ইতিহাসের নিরপেক্ষ পাঠে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধ মূলত একটি গভীর রাজনৈতিক ঘটনা—যার তাৎপর্য এখনো এক চলমান প্রক্রিয়া। যুদ্ধের মঞ্চ বাংলাদেশ হলেও এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল বৈশ্বিক রাজনীতির অঙ্গনে। তৎকালীন দুই পরাশক্তি—যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন—নিজ নিজ স্বার্থে এখানে জড়িত ছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বহু প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বও এই সংঘাতে ভূমিকা নিয়েছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধ কখনোই সরল বা একরৈখিক ইতিহাস নয়; বরং দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল হিসেবে তা গড়ে ওঠে নানা বয়ানের সংমিশ্রণে। প্রত্যেক ঐতিহাসিক নিজ অভিজ্ঞতা ও অবস্থান থেকে ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেন, ফলে দৃষ্টিভঙ্গির বৈচিত্র্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায়ও এই ভিন্নতা বিদ্যমান।

হাসান ফেরদৌসের ভুট্টোর তওবা ও মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক গ্রন্থটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণের প্রচেষ্টায় এক গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রণী সংযোজন বলা যায়। গ্রন্থটির ১০টি প্রবন্ধ পাঠ করলে পাঠক একদিকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম খলনায়ক রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর সহযোগী হেনরি কিসিঞ্জারের নেপথ্য ভূমিকা ও কূটচাল সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবেন, অন্যদিকে পরিচিত হবেন সেই সময়ের প্রায় বিস্মৃত দুই মার্কিন ব্যক্তিত্ব—নৌ সেনা কর্মকর্তা চার্লস র‍্যাডফোর্ড ও সাংবাদিক সিডনি শ্যানবার্গের সাহসী উপস্থিতির সঙ্গে। একই সঙ্গে উন্মোচিত হবে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা আরও অনেক অজানা অধ্যায়।

প্রথম প্রবন্ধ ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও তিন পরাশক্তি’ বাংলাদেশকে ঘিরে নানামুখী আন্তর্জাতিক তৎপরতার দালিলিক ও তথ্য-উপাত্তভিত্তিক মূল্যায়ন। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনও পররাষ্ট্রনীতিতে সব সময় নিজেদের কর্মকাণ্ডকে নিছক জাতীয় স্বার্থে সীমাবদ্ধ রাখেনি; বরং তা নৈতিকতা ও শ্রেষ্ঠত্বের এক কৃত্রিম আবরণে মুড়ে উপস্থাপন করেছে। একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে চীনের অবস্থানও ছিল কৌশলনির্ভর; কিন্তু নৈতিকতার পরিপন্থী। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বিরোধের কারণে চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলে এবং পাকিস্তানের গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ উপেক্ষা করে। বিপরীতে, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে জাতীয় স্বার্থের কোনো সংঘাত ছিল না; বরং ছিল পারস্পরিক বোঝাপড়া ও কৌশলগত সহযোগিতা। বাংলাদেশের প্রতি সোভিয়েতের সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি আসলে ভারতের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও দক্ষিণ এশিয়ায় কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার নীতিরই প্রতিফলন। এই নির্মম সত্য তুলে আনতে গিয়েও লেখক বাস্তবতা ও সত্য থেকে বিচ্যুত হননি, অতিক্রম করেছেন একদেশদর্শিতা৷

‘১৯৭১: ইন্দিরা, নিক্সন ও কিসিঞ্জার’ শীর্ষক প্রবন্ধে বিশ্লেষণ ও ফ্যাক্ট চেকের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন, একাত্তরের বাংলাদেশ সংকটে নিক্সন-কিসিঞ্জারের প্রকৃত ব্যর্থতা ছিল স্পষ্ট গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে বরং সেই হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী এক স্বৈরশাসকের পক্ষ সমর্থন করা। গবেষক ভ্যান হলেন একে আখ্যা দিয়েছেন ‘আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মানবিক মাত্রা অনুধাবনে ব্যর্থতা’ হিসেবে।

জুলফিকার আলী ভুট্টো থেকে শুরু করে পারভেজ মোশাররফ পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো শাসকই একাত্তরের ভয়াবহ গণহত্যার দায় স্বীকার করেননি বা এর জন্য অনুতাপ প্রকাশও করেননি। ‘গণহত্যা’ শব্দটি যেন তাঁদের মুখেই ওঠে না। মাঝেমধ্যে কূটনৈতিক কৌশলে তাঁরা ‘অ্যাপোলজি’ নয়, ‘রিগ্রেট’ শব্দে দায় এড়িয়ে গেছেন। ১৯৭৪ সালের ৩০ জুন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’–এ প্রকাশিত ‘ভুট্টোর ক্ষমাপ্রার্থনা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে ভুট্টোর বাংলাদেশের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের উল্লেখ করা হলেও লেখক তাতে প্রশ্ন তুলেছেন—যিনি একাত্তরের হত্যাযজ্ঞে নীরব সমর্থন দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার ও অবমাননা করেছিলেন, তাঁর সেই তথাকথিত তওবা কতটা গ্রহণযোগ্য?

‘একাত্তরের গণহত্যা ও ভুট্টোর তওবা’ প্রবন্ধে লেখক ভুট্টোর আচরণের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানি মনস্তত্ত্বের প্রকৃত মুখোশ উন্মোচন করেছেন—যেখানে অনুশোচনার ভাষার আড়ালে লুকিয়ে আছে অস্বীকার, অবজ্ঞা ও রাজনৈতিক কূটচাল।

একটি জাতির কাছে তাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অতি মূল্যবান সম্পদ। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক ইতিহাসচর্চার উপযুক্ত বাহন হিসেবে পাঠক এ গ্রন্থটিকে নির্দ্বিধায় বেছে নেবেন বলে মনে করি।

ভুট্টোর তওবা ও মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক
হাসান ফেরদৌস

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রকাশ: নভেম্বর ২০২৪
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
পৃষ্ঠা: ১৫৯
মূল্য: ৪৬০ টাকা

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রবন ধ গণহত য প রক শ র জন ত

এছাড়াও পড়ুন:

দু–তিন দিনে পড়ার মতো মুক্তিযুদ্ধের অনবদ্য পাঁচ উপন্যাস

মুক্তিযুদ্ধের বঞ্চনা ও প্রতিরোধের মর্ম অনুধাবন ও সামষ্টিকভাবে জাতীয় চেতনাবোধ প্রজ্বালনে বৃহৎ পরিসরের উপন্যাস পাঠ অত্যন্ত জরুরি। যুদ্ধের ঘটনাশ্রয়ী বড় উপন্যাসগুলো কেবল ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ দেয় না, বরং যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক গভীরতা, মানুষের ব্যক্তিগত সংগ্রাম এবং নৈতিক দ্বন্দ্বের সঙ্গে পাঠককে নিবিড়ভাবে পরিচিত করায়। আজ থাকছে যুদ্ধনির্ভর অজস্র লিখিত ভাষ্যের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি উপন্যাস, যেগুলো পরবর্তী প্রজন্মকে আখ্যানের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার মূল্য সম্পর্কে সচেতন করতে সক্ষম এবং যুদ্ধের অভিঘাত, ত্যাগ ও প্রভাবের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করে।

১. রাইফেল রোটি আওরাত

‘রাইফেল রোটি আওরাত’ আনোয়ার পাশার (১৯২৮-১৯৭১) মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে রচিত একটি কালজয়ী উপন্যাস। ১৮২ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে ২৮ মার্চের ভোর পর্যন্ত মাত্র তিন দিনের ঘটনাবলিকে কেন্দ্র করে। এতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে উদগ্র বীভৎসতায়। কেন্দ্রীয় চরিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীন, যিনি সপরিবার টিচার্স কোয়ার্টারের ২৩ নম্বর ভবনে থাকতেন। চারপাশে সহকর্মী ও ছাত্রদের লাশের স্তূপের মাঝেও সুদীপ্ত শাহীন ও তাঁর পরিবার ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। এই বেঁচে থাকার অপরাধবোধ, ভয়াবহ গণহত্যার চাক্ষুষ বিবরণ এবং নতুন ভোরের প্রতীক্ষাই উপন্যাসটির করুণ আবেদন।

আনোয়ার পাশা (১৯২৮—১৯৭১)

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দু–তিন দিনে পড়ার মতো মুক্তিযুদ্ধের অনবদ্য পাঁচ উপন্যাস
  • ওসমান দোসর মাকসুদের প্রচারণায় শংকর সাহা, সনাতন সমাজে ক্ষোভ
  • মুক্তিযুদ্ধে লোকশিল্পী ও চারণকবিদের সাংস্কৃতিক ভূমিকা