মুহম্মদ ইউসুফ সিদ্দিক রচিত নিদ্রিত শিলার মুখরিত লিপি: বাংলায় আরবী-ফার্সী লেখমালা (১২০৫-১৪৮৮) বইটি সম্প্রতিকালে প্রকাশিত শিলালিপিভিত্তিক অতি মূল্যবান গ্রন্থ। বিজ্ঞ গবেষকের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে কঠিন শিলা বা প্রস্তরের ওপর উৎকীর্ণ শিলালিপি। মধ্যযুগের আরবি-ফারসি শিলালিপিগুলো বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ। শিলা বা পাথরের মসৃণতল খোদাই করে অভীষ্ট বাণী লিপিবদ্ধ করা হয়, যা শিলালিপি নামে অভিহিত হয়ে থাকে। মধ্যযুগে কাগজের প্রচলন শুরু হলেও তা ছিল অতি দুর্লভ ও ব্যয়বহুল; উপরন্তু সহজপাচ্য ও ক্ষয়িষ্ণু। এ জন্য সে যুগের রাজা-বাদশাহরা তাঁদের কীর্তিকলাপ সংরক্ষণের টেকসই মাধ্যম হিসেবে শিলালিপিকে বেছে নিয়েছিলেন।

মুসলিম শাসনামলে (১২০৪-১৭৫৭) বাংলায় এযাবৎ এ রকম চার শতাধিক শিলালিপির সন্ধান পাওয়া গেছে। দেশ-বিদেশের পণ্ডিতেরা বিভিন্ন সময় এসব শিলালিপি সংগ্রহ, পাঠোদ্ধার ও আলোচনা-গবেষণা করে বাংলার ইতিহাস নির্মাণে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন। এগুলোর অধিকাংশই আরবি ও ফারসি ভাষায় লিপিকৃত। অনেক শিলালিপিতে আরবি-ফারসি ভাষার মিশ্রণও রয়েছে। আবার বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায়ও দু–একটি শিলালিপি পাওয়া গেছে।

শিলালিপিগুলো প্রণীত হয়েছে মূলত বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ উপলক্ষে—যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, দুর্গ, রাজপ্রাসাদ, তোরণ বা নগরের প্রবেশদ্বার, ফটক বা দুর্গের প্রবেশদ্বার, রাজপ্রাসাদের প্রবেশদ্বার, মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভ, সমাধিভবন, সমাধিবেদি, খানকাহ, মাজার বা পীরের দরগাহ, ঈদগাহ, ইমামবাড়া, সিকায়াহ বা জলসত্র, দিঘি, পুল, রাস্তা ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা সর্বাধিক। এরপর আছে সুফি পীর-দরবেশদের খানকাহ, দরগাহ ও সমাধিগৃহ। ব্যয়বহুল এসব স্থাপনা নির্মাণের ও শিলালিপি মুদ্রণের কাজে মুখ্যত শাসকশ্রেণি ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা জড়িত ছিলেন। শিলালিপির বাণীতে নির্মাতা ও পৃষ্ঠপোষক রূপে তাঁদেরই নামধাম-কাল পাওয়া যায়।

সাড়ে পাঁচ শ বছর ধরে এ দেশে এ রকম মূল্যবান স্থাপনা, শিলালিপি, মুদ্রা ইত্যাদি নির্মিত হলেও সে যুগের পণ্ডিতদের এগুলোর ঐতিহাসিক তাৎপর্য উপলব্ধি ও মূল্যায়ন করার জ্ঞান ও মানসিকতা ছিল না। ফলে সমকালের ও পরবর্তীকালের অনেক কিছু ধ্বংস হতে বসেছিল।

প্রথমে দেশীয় পণ্ডিত গোলাম হুসেন সলিম যোধপুরী ও তাঁর শিষ্য সৈয়দ ইলাহি বকশ গৌড়-পাণ্ডুয়ার শিলালিপির প্রতি আকৃষ্ট হন। প্রথমজন রিয়াজ-উস-সালাতিন (১৭৮৮) এবং দ্বিতীয়জন খুরশিদ-ই-জাহাননামা নামে ইতিহাসগ্রন্থে তাঁদের সংগৃহীত শিলালিপির উপাদান ব্যবহার করেন। ইলাহি বকশ তাঁর রচনায় পূর্বের এবং নিজের সংগৃহীত মোট ৪২টি শিলালিপির উপাদান ব্যবহার করেন। এ রকম গবেষণা ও গ্রন্থ রচনার ধারা থেমে যায়নি। একুশ শতকের গোড়ার দিকে মুহম্মদ ইউসুফ সিদ্দিক লিখেছেন অ্যারাবিক অ্যান্ড পারসিয়ান ইন্সক্রিপশনস অব বেঙ্গল (২০১৭) বইটি। এতে সর্বাধিক সংখ্যক ৪২৫টি শিলালিপির বিবরণ রয়েছে, যা অন্য সব গ্রন্থের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।

আরবি-ফারসি শিলালিপি নিয়ে দেশি ও বিদেশি পণ্ডিতদের হাতে এযাবৎ যা কিছু রচিত হয়েছে, তার সবই ফারসি ও ইংরেজি ভাষায়। বাংলা ভাষায় অনুরূপ কোনো গ্রন্থ প্রণীত হয়নি। মুহম্মদ ইউসুফ সিদ্দিকই প্রথম নিদ্রিত শিলার মুখরিত লিপি (২০২১) গ্রন্থটি প্রণয়ন করে দীর্ঘ দুই শ বছরের শূন্যতা দূর করলেন। আরবি-ফারসি বিভাষা, তার ওপর আরবি হরফের অলংকৃত লিখনশৈলী দেশি পাঠকের কাছে কঠিন শিলার মতোই দুর্বোধ্য ও রহস্যময় ছিল। কিন্তু লেখকের ভাষার সৌকর্যে এবং স্বচ্ছ বর্ণনার গুণে তা অনেকটাই সরস ও উপাদেয় হয়ে উঠেছে।

শিলালিপি একটি যৌথ শিল্পকর্ম। একটি পূর্ণাঙ্গ ও আদর্শ শিলালিপি নির্মাণে একাধিক ব্যক্তির ভূমিকা থাকে। এর নির্মাণপ্রক্রিয়া ও বিভিন্ন ব্যক্তির ভূমিকা সম্পর্কে লেখক বলেন, ‘কোনও সুলতান একবার কোনও শিলালিপি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলে প্রথম কাজ ছিল পংক্তি ক’টি রচনা করা। এ কাজে তখনকার মক্তব বা মাদ্রাসার অধ্যাপকদের মধ্যে কবিপ্রতিভা আছে এমন কাউকে নিয়োগ করা হত।…তাঁদের রচনা সুলতানের মনমতো হলে তা যেত একজন চারুলিপিকর অর্থাৎ ক্যালিগ্রাফারের কাছে। চারুলিপিকর (আরবি) অক্ষরকে শৈল্পিক রূপ দিতেন। সে রূপ ফুটত সে যুগের তুলট কাগজের ওপর। এরপর ফলকের গায়ে কাঠ–কয়লা দিয়ে সেই কাগজে আঁকা ছাঁদ ফুটিয়ে তোলা হত পাথরে, এবং শেষে দক্ষ খোদাইকর তা খোদাই করতেন। অক্ষরকে কি মুনশিয়ানায় এক-একটা থিমের আওতায় আনতেন সেই শিল্পী। বোঝাই যায়, প্রতিভাবান লিপিকরদের মর্যাদা ছিল সুউচ্চ, তাঁদের কেউ কেউ খ্যাত ছিলেন “যার্​রিন দাস্ত” বা “স্বর্ণহস্ত” নামে।’ (পৃ.

১৫)। নির্মাতা ও পৃষ্ঠপোষক ছাড়া বাণী–রচয়িতা, লিপিকর ও খোদাইশিল্পীও রয়েছেন। এর অতিরিক্ত পাথর-কাটা কারিগরও নিয়োগ করা হতো। তার কাজ ছিল পাথর ঘষামাজা করে সমতল ও মসৃণ করা এবং ‘পাথর কেটে লেখাগুলি উঁচু বুটিদার’ রূপে ফুটিয়ে তোলা
(ঐ, পৃ. ৬৫)।

এখন গ্রন্থের সূচিপত্রের দিকে নজর দেওয়া যাক। গ্রন্থে মোট আটটি অধ্যায়ে মূল বিষয় আলোচিত হয়েছে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে প্রারম্ভে আছে প্রতীকচিহ্ন, বর্ণান্তর নীতি, শব্দসংক্ষেপ, পটভূমি, মুখবন্ধ, প্রাক্​–কথন, বই সম্পর্কে কিছু কথা, ইসলামি শিল্পকলা ও বঙ্গীয় সংস্কৃতি আর অন্তর্ভাগে আছে পরিশিষ্ট, গ্রন্থপঞ্জি, নির্ঘণ্ট ও মানচিত্র। মূল বিষয়বস্তুর মুখ্য দুটি অংশ—প্রথমাংশের ছয়টি অধ্যায়ে আছে শিলালিপি–সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য, তত্ত্ব, বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস–সম্পর্কিত বিশ্লেষণমূলক আলোচনা এবং দ্বিতীয়াংশে দুটি অধ্যায়ে আছে সংকলিত শিলালিপির মূল টেক্সটসহ কন্টেক্সট ও টেক্সচারের বর্ণনামূলক আলোচনা। উল্লেখ্য, গ্রন্থে ১২০৫ থেকে ১৪৮৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, অর্থাৎ বখতিয়ার খিলজি থেকে ইলিয়াস শাহি রাজবংশের শাসনামল পর্যন্ত প্রাপ্ত ১০৬টি শিলালিপি সংকলিত ও আলোচিত হয়েছে।

পরিশিষ্টে ‘বাংলার মুসলিম শাসকদের কালানুক্রম’ ও ‘বাংলার ইসলামি শিলালিপির তালিকা’ শিরোনামে দুটি মূল্যবান তালিকা রয়েছে। দ্বিতীয় তালিকায় সুলতানি যুগ ও মোগল যুগ মিলিয়ে সর্বমোট ৪২৪টি শিলালিপির উল্লেখ রয়েছে, যা পূর্বে প্রকাশিত ইংরেজি গ্রন্থে প্রদত্ত তালিকার চেয়ে অনেক বেশি। গ্রন্থ শেষে যথাবিহিত গ্রন্থপঞ্জি ও নির্ঘণ্ট রয়েছে।

গ্রন্থখানি পাঠ করে আমাদের মনে হয়েছে, শিলালিপির খুঁটিনাটি যাবতীয় বিষয় লেখকের নখদর্পণে। বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘সাপের হাঁচি বেদেয় চিনে।’ এর অর্থ অভিজ্ঞ ব্যক্তি কোনো বিষয়ের অন্তর্গত মর্ম বুঝতে পারেন। গ্রন্থকার আরবি-ফারসি শিলালিপি দেখেই এর ভেতর-বাইরের অন্তর্নিহিত খবর বলে দিতে পারেন। এটি তাঁর নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞার ফল, যা তিনি সারা জীবনের সাধনায় আয়ত্ত করেছেন।

নিদ্রিত শিলার মুখরিত লিপি

বাংলায় আরবী-ফার্সী লেখমালা (১২০৫-১৪৮৮) 

মুহম্মদ ইউসুফ সিদ্দিক

প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী, ঢাকা,

৬৬২ পৃষ্ঠা, দাম: ১৫০০ টাকা

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত হয় ছ ল প কর গ রন থ প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

বাগেরহাটে বিদেশি পিস্তলসহ ১১ জন আটক

বাগেরহাটের মোল্লাহাটে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে টোল প্লাজার সামনে একটি মাইক্রোবাস থেকে চারটি বিদেশি পিস্তল, চারটি ম্যাগজিন এবং নয় রাউন্ড গুলিসহ ১১ জনকে আটক করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। 

বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) সন্ধ্যায় গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ওই মাইক্রোবাসে তল্লাশি চালানো হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, ঢাকা মেট্রো–চ ১৫-৬৭৭০ নম্বরের মাইক্রোবাসটি মোল্লাহাটের পথ দিয়ে খুলনার দিকে যাচ্ছিল। এতে তল্লাশি চালিয়ে চারটি ৭.৬২ মিলিমিটার চাইনিজ পিস্তল, চারটি ম্যাগজিন ও নয় রাউন্ড গুলি পাওয়া গেছে। এ সময় ১১ জনকে আটক করা হয়েছে।

আরো পড়ুন:

মৌলভীবাজার সীমান্তে আবারো ২৫ জনকে ঠেলে দিল বিএসএফ

চবিতে গাঁজা সেবনকালে ৩ ছাত্রীসহ ৯ শিক্ষার্থী আটক

আটক ব্যক্তিরা সবাই ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা। তারা হলেন—কাউসার আলী (৪৩), মো. মেহেদী হাসান (২৩), আতাউর রহমান (৩০), মো. খোকন বিশ্বাস (৪৫), খোকন মিয়া (৩৫), আবুল হোসেন (৪৩), মো. ইমদাদুল হক (৩১), জনি মিয়া (২৭), সেলিম শাহ (৩৪), মাসুম পারভেজ (২২) ও প্রসেনজিৎ চন্দ্র দাশ (৩৫)। সবাইকে বাগেরহাট জেলা গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছে।

বাগেরহাটের পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল আরিফ জানিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা ছিল। আটক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে অস্ত্রের উৎস ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা চলছে।

ঢাকা/শহিদুল/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ