জুলাইয়ে কোনো যুদ্ধ হয়নি তাই এ আইনে বিচার হয় না
Published: 7th, July 2025 GMT
জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ আগামী বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ উভয় পক্ষের শুনানি শেষে গতকাল সোমবার এ তারিখ দেন।
এ মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পলাতক আসাদুজ্জামান খান কামাল ও কারাগারে থাকা সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। পলাতক দুই আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত (স্টেট ডিফেন্স) আইনজীবী আমির হোসেন লিখিতভাবে প্রসিকিউশনের বক্তব্য খণ্ডন করেন। এ সময় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে গত ১ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পক্ষে ৫টি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
অভিযোগ গঠন বিষয়ে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তারা নির্দোষ।
শুনানিতে আমির হোসেন বলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করা হয়েছিল। সে সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী নানা অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ করা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে অভ্যুত্থানের সময় দেশে কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। সেটি ছিল রাজনৈতিক বিরোধ। তাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১৯৭৩ এর আইনে যুদ্ধ ছাড়া জুলাইয়ের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার কোনো সুযোগ নেই। নতুন কোনো অধ্যাদেশ বা অন্য কোনো প্রচলিত আইনে আসামিদের বিচার করা যেতে পারে।
আমির হোসেন ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে বলেন, ২০০৯ সাল থেকে চলতি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ সময় তিনি ঐতিহাসিক পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত ছিলেন। শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত কোটা আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার কোনো আদেশ বা নির্দেশ দেননি। দেশ পরিচালনায় তাঁর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলায় সুপিরিয়র রেসপনসিবলিটির (সর্বোচ্চ দায়) অভিযোগ আনা হয়েছে।
আমির হোসেন ট্রাইব্যুনালকে বলেন, জুলাই আন্দোলনের সময় মেট্রোরেল, বিটিভি ভবন, কেপিআইভুক্তসহ যেসব স্থাপনায় হামলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। এসব স্থাপনায় হামলা ও ধ্বংসের কারণে তিনি তখন বিমর্ষ ও ব্যথিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শনেও গিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগ মনগড়া। তিনি বলেন, আসাদুজ্জামান খানও সুনামের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এই দুই আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ উদ্দেশ্যমূলক, মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।
শুনানিতে আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, গত বছর ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেননি। তাঁর বক্তব্যের অপব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বলে তিনি নিজেই তখন বলেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে তিনি এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন মাত্র।
আমির হোসেন ট্রাইব্যুনালকে বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনকারীদের লাশ কবর দিতে বাধা, লাশে আগুন দেওয়া ও লাশ গুম করার নির্দেশদাতা হিসেবে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা ভিত্তিহীন ও মনগড়া। আন্দোলনকারীদের রাজাকার সম্বোধন করে তাদের ফাঁসি দেওয়ার হুমকিও শেখ হাসিনা দেননি। আমির হোসেন বলেন, প্রসিকিউশন এর কোনো দালিলিক প্রমাণ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করতে পারেনি।
আমির হোসেন আরও বলেন, গত বছরের ১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ মৃত্যুর ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্ররোচনা, সহায়তা ও ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা অসত্য ও ভিত্তিহীন। আবু সাঈদের মৃত্যুতে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। এমনকি তাঁর পরিবারকে ঢাকায় এনে শেখ হাসিনা সহানুভূতি জানিয়ে আর্থিক সাহায্য করেছিলেন।
আমির হোসেন ট্রাইব্যুনালে দাবি করেন, চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জনের লাশে আগুন দেওয়ার ঘটনা শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর ঘটেছে। ওইদিন সকালে তিনি দেশ ছেড়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগও ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক।
গণঅভ্যুত্থানের পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ডের যে অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে, সেটিকে মিথ্যা দাবি করে আমির হোসেন বলেন, ওই সময় এবং সরকার পতনের পরে দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা চালানো হয়েছে, থানা লুট করা হয়েছে। এমনকি সারাদেশে অসংখ্য পুলিশ হত্যা করা হয়েছে। সে সবের কোনে বিচার হয়নি।
গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে শুনানিতে এই আইনজীবী বলেন, আন্দোলনের সময় পুলিশ মানুষের জানমাল রক্ষার স্বার্থে দায়িত্ব পালন করেছে। তিনি বলেন, দেশে-বিদেশে বিভিন্ন আন্দোলনে বহু মানুষের হতাহত হওয়ার নজির আছে। এর জন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে কোনো দেশ বিচার করেছে, এমন নজির নেই।
আমির হোসেন বলেন, শুধু একটি বিশেষ বাহিনীর সদস্য ও প্রধান ছাড়া রাষ্ট্রের আর কোনো বাহিনীর সদস্য কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাউকে এই মামলায় আসামি করা হয়নি। ফলে পদ্ধতিগত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, একপেশে ও মনগড়া।
রাষ্ট্রনিযুক্ত এই আইনজীবী বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রাথমিক উপাদান পাওয়া যায়নি। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান অব্যাহতি পাওয়ার হকদার। তাই ন্যায় বিচারের স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ না করে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক।
মামলার অপর আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ট্রাইব্যুনালে হাজির থাকলেও তাঁর আইনজীবী জায়েদ বিন আজাদ জানান, অভিযোগ গঠন বিষয়ে তিনি শুনানি করবেন না। এরপর প্রসিকিউশন পক্ষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে রাখেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের শুনানির পর অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশের জন্য বৃহস্পতিবার দিন রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আস দ জ জ ম ন খ ন ম নবত ব র ধ ন র সময় অপর ধ র আইনজ ব ই আস ম
এছাড়াও পড়ুন:
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাবাকে হত্যায় ছেলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে বাবাকে হত্যার দায়ে ছেলে জসিম মিয়াকে (৪৩) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এর পাশাপাশি তাকে ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরো এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
বুধবার (১৫ অক্টোবর) বেলা ১১টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা ও দায়রা জজ মো. শহিদুল ইসলাম এ রায় ঘোষণা করেন।
আরো পড়ুন:
ভারতীয় ভ্যাকসিন-বীজ বিক্রি করায় ৪ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা
শেরপুরে বালু উত্তোলন: ৯ জনকে কারাদণ্ড
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট দুপুরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের জিনোদপুর ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামে পাট কাটা নিয়ে লিল মিয়ার (৭৫) সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয় তার ছেলে জসিম উদ্দিনের। একপর্যায়ে ঘর থেকে কাঠ নিয়ে এসে বাবার মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করেন জসিম উদ্দিন। এতে রক্তাক্ত হয়ে বৃদ্ধ লিল মিয়া মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী মমতাজ বেগম বাদী হয়ে নবীনগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করলে জসিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ জসিম উদ্দিনকে দায়ী করে ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। একই বছরের ২৭ আগস্ট একমাত্র আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নেওয়া হয় এবং ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর তার বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩০২/৩২৩ ধারায় চার্জ গঠন করা হয়। সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তি-তর্ক শেষে আজ আদালত জসিমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরো এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফখরুদ্দিন খান সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, এ রায়ের মাধ্যমে বাদী ন্যায়বিচার পেয়েছেন।
তবে, আসামিপক্ষের আইনজীবী নাজমুল হক রিটন বলেছেন, এ রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। উচ্চ আদালতে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।
ঢাকা/পলাশ/রফিক