কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান ওরফে তনু হত্যা মামলায় তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই। অথচ এ হত্যাকাণ্ডের ৯ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ২০ মার্চ। দীর্ঘ এ সময়ে ছয়বার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়েছে। কিন্তু এসব কর্মকর্তা কারা, কেন এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তা তদন্ত করে বের করতে পারেননি। এ কারণে ক্ষুব্ধ তনুর মা–বাবা, তাঁর পরিবারের সদস্য, সহপাঠীসহ কুমিল্লার সচেতন নাগরিক সমাজ।

তনুর পরিবারের সদস্যরা বলেন, ৯ বছরে চারটি তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন আর ছয়বার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন ছাড়া তদন্তে কোনো ধরনের অগ্রগতি দেখতে পাননি তাঁরা।

গতকাল বুধবার দুপুরে ক্ষোভের সঙ্গে তনুর মা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘তনুডা যহন আছিল, তহন আমরার জীবনডা আছিল চান্দের মতো। আর অহন আমরার জীবনডা পুরা আন্ধার (অন্ধকার)। আইজ ৯ বছর হইল আমার আদরের মাইয়াডা কবরে। খুনিরার চেহারা অহনো সামনে আইল না। বিচার কিতা পাইয়াম হেইডা বুইজ্জালাইসি। এই ৯ বছর খালি আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) পাল্টান ছাড়া আর কোনো কামই হইছে না। আমি সরকারের কাছে আইওদের বিচার আগে চাই। তাঁরার (তাঁদের) কারণে আমারা মাইয়ার খুনের বিচার হইতাছে না।’

এত দিন রাজনৈতিক সরকার ছিল। বিভিন্ন কারণে খুনিরা সামনে আসেনি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই।তনুর বাবা ইয়ার হোসেন

তনুর বাবা ইয়ার হোসেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী। চাকরির সুবাদে সেনানিবাসের কোয়ার্টারে পরিবার নিয়ে থাকেন। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের অদূরের জঙ্গল থেকে তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন তনুর বাবা কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনার শুরুতে প্রথমে থানা পুলিশ, পরে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এবং এরপর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দীর্ঘ সময় ধরে মামলাটি তদন্ত করেও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। শেষে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ২০২০ সালের ২১ অক্টোবর তনু হত্যা মামলার নথি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সদর দপ্তরে হস্তান্তর করে সিআইডি। প্রায় চার বছর মামলাটি তদন্ত করেন পিবিআই সদর দপ্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো.

মজিবুর রহমান। তিনিও তদন্ত শেষ না করে বদলি হয়ে গেছেন। সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে মামলাটির ষষ্ঠ তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছেন পিবিআই রাজধানীর কল্যাণপুর কার্যালয়ের পরিদর্শক মো. তরিকুল ইসলাম।

আমরা চেষ্টা করছি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে আসামিদের শনাক্ত করার। আমাদের তদন্তে কোনো অবহেলা নেই। যখন প্রয়োজন, তখন ভিকটিমের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। যোগাযোগ নেই, বিষয়টি সঠিক নয়।মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম

তনুর ভাই আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রায় সাত মাস হলো তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ওই কর্মকর্তা একবারও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। আমরাই তদন্ত কর্মকতা পরিবর্তনের তথ্য পেয়ে তাঁকে কল করেছি। প্রথমে কল রিসিভ করলেও বর্তমানে তিনি আমাদের কলও রিসিভ করেন না। আমার অসুস্থ মা ও বাবা তনুর জন্য কান্না করছে, কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত তদন্তের কোনো অগগ্রতি দেখছি না।’

মামলার তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আগের তদন্ত কর্মকর্তারা একাধিকবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। মামলার সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করছি। আমরা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছি। প্রক্রিয়াটি শেষ হলে আমরা আবারও ঘটনাস্থলে যাব। সেটি ঈদের আগেও হতে পারে, পরেও হতে পারে।’

তনুর মা ও ভাইয়ের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে আসামিদের শনাক্ত করার। আমাদের তদন্তে কোনো অবহেলা নেই। যখন প্রয়োজন, তখন ভিকটিমের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। যোগাযোগ নেই, বিষয়টি সঠিক নয়।’

মেয়ের খুনিদের বিচার না হলে মরেও শান্তি পাবেন না বলে জানান তনুর বাবা ইয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন রাজনৈতিক সরকার ছিল। বিভিন্ন কারণে খুনিরা সামনে আসেনি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র পর ব র র সদস য র তদন ত ক আম দ র ৯ বছর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

২২ ক্যাডার নিয়ে চলতেন স্বেচ্ছাসেবক দলের জিতু

বগুড়ায় মেয়েকে উত্ত্যক্ত ও বাবাকে খুনে অভিযুক্ত জিতু ইসলাম দলীয় প্রভাবে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। কথায় কথায় যাকে-তাকে অহেতুক মারধর করতেন। চলতেন ২২ জনের ক্যাডার বাহিনী নিয়ে। তারা সবাই নানা অপকর্মে জড়িত এবং একাধিক মামলার আসামি। তাঁর আয় চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসা থেকে। গতকাল রোববার এলাকায় গিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা যায়, জিতু ফুলবাড়ী কারিগরপাড়ার মৃত সেকেন্দার আলীর ছেলে। ২০০৩ সালে এলাকায় বালু ব্যবসা নিয়ে প্রতিপক্ষ রবিউল ইসলামকে খুন করেন। সেই মামলায় তাঁর ১৪ বছর সাজা হয়। সাজা খেটে তিন বছর আগে বের হন। এর পর এলাকায় গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। তাঁর বাহিনীতে যে ২২ জন সদস্য, তারা কেউ রাজনৈতিক দলের পদ-পদবিতে নেই। হত্যা মামলা ছাড়াও জিতুর বিরুদ্ধে একটি মাদক ও একটি ডাকাতির মামলা রয়েছে।

ফুলবাড়ীর এক মুদি দোকানি বলেন, জিতু মাঝেমধ্যে তাঁর দোকান থেকে বাকি নিতেন। দু’বছরে বাকির পরিমাণ প্রায় ৪৮ হাজার টাকা হয়। তখন একদিন টাকা চান। এ কারণে জিতু তাঁকে মারধর করে নাকে খত নেন।
বৃন্দাবন এলাকার আরেক ব্যবসায়ী বলেন, মাঝেমধ্যে জিতু তাঁর বাহিনী নিয়ে হাজির হতেন। মোটা অঙ্কের চাঁদা চাইতেন। চাঁদার কমপক্ষে অর্ধেক দিয়ে তবে নিস্তার পাওয়া যেত। এ ছাড়া ঈদে সেলামির নামে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হতো তাঁকে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী জানান, তাঁর কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা চান জিতু। না দেওয়ায় দোকানে ককটেল হামলা করেন। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় আগস্টের পর জিতু বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এলাকার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নিয়ে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। ছোট ভাই মিতুলও তাঁর বাহিনীর সদস্য।

জিতু গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের ১০১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সহসাধারণ সম্পাদকের পদ পান। সন্ত্রাসী হয়ে দলের পদ পাওয়ায় এলাকায় তাঁকে নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পদ পেয়ে তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

এলাকার এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘জিতুর কারণে আমরা মুখ খুলতে পারি না। সে চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার মাধ্যমে এলাকা অতিষ্ঠ করে তুলেছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি পেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। তার নির্যাতনের শিকার অর্ধশতের কম হবে না। তার বখাটেপনার কারণে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হতো না।’
এক বছর আগে থেকে ফুলবাড়ির পাশেই শহরের শিববাটি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকেন জিতু। সেই এলাকার বাসিন্দা রিকশাচালক শাকিল হোসেন। শাকিলের মেয়ে স্থানীয় ভান্ডারী সিটি বালিকা বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। এক মাস আগে ৫২ বছর বয়সী জিতু বিয়ের প্রস্তাব দেন শাকিলের মেয়েকে। বিষয়টি শাকিল জেনে রাগ করেন। জিতুর ওপর চড়াও হন। কিছুতে রাজি না হলে নানাভাবে নির্যাতন করতে থাকেন জিতু। তাঁর মেয়েকেও উত্ত্যক্ত করতেন। এরই এক পর্যায়ে শনিবার বিকেলে শাকিলকে পিটিয়ে খুন করেন জিতু ও তাঁর বাহিনী।
এ হত্যার ঘটনায় জিতুকে এক নম্বর আসামি করে ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে গতকাল রোববার বগুড়া সদর থানায় হত্যা মামলা করেছেন শাকিলের স্ত্রী মালেকা খাতুন। পুলিশ শনিবার রাতেই জিতু ও তাঁর সহযোগী মতি এবং বিপ্লবকে আটক করে।

সন্ত্রাসীকে দলের পদ দেওয়ার বিষয়ে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সরকার মুকুল বলেন, ‘আমি জানতাম না, সে দলের নাম ভাঙিয়ে এসব অপকর্ম করছে। আমরা তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছি।’ শনিবার রাতে স্বেচ্ছাসেবক দল কেন্দ্রীয় সভাপতি এস এম জিলানী ও সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসানের সই করা বিবৃতিতে জিতু ইসলামকে বহিষ্কার করা হয়। সেই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ জানানো হয়।

বগুড়া সদর থানার ওসি হাসান বাসির বলেন, ‘এ মামলার অন্য আসামিদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ফুলবাড়ী পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক জোবায়ের খান জানান, গতকাল জিতুসহ তিন আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মেহেদী হাসান পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এদিকে হত্যার প্রতিবাদ ও দোষীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম জেলা শাখা। গতকাল বিকেলে শহরের সাতমাথায় সংগঠনের সভাপতি অ্যাডভোকেট দিলরুবা নূরী এতে সভাপতিত্ব করেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ