন, ‘আমাদের ট্রেনিংয়ের মোটো ওয়ান বুলেট ওয়ান ম্যান। পুলিশের তো বুলেটই ইউজ করা উচিত না।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, পুলিশ সংস্কারের আলোচনা খুব বিলম্বিত। পুলিশ বিভাগ স্বয়ং সংস্কারটি চায়, সেখানে ঐকমত্যে কমিশনের সুপারিশে বিষটি যায়নি। যত দূর জানি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে বাধাটা। তিনি বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যে প্রস্তাবগুলো পাঠিয়েছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো কী অ্যাড্রেস করা হয়েছে। যেখানে পুলিশ বাদ যাচ্ছে, তাহলে এ আলোচনার মানে কী। অল আর অ্যারেঞ্জ শো।’ তাঁর ভাষ্য, ‘সারাক্ষণ গল্প আর গোলটেবিল বৈঠক দিয়ে কিছু হবে না। এ জাতি ধ্বংস হয়েছে বৈঠকের কারণে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান বলেন, ‘আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইন পরিবর্তনের সুপারিশ করি না। বিদ্যমান যে আইনগুলো আছে সেসবের সঠিক প্রয়োগ করে ইমপ্রুভমেন্টের দিকে যাওয়া প্রয়োজন। তবে পুলিশের ক্ষেত্রে আবার আমি আইন পরিবর্তনের কথা বলি।’ তিনি বলেন, একটা অদ্ভুত কারণে পুলিশ আইনে পুলিশ রেগুলেশনস অব বেঙ্গল (পিআরবি) রয়ে গেছে। দেশের কোনো আইনের সঙ্গে বেঙ্গল শব্দটি নাই। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে বেঙ্গলটা রাখা হয়েছে গর্বভরে। সেখানে অনেক সংশোধন এসেছে, কিন্তু বেঙ্গল শব্দটি রেখে দিয়েছে, কারণ সাকসেস সরকার ঔপনিবেশিক মনোভাবটা রাখতে চান।

পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য জারিফ রহমান বলেন, ঐকমত্য কমিশন থেকে পুলিশ সংস্কারকে বাদ দেওয়া জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে এক ধরনের বেইমানি। খেলাফতে মজলিসের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ আবদুল কাদের বলেন, পুলিশকে কখনো ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। এ জন্য পুলিশের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।

বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি এম আকবর আলী সভাপতিত্বে আলোচনা অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন পুলিশের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. মতিয়ার রহমান। তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীর বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ হলো, ঔপনিবেশিক আইন ও কাঠামো, মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিগত ঘাটতি, দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাব।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির তথ্য সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এস এম জহিরুল ইসলাম।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অবসরপ র প ত ব শ বব দ য কর মকর ত অন ষ ঠ ন র জন ত ক র রহম ন ন বল ন ব ঙ গল র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে কি শতভাগ একমত হতে হবে

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার দ্বিতীয় দিনের আলোচনা শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ প্রেস ব্রিফিং করার সময় অধ্যাপক আলী রীয়াজ তথা ঐকমত্য কমিশনের বরাবর একটি ন্যায্য প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সব বিষয়েই যদি ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে শতভাগ একমত হতে হয়, তবে আলোচনার কি প্রয়োজন ছিল?’

প্রশ্নটি যথেষ্ট ন্যায্য মনে করি। মূলত আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়ে দ্বিমত নিয়ে বিএনপির অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ এ কথা বলেছেন। বাস্তবিকই বিএনপি একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রথম থেকেই সম্পূর্ণ সহযোগিতা করে আসছে।

বিএনপির নিজস্ব রাজনৈতিক কমিটমেন্ট, রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা-৩১ দফা, যা তারা ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই জাতির সামনে হাজির করেছিল, তা থাকা সত্ত্বেও ঐকমত্যের স্বার্থে এবং একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জনআকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ দফার অনেক দফা থেকেই নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে।

সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য হচ্ছে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংশোধনের ব্যাপারে একমত হওয়া এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর মেনে নেওয়া। বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিই প্রথম ৩১ দফার প্রস্তাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রস্তাবনা করেছিল। দফা-১ এবং দফা ১০-১৫ পর্যন্ত, এখন যে সংস্কার কমিশনগুলো কাজ করছে, তার প্রতিটির কথাই উল্লেখিত ছিল।

২.

বিএনপি তিনবার সরকার গঠন করেছে এবং দুবার বিরোধী দলে ছিল। বিএনপি তাদের সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা, বিচ্যুতি এবং বিশেষত বিগত ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের অপশাসনকে মাথায় রেখে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে ক্রমাগত ফলপ্রসূ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জনকল্যাণের আলোকে এই ৩১ দফা জনপরিসরে হাজির করেছে।

শেখ হাসিনার পলায়নের পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল নিয়ে কোনো শর্তারোপ করেনি। বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের দিক থেকে একটাই চাওয়া ছিল: ন্যূনতম সংস্কার করে অন্তর্বর্তী সরকার যেন একটি সঠিক, গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নির্বাচন দেয় এবং এর মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন হয়; দীর্ঘদিন থেকে ভোটাধিকারবঞ্চিত মানুষ যেন ভোট দিতে পারে এবং একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পায়—এটাই ছিল বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর চাওয়া।

এ রকম প্রেক্ষাপটে বিএনপি বরাবরই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বতোভাবে সহায়তা করে আসছে যেন গণতান্ত্রিক রূপান্তর মসৃণ হয়। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম থেকেই নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা না দিয়ে নানান ইস্যুতে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। দেশে বিভিন্ন দাবি নিয়ে অস্থিরতা চলতেই থাকে এবং এখনো চলমান।

ঐকমত্য কমিশন শুধু নয়, এর আগেও প্রতিটি কমিশন যখন আলাদা করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসেছে, বিএনপি প্রতিটি সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বসেছে, তাদের প্রস্তাব দিয়েছে এবং রাজনৈতিক আলোচনা করেছে। আবার সব কটি কমিশন নিয়ে ঐকমত্য কমিশন গঠিত হলে, সেই ঐকমত্য কমিশনেরও প্রতিটি আলোচনা পর্বে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে, তারা যুক্তি তুলে ধরছে তাদের অবস্থানের পেছনে।

নিজেদের মতের সঙ্গে মিল না হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি ঐকমত্য কমিশনের একটি সভাও এখন পর্যন্ত বর্জন করেনি। জামায়াতে ইসলামী অবশ্য খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে একটি সভা বর্জন করেছে। বিএনপি একমাত্র দল, যারা একটি সুনির্দিষ্ট টিম গঠন করে দিয়েছে সাংবিধানিক বিষয়গুলো নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা করার জন্য। বিএনপি কতটুকু আন্তরিক ও গুরুত্বের সঙ্গে এই আলোচনাকে নিয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়।

৩.

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন সময় বক্তৃতায় বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যেসব বিষয়ে একমত হবে, সেই বিষয়গুলো সন্নিবেশিত করে ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ তৈরি করবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো তাতে স্বাক্ষর করবে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফার প্রথম বৈঠকের দিন কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ জুলাই মাসে জুলাই সনদ হওয়ার ব্যাপারে নিরাশা প্রকাশ করেন। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতার কথা বলেন। তিনি বিএনপিকে ইঙ্গিত করে এ কথা বলেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।

সালাহউদ্দিন আহমদও তাঁর বক্তৃতায় এবং প্রেস কনফারেন্সে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন (শুধু যে বিষয়গুলোতে একমত হওয়া যাবে তা নিয়ে) জুলাই সনদের ব্যাপারে। এরই মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জামায়াতে ইসলামী, গণ অধিকার পরিষদ ও এনসিপি আবার পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে সরব হওয়ার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এবং সংস্কৃতি কতটা পিআর পদ্ধতির জন্য উপযুক্ত, এ বিষয়ে কোনো গবেষণা নেই। পিআর পদ্ধতিতে একটি এলাকার জনগণ জানবে না, তারা কাকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে পাচ্ছে। এ ছাড়া আরও আশঙ্কা রয়েছে, যোগ্যতাহীন অনেকে এমপি হবেন, কোনো দলে না থাকলে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে না এবং ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের সুযোগও তৈরি হতে পারে। যেসব রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের বিগত নির্বাচনগুলোতে তেমন কোনো আসন পায়নি বা কোনো আসনেই জিততে পারেনি, তারাই একটি পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে সংসদে জনপ্রতিনিধি পাঠাতে চাইছে।

আরও পড়ুনঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মান–অভিমান ও সহমত–দ্বিমত২১ জুন ২০২৫

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাওয়া, দেশকে ইচ্ছাকৃতভাবে আরেকটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, প্রধান উপদেষ্টা প্রথমবার যখন এপ্রিলে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন (বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের আগে), তখন কারণ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট অনুকূলে না এনে নির্বাচন করা যাবে না।

বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে প্রচুর পরিমাণে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এখানে শুধু রাজনৈতিক সংঘাত নয়, পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যেও সংঘাত হয়। দেশের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়া বা কোনোরকম উদ্যোগ নেওয়া হবে সবচেয়ে অবিবেচনাপ্রসূত কাজ।

পক্ষান্তরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশ, আনসার, র‍্যাবের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর একটি সক্রিয় তৎপরতা থাকে (নির্বাচনী আইন অনুযায়ী তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়)। নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার চলমান থাকে। এসব বিষয় বিবেচনায় ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জোর তৎপরতা চালানো উচিত, নির্বাচন কমিশনকে সেভাবে প্রস্তুত হওয়ার জন্য সহযোগিতা করা উচিত।

৪.

ঐকমত্য কমিশন শুধু নয়, এর আগেও প্রতিটি কমিশন যখন আলাদা করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসেছে, বিএনপি প্রতিটি সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বসেছে, তাদের প্রস্তাব দিয়েছে এবং রাজনৈতিক আলোচনা করেছে। আবার সব কটি কমিশন নিয়ে ঐকমত্য কমিশন গঠিত হলে, সেই ঐকমত্য কমিশনেরও প্রতিটি আলোচনা পর্বে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে, তারা যুক্তি তুলে ধরছে তাদের অবস্থানের পেছনে।

বর্তমান সময়ের প্রখ্যাত রাজনৈতিক আলোচক ডা. জাহেদুর রহমান একটা টিভি টকশোতে এ ব্যাপারে বলেছেন, ‘বিএনপি ঐকমত্য কমিশনে যে রাজনৈতিক আলোচনা করছে এবং যুক্তিতর্ক তুলে ধরছে, তা ইতিবাচক; বিএনপি ইচ্ছা করলে বলতে পারত, সব প্রস্তাব মেনে নিলাম; তারপর নির্বাচিত হওয়ার পর সেখান থেকে সরে আসতে পারত। কিন্তু বিএনপি তা করেনি, তারা সংস্কারটাকে ধারণ করে বলেই বাস্তবিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যতটুকু তাদের দিক থেকে সম্ভব, তারা সেটুকুতেই সম্মত হচ্ছে।’

এখানে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য, বিএনপি এবং সমমনা দল ব্যতীত অন্য কোনো দলেরই কিন্তু নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক প্রস্তাব ছিল না। তারা শুধু ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবকেই প্রতিধ্বনি করছে। কিন্তু বিএনপি বহু আগেই ৩১ দফার প্রস্তাব দিয়েছে এবং তার বাস্তবায়নে নিজেদের কর্মকৌশল করেছে।

৫.

আমরা আশা করি, ঐকমত্য কমিশন বাংলাদেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করবে। বাংলাদেশের মানুষ ভোটকে একটা উৎসব হিসেবে নেয়। ৫৪ বছরের বাংলাদেশে যে কটি (মোটাদাগে ৪টা) ভালো নির্বাচন হয়েছে, সেগুলোর সব কটিতেই মানুষ উৎফুল্লভাবে অংশগ্রহণ করেছে; দলের জন্য, প্রার্থীর জন্য ক্যাম্পেইন করেছে।

আমাদের দেশের মানুষের মনোজগৎকে রাতারাতি উন্নত বিশ্বের মতো পরিবর্তন করে ফেলা যাবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পিআর পদ্ধতি প্রচলিত থাকলেও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে পিআর পদ্ধতি নির্বাচনব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে এবং একটি বৃহত্তম দল হিসেবে বিএনপির প্রস্তাবগুলোকেও আমলে নিয়ে জুলাই সনদ তৈরি হওয়া দরকার।

আর সর্বজন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আলী রীয়াজ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের সাদাসিধে প্রশ্নের কী উত্তর দেন, তা শোনার প্রত্যাশায় রইলাম।

সালাহউদ্দিন আহমেদ রায়হান প্রকৌশলী ও লেখক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পুলিশকে জনবান্ধব ও মানবিক হিসেবে গড়ে তুলতে সংস্কারের বিকল্প নেই
  • ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে কি শতভাগ একমত হতে হবে
  • রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে শর্ত যোগ করার প্রস্তাব জামায়াতের
  • কোন কোন অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য, সে ব্যাপারে আইনি ব্যাখ্যা থাকা উচিত: এনসিপি
  • বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠায় ঐকমত্য হয়েছে: আলী রীয়াজ
  • রাষ্ট্রপতির ক্ষমা ও বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য
  • আত্মত্যাগের পথ পেরিয়ে সুযোগ এসেছে, হেলায় হারানো যাবে না: আলী রীয়া
  • প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ নিয়ে আলোচনায় একাধিক প্রস্তাব
  • নির্বাচনী রাজনীতি কোন দিকে গড়াচ্ছে?