সুন্দরবন-সংলগ্ন খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর গ্রামের জেলে আইয়ুব আলী। আগে তিনি বনের ভেতরে নদীতে জাল ফেলতেই ভরে উঠত নানা মাছ। কিন্তু এখন জাল ফেললে তেমন মাছ পাওয়া যায় না। জালে উঠে আসে চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল আর পলিথিন। শাকবাড়িয়া নদীর তীরে দাঁড়িয়ে তাঁর দীর্ঘশ্বাস, ‘আগের মতো মাছ আর পাওয়া যায় না।’

শুধু আইয়ুব আলী নন, সুন্দরবনঘেঁষা অসংখ্য গ্রামের মানুষই এখন এমন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। কারণ, লোকালয়ের হাটবাজার, চায়ের দোকান বা ছোটখাটো আয়োজনের অপরিহার্য উপকরণ হয়ে উঠেছে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের প্লেট, কাপ ও বোতল। অনুষ্ঠান শেষে সেগুলো ফেলে দেওয়া হচ্ছে বন-সংলগ্ন নদী-খালে। জোয়ার-ভাটার স্রোতে সেই বর্জ্য ভেসে যাচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের গভীরে।

পরিবেশবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতার অভাবে অনেকে সুন্দরবনে গিয়ে প্লাস্টিকের প্যাকেট, বোতল, প্লেট ও গ্লাস ফেলছেন বনের মধ্যে মাটি ও নদীতে। বন-সংলগ্ন ৮০টি গ্রাম থেকে ৫২টি নদী-খাল হয়ে জোয়ারের পানিতে বনে ছড়িয়ে পড়ছে প্লাস্টিক। এতে বনের পুরো জীববৈচিত্র্য প্লাস্টিকের আগ্রাসনের মুখে পড়ছে। এটি বন্ধে নাগরিক সচেতনতার পাশাপাশি কঠোর আইন ও টেকসই পরিকল্পনা প্রয়োজন।

সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন, যার বিস্তৃতি বাংলাদেশ ও ভারত মিলে প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায়। বিশ্বের মোট ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের এক-তৃতীয়াংশ এখানে পাওয়া যায়। জীববৈচিত্র্যের সমৃদ্ধির কারণে ১৯৯২ সালে রামসার সাইট ও ১৯৯৭ সালে ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে সুন্দরবন থেকে। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়, ভূমিক্ষয় প্রতিরোধ, কার্বন সঞ্চয় ও পুষ্টি ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সুন্দরবন।

আরও পড়ুনদূষণের বিপদে সুন্দরবন১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

নদী-খালে প্লাস্টিকের বর্জ্য

সরেজমিন সুন্দরবন-সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামের বাজার ও বসতবাড়ির আশপাশে নদীতীরে প্লাস্টিকের বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা গেছে। শাকবাড়িয়া, কয়রা ও সিবসা নদীর তীরবর্তী বাজারগুলোতে কাপ, প্লেট, বোতল ও চিপসের প্যাকেট জমে আছে, যা জোয়ারের পানিতে ভেসে যাচ্ছে সুন্দরবনে।

কয়রার মহেশ্বরীপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া কয়রা নদী পেরোলেই গহিন সুন্দরবন শুরু। নদীতীরবর্তী বনভূমির ফাঁকে আটকে আছে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের থালা ও বোতল। স্থানীয় সুকুমার মণ্ডল জানালেন, কয়েক দিন আগে গ্রামের এক বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে এসব প্লেট নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। সেগুলো ভেসে বনের মধ্যে এসে আটকে গেছে।

কয়রায় একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের পণ্য বিক্রেতা খলিলুর রহমান বলেন, করোনার সময় থেকে ওয়ান-টাইম প্লাস্টিকের প্লেট ও গ্লাসের বিক্রি বেড়েছে। এগুলো পরিষ্কার করতে ঝামেলা নেই। সস্তা ও ব্যবহার সুবিধাজনক হওয়ায় মানুষ বেশি কেনে।

আরও পড়ুনসুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলে প্রায় ২০০ শিল্পকারখানা স্থাপন০৪ মে ২০২৫

মাছের পেটে প্লাস্টিক

গত সোমবার সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার কপোতাক্ষ নদের তীরে প্লাস্টিকের বোতলসহ নানা আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা যায়। ওই দিন নৌকায় বনের শাকবাড়িয়া নদী দিয়ে চলার সময় প্রথমে মনে হয় মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কাছে গিয়ে বোঝা যায়, মাছ নয়, সবই প্লাস্টিকের বোতল।

কয়রার মদিনাবাদ গ্রামের আবদুস সামাদ জানালেন, সম্প্রতি কয়েকজন মিলে ট্রলারে চেপে বনের কালাবগী ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে যাচ্ছিলেন। পথে শিবসা নদী থেকে একটি ভাসমান অসুস্থ মাছ ধরেন। প্রায় সাত কেজি ওজনের ভেটকি মাছটির পেটে ছোট পলিথিনের টুকরা পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুনদূষণ ও শিল্পের চাপে কোণঠাসা সুন্দরবন২১ মার্চ ২০১৮

গবেষণা কী বলছে

কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুন্দরবনভিত্তিক গবেষণা ও তথ্যসমৃদ্ধ ম্যাগাজিন ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’-তে বলা হয়েছে, হুগলি নদীর মাধ্যমে কলকাতা শহর থেকে প্রতিদিন বিপুল বর্জ্য সুন্দরবনে যায়। হুগলির পানিতে প্রতি ঘনমিটারে ৪৫০ থেকে ১ হাজার ২০০টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে। আর বাংলাদেশের সুন্দরবনের পশুর নদে গবেষণায় দেখা গেছে, বর্ষার আগে পানিতে গড়ে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৮১ হাজার ৫৬টি কণা ও পলিতে ৪৭টি কণা, যা বর্ষার পরে কমে যথাক্রমে ৭৩ হাজার ৭২২ ও ৪১টি কণায় নেমেছে। ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবনে ফাইবারজাতীয় মাইক্রোপ্লাস্টিক সবচেয়ে বেশি।

ভারতের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সায়ন ভট্টাচার্য বলেন, সুন্দরবনে মাছ ধরার পরিত্যক্ত প্লাস্টিক জাল থেকে বিপুল পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হয়। এতে গাছের বৃদ্ধি ও অঙ্কুরোদ্‌গম ব্যাহত হয়। সুন্দরবনের খাদ্যশৃঙ্খলের বিভিন্ন স্তরের প্রাণিদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, সুন্দরবন–সংলগ্ন উপকূলের মানুষ প্রতিদিন বাদাবন থেকে ধরা মাছ খাওয়ায় তাদের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক জমার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এসব সূক্ষ্ম কণা ফুসফুস ও বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় সুন্দরবনে প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সুন্দরবনের ছয়টি স্থানের পানি ও মাটি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, প্রতি লিটার পানিতে গড়ে ২ দশমিক ২২টি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা এবং প্রতি কেজি মাটিতে গড়ে ৭৩৪টি কণা পাওয়া গেছে।

এ ছাড়া ২০২২ সালের অক্টোবরে ‘সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট’ জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সুন্দরবনের তিনটি প্রধান নদীর কমপক্ষে ১৭ প্রজাতির মাছ ও ৩ প্রজাতির শেলফিশে মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্ত করার বিষয়টি তুলে ধরা হয়।

আরও পড়ুনসুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা১২ মে ২০২৫

হুমকিতে জীববৈচিত্র্য

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, প্লাস্টিক দূষণের কারণে বনের স্থল ও জলজ প্রাণী এবং গাছপালার হুমকি বাড়ছে। মাছের মাধ্যমে প্লাস্টিক খাদ্যশৃঙ্খলে মানুষের মধ্যেও চলে আসছে। এ বিষয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি দূষণ রোধে কর্তৃপক্ষের আরও সক্রিয় হতে হবে।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, বনের ভেতর দিয়ে নৌপথ আছে। চলাচলকারী জলযান থেকে প্লাস্টিক ও পলিথিন ফেলে বনের ক্ষতি করছে। তাঁরা ট্যুর অপারেটরদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, সুন্দরবনে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকের প্লেট, বোতল বহন সম্পূর্ণ নিষেধ। প্লাস্টিকের দূষণ রোধে তাঁরা আরও কঠোর হবেন। তবে লোকালয় থেকে যেসব প্লাস্টিক বর্জ্য সুন্দরবনে আসছে, সেগুলো রোধে জনসচেতনতা দরকার। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: একব র ব যবহ র ন স ন দরবন স ন দরবন র বর জ য

এছাড়াও পড়ুন:

দূরন্ত এমবাপ্পের ডানায় চড়ে উড়ছে রিয়াল

নতুন মৌসুমের শুরু থেকেই দারুণ ছন্দে কিলিয়ান এমবাপ্পে। তাঁর ওপর ভর করে উড়ছে রিয়াল মাদ্রিদও। সর্বশেষ গতকাল রাতে লা লিগার ম্যাচে লেভান্তের মাঠে রিয়াল জিতেছে ৪–১ গোলে। এ জয়ে রিয়ালের হয়ে জোড়া গোল করেন এমবাপ্পে। অন্য দুটি গোল ভিনিসিয়ুস জুনিয়র ও ফ্রাঙ্কো মাস্তানতুয়োনোর।

দুর্দান্ত এ জয়ে চলতি মৌসুমে লা লিগার ৬ ম্যাচের সব কটিতেই জিতল রিয়াল। শীর্ষে থাকা রিয়ালের পয়েন্ট এখন ১৮। দুইয়ে থাকা বার্সেলোনার পয়েন্ট ৫ ম্যাচে ১৩। পাশাপাশি সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এখন পর্যন্ত খেলা ৭ ম্যাচের প্রতিটিতে জিতল রিয়াল।

এর আগে রিয়াল প্রথম ৭টি অফিশিয়াল ম্যাচ জিতেছিল ১৯১৬-১৭ (আর্থার জনসন), ১৯৩১-৩২ (লিপ্পো হার্জকা), ১৯৩৪-৩৫ (পাকো ব্রু), ১৯৬১-৬২ ও ১৯৬৮-৬৯ (মিগেল মুনিয়োস), ২০০৯-১০ (ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি) ও ২০২২-২৩ (কার্লো আনচেলোত্তি) মৌসুমে।

আরও পড়ুনপিছিয়ে পড়েও এমবাপ্পের ৫০তম গোলে মার্শেইকে হারাল ১০ জনের রিয়াল১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

এ ছাড়া লা লিগার ইতিহাসে এটি রিয়ালের টানা ৬ ম্যাচ জেতার ষষ্ঠ ঘটনা। এর আগে ১৯৫৮–৫৯, ১৯৬১–৬২, ১৯৬৮–৬৯, ১৯৮৭–৮৮ ও ২০২২–২৩ মৌসুমেও লিগে টানা ৬ ম্যাচ জিতেছিল তারা। তবে এই ৫ বারের মধ্যে ৩ বার চ্যাম্পিয়ন হলেও ২ রানার্সআপ হয়েছে তারা। রিয়ালের পাশাপাশি ইতিহাসের অংশ হয়েছেন জাবি আলোনসোও। লা লিগার ইতিহাসে তিনি অষ্টম কোচ হিসেবে প্রথম ৬টি লিগ ম্যাচ জিতলেন।

রিয়াল তারকাদের গোল উদ্‌যাপন

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দূরন্ত এমবাপ্পের ডানায় চড়ে উড়ছে রিয়াল
  • ডাকাত-মহাজনদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন
  • নিউজিল্যান্ডে সন্তানদের হত্যা করে স্যুটকেসে লুকিয়ে রাখার ঘটনায় মা দোষী সাব্যস্ত
  • আজ শ্রীলঙ্কাকে হারানো পাকিস্তানের জন্য একটু কঠিন
  • সুন্দরবন এলাকার উন্নয়নে পৃথক মন্ত্রণালয় দাবি