চিকিৎসকের ৩১ পদে শূন্য ১৮, বেহাল চিকিৎসাসেবা
Published: 7th, July 2025 GMT
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মানুষের বসবাস। তাদের জন্য একমাত্র সরকারি চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক সংকটে চিকিৎসা কেন্দ্রটি এখন যেন নিজেই রোগীতে পরিণত হয়েছে। ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩১ চিকিৎসকের পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন ১৩ জন। বাকি ১৮ পদই শূন্য। এতে উপজেলার বাসিন্দাসহ আশপাশের এলাকার রোগীদের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।
গত শনিবার ৫ বছরের মেয়ে তানিশাকে নিয়ে আসেন কাশিপুর গ্রামের মরিয়ম আক্তার। মেয়ের শরীরে ফুসকুড়ি হয়েছে। সারাদিন চুলকায়, রাতে ঘুমাতে পারে না। তিনি জানান, আগেও দুবার এসেছিলেন, তখনও চর্মরোগের চিকিৎসক ছিলেন না। বাধ্য হয়ে সাধারণ চিকিৎসককে দেখিয়ে ওষুধ নিয়েছেন। কিন্তু অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় আবার এসেছেন। এবারও শোনেন, এ রোগের চিকিৎসক নেই।
মরিয়ম আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী দিনমজুর। আমরার মতো গরিব মাইনষের পক্ষে ১ হাজার ট্যাহা ভিজিট দিয়া ডাক্তার দেহানির সাঙ্গে নাই। বাধ্য অইয়া সরকারি হাসপাতালে আওন লাগে। কিন্তু আইয়া হুনি, বড় ডাক্তার নাই। এতে মনডা খারাপ অইয়া যায়।’
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে জানা গেছে, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে দীর্ঘদিন ধরে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। জুনিয়র কনসালট্যান্ট (নাক, কান ও গলা) নেই অন্তত পাঁচ বছর। চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ দু’বছর নেই। চক্ষু বিশেষজ্ঞের পদ থাকলেও এ পর্যন্ত কোনো চিকিৎসক যোগদান করেননি। মেডিকেল অফিসারের ১০টি পদের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র পাঁচজন।
শুধু চিকিৎসক নয়, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদেও রয়েছে জনবল সংকট। অনেক সময় বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারদের (স্যাকমো)। অনেক মেডিকেল অফিসার ২৪ ঘণ্টাও দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিদিন গড়ে ৩৫০ জন রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। অথচ প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় কর্মরত চিকিৎসকের পাশাপাশি নার্সদেরও সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সোমবার সরেজমিন দেখা যায়, বহির্বিভাগে রোগীর দীর্ঘ সারি। সেখানে কথা হয় তাসলিমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি সাড়ে ৩ বছর বয়সী মেয়ে তাবাচ্ছুম আক্তার ইরিনকে কানের সমস্যার জন্য চিকিৎসক দেখাতে আসেন। এসে জানতে পারেন, কানের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। বাধ্য হয়ে তিনি দায়িত্বরত উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের কাছে দেখানোর জন্য লাইনে দাঁড়ান।
গত বৃহস্পতিবার গলাব্যথার চিকিৎসা নিতে আসেন হোসনে আরা খাতুন নামে এক নারী। তিনিও এসে জানতে পারেন, নাক, কান ও গলার বিশেষজ্ঞ নেই। তিনি বলেন, ‘এ সমস্যাটা নিয়ে গত সপ্তাহেও এসেছিলাম। চিকিৎসায় কোনো উন্নতি হয়নি। যেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখার কথা, সেখানে স্যাকমোরা তাড়াহুড়ো করে কী যেন ওষুধ লিখে দেয়। কাজ হয় না। এবারও ভালো না হলে এখানে আর আসব না।’
চিকিৎসক সংকটের প্রভাব পড়ছে ভর্তি রোগীদের চিকিৎসাসেবায়ও। একাধিক রোগী জানান, সকালে একবার চিকিৎসক দেখে গেলে সারাদিন আর খবর থাকে না। কোনো ধরনের সমস্যা হলে খবর দিলেও চিকিৎসক ওয়ার্ডে আসেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দায়িত্বরত একাধিক নার্সের ভাষ্য, তারা তাদের সর্বোচ্চ সেবাটাই দেওয়ার চেষ্টা করছেন। চিকিৎসক থাকলে সেবার মান আরও ভালো করার সুযোগ ছিল।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক সংকটের বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রোগের বিশেষজ্ঞ নেই। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমলেই নিচ্ছে না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তিতে তাদের মাথাব্যথা নেই। এনায়েতনগর গ্রামের মো.
চিকিৎসক সংকট থাকলেও সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে দাবি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সাদিয়া তাসনিম মুনমুনের। তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। সংকট কেটে যাবে।
এ বিষয়ে জেলার সিভিল সার্জন সাইফুল ইসলাম খান বলেন, ‘জনবল শূন্য থাকার বিষয়ে আমি অবগত আছি। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। আশা করি, কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। এতে অচিরেই সংকট কেটে যাবে।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ব স থ য কমপ ল ক স ম ড ক ল অফ স র র চ ক ৎসক চ ক ৎসক র চ ক ৎসক ন উপজ ল ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাস্থ্যে প্রকল্প থেকে সরছে সরকার: ১৭ মাস বেতনহীন, চাকরি হারানোর শঙ্কা
প্রকল্পভিত্তিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এতে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। দুই হাজারের বেশি কর্মী ১৭ মাস বেতন–ভাতা পাচ্ছেন না। অনেকের চাকরিচ্যুতির আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। এতে কিছু সেবা চালিয়ে যাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে।
১৯৯৮ সালে সরকার স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত কর্মসূচি (সেক্টর প্রোগ্রাম নামে পরিচিত) শুরু করেছিল। এ পর্যন্ত সরকারের চারটি কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। সর্বশেষ কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের জুনে। পরের মাস জুলাই থেকে পঞ্চম সেক্টর কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা ছিল।
১৯৯৮ সালে সরকার ‘সেক্টর প্রোগ্রাম’ শুরু করেছিল। ৩০টির বেশি অপারেশন প্ল্যানের মাধ্যমে এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হতো। গত বছরের ৫ আগস্টের পর এ কর্মসূচি বন্ধ। অস্থায়ীভাবে থাকা অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী বাদ পড়ছেন। যাঁরা আছেন, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে অনেকের বেতন-ভাতাও বন্ধ।৩০টির বেশি অপারেশন প্ল্যানের মাধ্যমে সেক্টর কর্মসূচি বাস্তবায়িত হতো। অপারেশন প্ল্যানগুলো ছিল এক একটি পৃথক প্রকল্প। এসব প্রকল্পে বিভিন্ন দাতা সংস্থা তাদের সামর্থ্য ও স্বার্থ অনুযায়ী অর্থসহায়তা দিত। এসব প্রকল্পে স্বাস্থ্য বিভাগের নিজস্ব জনবল ছিল। পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক অস্থায়ী জনবলও ছিল।
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর প্রায় হঠাৎই অন্তর্বর্তী সরকার ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য সেক্টর কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়। এ কর্মসূচিতে দীর্ঘদিন অস্থায়ীভাবে থাকা অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী বাদ পড়ছেন। ২০২৪ সালের জুলাই থেকে অনেকের বেতন–ভাতা বন্ধ। অন্যদিকে দাতা সংস্থা গ্লোবাল ফান্ড অর্থসহায়তা কমিয়ে দেওয়ার কারণে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে যুক্ত জনবলের একটি অংশ ৩১ ডিসেম্বরের পর আর চাকরিতে থাকতে পারবে না।
তবে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম চেষ্টা করছেন সেক্টর প্রোগ্রামে যাঁরা অস্থায়ী নিয়োগে চাকরি করতেন, তাঁরা যেন স্বাস্থ্য বিভাগের ভবিষ্যৎ কর্মসূচিতে কাজ করার সুযোগ পান।
গত ৯ অক্টোবর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে লেখা এক চিঠিতে বলেন, সেক্টর কর্মসূচি শেষে স্বাস্থ্য বিভাগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য ডিপিপির (ডিটেইল প্রজেক্ট প্ল্যান বা বিস্তারিত প্রকল্প পরিকল্পনা) প্রস্তাব করা হয়েছে। সেক্টর কর্মসূচিতে কাজ করা জনবলকে ডিপিপিতে ‘ক্যারিড ওভার’ করা হবে।
এমন পদক্ষেপ আগেও নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর আগে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে পর্যায়ভিত্তিক নিয়োগ করা জনবল পরবর্তী প্রকল্পে অব্যাহত রাখার অনুমোদন দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্য–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রকল্পভিত্তিক কর্মসূচি বন্ধ করে দেওয়ায় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ, এইচআইভি-এইডস, পুষ্টিসহ বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে শিথিলতা এসেছে। এতে রোগ বেড়ে যেতে পারে—এমন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।কেন সেক্টর কর্মসূচি বাদএকসময় স্বাস্থ্য খাত কর্মসূচি ও এর অপারেশন প্ল্যানগুলোতে দাতা সংস্থার অর্থায়ন বেশি ছিল। এখন তা কমে এসেছে। স্বাস্থ্য খাত কর্মসূচিতে এখন বেশির ভাগ অর্থায়ন সরকারের। তাই প্রকল্পভিত্তিক কর্মসূচি থেকে সরে এসে সব কর্মকাণ্ড স্বাস্থ্যের মূল কাঠামোতে যুক্ত করা প্রয়োজন মনে করছে সরকার।
৬ মার্চ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সেক্টর কর্মসূচির দুর্বলতা ও এই কর্মসূচি থেকে সরে আসার যুক্তি তুলে ধরা হয়। ওই সভার কার্যবিবরণীতে অন্তত সাতটি সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ আছে। এক, রাজস্ব বাজেট ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় কাজের ডুপ্লিকেশন ও ওভারল্যাপিং হয়। দুই, স্থায়ী কাজ বাধাগ্রস্ত হতে দেখা গেছে উন্নয়ন বাজেটের কারণে। তিন, ২৬ বছর চলার পরও স্বাস্থ্য খাতে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক স্থায়ী কাঠামো গড়ে ওঠেনি। চার. পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়েছে ও শূন্য পদ পূরণের উদ্যোগ অনুভূত হয়নি। পাঁচ, দাতা সংস্থার অর্থায়নে অনেকে বেতন পায় বলে বেতনবৈষম্য তৈরি হয়েছে। ছয়, অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীনভাবে স্থাপনা তৈরি হলেও জনবল তৈরি ও সেবা চালু হয়নি। সাত, অনেক ক্ষেত্রে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।
বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, ইউএসএআইডি, জাইকা, ডিফিডসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা সেক্টর কর্মসূচিতে যুক্ত ছিল। বেশ কিছু দেশের দূতাবাস ছোট–বড় প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। এ ছাড়া দেশের অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গবেষণা সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় সেক্টর কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত ছিল। এদের কারও সঙ্গে আলোচনা না করে সরকার কর্মসূচি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি দাতা সংস্থার প্রতিনিধি ২৬ নভেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এতকাল দাতাদের অর্থে, পরামর্শে চলেছে। এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দাতা সংস্থা, এমনকি দেশের জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতবিনিময়েরও প্রয়োজন বোধ করল না। এটা দুঃখজনক।’
ঢাকার আজিমপুরের এই শিশু বিকাশ কেন্দ্র আগে থেকে ধুঁকছিল। এখন টিকে থাকা নিয়েই সংশয়