ভূমিকা

জালালউদ্দিন রুমির (১২০৭–১২৭৩) জন্ম তৎকালীন পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন বলখ শহরে, যার বর্তমান অবস্থান আফগানিস্তানে। পরে তিনি ১২ বছর বয়সে তাঁর পিতার সঙ্গে পালিয়ে আসেন দক্ষিণ তুরস্কের কোনিয়া শহরে। ১২৩১ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত তাঁর পিতা তুরস্কের একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। ইরান, আফগানিস্তান আর তুরস্ক—এই তিন দেশই তাঁকে তাঁদের কবি বলে মনে করে। পুরো নাম মাওলানা জালালউদ্দিন মোহাম্মদ রুমি বলখি। জালালউদ্দিন রুমিও বাবার মতো শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নেন। বেশ প্রাচুর্যময় পরিবারে তাঁর জন্ম।

শামস তাবরিজি নামের এক ভবঘুরে দরবেশের সঙ্গে রুমির পরিচয় হয়। তিনি তাঁর কাছে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করেন। একদিন তিনি ও শামস তাবরিজি একটি ঘরে আধ্যাত্মিক আলোচনায় থাকাকালীন পেছন দরজা থেকে তাঁর (শামস তাবরিজি) ডাক আসে এবং তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর আর কখনোই ফিরে আসেননি। তাঁকে আর খুঁজেও পাওয়া যায়নি। কথিত আছে, কবির ছেলে আলাউদ্দিনের ইঙ্গিতে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি সিরিয়ায় লেখাপড়া করেন এবং নানা বিষয়ে প্রচুর জ্ঞানার্জন করেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের সমস্ত শাখায় তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল।

রুমি এখন সারা পৃথিবীতে মানুষের কাছে এক অন্য রকম জনপ্রিয় নাম। রুমির কবিতা আমেরিকায় বেস্ট সেলার। সৌদি আরব ছাড়া সারা দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ তাঁর বই কিনে পড়ে। মানবিক দর্শনের বাণী তিনি উচ্চারণ করেছেন সাবলীল ভঙ্গিমায়। তিনি সুফিবাদী কবি ছিলেন। সুফিবাদের মর্মকথাকে তিনি বিকশিত করেছিলেন তাঁর উন্নত ধ্যানধারণায়। সব ধর্মের মানুষকে সমান চোখে দেখতেন। তিনি বলতেন, আমার ধর্ম হলো ভালোবাসা। তাঁর বিপুল প্রতিভার স্বাক্ষর তাঁর ছয় খণ্ডে প্রকাশিত মরমি এপিক ‘মসনভি’।

জালালউদ্দিন রুমির কবিতাগুচ্ছ

কলস এবং তার শুকনো প্রান্ত

মন এক সমুদ্র.

..আমি এবং পৃথিবীর অনেক কিছু
সেখানে গড়ে যাচ্ছে, যা রহস্যময়, অস্পষ্টভাবে দেখা যায়!
আর আমাদের শরীর? আমাদের শরীর একটা কাপ—
সমুদ্রের ওপরে ভাসছে; অতি দ্রুতই এটা ভরে যাবে জলে
এবং ডুবে যাবে...
এটা জলের এতটাই নিচে চলে যাবে যে এমনকি একটি
বুদ্বুদও দেখা যাবে না।

আত্মা এতটাই নিকটে যে তুমি তা দেখতে পাও না!
কিন্তু এটার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করো...সেই কলস হয়ো না,
যা পানিতে পূর্ণ, যার কিনার সর্বদা শুকনো।
সেই অশ্বারোহী হয়ো না যে দ্রুতগতিতে ঘোড়া চালায় সারা রাত,
কিন্তু যে ঘোড়ার পিঠে সে সওয়ার, তাকে কখনোই দেখে না।

[ইংরেজি অনুবাদ: রবার্ট ব্লাই]

অন্ধকার খোঁজ

বন্ধুদের সাথে বসো; ঘুমাতে যেয়ো না।
মাছের মতো সমুদ্রের তলদেশে ডুব দিয়ো না।

সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস হও,
ঝড়ের মতো নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ো না।

জীবনের জলরাশি অন্ধকার থেকে উৎসারিত।
অন্ধকার খোঁজো, এর থেকে দৌড়ে পালিয়ো না।

রাতের অভিযাত্রীরা আলোতে পূর্ণ থাকে,
এবং তুমিও তা–ই; এই সঙ্গ ছেড়ো না।

সোনালি থালায় সদা জাগ্রত মোমবাতি হও,
নোংরার ভেতরে গলে পোড়ো না পারদের মতো।

চাঁদ উদিত হয় রাতের অভিযাত্রীদের জন্য,
চাঁদ পূর্ণ হলে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দাও।

[ইংরেজি অনুবাদ: কবির হেলমিনস্কি]

ভালোবাসা অনেকটা মকদ্দমার মতো

শুদ্ধতার জন্য ব্যাকুল কাউকে দেখে আমি বিস্ময়াভিভূত হই
যখন তার ঘষেমেজে চকচকে হবার কথা,
তখন সে অভিযোগ করে অদক্ষ পরিচালনার।
ভালোবাসা অনেকটা মকদ্দমার মতো:
কঠোর ব্যবহার সহ্য করার নাম হলো সাক্ষ্য;
যখন তোমার কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকবে না,
তুমি মামলায় হেরে যাবে।
যখন বিচারক তোমার সাক্ষ্যপ্রমাণ দাবি করবে দুঃখ করো না;
সাপের গালে চুমো দাও যেন তুমি ধন–রত্ন লাভ করতে পারো।
ওই কঠোরতা তোমার জন্য নয়,
তোমার ভেতরের ক্ষতিকর গুণাবলির জন্য।
যখন কেউ একটি কার্পেটে বারবার আঘাত করে
এই আঘাতগুলো কার্পেটে করে নয়,
করে ওই কার্পেটের ভেতরের ধুলাবালুকে।

[ইংরেজি অনুবাদ: কবির হেলমিনস্কি ও ক্যামিলি হেলমিনস্কি]

পরিপক্ব ফল

পৃথিবী একটা গাছের মতো, যেখানে আমরা ঝুলে আছি—
আমরা এখানে অর্ধপাকা ফলের মতো।
অপরিপক্ব ফল ডালের সাথে লেগে আছে শক্তভাবে
কারণ, এটা এখনো পাকেনি, এটা প্রসাদের জন্য অযোগ্য।
যখন ফলগুলো পরিপক্ব, মিষ্টি ও রসালো হবে,
তখন তারা তাদের ঠোঁট কামড়ে বাঁধন ঢিলা করে ফেলে।
মুখ মিষ্ট হয়ে উঠলে
পৃথিবী হারায় তার আবেদন।
পৃথিবীর সাথে শক্তভাবে লেগে থাকা হলো অপরিপক্বতা;
তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত একটি ভ্রূণ,
তোমার কাজ হলো রক্ত পান করা।

[ইংরেজি অনুবাদ: কবির হেলমিনস্কি ও ক্যামিলি হেলমিনস্কি]

বুদ্ধিজীবী

বুদ্ধিজীবী সব সময় নিজেকে জাহির করে;
প্রেমিক সব সময় সরিয়ে রাখে নিজেকে।
বুদ্ধিজীবী ডুবে যাওয়ার ভয়ে দৌড়ে পালায়
ভালোবাসার মূল কাজ সমুদ্রে ডুবে যাওয়া
বুদ্ধিজীবীরা বিশ্রামের পরিকল্পনা করে
প্রেমিকেরা বিশ্রামে লজ্জিত।
এমনকি মানুষের ভিড়ের মধ্যেও একজন প্রেমিক সব সময় একা;
জল ও তেলের মতো সে আলাদা থাকে।
যে মানুষ কোনো প্রেমিককে উপদেশ দেওয়ার মতো কষ্টসাধ্য কাজ করে,
সে কিছুই পায় না। সে আসক্তি দ্বারা উপহাসিত।
ভালোবাসা হলো কস্তুরির মতো। এটা মানুষকে আকৃষ্ট করে।
ভালোবাসা হলো বৃক্ষ আর প্রেমিকেরা এর ছায়া।

[ইংরেজি অনুবাদ: কবির হেলমিনস্কি]

লোভ ও উদারতা

তার মুখের দিকে তাকাও।
তার চোখের গভীরে তোমার চোখ উন্মুক্ত করো।
যখন সে হাসে, সবাই তার প্রেমে পড়ে যায়।
টেবিল থেকে তোমার মাথা ওপরে তোলো। দেখো,
এই বাগানের কোনো প্রান্ত নেই।
মিষ্টি মিষ্টি ফলের সমাহার, তোমার মনে যা যা আসে সব ধরনের,
ডালগুলো সবুজ এবং মৃদুভাবে দুলছে

ধরিত্রীর মুখের দিকে তোমার কতক্ষণ তাকিয়ে থাকা উচিত?
ফিরে এসো এবং আবার তাকাও।
এখন তুমি গাছগাছালি ও জন্তু-জানোয়ারদের গভীর অতলে
দেখতে পাবে স্নায়বিক লালসা। এখন তুমি দেখতে পাবে
নিরবচ্ছিন্নভাবে তারা নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে।

লালসা ও উদারতা হলো ভালোবাসার সাক্ষ্য।
তুমি যদি ভালোবাসা কী তা দেখতে না পারো,
এর পরিণতি দেখো।
যদি তুমি প্রত্যেক বস্তুতে ভালোবাসার রং দেখতে না পাও,
তাহলে ক্লান্ত মলিন প্রেমিকের মুখ খোঁজো।

এই শহরের সমস্ত দোকানপাট, লোকজন
যারা চারদিকে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে,
যাদের সাথে অনেক টাকা আছে কিংবা যাদের সাথে কিছুই নেই—
সবাইকে সাথে নাও।

[ইংরেজি অনুবাদ: জন ময়নে ও কোলম্যান বার্কস]

আঙুরগুলো যখন মদে রূপান্তরিত হয়

যখন আঙুরগুলো মদে রূপান্তরিত হয়
তারা আকাঙ্ক্ষা করে যে আমাদের সামর্থ্যেরও পরিবর্তন হোক।

যখন তারকারা উত্তর গোলার্ধে আবর্তন করে,
তারা আমাদের সচেতনা বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা করে।

মদও আমাদের সাথে মাতাল হয়,
অন্যভাবে নয়।
শরীর বিকশিত হয় আমাদের থেকে, আমরা শরীর থেকে নই।

আমরা মৌমাছির মতো,
এবং আমাদের শরীর একটি মৌচাক।
আমরা তৈরি করেছিলাম শরীর,
কোষের পর কোষ দিয়ে আমরা তা তৈরি করেছিলাম।

[ইংরেজি অনুবাদ: রবার্ট ব্লাই]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ ল লউদ দ ন উদ দ ন র আম দ র অন ব দ র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

‘সব দলই ভারতকে হারাতে পারে, বাংলাদেশেরও বিশ্বাস আছে’

‘আপনি তাহলে ফাইনালের পরই হাসবেন?’—প্রশ্নটা শুনে ইতিবাচক উত্তরই দিলেন ফিল সিমন্স। কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস, মুখে একটু মুচকি হাসি।

বাংলাদেশ দলের প্রধান কোচ যে একেবারেই হাসেন না, তা নয়। তবে মাঠে তাঁর মুখ বেশির ভাগ সময়ই থাকে গম্ভীর।

শ্রীলঙ্কাকে হারানোর পরও ছিলেন একই রকম। নির্লিপ্ত সেই চেহারার ছবিটা ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আগামীকাল ভারতের বিপক্ষে সুপার ফোরে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে মাঠে নামবে বাংলাদেশ। এই ম্যাচের আগে আজ সংবাদ সম্মেলনে আসা সিমন্সের কাছেই সেই প্রসঙ্গ তোলা হয়।

সিমন্সের উত্তর শুনে বাংলাদেশের সমর্থকেরা স্বপ্ন দেখতে পারেন আরও বড় কিছুর, ‘আমি এমন একজন, যে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমরা শুধু শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচ জিততে আসিনি। আমরা এসেছি চ্যাম্পিয়ন হতে। বাদ পড়লে বা চ্যাম্পিয়ন হলে তখনই আবেগ দেখা যাবে। তবে এখন আমার কাজ ড্রেসিংরুমে সবার পা মাটিতে রাখা।’

গ্রুপ পর্বে রানার্সআপ হয়ে এলেও সুপার ফোরে দারুণ শুরু করেছে বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কাকে ৪ উইকেটে হারানোর পর এখন তাদের হাতছানি দিচ্ছে এশিয়া কাপের ফাইনাল। তবে দ্বিতীয় ম্যাচে কঠিন প্রতিপক্ষ ভারতের মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ। গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচেই জেতার পর সুপার ফোরেও তারা পাকিস্তানকে হারিয়েছে। ভারতকে কি হারানো সম্ভব?

সিমন্সের উত্তর, ‘সব দলেরই ভারতকে হারানোর সক্ষমতা আছে। খেলাটা হয় একটা নির্দিষ্ট দিনে। ভারত আগে কী করেছে, সেটা তখন কোনো কাজে আসে না। ম্যাচের দিন, ওই সাড়ে তিন ঘণ্টায় কী হলো—সেটাই আসল। আমরা আমাদের সেরাটা খেলব, ভারতের ভুলের অপেক্ষায় থাকব। এভাবেই ম্যাচ জেতা যায়।’

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল

সম্পর্কিত নিবন্ধ