এবার এপ্রিলে গরম কম ছিল, কারণ কী
সেকশন: পরিবেশ-বাংলাদেশ
ট্যাগ: তাপমাত্রা, গরম, তাপ্রবাহ, বিশেষ সংবাদ
মেটা: বাংলাদেশে সবচেয়ে তপ্ত মাস এপ্রিল। তবে এবারের এপ্রিলে তাপমাত্রা ছিল গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে কম।
একসার্পট: গতবারের এপ্রিলে যে ভয়াবহ তাপ বয়ে গেছে, এবারের এপ্রিলে সেই তাপ নেই। এবারের এপ্রিলে গড়ে তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম।
ছবি: April 25 (হিরো ইমেজ)
April 2024 (দ্বিতীয় ছবি)
পার্থ শঙ্কর সাহা, ঢাকা
‘রোদির ঠ্যালায় শরীলডা পুড়ে যাচ্চে। তারপরও দুটো পয়সার জন্নি পরিশ্রম কচ্চি। তবে ভয় কচ্চে ককন আবার জ্বর-টর শুরু হয়ে যায়।’
কৃষিশ্রমিক রতন আলী খেতে কাজ করতে করতে এ কথা বলেছিলেন। না, রতন আলী সাম্প্রতিক গরম নিয়ে এ কথা বলেননি। প্রথম আলোতে গত বছরের (২০২৪) ৩০ এপ্রিল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রতন আলী গরমে ওই কষ্টের কথা বলেছিলেন। ‘চুয়াডাঙ্গায় ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড’ শিরোনামে এ প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। রতন তখন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার হাজরাহাটি মাঠে খেতে কাজ করছিলেন।
গেল বছরের এপ্রিলে ‘শরীলডা পুড়ে যাওয়া’ এমন গরম নিয়ে প্রতিবেদনের অন্ত ছিল না। দেশের নানা প্রান্ত থেকে এমন প্রতিবেদন আসত। শুধু মাঠে কাজ করা এমন মানুষ নন; শিক্ষক, চিকিৎসক, শিক্ষার্থী, প্রকৌশলী, দিনমজুর ইত্যাদি নানা পেশার মানুষ তাঁদের কষ্টের কথা বলতেন। ওই মাসে গরমের একের পর এক রেকর্ড ভেঙে যাচ্ছিল। রেকর্ড ভাঙার তথ্য থাকত সরকারি দপ্তরের নথিতে। বাস্তবে মানুষের জীবনযাপন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। দেশের ৭৬ বছরের ইতিহাসে এমন গরম পড়েনি।
গত বছরের রমজানের ২৬ দিনের ছুটি শেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা ছিল ২১ এপ্রিল। ঠিক এর আগের দিন ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয় ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। আবহাওয়া অধিদপ্তর তীব্র গরমের ‘রেড অ্যালার্ট’ জারির পরই সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এবার দেশের সবচেয়ে উষ্ণ এপ্রিলের পরিস্থিতি কিন্তু ভিন্ন। কিন্তু কেন?
তপ্ত এপ্রিল, এবার-সেবার
বাংলাদেশে সবচেয়ে তপ্ত মাস এপ্রিল। এ মাসে গড় তাপমাত্রা থাকে ৩৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপরই আছে মে মাস, গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ৩২ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতবারের এপ্রিলে যে ভয়াবহ তাপ বয়ে গেছে, এবার সেই তাপ নেই। গত বছরের এপ্রিল মাসের চেয়ে এবারের এপ্রিলে গড়ে তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো.
তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তা মাঝারি তাপপ্রবাহ। তাপমাত্রা ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তীব্র তাপপ্রবাহ ধরা হয়। তাপমাত্রা ৪২-এর বেশি হলে তা অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলে গণ্য হয়।
তাপপ্রবাহের এই হিসাব মাথায় রাখলে বলা যায়, গত বছর এপ্রিলের প্রতিটি দিনে দেশে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে গেছে। এটুকুতেই শেষ নয়। গত বছর এপ্রিলের ৩০ দিনের মধ্যে ২০ দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে ছিল। এর মধ্যে আবার ১৩ থেকে ৩০ এপ্রিল একটানা সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ পার করেছিল। এর মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৩০ এপ্রিল, ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক দীর্ঘদিন ধরে তাপপ্রবাহ নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি গতবারের এপ্রিলের অবস্থা নিয়ে ২৫ এপ্রিল (২০২৪) প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘১৯৪৮ সাল থেকে উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেছি, এবারের মতো তাপপ্রবাহ টানা আগে হয়নি। বলা যায়, ৭৬ বছরের রেকর্ড এবার ভেঙে গেল।’
তবে চলতি বছর মাত্র এক দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০–এর কাছাকাছি গিয়েছিল। ২৩ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৩৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভান্ডারে থাকা ১৯৮১ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত তাপপ্রবাহের উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১০ সালের এপ্রিলে রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি ২০ দিন মৃদু থেকে মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। কোনো একক মাসে এর আগে এত দিন ধরে তাপপ্রবাহ হয়নি। গত ৪৩ বছরের মধ্যে দেখা গেছে যশোরে তাপপ্রবাহের দিন সবচেয়ে বেশি। এরপরই আছে ঢাকা ও চুয়াডাঙ্গা।
গত বছর টানা ৩৫ দিন একটানা তাপপ্রবাহ চলেছিল, যা রেকর্ড।
সেবার-এবার এপ্রিলের এই ভিন্নতা কেনবৈশ্বিক বায়ুপ্রবাহ, জলবায়ু পরিস্থিতি, উপমহাদেশীয় বায়ুর গতিপ্রকৃতি—তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া বা কমার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। পৃথিবী তপ্ত হচ্ছে, সেই বার্তা সবাই জানি। গত বছরের প্রায় প্রতিটি মাস আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তপ্ত ছিল। এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্তও বৈশ্বিক তাপমাত্রা আগের সময়ের চেয়ে বেশি ছিল।
গত বছরের এপ্রিল এত তপ্ত ছিল কেন? তাপমাত্রা গত বছর বৈশ্বিকভাবে ১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গিয়েছিল। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও।
এল নিনো মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের দুটি বায়ুপ্রবাহের একটি। এল নিনো বলতে মূলত উষ্ণায়নের অবস্থা বোঝায়। অন্যদিকে লা নিনো বোঝায় এর উল্টো অবস্থাকে। ২০২৩–এর সেপ্টেম্বর মাস থেকে এল নিনোর সক্রিয়তার কথা জানা যায়। এর কারণে ২০২৪–এ যে বিশ্বজুড়েই তাপপ্রবাহ বাড়বে, তা আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া ব্যুরো অব মেটেরোলজি এল নিনোর তথ্য জানায়। ১৬ এপ্রিল তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, এল নিনো শেষ হয়েছে।
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে গত বছরের পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, এল নিনো পরিস্থিতি শেষ ঘোষিত হলেও এর রেশ রয়ে গিয়েছিল। তাই সেবার এত তাপপ্রবাহ বেড়েছে। তবে এল নিনো পরিস্থিতি শেষ ঘোষিত হলেও এর রেশ রয়ে গিয়েছিল। তাই সেবার এত তাপপ্রবাহ বেড়েছিল।
চলতি বছর যে গত বছরের মতো এমন ভয়ানক গরম পড়বে না, তা আবহাওয়াবিদেরা আগে থেকেই বলেছিলেন। এর পেছনেও সেই বৈশ্বিক বায়ুপ্রবাহসহ অন্য অনুষঙ্গগুলোর ভূমিকা ছিল।
চলতি বছরে লা নিনা প্রাধান্যশীল বলে ধরা হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হয়েছিল, গরম অত তীব্র না–ও হতে পারে।
এ কে এম সাইফুল ইসলাম গতকাল সোমবার (৫ মে) বলছিলেন, এবার এল নিনো এবং লা নিনা নিরপেক্ষ অবস্থানে আছে এখনো। এ কারণে এপ্রিল অত তপ্ত হয়নি। মে মাসের প্রায় এক সপ্তাহ চলে গেলেও পরিস্থিতি অতটা তপ্ত নয়, যা গত বছর ছিল।
কালবৈশাখীর সংখ্যা বেড়েছেগ্রীষ্মের উষ্ণতা প্রশমিত করে কালবৈশাখী। এতে প্রবল বৃষ্টি হয়, তাতে কয়েক দিনের জন্য হলেও কমে যায় তাপ। তারপর আবার বাড়ে।
গত বছর এপ্রিল ও মে মাসে এই অস্বাভাবিক ও টানা তাপপ্রবাহের কারণ কালবৈশাখীর সংখ্যা ছিল একেবারেই কম। সাধারণত এপ্রিল মাসে ৯ দিন এবং মে মাসে ১৩ দিন কালবৈশাখী হয়। কিন্তু গত বছর এপ্রিল মাত্র ২ এবং মে মাসে চারটি কালবৈশাখী হয়েছিল বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে তাপমাত্রা ও বজ্রঝড় বা কালবৈশাখী নিয়ে গবেষণা করছেন।
চলতি বছর অন্তত ৯ দিন কালবৈশাখী হয়েছে বলে জানান আবুল কালাম মল্লিক। এ বছর এপ্রিলে স্বাভাবিকের চেয়ে সামান্য বৃষ্টি কম হলেও তা গত বছরের চেয়ে ছিল বেশি। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে মাসজুড়েই।
পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাবগত বছরের এপ্রিল মাসের গরমের ‘ভয়ানক’ স্মৃতি নায়লা ইসলামকে তাড়া করে ফেরে। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারী চাকরিজীবী ও দুই সন্তানের মা। দুই সন্তান কলেজ ও স্কুলে পড়ে। গত বছরের গরমের কথা ভেবে রাজধানীর তেজকুনি পাড়ার এই নারী এবার এসি কিনেছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘কষ্ট করে হলেও বাচ্চাদের কথা ভেবে এবার এসি কিনেছিলাম। কিন্তু এবারের এপ্রিল মাস ভালোই গেল। জানি না মে মাসে গরম কেমন পড়বে। এপ্রিলে মাত্র দিন তিনেক বোধ হয় এসি ব্যবহার করেছিলাম।’
এপ্রিলের এই কম গরম প্রশান্তি দিয়েছে এমন অনেককেই।
গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত দেশে খুব কম বৃষ্টি হয়েছে। এই পাঁচ মাসে যত কম বৃষ্টি হয়েছে, তা ২০১৩ সালের পর হয়নি বলে জানান আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ।
পাঁচ মাসের এই যে কম বৃষ্টি, এর কারণ আসলে পশ্চিমা লঘুচাপ সৃষ্টি না হওয়া। এর ফলেই সাধারণত বৃষ্টি হয়। কিন্তু ওই মাসগুলোতে এই লঘুচাপ প্রায় ছিল না বললেই চলে। কিন্তু পাঁচ মাসের অনাবৃষ্টির পর এপ্রিলে পশ্চিমা বায়ুপ্রবাহের গতি বাড়ে। তাতে বৃষ্টিও হয়।
মো. বজলুর রশীদ বলছিলেন, এপ্রিলে এসে পশ্চিমা লঘুচাপ বাড়ে। সেই সঙ্গে বাড়ে বৃষ্টির প্রবণতা। এবার এপ্রিলে তাই হয়েছে। তাতে গরম অনেকটাই কমেছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দশম ক ৯ ড গ র ব য় প রব হ বল ছ ল ন প রব হ ব স লস য় স প রব হ র পর স থ ত বছর র ম এল ন ন হয় ছ ল র কর ড গরম র সবচ য় অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
ঈদুল আজহায় ছুটি শুরু ৫ জুন থেকে, দুই শনিবার অফিস খোলা
পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটি শুরু হবে আগামী ৫ জুন থেকে। টানা ১০ দিন ছুটি থাকবে। অর্থাৎ ছুটি শেষ হবে ১৪ জুন।
আজ মঙ্গলবার সচিবালয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ছুটির এই সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে উপস্থিত দায়িত্বশীল একজন উপদেষ্টা প্রথম আলোকে ছুটির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
ওই উপদেষ্টা আরও জানান, ১৭ জুন ও ২৪ জুন সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবার সব সরকারি অফিস খোলা থাকবে।
এর আগে ১০ দিনের ছুটি ঘোষণার কথা জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তিনি এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।
এ বছর পবিত্র ঈদুল ফিতরেও ২৮ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৯ দিন ছুটি ছিল। ঈদ উপলক্ষে আগেই পাঁচ দিন টানা ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। সেখানে নির্বাহী আদেশে আরও এক দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল।
আরও পড়ুনঈদুল আজহায় ছুটি ১০ দিন: প্রেস সচিব৩৯ মিনিট আগেঅবশ্য এই ছুটি শুরুর দুই দিন আগে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের ছুটি ছিল। পরদিন বৃহস্পতিবার ২৭ মার্চ এক দিন অফিস খোলা ছিল।