ডিসেম্বরের আগেই ব্যাংক খাত সংস্কার করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। শনিবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি।

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ঠিক আছে, যদি তা আরও বাড়ানো হয়, তবে ব্যাংক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সঞ্চয়পত্রের হার বাড়িয়ে দিলে সবাই সঞ্চয়পত্র কিনবে, কেউ ব্যাংকে টাকা রাখবে না।

তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোতে লিকুইডিটির একটা ব্যাপার আছে। আমাদের তো ব্যালেন্স করে দেখতে হবে। সবাই সঞ্চয়পত্র কিনলে ব্যাংক কোত্থেকে টাকা পাবে? 

ব্যাংকিং খাতকে সংকটমুক্ত করা যাবে কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের টাকা পয়সা নিয়ে বিদেশে চলে গেছে অনেকে। এ রকম ঘটনা পৃথিবীর কোনো দেশে ঘটে নাই। ব্যাংকিং খাতে সংস্কার সময় সাপেক্ষ, এটা আমরা করতে পারব না। এটা নির্বাচিত সরকার এসে করবে। কিছুদিন আগে আর্থিকভাবে দুর্বল ১২টি ব্যাংককে ৫২ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে ২২ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, তবে এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে জানিয়ে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংক বড় একটা উদাহরণ। প্রাইভেট সেক্টরের বড় এই ব্যাংকে কিন্তু এখন আস্থা ফিরে এসেছে। অন্যান্য ব্যাংকের ক্ষেত্রে একটা আইন হয়েছে, ব্যাংক রেজ্যুলেশন অ্যাক্ট। এই আইনের প্রথম শর্তটা হলো- যারা টাকা-পয়সা জমা দিয়েছে ব্যাংকে তাদের টাকা ফেরত দিতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। কারও টাকা মার যাবে না, হয়তো সময় লাগতে পারে। কোনো কোনো ব্যাংকের হয়তো ব্যবসা নাই, সেগুলো হয়তো সময় লাগবে। এগুলোর হিসাব করা হচ্ছে এবং আমরা কারিগরি সহায়তা নিচ্ছি, কীভাবে মূল্যায়ন করতে হয়। 

তিনি আরও বলেন, নবীনগর টু বাঞ্ছারামপুর ও আড়াইহাজার সড়কের কাজ একনেকে অনুমোদন হয়েছে, দ্রুতই কাজ শুরু হবে। নবীবগর টু আশুগঞ্জ সড়ক নির্মাণ ও নবীনগর টু কোম্পানিগঞ্জ সড়কের সংস্কার কাজ প্রক্রিয়াধীন।  

উপদেষ্টা আরও বলেন, নবীনগরসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রতিটি উপজেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পরিকল্পনা রয়েছে, সেই লক্ষ্যে আমাদের কাজ চলছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো.

দিদারুল আলম সভাপতিত্বে ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিব চৌধুরী সঞ্চালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন- নবীনগর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পিয়াস বসাক, সহকারী কমিশনার (ভূমি) খালেদ বিন মুনছুর, প্রেস ক্লাব সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন শান্তি প্রমুখ।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব র হ মণব ড় য় উপদ ষ ট

এছাড়াও পড়ুন:

জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় নিয়ে কিছু নিরীহ প্রশ্ন

ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের মিশন বা কান্ট্রি অফিস খোলা নিয়ে যে ঢাকঢাক গুড়গুড় চলছে, সেটি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সর্বশেষ বক্তব্যেও স্পষ্ট। যেমন– বৃহস্পতিবার পরররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, এ ধরনের কার্যালয় খোলা বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে কিনা? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি বিচার আমি করতে চাই না’ (সমকাল অনলাইন, ৩ জুলাই ২০২৫)। তার মানে, বর্তমান সরকার ‘বিচার’ ও বিবেচনা ছাড়াই ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছে?

আমরা জানি, গত রোববার (২৯ জুন ২০২৫) উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, কান্ট্রি অফিসটি স্থাপনের খসড়া প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ঢাকায় প্রাথমিকভাবে তিন বছরের জন্য কার্যালটি স্থাপন হচ্ছে। ওদিকে খোদ জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনারের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, উপদেষ্টা পরিষদ কী অনুমোদন দিয়েছে, এ বিষয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণা নেই (সমকাল, ৩০ জুন ২০২৫)। তাহলে কি আমরা ধরে নেব, জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সঙ্গেও সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে?

এটি বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, এ ধরনের সমঝোতা হতে হয় দুই পক্ষের সম্মতিতে। দুই পক্ষের মধ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খ, বলতে গেলে প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে আলোচনা ও বিতর্কের পর খসড়া চূড়ান্ত হয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপন নিয়ে সরকারই কি তাড়াহুড়া করছে? জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন– ‘আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না’। এমন গুরুতর সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কিসের এত তাড়া? অত তাড়াতাড়ি কোথায় যেতে চায়?

মনে আছে, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর অক্টোবরের শেষদিকে ঢাকা সফর করেছিলেন জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের ভলকার তুর্ক। ঢাকায় জাতিসংঘের ওই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ আরও দু’জন উপদেষ্টার উপস্থিতিতে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার পরিষদের কার্যালয় স্থাপনের সম্মতি দিয়েছে, শিগগিরই সেটি বাস্তবায়ন হবে। তিনি এও বলেন, ‘এখানে কার্যালয় থাকা মানে মানবাধিকারের জায়গা থেকে আমাদের শক্তি বাড়ল’ (প্রথম আলো, ২৯ অক্টোবর ২০২৪)।

অন্যদিকে, গত বৃহস্পতিবারই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এখন পর্যন্ত চারবার খসড়া আদান-প্রদান হয়েছে। আমরা কিছু সংযোজন-বিয়োজন এনেছি, জাতিসংঘ কিছু সুপারিশ করেছে। আমাদের কিছু পরিবর্তন রয়েছে তাদের দেওয়া খসড়া নিয়ে। সে পরিবর্তন যদি তারা গ্রহণ করে, তাহলে দ্রুত হবে। আর যদি গ্রহণ না করে এবং বলে পরিবর্তন করতে, তখন আমরা দেখব যে পরিবর্তন করা যাবে কিনা। প্রশ্ন হচ্ছে, এখনও যদি খসড়া আদান-প্রদান অবস্থাতেই থাকে, তাহলে গত বছর অক্টোবরে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টার পক্ষে ‘সম্মতি’ দেওয়ার কথা বলার অর্থ কী ছিল? বস্তুত, যদি গত ৯ মাসের ধারাবাহিকতা দেখি, ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ কার্যালয় স্থাপন নিয়ে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা, আইন  উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের মধ্যে সমলয় বা ‘সিনক্রোনাইজেশন’ নেই। তাহলে কি খোদ সরকারের ভেতরেই বিষয়টি নিয়ে এখনও সমন্বয়হীনতা রয়েছে? 

এক প্রতিবেদনে দেখছি, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, কার্যালয় ও মন্ত্রণালয় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কান্ট্রি অফিস খোলার বিষয়ে একমত নয়। গত ৩ জুন এ-সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে উপস্থিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধি প্রশ্ন তুলেছিলেন, এ ধরনের কার্যালয় থাকা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলনীয় কিনা (সমকাল, ৩০ জুন ২০২৫)। জুন মাসের গোড়ার ওই বৈঠকের পর গত এক মাসে কি কার্যালয়টি নিয়ে সরকারের ভেতরের এসব প্রশ্ন নিরসন করা সম্ভব হয়েছে?

প্রশ্ন কেবল দেশের ভেতরে নয়; বাইরেও রয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের দাপ্তরিক ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখছি, এ পর্যন্ত ১৫টি দেশে সংস্থাটির কান্ট্রি অফিস রয়েছে। দেশগুলোর নাম হলো– বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, শাদ, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, গিনি, হন্ডুরাস, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া, মেক্সিকো, নাইজার, ফিলিস্তিন, সুদান, তিউনিসিয়া ও ইয়েমেন। এ ছাড়া উত্তর কোরিয়ায় নজরদারির জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায়, যুদ্ধাবস্থায় রাশিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘন পর্যবেক্ষণে ইউক্রেনে এবং গৃহযুদ্ধরত সিরিয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে লেবাননে সংস্থাটির একটি করে কার্যালয় রয়েছে। দেশগুলো আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকলেও সেগুলোর অভিন্ন বিষয় হচ্ছে যুদ্ধ পরিস্থিতি বা জাতিগত বিরোধ। বাংলাদেশেও কি তেমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে?

এমনকি নেপালেও জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের একটি কার্যালয় সক্রিয় ছিল। কারণ, দেশটিতে ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাজতন্ত্রপন্থি সরকার ও মাওবাদী গেরিলাদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছিল। দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা, রাজতন্ত্রের বিলোপ এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর ২০১১ সালে কার্যালয়টির ব্যাপারে জাতিসংঘের সঙ্গে সমঝোতা আর নবায়ন করেনি নেপাল। এখন বাংলাদেশে কী এমন পরিস্থিতি হলো যে, নেপালের মতো আমাদেরও এ ধরনের কার্যালয় লাগবে? 

১৮ দেশের ওই তালিকায় অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়ায় স্থাপিত কার্যালয়টি প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়াকে, ইউক্রেনে স্থাপিত কার্যালয়টি রাশিয়াকে এবং লেবাননে স্থাপিত কার্যালয়টি সিরিয়াকে নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এই আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না যে, বাংলাদেশে সম্ভাব্য কার্যালয়টির সম্ভাব্য লক্ষ্য থাকবে প্রতিবেশী মিয়ানমারের দিকে। প্রশ্ন হচ্ছে, দক্ষিণ কোরিয়া বা ইউক্রেন বা লেবানন যেভাবে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ‘পাঙ্গা’ নিচ্ছে, বাংলাদেশের পক্ষে কি মিয়ানমার প্রশ্নে তেমন অবস্থান নেওয়া সম্ভব বা সংগত?
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ কথায় কথায় বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার সঙ্গে তুলনা দিত। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের সমর্থক কেউ কেউ কথায় কথায় ইউরোপের তুলনা দিচ্ছেন। স্বপ্নে পান্তার বদলে বিরিয়ানি খাওয়ার মতো এমন উন্নত দেশের তালিকায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে নাগরিকদের ভালোই লাগে বৈকি। কিন্তু জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের কান্ট্রি অফিস থাকা দেশের তালিকা দেখলে তো দুঃস্বপ্নেও চমকে উঠতে হয় না?

এই প্রশ্নও দুর্মুখরা তুলতে পারেন, আমরা কথায় কথায় যেসব দেশের সঙ্গে নিজেদের তুলনা দেই, সেগুলোর কোনটায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের কান্ট্রি অফিস রয়েছে? দেখা গেছে, উন্নত দেশ তো বটেই, উন্নয়নশীল দেশগুলোরও কোনোটি এ ধরনের কার্যালয় স্থাপনে সম্মতি দেয় না। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেই এমন কার্যালয় নেই। তাহলে আমরা সম্মতি দিতে যাচ্ছি কোন উদাহরণ সামনে রেখে?
বড় কথা, নাগরিক হিসেবে আমাদের জানার অধিকার রয়েছে জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে চালাচালি চলা খসড়া সমঝোতায় কী রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা বিভিন্ন সময়েই বলেছেন যে, তারা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতে বিশ্বাস করেন। তাহলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুতর প্রশ্নের মুখে থাকা এমন একটি কার্যালয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে প্রয়োজনে গণশুনানি করা উচিত নয় কি?

বড় কথা, বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন থেকে কমিশনাররা একযোগে পদত্যাগের পর গত বছর নভেম্বর থেকে সাংবিধানিক সংস্থাটি স্থবির হয়ে রয়েছে। সেটিকে ছয় মাসেও সক্রিয় ও কার্যকর না করে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের কার্যালয় স্থাপনে এমন তাড়াহুড়ার কারণ কী?
 
শেখ রোকন: লেখক ও নদী-গবেষক
skrokon@gmail.com  

সম্পর্কিত নিবন্ধ