পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতেই হবে
Published: 5th, July 2025 GMT
পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতেই হবে। এটা করতে না পারলে সংস্কার করে কোনো লাভ হবে না। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া পুলিশ বাহিনীর সংস্কার সম্ভব নয়। শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির’ আয়োজনে ‘বাংলাদেশ পুলিশ সংস্কার: প্রেক্ষিত নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। তাঁরা বলেন, সব সংস্কারের উদ্দেশ্য একটাই, দেশে যেন আরেকটা ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে।
জুলাই অভ্যুত্থানের আগে পুলিশ ছিল একটা দানবীয় বাহিনী। পুলিশের এই ভাবমূর্তির জন্য বিদ্যমান ‘সিস্টেম’ বা ব্যবস্থা দায়ী উল্লেখ করে আলোচকেরা বলেন, পুলিশ সদস্যদের একটা বড় অংশ সংস্কার চায়। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাধার কারণে পুলিশ সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না। তাই পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও কিছু আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন।
আলোচকেরা বলেন, শেখ হাসিনা সরকার পুলিশ বাহিনীর ‘চেইন অব কমান্ড’ ভেঙে দিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়েছিলেন। গুম-খুন ও রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করতে অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে পুলিশকে প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়েছিলেন। এসব অপরাধে জড়িয়ে পুলিশ আজ আস্থার সংকটে পড়েছে। নৈতিকভাবে দুর্বল হয়েছে। গণতন্ত্র উত্তরণের একমাত্র পথ ‘ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার’ নির্বাচন। বর্তমান পুলিশ দিয়ে সেটি সম্ভব কি না, সেই শঙ্কা প্রকাশে কথা বলেন তাঁরা।
অনুষ্ঠানের মুখ্য আলোচক ছিলেন দৈনিক আমার দেশ–এর সম্পাদক ও প্রকাশক মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদ যেন ফিরে না আসে, সে জন্য গণতন্ত্রের উত্তরণ করতে হবে। উত্তরণের রাস্তাটা কী? একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন। ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন যদি করতে হয়, আমি কি পুলিশ ছাড়া করতে পারব? দ্যাটস আ বিগ চ্যালেঞ্জ।’
সস্প্রতি পটিয়া থানা ঘেরাও করে ওসিকে সরাতে বাধ্য করা এবং পাটগ্রাম থানা থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘এ রকম যদি ঘটতে থাকে, আমি এই ডিমোরালাইজ পুলিশ দিয়ে কীভাবে একটা ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন করব?’
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক ও এর ফলাফল নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন প্রতিদিন মিটিং করছে, আসলে জানি না এটার রেজাল্ট কী হবে। অন্তত একটা তো চাই, আমরা আপনারা একটা নির্বাচনের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেন। আর সেটা তৈরি করতে হলে পুলিশের মনোবল অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে।’
র্যাবে সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগের সমালোচনা করে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘র্যাবে একটা ফান্ডামেন্টাল উইকনেস আছে। র্যাবে সামরিক কর্মকর্তা ঢোকানো একটা মিসটেক। এর ফলে দুটি বাহিনীর সর্বনাশ করেছেন আপনারা। আপনারা পুলিশেরও সর্বনাশ করেছেন, সামরিক বাহিনীরও সর্বনাশ করেছেন। সামরিক বাহিনী র্যাবে ঢুকে করাপটেড হয়েছে, ক্রিমিনাল হয়েছে। এর ফলে সামরিক বাহিনীতেও রাজনীতিকীকরণ হয়েছে। পুলিশের মধ্যে সামরিক বাহিনী নিয়ে আসা ওয়াজ আ রং কনসেপ্ট।’
অনুষ্ঠানে বিচারপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘এ দেশে পুলিশের ও আমলার সফলতার কোনো শেষ নাই। কিন্তু তাদের বিফলতা অনেক। তারা বছরের পর বছর সফলতা দেখাচ্ছে, কিন্তু গত ১৭ বছর তাদের ভূমিকা ছিল একদলীয়।’
বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সহসভাপতি মো.
মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবর বলেন, সেনাবাহিনী ক্ষণিকের জন্য পুলিশের দায়িত্ব পালন করতে পারে। কিন্তু কোনোমতেই আর্মি সেটা রিপ্লেস করতে পারে না। পুলিশের কাজটা পুলিশকেই করতে হবে। তিনি বলেন, ‘সেনাবহিনী সিভিলিয়ান পাওয়ারে রিপ্লেস হচ্ছে মানে এটা পুলিশের ব্যর্থতা। এটা কখনোই কোনো দেশের জন্য, কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য সুসংবাদ নয়। এভরি টাইম মিলিটারি ডিপ্লয়েড ইন দ্য ফেলিওর অব পুলিশ।’
পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কাজের ধরন আলাদা মন্তব্য করে ফজলে এলাহী বলেন, ‘আমাদের ট্রেনিংয়ের মোটো ওয়ান বুলেট ওয়ান ম্যান। পুলিশের তো বুলেটই ইউজ করা উচিত না।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, পুলিশ সংস্কারের আলোচনা খুব বিলম্বিত। পুলিশ বিভাগ স্বয়ং সংস্কারটি চায়, সেখানে ঐকমত্যে কমিশনের সুপারিশে বিষটি যায়নি। যত দূর জানি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসেছে বাধাটা। তিনি বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যে প্রস্তাবগুলো পাঠিয়েছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো কী অ্যাড্রেস করা হয়েছে। যেখানে পুলিশ বাদ যাচ্ছে, তাহলে এ আলোচনার মানে কী। অল আর অ্যারেঞ্জ শো।’ তাঁর ভাষ্য, ‘সারাক্ষণ গল্প আর গোলটেবিল বৈঠক দিয়ে কিছু হবে না। এ জাতি ধ্বংস হয়েছে বৈঠকের কারণে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান বলেন, ‘আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইন পরিবর্তনের সুপারিশ করি না। বিদ্যমান যে আইনগুলো আছে সেসবের সঠিক প্রয়োগ করে ইমপ্রুভমেন্টের দিকে যাওয়া প্রয়োজন। তবে পুলিশের ক্ষেত্রে আবার আমি আইন পরিবর্তনের কথা বলি।’ তিনি বলেন, একটা অদ্ভুত কারণে পুলিশ আইনে পুলিশ রেগুলেশনস অব বেঙ্গল (পিআরবি) রয়ে গেছে। দেশের কোনো আইনের সঙ্গে বেঙ্গল শব্দটি নাই। কিন্তু পুলিশের ক্ষেত্রে বেঙ্গলটা রাখা হয়েছে গর্বভরে। সেখানে অনেক সংশোধন এসেছে, কিন্তু বেঙ্গল শব্দটি রেখে দিয়েছে, কারণ সাকসেস সরকার ঔপনিবেশিক মনোভাবটা রাখতে চান।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য জারিফ রহমান বলেন, ঐকমত্য কমিশন থেকে পুলিশ সংস্কারকে বাদ দেওয়া জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে এক ধরনের বেইমানি। খেলাফতে মজলিসের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ আবদুল কাদের বলেন, পুলিশকে কখনো ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। এ জন্য পুলিশের প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।
বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি এম আকবর আলী সভাপতিত্বে আলোচনা অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন পুলিশের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. মতিয়ার রহমান। তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীর বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ হলো, ঔপনিবেশিক আইন ও কাঠামো, মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিগত ঘাটতি, দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাব।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির তথ্য সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব এস এম জহিরুল ইসলাম।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অবসরপ র প ত ব শ বব দ য কর মকর ত অন ষ ঠ ন র জন ত ক র রহম ন ন বল ন ব ঙ গল র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সকলের অবগতির জন্য প্রকাশ করা হয়েছে।
৮ খণ্ডের এই প্রতিবেদনে কমিশনের সুপারিশ, জুলাই জাতীয় সনদ ছাড়াও ঐকমত্য গঠন প্রক্রিয়ার সময় রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর দেওয়া মতামত, দল ও জোটগুলোর সঙ্গে আলোচনার সারসংক্ষেপ, কমিশনের অন্যান্য নথিপত্র এবং কমিশনের করা জনমত জরিপের ফলাফল রয়েছে।
আরো পড়ুন:
নির্বাচনে পুলিশকে ‘ঐতিহাসিক দায়িত্ব’ পালনের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
৬৯ শতাংশ মানুষ মনে করে ড. ইউনূস ভালো কাজ করছেন: জরিপ
মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এই তথ্য পোস্ট করা হয়।
সেখানে বলা হয়, প্রতিবেদনের সব খণ্ড https://reform.gov.bd ঠিকানার ওয়েবপেইজে দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন ছাড়াও এর আগে ও পরে গঠিত মোট ১১টি সংস্কার কমিশনের সব প্রতিবেদনও এই ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত বছরের অক্টোবর মাসে এবং পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে সর্বমোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে গঠিত ৬টি সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমের সমাপ্তিলগ্নে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে সহ-সভাপতি করে গঠন করা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
অন্য পাঁচটি কমিশনের প্রধানদেরকে এই কমিশনের সদস্য হিসেবে রাখা হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধানদের অপারগতার কারণে দুই কমিশনের দুজন জ্যেষ্ঠ সদস্যকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর রাজনৈতিক দলগুলো এবং নাগরিক সমাজের সঙ্গে বিভিন্ন ধাপের ধারাবাহিক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে গত ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে চূড়ান্ত করা হয় জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫। এরপর গত ১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে আনুষ্ঠানিকভাবে জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়। ইতোমধ্যেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের আলোকে সরকার জুলাই ‘জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান) আদেশ’ জারি করেছে।
ঢাকা/রাসেল