এবার আনিস-হাওলাদারকে অব্যাহতি, নেতাকর্মীদের ক্ষোভ
Published: 7th, July 2025 GMT
দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে অব্যাহতি দেওয়ার খবর প্রকাশ করেছে জাতীয় পার্টি। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতির ঘটনার মধ্যেই এ খবর পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নেতাকর্মীরা।
সোমবার (৭ জুলাই) বিকেলে পৃথক এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ অব্যাহতির বিষয়টি জানানো হয়।
গত ২৮ জুন প্রেসিডিয়াম সভায় এই তিন নেতাকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে পার্টির প্রাথমিক সদস্যসহ সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হলেও আজ সোমবার এ খবর প্রকাশ করেছে দলটি। এতদিন বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছিল। প্রেসিডিয়াম সভার সিদ্ধান্ত কি কারণে এতদিন গোপন রাখা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দলে এভাবে গঠনতন্ত্রের দোহাই দিয়ে অগণতান্ত্রিক বহিষ্কারের ঘটনায় নেতাকর্মীরা ক্ষোভ জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “দলে গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য গঠনতন্ত্রের স্বৈরাচারী ধারা সংশোধনের দাবি তোলায় বলী হয়েছেন এসব শীর্ষনেতা। ওই বিশেষ ধারায় তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।”
নেতাকর্মীদের দাবি, দলে গণতন্ত্র নেই। যখন ইচ্ছা বহিষ্কার আবিষ্কারের ঘটনা চলছে। কোনো জবাবদিহিতা নেই। জবাবদিহিতা চাইতে গেলে হেনস্থা, এমনকি দল থেকে বহিষ্কার হতে হয়। যার সর্বশেষ প্রমাণ দলের দুই কো-চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বহিষ্কার। দল সবার মতামতে চলবে, কিন্তু এখন দল চলছে এক ব্যক্তির মর্জিতে। এভাবে দল চলতে থাকলে একদিন জাতীয় পার্টি মুসলিম লীগে পরিণত হবে।
সোমবার দলের দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় পার্টির গত ২৫ জুন জেলা/মহানগরের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক/আহ্বায়ক, সদস্য সচিবদের মতবিনিময় সভায় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো- চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, কো-চেয়ারম্যান ও মহাসচিব মো.
গত ২৮ জুন দলের প্রেসিডিয়াম সভায়ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ওই তিন নেতাকে দলীয় সব পদ-পদবী থেকে অব্যাহতি প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এমতাবস্থায় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের, গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এবং কো-চেয়ারম্যান ও মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুকে প্রাথমিক সদস্যসহ দলীয় সব পদ-পদবী থেকে অব্যাহতি প্রদান করেছেন। এ আদেশ ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।
এর আগে, পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দিয়ে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে জাতীয় পার্টির নতুন মহাসচিব নিযুক্ত করা হয়েছে। সোমবার জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ নিয়োগ দেন বলে দলের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে, বর্তমান মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে দলের বৈধ মহাসচিব দাবি করে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীর মহাসচিব নিয়োগ দলীয় চেয়ারম্যান জিএম কাদের কর্তৃক চরম অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক এবং গঠনতন্ত্রের সরাসরি লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছেন দলটির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার।
সোমবার বিকেলে চুন্নুকে বাদ দিয়ে পাটোয়ারীকে নতুন মহাসচিব নিয়োগের এক প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমে পাঠানো এক যৌথ বিবৃতিতে তারা একথা বলেন।
তারা বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নুই জাতীয় পার্টির বৈধ ও সম্মানিত মহাসচিব। ঘোষিত কাউন্সিলের আগে চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তে কোনো নিয়োগ বা বহিষ্কার কার্যকর নয়। জাতীয় পার্টির বর্তমান মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নুকে কোনো কারণ ছাড়াই অব্যাহতি দিয়ে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে একক সিদ্ধান্তে মহাসচিব নিয়োগ চরম অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক এবং গঠনতন্ত্রের সরাসরি লঙ্ঘন। এটি একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ, যা পার্টির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
তারা বলেন, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইতোমধ্যে জাতীয় কাউন্সিল ঘোষিত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোনো প্রকার নিয়োগ, অব্যাহতি বা বহিষ্কার সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধ। এই ধরনের সিদ্ধান্ত দলের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে ফেলছে।
তারা আরো বলেন, আমরা বিস্মিত যে, দায়িত্বশীল প্রেসিডিয়াম সদস্যদের নিয়মিত চাঁদা প্রদান সত্ত্বেও মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে যেভাবে অব্যাহতির চিঠি প্রদান করা হয়েছে, তা শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, বরং নীতিহীন ও সম্মানহানিকর আচরণ।
তারা জাতীয় পার্টিকে ব্যক্তি নয়, গঠনতন্ত্র ও আদর্শে পরিচালিত হওয়ার দাবি জানান।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/মেহেদী
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম জ ব ল হক চ ন ন ক গঠনতন ত র ন ত কর ম অব য হ প রক শ সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনী আচরণবিধিতে এআই নিয়ে কথা নেই কেন
গত সপ্তাহে নির্বাচন কমিশন ‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা ২০২৫’–এর খসড়া প্রকাশ করে ১০ জুলাইয়ের মধ্যে এ বিষয়ে নাগরিকদের মতামত আহ্বান করেছে। নির্বাচনের প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই আচরণবিধি, যা প্রতিযোগিতার মাঠকে সবার জন্য সমান করতে প্রয়োজন।
আচরণবিধিতে খুব বেশি নতুনত্ব নেই, যদিও কিছু পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপের ওপর বাড়তি গুরুত্ব নজরে পড়ে। নির্বাচনী প্রচারে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের প্রসঙ্গ শেষ মুহূর্তের সংযোজন না হলেও খুব সুচিন্তিত নয়।
সবচেয়ে বিস্ময়ের কথা, এই আচরণবিধিতে এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়ে স্পষ্ট করে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। কিংবা কমিশনের তরফ থেকে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তার কোনো ধারণা মেলে না।
অথচ বিশ্বের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোয় এআইয়ের অপব্যবহার বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে। আচরণবিধির অন্যান্য বিষয়ে কিছু বলার আগে তাই এআইয়ের সম্ভাব্য অপব্যবহারের ঝুঁকির কথাই বলা দরকার।
২.
গত ২ জুন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার আন্তর্জাতিক সংস্করণে ইতিমধ্যেই ৫০টি দেশের নির্বাচনে এআই কী ধরনের হুমকি তৈরি করেছিল, তা উল্লেখ করে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
‘এআই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে শুরু করেছে’ (এআই কনটেন্ট ইজ স্টার্টিং টু ওয়ার ডাউন ডেমোক্র্যাসি) শিরোনামের এ প্রতিবেদনে সর্বসাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত হিসেবে কানাডার নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নিকে শিশু যৌননিপীড়ক জেফরি এপস্টেইনের সঙ্গে সুইমিংপুলে একসঙ্গে সাঁতার কাটার বানোয়াট ছবি এক্স (সাবেক টুইটার) প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে পড়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
মার্ক কার্নির বিরুদ্ধে এ অপপ্রচার কাজে আসেনি। কিন্তু রোমানিয়ায় গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এআইয়ের অপব্যবহার ঘটেছিল দেশটির বাইরে রাশিয়ার একটি নেটওয়ার্ক থেকে এবং শেষ পর্যন্ত আদালত সেই নির্বাচন বাতিল করে দেন।
এরপর দেশটিকে গত মার্চে নতুন করে নির্বাচন আয়োজন করতে হয় এবং আগের নির্বাচনের বিজয়ী আর প্রার্থী হতে পারেননি। এআইয়ের অপব্যবহারের কারণে নির্বাচন বাতিল হওয়ার ঘটনা বিশ্বে এটিই প্রথম হলেও শেষ যে নয়, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই।
৩.
২০২৪ সাল ছিল বিশ্বজুড়ে নির্বাচনের বছর। প্রায় ২০০ কোটি মানুষ গত বছর তাঁদের ভোটাধিকারচর্চার সুযোগ পেয়েছিলেন। সুইজারল্যান্ডের একটি স্বাধীন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল অন দ্য ইনফরমেশন এনভায়রনমেন্ট’ তাদের গবেষণার ভিত্তিতে বলেছে, এসব নির্বাচনের ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে এআই ব্যবহৃত হয়েছে। তবে তার সবটাই যে নেতিবাচক বা ক্ষতিকর, তা নয়।
জরিপে তারা দেখেছে, ২৫ শতাংশ এআইয়ের ব্যবহার প্রার্থীরা স্বচ্ছতার সঙ্গে করেছেন মূলত বিশেষ বিশেষ জনগোষ্ঠীর কাছে তাঁদের বক্তৃতা-বিবৃতি স্থানীয় ভাষা ও উচ্চারণরীতি অনুযায়ী ভাষান্তরের জন্য। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীর অনিষ্ট করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টাই হচ্ছে প্রধান প্রবণতা।
এআইকে হাতিয়ার হিসেবে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারে আমরাও যে পিছিয়ে নেই, তা স্থানীয় বিশেষজ্ঞ ও গবেষকেরা ইতিমধ্যেই চিহ্নিত করে তুলে ধরেছেন।
গত ৩০ জুন ডিসমিসল্যাব তাদের যে গবেষণার ফল প্রকাশ করেছে, তা খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের। ১৮ থেকে ২৮ জুন, মাত্র ১০ দিনে ফেসবুকের বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপ থেকে ৭০টি ভিডিও সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে তারা নিশ্চিত হয়েছে, এগুলো এআই দিয়ে তৈরি।
এসব রাজনৈতিক প্রচারমূলক ভিডিও বিশ্লেষণে তারা দেখেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উল্লেখ করা হয়নি যে এগুলো এআই দিয়ে তৈরি। ভিডিওগুলো অনেকটা নিখুঁত। ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাবের কারণে এসব ভিডিওতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তাই প্রবল।
ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণ করা ভিডিওগুলো ২ কোটি ৩০ লাখের বেশিবার দেখা হয়েছে (ভিউ)। ভিডিওগুলোয় ব্যবহারকারীরা রিঅ্যাকশন (প্রতিক্রিয়া) দিয়েছেন ১০ লাখের বেশি।
ডিসমিসল্যাব তাদের গবেষণায় বলছে, প্রতিটি ভিডিও গড়ে প্রায় ৩ লাখ ২৮ হাজারবার দেখা হয়েছে এবং গড়ে ১৭ হাজার রিঅ্যাকশন পেয়েছে, যা এসব আধেয়র (কনটেন্ট) বিস্তার ও প্রভাব সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়।
ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি, ইসলামী আন্দোলন—কেউই এ থেকে পিছিয়ে নেই। এআই ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা, এর জন্য বেশি জনশক্তির প্রয়োজন নেই, দরকার প্রযুক্তিজ্ঞানের অধিকারী কিছু সৃজনশীল কর্মী ও বিনিয়োগ।
গোপনে বা প্রবাস থেকে কার্যক্রম পরিচালনাকারী আওয়ামী লীগও এ কাজে পিছিয়ে নেই। ভবিষ্যতে যে তা আরও বাড়বে, সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। কেননা ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পরপর তাদের নেতা–কর্মী ও সমর্থকদের একটি বড় অংশ পালিয়ে প্রতিবেশী ভারত ও ইউরোপ-আমেরিকায় আশ্রয় নিয়েছে। রাজনৈতিক প্রচারণায় প্রযুক্তির ব্যবহারে ভারত, বিশেষ করে শাসক দল বিজেপি অনেক দিন ধরেই এগিয়ে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগের তৎপরতা যে বহুগুণে বাড়বে, তা সহজেই অনুমেয়।
৪.
গণতন্ত্রে ‘নির্বাচন’ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ, যখন ভোটার সজ্ঞানে তাঁর পছন্দ বেছে নিতে পারেন। কিন্তু তাঁকে যদি বিভ্রান্ত করা যায়, তাহলে তা আর জেনেশুনে বাছাই হবে না, হবে গুরুতর ভুল।
মনে হতে পারে, পাশ্চাত্যের দেশগুলো যেখানে এআইয়ের বিপদ থেকে তাদের নির্বাচনব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমাদের আর কী করার আছে? উত্তর: আছে। আমাদেরও অনেক কিছু করার আছে। ঝুঁকি পুরোপুরি দূর করা না গেলেও অনেকটাই কমিয়ে আনা যাবে। নির্বাচন কমিশনকে তাই এখনই এ বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।
পোস্টার নিষিদ্ধ করা, ব্যানারের মাপ ঠিক করে দেওয়া কিংবা একরঙা প্রচারপত্রের বাধ্যবাধকতা নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় সমতা ও ন্যায্যতার জন্য জরুরি ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি জরুরি এআইয়ের অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও প্রতিপক্ষকে যেনতেনভাবে ঘায়েল করার অপচর্চা ঠেকানো।
আমরা আগের অন্তত দুটি নির্বাচনে দেখেছি, অন্তর্দলীয় কোন্দলেও প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ভুয়া আধেয় ছড়ানো হয়েছে। ভোটের আগের রাতে কণ্ঠ নকল করা অডিও ছড়িয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ভুয়া ঘোষণা প্রচার করা হয়েছে। এখন সেই বিপদ বহুগুণে বেড়েছে।
মেটা, গুগল, মাইক্রোসফট, এক্সসহ প্রায় সব বড় প্রযুক্তি কোম্পানি ও প্ল্যাটফর্ম নিত্যনতুন সুবিধাসহ গ্রাহকবান্ধব এআই টুলস সহজলভ্য করে চলেছে। ডিপফেক ভিডিও তৈরি এখন এতটাই সহজ হয়েছে যে প্রার্থী ও দলগুলোকে এখন সারাক্ষণ আতঙ্কে কাটাতে হবে।
৫.
এআই ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু অপব্যবহার রুখতেই হবে, অন্তত সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। প্রার্থী বা দলের পক্ষে ইতিবাচক বা প্রতিপক্ষের জন্য নেতিবাচক প্রচারের লক্ষ্যে দেশের ভেতরে ও বাইরে যে কেউ এআই ব্যবহার করলে, তার স্পষ্ট ঘোষণা সেই কনটেন্টে থাকতে হবে, না হলে প্রার্থী ও দলকে এর জন্য দায় নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা দরকার।
প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার, অপপ্রচার, কুৎসা কিংবা মানহানিকর কিছু করা হলে তা নির্বাচনী অপরাধ হিসেবে গণ্য করে তার তাৎক্ষণিক সাজার বিধান রাখা প্রয়োজন।
এসব অপরাধ চিহ্নিত করায় কমিশনের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন এত অল্প সময়ে সম্ভব নাও হতে পারে, এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে কমিশনের উচিত হবে প্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়া।
দেশে যাঁরা প্রযুক্তি খাতের ভালো–মন্দ নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের একত্র করে একটি সমন্বিত কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সে জন্য প্রবাসী প্রযুক্তিবিদদের সাময়িক সময়ের জন্য দেশে এনে অথবা দূরযোগাযোগের মাধ্যমে কাজে লাগানোর উদ্যোগ এখনই নেওয়া উচিত।
বড় প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোর সহযোগিতাও এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে যেমন বিশেষ উদ্যোগ নিতে বলা যায়, তেমনি কমিশন নিজেও উদ্যোগী হয়ে এসব কোম্পানির প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে।
ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটা, এক্স, মাইক্রোসফট, গুগল, ইউটিউব—এদের সবারই অপতথ্য, ভুয়া তথ্য বা কুতথ্য প্রচার ঠেকানো বা অপসারণের অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু তারা যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় তা প্রতিপালনে অনেকাংশেই ব্যর্থ হচ্ছে, সেটা আমরা প্রতিনিয়তই প্রত্যক্ষ করছি।
কিন্তু উন্নত ও ধনী দেশগুলোর মতো তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত কিংবা জরিমানার মতো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি প্রধানত আমাদের দুর্বলতার কারণে। এখন তা কাটিয়ে উঠতে হবে।
৬.
গত বছর ওপেনএআইয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে তারা রুয়ান্ডা, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা কীভাবে ব্যর্থ করে দিয়েছে, তার ওপর আলোকপাত করেছে।
গত বছরের মে মাসে ইসরায়েলি একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি ভারতের নির্বাচন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া মন্তব্য উৎপাদনের চেষ্টা করলে ওপেনএআই কীভাবে তা নস্যাৎ করে দিয়েছিল, সে কথাও তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে। জিরো-জিনো নামে ওপেনএআই ওই অপারেশন চালিয়েছিল।
বহুজাতিক প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোর কাছ থেকে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের জন্য সহযোগিতা আদায় করা তাই একেবারে দুঃসাধ্য কিছু নয়।
এআইয়ের অপব্যবহার যদি আমাদের গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের ধারাকে বিভ্রান্তির গহ্বরে ঠেলে দিয়ে ভবিষ্যৎকে আরও অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়, তাহলে তার দায় কিন্তু নির্বাচন কমিশনকেও বহন করতে হবে।
৭.
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের বিষয়েও নীতিমালাটি অসম্পূর্ণ। মনে রাখা দরকার, সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপনের একটা বড় অংশ প্রবাসীদের পক্ষ থেকে হতে পারে, আবার বিদেশি রাষ্ট্র বা কোনো প্রতিষ্ঠানও করতে পারে।
সুতরাং সেগুলো নিয়ন্ত্রণের উপায়ও উদ্ভাবনের কথা ভাবা দরকার। আর নির্বাচনী ব্যয়ের সবটাই ব্যাংকিং মাধ্যমে করা বাধ্যতামূলক করা উচিত, যাতে তা খুঁজে বের করা ও তার নিরীক্ষা সম্ভব হয়, না হলে কালোটাকার ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না।
কামাল আহমেদ সাংবাদিক
মতামত লেখকের নিজস্ব