সারা পৃথিবীতে বটের কত যে ভাইবোন আছে, কে জানে! এ দেশেই আছে অন্তত ১৫ রকমের বট। এগুলোর একটি কৃষ্ণবট। এ গাছের অন্য নাম কৃষ্ণডুমুর। বট একান্তই বাংলার গাছ, সে অর্থে কৃষ্ণবটও এ অঞ্চলের গাছ।
বট ও কৃষ্ণবট—দুটিই মোরেসি গোত্রের গাছ, ডুমুরও এ গোত্রের। বটের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Ficus benghalensis এবং কৃষ্ণবটের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Ficus krishnae। তৎকালীন বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, কলকাতার পরিচালক ডেভিড প্রেইন ১৮৯৬ সালে হাওড়ার আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান বোটানিক গার্ডেনের কাছে থাকা একজনের ব্যক্তিগত বাগানে এই প্রজাতির দেখা পান। সেই গাছের দুটি ডাল কেটে এনে তিনি বাগানে পুঁতে দেন, যা থেকে দুটি গাছের জন্ম হয়। পরবর্তী সময়ে ওই দুটি গাছ থেকে আবার ডাল কেটে কেটে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ও ওয়ারীতে বলধা গার্ডেনে দুটি কৃষ্ণবটগাছ লাগানো হয়। গাছ দুটি বেশ বড়, তবে অন্য বটের মতো বিশাল নয়। কৃষ্ণবটের ঝুরি অন্য বটের মতো নামে না, পাতাগুলোও অন্য রকম, উচ্চতাও কম। কৃষ্ণবটের পাতা যেন ঝালমুড়ি খাওয়ার ঠোঙা, বোঁটার কাছে দুই পাশ থেকে পত্রফলক কেউ যেন টেনে আঠা দিয়ে জুড়ে পকেট তৈরি করে দিয়েছে। এই অদ্ভুত আকৃতিই কৃষ্ণবটকে অন্যান্য বটগাছ থেকে আলাদা করে দিয়েছে।
পাতার এই ঠোঙার মতো গড়ন অনেক লোককাহিনির জন্ম দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় কাহিনির একটি হলো, শ্রীকৃষ্ণ মাখন খেতে খুব পছন্দ করতেন। তাই তিনি প্রায়ই শিকেয় তুলে রাখা মাখনের ভাণ্ড থেকে মাখন চুরি করে খেতেন। একবার যখন মা যশোদা তাঁকে মাখন চুরি করার সময় ধরে ফেললেন, তখন তিনি এই বটের পাতাকে ঠোঙার মতো করে তার মধ্যে মাখন লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। তখন থেকেই এ গাছের পাতার এরূপ গড়ন। এ কাহিনি কৃষ্ণবটের নামকরণের পেছনেও ভূমিকা রাখতে পারে। এ থেকে হিন্দিতে এ গাছের নাম রাখা হয়েছে ‘মাখন কোটরি’। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও শ্রীলঙ্কায় এ গাছ আছে।
ঢাকা শহরে আর কোথাও কৃষ্ণবটগাছ চোখে পড়েনি। তবে ২০২৪ সালের জুনে অনুষ্ঠিত আগারগাঁওয়ে বৃক্ষমেলায় কয়েকটি নার্সারিতে বিদেশ থেকে আমদানি করা বেশ কিছু কৃষ্ণবটের চারা বিক্রি করতে দেখা গেছে। তাতে মনে হয়, এখন দেশের আরও অনেক জায়গায় এ গাছ ছড়িয়ে পড়েছে।
বলধা গার্ডেনের কৃষ্ণবটগাছের নামফলকে লেখা আছে, ‘পাতা মুড়ির ঠোঙার মতো ফোল্ডিং হয়ে থাকে। টুনটুনি পাখি অনায়াসে এই পাতায় বাসা করতে পারে। ধারণা করা হয়, বটের এই পাতায় কৃষ্ণ মাখন চুরি করে খেত বলেই এর নামকরণ করা হয়েছে কৃষ্ণবট।’
বলধা গার্ডেনের নামফলকে কৃষ্ণবটের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম লেখা রয়েছে Ficus benghalensis var.
কৃষ্ণবটগাছের পাতা বটের মতো সম্পূর্ণ ঝরে যায় না, আবার বটের মতো অনেক পাতা নিয়ে ডালপালা ছায়া তৈরি করে না, গাছ চিরসবুজ বৃহদাকারের বৃক্ষ, ৮ থেকে ২২ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। ডালপালাগুলো এলোমেলেভাবে ছড়ায়, স্বল্প কিছু ঝুরি নামে বয়স্ক ডাল থেকে। পাতা দেখতে অনেকটা কাঁঠালপাতার মতো হলেও তার গোড়া কাপ বা ঠোঙার মতো। পাতা ৮ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার লম্বা এবং ৭ থেকে ১১ সেন্টিমিটার চওড়া। পাতার বোঁটা ভাঙলে সেখান থেকে সাদা দুধের মতো আঠালো কষ ঝরে। ফল খুব ছোট, আকার মাত্র ১ থেকে ৩ মিলিমিটার। ফল পাকলে লাল হয়ে যায়।
কৃষ্ণবটগাছের ঔষধি গুণ রয়েছে। এ গাছের শিকড়, ডালপালা, পাতা ও ফল থেকে বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি করা হয়। বিশেষ করে আলসার বা ক্ষত, জ্বর, কুষ্ঠ, বমি, আমাশয়, সিফিলিস, যকৃতের প্রদাহ ইত্যাদি রোগের চিকিৎসায় এ গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয় বলে বিভিন্ন গবেষণাপত্র থেকে জানা গেছে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়: কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ঠ ঙ র মত
এছাড়াও পড়ুন:
উদ্বোধন হয়নি তিস্তা সেতু, অপেক্ষা আরো ২৩ দিন
পূর্ব নির্ধারিত সময়ের অন্তিম মুহূর্তে তিস্তা সেতুর উদ্বোধন পেছানো হয়েছে। উত্তরবঙ্গের বহুল প্রতিক্ষার এই সেতুটি শনিবার ২ আগস্ট উদ্বোধনের অপেক্ষায় ছিলেন গাইবান্ধা ও কুরিগ্রামের (হরিপুর-চিলমারী) লাখো মানুষ। নতুন সময় অনুযায়ী আগামী ২৫ আগস্ট এই সেতু উদ্বোধন করা হবে।
গত ৪ জুলাই স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী সেতুটি যান। তিনি সেতুটি জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানকে স্মরণীয় করে রাখতে জুলাই মাসেই উদ্বোধন করার কথা বলেছিলেন। এরপর গত ১৩ জুলাই স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব মোহাম্মদ শামীম বেপারী স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে ২ আগস্ট সেতুটি উদ্বোধনের বিষয়টি জানানো হয়।
আরো পড়ুন: চলতি মাসেই খুলতে পারে চিলমারী-হরিপুর ব্রিজ
আরো পড়ুন:
গোপালগঞ্জের ঘটনায় সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করবে: সেতু উপদেষ্টা
চলতি মাসেই খুলতে পারে চিলমারী-হরিপুর ব্রিজ
সেতু উদ্বোধনের তারিখ পেছানো সম্পর্কে জানতে চাইলে রবিবার (৩ আগস্ট) এলজিইডির গাইবান্ধার নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জ্বল চৌধুরী বলেন, “আমাদের কাছে হঠাৎ নির্দেশনা এসেছে। আগস্ট মাস ঘিরে ওপর মহলে হয়তো ব্যস্ততা রয়েছে। সে কারণেও তারিখ পেছানো হতে পারে। ২৫ আগস্ট নতুন তারিখ নির্ধারন করা হয়েছে। এর বেশি আমার জানা নেই।”
সেতুটি চালু হলে শুধু দুই উপজেলার মানুষ নয়, গাইবান্ধা এবং কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সেতুটি বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসা সংশ্লিষ্টরা।
তিস্তা সেতু বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন করা শরিতুল্ল্যাহ মাস্টার বলেন, “স্বপ্নের তিস্তা সেতু উদ্বোধনের অপেক্ষায় ছিলাম। তিস্তা সেতু (হরিপুর-চিলমারী) এবারো উদ্বোধন হলো না। ২ আগস্ট থেকে পিছিয়ে আগামী ২৫ আগস্ট সেতু উদ্বোধনের নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো উদ্বোধনের তারিখ পেছানো হলো।”
তিনি আরো বলেন, “এই তিস্তা সেতু বাস্তবায়নের দাবিতে ১৯৯৫ সালে আমি একাই আন্দোলন শুরু করি। তখন মানুষ আমাকে অবজ্ঞা করত। তিস্তা সেতুর কথা কল্পনাও করতে পারেননি তারা। আমি উত্তরবঙ্গের মানুষের ভাগ্য বদলাতে এই আন্দোলন করেছি। নিজের স্বার্থের জন্য কিছু করিনি।”
বারবার উদ্বোধনের তারিখ পেছানোয় আশাহত এবং ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাদের দাবি, এবার ২৫ আগস্ট তারিখটি যেন কোনোভাবেই পেছানো না হয়।
তিস্তা সেতুটি শরিতুল্ল্যাহ মাস্টারের নামে নামকরণের আন্দোলনের আহ্ববায়ক শামিম মন্ডল বলেন, “আমরা জানতাম ২ আগস্ট তিস্তা সেতু উদ্বোধন হবে এবং সেটি শরিতুল্ল্যাহ মাস্টারের নামে নামকরণ করা হবে। উদ্বোধনের আগে এবারো তারিখ পেছানো হলো।”
তিনি আরো বলেন, “যে মানুষটি ৩০ বছর ধরে মানুষের বঞ্চনা সহ্য করে তিস্তা সেতুকে বাস্তবে রূপ দিলেন, আমরা এলাকাবাসী তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তার কারণেই উত্তরবঙ্গের অর্থনীতির চিত্র পাল্টে যাবে। আগামী ২৫ আগস্ট তিস্তা সেতুর উদ্বোধনের আগেই সেতুটির নাম পরিবর্তন করে শরিতুল্ল্যাহ মাস্টারের নামে নামকরণ করার জোর দাবি জানাই।”
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, সেতুটি নির্মিত হয়েছে সৌদি সরকারের অর্থায়নে, চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের তত্ত্বাবধানে। ৮৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১,৪৯০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৯.৬ মিটার প্রস্থের পিসি গার্ডার সেতুটি বাস্তবায়নে সরাসরি তদারক করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। দেশের ইতিহাসে এটিই এলজিইডির সর্ববৃহৎ প্রকল্প।
সেতুটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে প্রায় ৮০ কিলোমিটার এক্সেস সড়ক। যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে ৫৮টি বক্স কালভার্ট ও ৯টি আরসিসি সেতু। বেলকা বাজার, পাঁচপীর, ধর্মপুর, হাট লক্ষ্মীপুর, সাদুল্যাপুর ও ধাপেরহাটসহ অন্তত ১০টি বাজার ও মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে পুরো সুন্দরগঞ্জ ও চিলমারী অঞ্চল।
২০১৪ সালের ২৫ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করা হয়। এরপর ২০২৪ সালের ৩০ নভেম্বর সেতুটি পরিদর্শনে আসেন এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী গোপাল কৃষ্ণ দেবনাথ। সে সময়ে তিনি চলতি বছরের মার্চে সেতুটি উদ্ধোধন হতে পারে বলে জানিয়েছিলেন। পরবর্তীতে চলতি বছরের ২ আগস্ট উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। সেটি পিছিয়ে এখন আগামী ২৫ আগস্ট নির্ধারন করা হয়।
ঢাকা/মাসুম/মাসুদ