ঘুষ, মন্ত্রী আর গোপন ডায়েরি: পদ্মা সেতু নিয়ে দুদকের সেই এজাহারে যা ছিল
Published: 3rd, July 2025 GMT
সেতু ছিল, নদীও ছিল—ঘাটতি ছিল বিশ্বাসে
নিকিতা ক্রুশ্চেভ একবার বলেছিলেন, ‘রাজনীতিবিদেরা সর্বত্রই এক। তাঁরা সব সময় সেতু তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দেন, যদিও সেখানে কোনো নদীই নেই।’ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উক্তিটি অবশ্য পুরোপুরি খাটে না। এখানে নদী ছিল, সেই নদীতে সেতু তৈরির প্রতিশ্রুতিও ছিল। তবে ছিল না কেবল বিশ্বাস। অবিশ্বাসের পেছনে কারণও হয়তো ছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু হলেও এর পেছনের অনেক ঘটনা এখনো অজানা রয়ে গেছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেই আওয়ামী লীগ পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল। যদিও ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় একনেক সভায় প্রথম প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছিল। তখন ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। এরপর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। তাদের সময় ২০১১ সালের জানুয়ারিতে সেতু নির্মাণের ব্যয় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়। বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও, দুর্নীতির অভিযোগে তা স্থগিত করে দেয়। মূলত পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগেই বিপত্তি শুরু হয়েছিল।
বিশ্বব্যাংকের তদন্তে উঠে আসে, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে ঘুষ ও কমিশনের দাবি করা হয়েছিল। তাঁর নামেই কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে ঠিকাদারদের। বিশ্বব্যাংক স্পষ্ট জানায়—দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে অর্থায়ন বন্ধ থাকবে।
আরও পড়ুনপদ্মা সেতু প্রকল্প: লিটন চৌধুরীর চাপে কিনতে হয় ৯০০ কোটি টাকার জমি ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪পরবর্তী সময়ে সেতু বিভাগের সচিব ও প্রকল্প পরিচালক বদল হলেও মন্ত্রী বহাল থাকেন। আন্তর্জাতিক তদন্তে আরও দুর্নীতির প্রমাণ মেলে। বিশ্বব্যাংক একাধিকবার চিঠি, প্রমাণ ও শর্ত দেয়। শেষ পর্যন্ত সরকার মন্ত্রিত্বে পরিবর্তন আনে। দুদক পরে বলে—মন্ত্রী দুর্নীতিতে জড়িত নন, কিন্তু বিশ্বব্যাংকের তদন্তে উল্টো দাবি ওঠে। শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক তহবিল দেওয়া বন্ধ রাখলেও সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে।
আবারও আলোচনায় সেই পদ্মা সেতুর দুর্নীতি২০১২ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অনিয়মের যে অভিযোগ উঠেছিল, তা নতুন করে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন গত মঙ্গলবার বলেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে অনিয়মের যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ‘গায়ের জোরেই’ মামলাটি থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগে যে বিভ্রান্তি ও অনিয়মের অভিযোগ ছিল, সেসবের যথেষ্ট উপাদান থাকলেও শেষ পর্যন্ত আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) দিয়ে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়। মামলাটি অনেকটা ‘গায়ের জোরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে’। এ কারণে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করতে নতুন করে তদন্ত শুরু করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে পরামর্শক নিয়োগে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ২০১২ সালে এ প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করেছিল বিশ্বব্যাংক। এরপর একই বছরের ১৭ ডিসেম্বর এ বিষয়ে বনানী থানায় মামলা করে দুদক। মামলার সেই এজাহারে ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। মামলায় মোট সাতজনকে আসামি করা হয়। তাঁদের মধ্যে প্রধান আসামি ছিলেন তৎকালীন সেতু বিভাগের সচিব মো.
‘ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে দুদকের উপপরিচালক (তৎকালীন) আবদুল্লাহ আল জাহিদ ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর বনানী থানায় যে মামলাটি করেছিলেন, সেখানে সাতজনকে আসামি করা হয়েছিল। ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর আদালত দুদকের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে সাত আসামির সবাইকে অব্যাহতি দেন। এর আগে একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দুদকের পক্ষে বলা হয়েছিল যে পদ্মা সেতু নির্মাণে ‘দুর্নীতি বা ষড়যন্ত্রের’ কোনো প্রমাণ তারা পায়নি।
দুদক চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেছেন, নতুন তদন্তে কেউ দায়ী প্রমাণিত হলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগে যাঁদের আসামি করা হয়েছিল, প্রয়োজনে তাঁদের আবারও ডাকা হতে পারে। তদন্তে নতুন কোনো নাম এলে সেটিও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
মামলাটি করা হয়েছিল ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর, বনানী থানায়। মূল অভিযোগ ছিল কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে ঘুষ দিয়ে পদ্মা সেতুর পরামর্শক নিয়োগ পাইয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে। এতে বাংলাদেশি সরকারি কর্মকর্তারাও জড়িত ছিলেন।
মূল অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল—
• সচিব নিজের মতো করে কমিটি গঠন করে, জাপানি কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
• পরে এসএনসি-লাভালিনকে অগ্রাধিকার দিতে গোপনে দরপত্র ও তথ্য পাচার করা হয়।
• টেন্ডার মূল্যায়নে ইচ্ছেমতো নম্বর কেটে অন্যদের বাদ দিয়ে লাভালিনকে সুবিধা দেওয়া হয়।
• প্রাপ্ত তথ্য, ই–মেইল ও সাক্ষ্য থেকে ঘুষের লেনদেনের পরিকল্পনা ও পছন্দের তালিকা পাওয়া যায়।
• রমেশ শাহর ডায়েরিতে উল্লেখ আছে, কাজ পেলে কাদের কত শতাংশ ঘুষ দেওয়া হবে—সেখানে সচিবের নামও রয়েছে।
• কানাডা ও বাংলাদেশে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক, প্রভাব খাটানো ও ভয়ভীতি প্রদর্শনেরও প্রমাণ পাওয়া গেছে।
• তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল হাসান চৌধুরীর নাম উঠে এলেও তাঁদের সংশ্লিষ্টতা এখনো নিশ্চিত নয়—তদন্তে খতিয়ে দেখা হবে।
এজাহারের পূর্ণ বিবরণএ মর্মে এজাহার করা হয়েছে যে (১) মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সাবেক সচিব, সেতু বিভাগ/নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, ঢাকা, (২) কাজী মো. ফেরদাউস, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (নদীশাসন), বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, ঢাকা, (৩) মো. রিয়াজ আহমেদ জাবের, নির্বাহী প্রকৌশলী (ব্রিজ কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স ডিভিশন-৪), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), রমনা, ঢাকা, (৪) মোহাম্মদ মোস্তফা, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট লিমিটেড (ইপিসি), বাংলাদেশে এসএনসি-লাভালিনের স্থানীয় উপপরামর্শক, (৫) মোহাম্মদ ইসমাইল, সাবেক পরিচালক (আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগ), এসএনসি-লাভালিন, (৬) রমেশ শাহ, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট (আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগ), এসএনসি-লাভালিন, কানাডা এবং (৭) কেভিন ওয়ালেস, এসএনসি-লাভালিন একে অপরকে আর্থিক লাভবান করার অসৎ অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক অসদাচরণ করে ও বিধিবিধান ভঙ্গ করে ঘুষ লেনদেনের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম দরদাতা এসএনসি-লাভালিনকে কার্যাদেশ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দণ্ডবিধির ১৬১ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারার অপরাধ করার অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করেন, যা দণ্ডবিধির ১২০ (বি) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের নির্মাণ তদারকি পরামর্শক হিসেবে এসএনসি-লাভালিন কার্যাদেশ প্রাপ্ত হলে বর্ণিত ঘুষ লেনদেন সম্পন্ন হতো।
পদ্মা সেতুউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ষড়যন ত র ষড়যন ত র র ঘ ষ ল নদ ন ২০১২ স ল ল নদ ন র ব শ বব য প রকল প তৎক ল ন ব যবস থ মন ত র র চ লক হয় ছ ল অপর ধ সরক র তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
গণঅভ্যুত্থানে হত্যায় বিএনপি নেতাকর্মীদের আসামি করার প্রতিবাদে বিক
রাজধানীর মিরপুর থানায় দায়ের করা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হত্যা মামলায় শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে উপজেলা বিএনপি এবং সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
বুধবার (১ অক্টোবর) বিকেল ৫টায় উপজেলার কোদালপুর বাজার থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়ে বাজার প্রদক্ষিণ করে কোদালপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে এক ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
আরো পড়ুন:
জলাবদ্ধতা নিরসনের দাবিতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বিক্ষোভ
খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা বহাল, ২ মহাসড়কে অবরোধ শিথিল
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, গত ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকার মিরপুর থানায় ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে প্রধান আসামি করে গণঅভ্যুত্থানে নিহতের ঘটনায় হত্যা মামলা করা হয়। মামলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে গোসাইরহাট উপজেলা বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অবিলম্বে মামলা থেকে নিরপরাধ বিএনপি নেতাকর্মীদের নাম প্রত্যাহারের দাবি জানান তারা।
গোসাইরহাট উপজেলা বিএনপির সদস্য তারেক আজিজ মোবারক ঢালী বলেন, ‘‘যেসব বিএনপি নেতাকর্মীর নাম মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তারা সকলে বিগত দিনে স্বৈরাচারি হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে আমার সঙ্গে কাজ করেছেন। তাদের ষড়যন্ত্রমূলকভাবে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। আমরা চাই অবিলম্বে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হোক।’’
কোদালপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম সালু মৃধা বলেন, ‘‘বিগত দিনে বিএনপি করার কারণে আমরা মামলা খেয়েছি, জেল খেটেছি, হামলার শিকার হয়েছি। এখন আবার আমাদের নাম একই মামলায় জড়ানো হয়েছে। এটি ঘৃণিত ষড়যন্ত্র, এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার চাই।’’
ভুক্তভোগী উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সুমন মৃধা বলেন, ‘‘আমি বিগত দিনে ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ছিলাম। এমনকি, জুলাই আন্দোলনেও অংশ নিয়েছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, গত ২০ সেপ্টেম্বর আমার নাম মিরপুর থানার মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।’’
তিনি এর তীব্র নিন্দা এবং সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে মামলা থেকে তার নাম প্রত্যাহারের দাবি জানান।
ঢাকা/আকাশ/বকুল