পারিবারিক বন্ধন ও আনন্দের অভাব

শিশুর বিকাশের মূলে রয়েছে পরিবার। একটি শিশু অনেকগুলো চাহিদা নিয়ে জন্মায়। সে ভালোবাসা, উষ্ণতা, যত্ন ও নিরাপত্তা চায় এবং একই সঙ্গে আনন্দও চায়। শিশুর এসব চাহিদা পূরণ হচ্ছে কি না, তার ওপর নির্ভর করে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিশুর বন্ধন নিরাপদ হচ্ছে কি না। মনোবিজ্ঞানী জন বলবি তাঁর ‘বন্ধন তত্ত্বে’ শিশুর বিকাশে নিরাপদ বন্ধনের কথা বলেছেন, যা শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য জরুরি। শিশুর সঙ্গে থেকে পর্যাপ্ত যত্ন ও আদর, শারীরিক ও আবেগসংক্রান্ত নিরাপত্তা দেওয়া, শিশুর সঙ্গে খেলা ও আনন্দদায়ক সময় কাটানোর মতো কাজগুলো শিশুকে নিজের ও অন্যের প্রতি আস্থা তৈরিতে সহযোগিতা করে। কিন্তু অনেক পরিবারেই শিশুরা নিরাপদ বোধ করে না। তাদের বিভিন্ন চাহিদার প্রতি অভিভাবকের অবজ্ঞা বা অতিসুরক্ষা, শারীরিক ও মানসিক শাস্তি, ক্রমাগত অন্যের সঙ্গে তুলনা, সমাজে নিজেকে সফল বাবা-মা হিসেবে জাহির করার জন্য শিশুর কাছে অতি প্রত্যাশা, পারিবারিক কলহ ইত্যাদি শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকের সম্পর্ককে বিষিয়ে তোলে। নিজের অজান্তেই তখন ভালোবাসা ও আনন্দের জন্য বিভিন্ন মাধ্যম খুঁজতে থাকে শিশু। পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া মানসিক আঘাতের ফলে শিশুরা একদিকে যেমন মানসিকভাবে অসুস্থ হতে পারে, আবার কিছু শিশু নিজের চাহিদা পূরণে বেছে নেয় ভুল পথ, ভুল সঙ্গ, যা তাকে ধীরে ধীরে অপরাধী করে তোলে। মাদক সেবন, ফোনাসক্তি ও ক্ষতিকর কনটেন্ট দেখা (সহিংস ভিডিও গেম, পর্নোগ্রাফি), কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়াটা শিশু-কিশোরদের নৃশংস করে তুলতে পারে।

প্রযুক্তি ও শিল্পসংস্কৃতির প্রভাব

অনেক সমাজেই সহিংসতাকে পুরুষত্বের নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরা হয়। আলফা মেল হিসেবে একধরনের অহংবোধ করে তারা। শিশুরা যখন দেখে যে হিরোদের অস্ত্রধারী হতে হয়, মারামারি করেই জয়ী হতে হয়, তখন তারা সেটাকেই অনুকরণ করে। বিশেষ করে টেলিভিশন, সিনেমা, ভিডিও গেম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহিংসতা যখন বিনোদনের উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন শিশুরা বাস্তবতা ও কল্পনার পার্থক্য করতে পারে না। এই মিডিয়া কনটেন্টগুলো অনেক সময় শিশুর মনে নৃশংসতা ও প্রতিহিংসার বীজ বুনে দেয়। বর্তমানে শিশুদের মধ্যে ইন্টারনেট, গেম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার বড় চিন্তার বিষয়। অনেক গেমে ‘হত্যা’, ‘বিরোধ’, ‘জয়-পরাজয়’-এর মধ্য দিয়ে সহিংসতা উপস্থাপন করা হয়। শিশুরা এসব গেমে মেতে উঠলে বাস্তব জীবনে মানুষের প্রতি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে একই ধরনের আচরণ করে। এভাবে ক্রমেই তাদের আচরণে নৃশংসতা ঢুকে পড়ে।

বিদ্যালয় ও বন্ধুবান্ধবের প্রভাব

বিদ্যালয় হচ্ছে শিশুর দ্বিতীয় ঘর। যদি একজন শিশু সহপাঠীদের দ্বারা বারবার বুলিংয়ের শিকার হয় বা কোনো বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে নেতিবাচক আচরণ শেখে, তবে তার মধ্যেও প্রতিশোধপরায়ণতা ও রাগ জন্ম নিতে পারে। আবার অনেক সময় দলগত চাপে পড়ে শিশুরা এমন কাজ করে ফেলে, যা তার নিজের মন থেকেও আসে না। বরং ‘গ্রুপ একসেপ্টেন্স’ বা দলে গ্রহণযোগ্যতা পেতে তারা এমনটা করে থাকে। অনেক সময় বন্ধুদের মধ্যে নিজের ‘কুলনেস’ প্রকাশ করতে গিয়েও শিশু-কিশোরেরা সহিংস হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুনকিশোর ও তরুণেরা রাত জাগে কেন১৬ আগস্ট ২০২৪সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব

শিশুদের বড় করার ব্যাপারে অনেক অভিভাবকের সচেতনতা ও দক্ষতার ঘাটতি থাকে। তেমনি শিশুরা ভুল পথে পা বাড়ালে কী করণীয়, সে ব্যাপারেও অনেক অভিভাবক কিছু বুঝে উঠতে পারেন না। অনেক সময় অতিরিক্ত শাসন বা দূরত্ব শিশু-কিশোরদের জন্য আরও বিপদ ডেকে নিয়ে আসে।

একটি শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য কী দরকার, কোন পথে থাকতে হবে, কোন কাজের কী ফলাফল হতে পারে, সে সম্পর্কে অভিভাবকদের প্রথমে সচেতন হতে হয়। তারপর সেই অনুযায়ী সন্তানকে দীক্ষা দিতে হয়। শিশুর বিকাশ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অনেক সময় পরিবার, বিদ্যালয় এবং সমাজ শিশুদের নৈতিক শিক্ষা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখাতে ব্যর্থ হয়। ফলে শিশুরা নিজেদের ভুল সিদ্ধান্তকে বিচার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তারা বুঝে উঠতে পারে না, তাদের কোন আচরণ ক্ষতিকর।

সন্তান বড় করাটা আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব। কিন্তু এটিকে সহজ মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রত্যেক অভিভাবকের শিশুর বিকাশ সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা থাকা আবশ্যক। এতে সন্তানকে বোঝা এবং তার সমস্যাগুলো সমাধানে সাহায্য করা অভিভাবকের জন্য সহজ হয়। পারিবারিক বন্ধন ও একটি সংবেদনশীল, সমমর্মিতার সমাজই পারে শিশু-কিশোরদের নৃশংস না হয়ে মানবিক মানুষ হিসেবে তৈরি করতে।

আরও পড়ুনকিশোর–কিশোরীদের খাবারদাবার কেমন হবে২৫ মার্চ ২০২১.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য পর ব র আনন দ

এছাড়াও পড়ুন:

ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু : পুলিশের দাবি, বাড়ির ছাদ থেকে পড়েছেন, হত্যার অভিযোগ পরিবারের

ভোলা সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাইফুল্লাহ আরিফকে (৩০) হত্যা করা হয়েছে বলে তাঁর পরিবার অভিযোগ করেছে। আজ মঙ্গলবার দুপুরে ভোলা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে তাঁর বাবা বশির উদ্দিন (মাস্টার) এই অভিযোগ করেন।

এ সময় বশির উদ্দিন বলেন, পুলিশ দাবি করছে, ছাদ থেকে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ছাদ থেকে পড়ার কোনো সুযোগ নেই; সেখানে বাঁশের বেড়া ও প্রতিটি তলায় ব্যালকনি ছিল। পুলিশের আচরণ শুরু থেকেই সন্দেহজনক।

এর আগে গত শনিবার পুলিশ সুপার শরীফুল হক তাঁর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, প্রাথমিক তদন্তের তথ্য অনুযায়ী অসতর্কতাবশত নিজ বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে সাইফুল্লাহ আরিফ মারা গেছেন।

সাইফুল্লাহ আরিফ ভোলা পৌরসভার কালীবাড়ি রোডে নবী মসজিদ গলি এলাকার বশির উদ্দিনের ছেলে। গত ৩১ আগস্ট ভোরে নিজ বাড়ির সামনে থেকে সাইফুল্লাহ আরিফের লাশ উদ্ধার করা হয়।

আজ দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে বশির উদ্দিন বলেন, ‘আমার ছেলে দুর্ঘটনায় নয়, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এর কিছু প্রমাণ আছে। আরিফের শরীরে একাধিক কাটা ও ভাঙা জখম ছিল, এমনকি হাতের রগ কাটা ছিল। পুলিশের দাবি করছে, ছাদ থেকে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যুর সুযোগ নেই, কারণ, ছাদে বাঁশের বেড়া ও প্রতিটি তলায় ব্যালকনি ছিল। পুলিশ সুপার আমার ছেলেকে নেশাগ্রস্ত আখ্যা দিলেও তাঁর কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া পুলিশ কীভাবে এমন কথা বলতে পারে। পুলিশের আচরণ শুরু থেকেই সন্দেহজনক। এ ঘটনায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

বশির উদ্দিন আরও বলেন, সাইফুল্লাহ আরিফ কোনো ধরনের মাদকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সে ছাত্রলীগের সহসভাপতি হলেও কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেনি। হত্যাকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ সত্য গোপন করছে। সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করতে মামলাটি সিআইডি বা পিবিআইয়ের কাছে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বশির উদ্দিন বলেন, তাঁর ছেলের সঙ্গে অনেকের বিরোধ ছিল। তবে জমিজমার বিরোধ ও মাদক ব্যবসার বিরোধ নিয়ে তাঁর ছেলে খুন হয়নি। এগুলোর সঙ্গে সে জড়িত ছিল না।

শনিবার পুলিশ শরীফুল হক তাঁর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সাইফুল্লাহ আরিফের মৃত্যুর রহস্য উদ্‌ঘাটনে প্রাথমিক তদন্ত শেষে জানা যায়, তিনি অসতর্কতাবশত নিজ বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন। ৩০ আগস্ট দিবাগত রাত অনুমান ১২টা ১৫ মিনিটে রাতের খাবার শেষে সাইফুল্লাহসহ পরিবারের সবাই নিজ নিজ ঘরে ঘুমাতে যান। ভোর ৫টা ১০ মিনিটে ফজরের নামাজের জন্য বের হওয়ার সময় তাঁর বাবা বশির উদ্দীন (৭০) বাড়ির সামনে গেটের পাশে রক্তাক্ত অবস্থায় ছেলের মরদেহ দেখতে পান। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ভোলা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। সুরতহালে দেখা যায়, আরিফের মাথা ও হাতে গুরুতর আঘাত ছিল। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, আরিফ দীর্ঘদিন ধরে নেশায় আসক্ত ছিলেন এবং হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় প্রায়ই ছাদে যেতেন। ঘটনার দিন রাতেও তিনি ছাদে ওঠেন এবং অসতর্কতাবশত রেলিংবিহীন অংশ থেকে পড়ে গিয়ে গুরুতর জখমপ্রাপ্ত হয়ে মারা যান।

পরিবারের অভিযোগ সম্পর্কে আজ দুপুরে পুলিশ সুপার শরীফুল হক মুঠোফোনে বলেন, ‘ওই ঘটনায় তদন্ত চলমান। সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক তদন্তের কথা জানানো হয়েছে। তদন্তে তথ্য সংযোগ-বিয়োগের সুযোগ রয়েছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আগামী সরকারের মন্ত্রীদের জন্য গাড়ি কেনার অতি আগ্রহের কারণ কী, প্রশ্ন টিআইবির
  • মুসলিম পরিবারে শিশুর নিরাপত্তা
  • পুরোপুরি বিলুপ্তির পর উগান্ডায় আবার ফিরল গন্ডার
  • ছাত্রলীগ নেতার মৃত্যু : পুলিশের দাবি, বাড়ির ছাদ থেকে পড়েছেন, হত্যার অভিযোগ পরিবারের