সমকালীন গান, শিল্পী নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন সুবীর নন্দী
Published: 7th, May 2025 GMT
প্রথম আলো :
গত শতকের ষাট দশককে বলা হয় আধুনিক বাংলা গানের জাগরণের সময়। এরপর দ্রুত এর সংস্কার হলেও এই একুশ শতকে এসে বাংলা আধুনিক গান তার কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে আসতে পেরেছে?
সুবীর নন্দী: নিশ্চয়ই আসতে পেরেছে। বিন্দুমাত্র সন্দেহ এতে নেই। ষাট দশক ছিল আধুনিক বাংলা গানের উত্তরণের সময়। ওই সময় আমাদের দেশে ছিল ভারতীয় বাংলা গানের একচ্ছত্র প্রভাব। আর এই প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পী তাঁদের সংগীত প্রতিভা, জ্ঞান এবং ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছিলেন আধুনিক বাংলা গানের নতুন অধ্যায়। এ প্রসঙ্গে বলতে গেলে সবার আগে যাঁর নামটি আসে, তিনি আবু বক্কর সিদ্দিকী। আরও ছিলেন শ্রদ্ধেয় আব্দুল আলিম চৌধুরী, আব্দুল আহাদ চৌধুরী, কামাল হোসেন, আলাউদ্দিন প্রমুখ। তাঁরা আমাদের নিজস্ব গীতিকার, সুরকার নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে গান করে আধুনিক বাংলা গানকে একটা প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করিয়ে দেন। স্বাধীনতার পর তৈরি হলো আরেকটা ধারা। তখন গানের মধ্যে ফোক গানের প্রভাব পড়ে। ওই সময় এর কান্ডারি ছিলেন আজম খান, ফিরোজ সাঁই প্রমুখ।
প্রথম আলো :
আপনার দীর্ঘ সংগীতজীবন। এই জীবনে কোন শিল্পীর গান আপনাকে বেশি প্রভাবিত করেছে?
সুবীর নন্দী: নিজের অজান্তে ছোটবেলা থেকে গান শুনতে শুনতে উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী পঙ্কজ মল্লিক, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, জগজিৎ সিংয়ের ভক্তে পরিণত হয়েছিলাম। তাঁদের গান এখনো আমি শুনি, যা তখন আমাকে প্রভাবিত করেছে।
প্রথম আলো :
আজকের সুবীর নন্দী হয়ে ওঠার পেছনে বড় অবদান কার?
সুবীর নন্দী: এটা আমার পক্ষে বলা মুশকিল। কেননা, আমার সংগীতজীবনে অনেকের অবদান আছে, একজনকে আলাদা করে বলা কঠিন। কারণ, আমি অনেকের কাছে গানের তালিম নিয়েছি। ওস্তাদ ছিলেন। স্কুলে গান করতে কেউ কেউ শিখিয়েছেন।
১৯৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার নন্দীপাড়ায় সুবীর নন্দীর জন্ম। সুবীর নন্দীর সংগীতে হাতেখড়ি মা পুতুল রানীর কাছে। পরে ওস্তাদ বাবর আলী খানের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নেন। সিলেট বেতারে তিনি প্রথম গান করেন ১৯৬৭ সালে।প্রথম আলো :
৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে যাঁদের বয়স, তাঁদের একটা বড় অংশ কিন্তু এখন গান শুনছেন না। এখন গান শুনছে তরুণ প্রজন্ম। তাঁদের বয়স¦১৪ থেকে ২২-এর মধ্যে। এর কারণ কী?
সুবীর নন্দী: আসলে সংগীত ব্যাপারটা সময়নির্ভর। একটা নির্দিষ্ট ধারার ওপর ভর করে এর চলন, বলন, আকারের পরিবর্তন ঘটে। আগে ভালো যা ছিল, এখনো আছে। এখনো তৈরি হচ্ছে শ্রুতিমধুর গান। তবে এখন মানুষের সময় খুব সীমিত হয়ে গেছে। মানুষ এখন দুপুরে ভাতের ঝামেলা এড়ানোর জন্য একটি বার্গার খেয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। এই ‘বার্গার’ সংস্কৃতির সময় অনেকে হয়তো বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার সময় গাড়িতে গান শোনা ছাড়া অন্য কোনো সময় বের করতে পারে না। আবার জ্ঞানী শ্রোতার মধ্যে একটা দর্শন কাজ করে।¦তাঁরা মনে করেন, ভারতীয় গান না শুনলে জ্ঞানী শ্রোতা হওয়া যাবে না।
‘মনেরও রঙে রাঙাব’ অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন সুবীর নন্দী.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ব র নন দ প রথম আল র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
প্রথম হিজরতকারী ৫ নারী সাহাবি
নবুওয়তলাভের পঞ্চম বছর, নবীজি (সা.) দেখলেন শুধুমাত্র ইসলামগ্রহণের ‘অপরাধে’ নিজ গোত্রের আপন লোকেরাই সাহাবিগণের ওপর অমানবিক নির্যাতন শুরু করেছে। দিন যত যায়, জুলুম-নিপীড়ন আর অবমাননা বাড়তে থাকে। যারা সমাজে খুব সম্মানের সাথে চলাফেরা করতেন, তাদেরই এখন আড়ালে-আবডালে থাকতে হয়।
সাহাবিগণের এই ‘পরাধীনতা’ নবীজির (সা.) মনে খুব কষ্ট দিল। তিনি তাদের বললেন, ‘তোমরা আল্লাহর জমিনের কোথাও হিজরত করে চলে যাও, আল্লাহ শীঘ্রই তোমাদের একত্রিত করবেন। সাহাবিগণ আরজ করলেন, কোথায় যাব? তিনি হাবশার দিকে ইঙ্গিত করেন।’ (সীরাতুল মুস্তফা, ইদরীস কান্ধলবী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২১১-২১২, ইফাবা)
আরেক বর্ণনায় আছে, নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা হাবশায় চলে যাও, এটাই তোমাদের জন্য ভালো। কারণ সেখানে একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ আছেন, যার রাজত্বে কেউ জুলুমে শিকার হয় না। সেই দেশটা সত্য ও ন্যায়ের দেশ। আল্লাহ যতদিন পর্যন্ত তোমাদের জন্য এই জুলুম থেকে বাঁচার পরিবেশ না করে দেন, ততদিন পর্যন্ত তোমরা সেখানে থাকতে পারো। (সীরাতুন নবী, ইবনে হিশাম, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৮৪, ইফাবা)
এই নির্দেশ পেয়ে ৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে, হিজরিপূর্ব ৭ সালের রজব মাসে সাহাবিগণ মক্কা ছেড়ে সমুদ্রপথে আফ্রিকার দিকে রওনা দেন, যা ইতিহাসের কিতাবে ‘হাবশায় প্রথম হিজরত’ নামে প্রসিদ্ধ।
তারা খ্রিষ্টান রাজা নাজ্জাশি শাসিত আকসুম রাজ্যে (বর্তমান ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়া) গিয়ে নোঙর ফেলেন, এবং সেখানে বেশ নিরাপত্তার সঙ্গে তিন থেকে চারমাস বসবাস করেন। এরপর এমন একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে মক্কার সবাই ইসলামগ্রহণ করে ফেলেছে, তাই তারা ফিরে আসেন।
আরও পড়ুনআবিসিনিয়ায় নারী সাহাবিদের দ্বিতীয় হিজরত১৪ নভেম্বর ২০২৫সেই দুঃসাহসিক অভিযাত্রায় এগারোজন পুরুষের সাথে পাঁচজন নারী সাহাবিও ছিলেন, যাদের ত্যাগ ও কোরবানি পরবর্তীতে অন্য নারীদেরকেও ‘ধর্মপালনের স্বাধীনতার’ যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আমরা এখানে সংক্ষেপে সেই পাঁচজন নারী সাহাবি সম্পর্কে জানব।
১. রুকাইয়া বিনতে মুহাম্মদ (রা.)তাঁর জন্ম ৬০১ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি ছিলেন নবীজির (সা.) দ্বিতীয় মেয়ে। আবু লাহাবের ছেলে উতবাহর সাথে তাঁর বিয়ের চুক্তি (আকদ) হয়েছিল। কিন্তু নবীজি (সা.) নবুওয়তপ্রাপ্তির ঘোষণা দিলে আবু লাহাব সেই আকদ ভেঙে দেয়। এরপর রুকাইয়ার (রা.) বিয়ে হয় হযরত ওসমান ইবনে আফফানের (রা.) সাথে। তিনি স্বামীর সাথে হাবশায় হিজরত করেছিলেন, এই সময় তার বয়স ছিল ১৫।
তারা যখন হিজরত করার উদ্দেশ্যে রওনা দেন, নবীজি (সা.) তাদের কোনো খোঁজখবর পাচ্ছিলেন না। তিনি প্রতিদিন তাদের খবর নিতে বের হতেন। একদিন জনৈক মহিলা জানান তারা হাবশায় পৌঁছেছেন, নবীজি (সা.) এ খবর শুনে মন্তব্য করেন, ‘হজরত লুতের (আ) পর ওসমানই (রা.) প্রথম ব্যক্তি যিনি সপরিবারে হিজরত করেছেন। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদিস: ১৪৯৯৮) হযরত রুকাইয়া (রা.) ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
২. উম্মে সালামাহ হিন্দ বিনতে আবু উমাইয়া (রা.)তাঁর জন্ম ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি ছিলেন নবীজির (সা.) ফুফাতো ভাই ও দুধভাই আবু সালামাহ আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল আসাদের (রা.) স্ত্রী। স্বামীর সাথে তিনি হাবশায় হিজরত করেন, তখন তার বয়স ছিল ২১।
সে সময় তিনি সন্তানসম্ভাবা ছিলেন, হাবশায় তাদের প্রথম পুত্র সালামাহর জন্ম হয়। উহুদ যুদ্ধের পর আবু সালামাহ (রা.) শাহাদাতবরণ করলে নবীজির (সা.) সাথে উম্মে সালামাহর (রা.) বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন খুবই সাহসী ও জ্ঞান অনুরাগী নারী। তার অনেক প্রশ্নের ওপর কোরআনের আয়াত নাজিল হয়েছিল।
জীবনের শেষদিকে তিনি একদম সবার আড়ালে চলে যান, এমনকি তার মৃত্যুর তারিখ সঠিকভাবে জানা যায় না।
আরও পড়ুনমদিনায় হিজরত: ইসলামের ৬টি মাইলফলক০২ জুলাই ২০২৫৩. উম্মে আবদুল্লাহ লায়লা বিনতে আবু হাসমা (রা.)তিনি ছিলেন হজরত আমির বিন রবিয়াহর (রা.) স্ত্রী। হাবশার হিজরতের ঘটনা নিয়ে তিনি দুটো হাদিস বর্ণনা করেন। এর একটি হাদিস থেকে জানা যায় হিজরতের সময় এক মুসলিম অপর মুসলিমের কতটা আপন হয়ে উঠেছিল। উম্মে আবদুল্লাহ বলেন:
সাহাবিগণ যখন হাবশার উদ্দেশ্যে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের ঘরে এলেন এবং বললেন, ‘মুসআব ইবনে উমাইরকে (রা.) তার মা আটকে রেখেছে। তিনি আজ রাতেই বের হতে চান। যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়বে, তখন তিনি চলে আসবেন।’
আমার স্বামী, আমির ইবনে রবিয়াহ (রা.) বললেন, ‘আমরা তার জন্য অপেক্ষা করব, দরজা বন্ধ করব না।’
রাত গভীর হলে মুসআব (রা.) আমাদের কাছে এসে পৌঁছালেন। সেদিন রাতটা আমাদের সঙ্গেই কাটালেন। পরদিনও ছিলেন, তারপর রাতে চুপিসারে বেরিয়ে পড়লেন। আমরা তার সঙ্গে দেখা করার অঙ্গীকার করেছিলাম—তিনি সেই জায়গায় এসে মিলিত হলেন, আর আমরা একত্রে রওনা হলাম। আমরা সবাই পায়ে হেঁটে চলছিলাম, কেবল একটি উট ছিল, তাতে আমি ছিলাম।
মুসআবের (রা.) শরীর ছিল খুবই নাজুক, তিনি পায়ের তলায় মাটি সহ্য করতে পারছিলেন না। আমি দেখেছি, তিনি কদম ফেলছেন আর তার পা থেকে রক্ত ঝরছে। আমির (রা.) তা দেখে নিজের জুতা খুলে তাকে দিয়ে দিলেন।
শেষ পর্যন্ত আমরা জাহাজে পৌঁছালাম। সেখানে একটি জাহাজ পাওয়া গেল, যা সদ্য ভুট্টা বোঝাই করে মাওর থেকে ফিরেছে। আমরা ভাড়া করে তাতে উঠলাম—সাগর পেরিয়ে প্রথমে মাওর, তারপর মাওর থেকে হাবশা।
লায়লা (রা.) আরও বলেন, ‘আমি দেখেছি, আমির (রা.) মুসআবের (রা.) প্রতি এমন মায়া দেখাচ্ছিলেন, এতটা মায়া নিজের সন্তানের প্রতিও দেখান না। অথচ মুসআবের (রা.) কাছে কানাকড়িও ছিল না, আর আমাদের কাছে ছিল সবমিলিয়ে পনের দিনার।’ (জামিউস সুন্নাতি ওয়া শুরুহিহা, হাদিস: ৩০৬৭)
৪. সাহলা বিনতে সুহায়ল (রা.)তিনি ছিলেন হযরত আবু হুযায়ফা ইবনে উতবার (রা.) স্ত্রী। হাবশায় হিজরতের সময় তিনিও সন্তানসম্ভাবা ছিলেন। সেখানে তাদের পুত্র মুহাম্মদ বিন আবু হুজায়ফার (রা.) জন্ম হয়।
৫. উম্মে কুলসুম বিনতে সুহায়ল (রা.)তিনি ছিলেন নবীজির (সা.) ফুফাতো ভাই হযরত আবু সাবরাহ ইবনে আবু রাহমের (রা.) স্ত্রী। তার স্বামী হাবশায় দুই-দুইবার হিজরত করেছিলেন।
কিন্তু তিনি প্রথমবার স্বামীর সাথে ছিলেন কিনা এই বিষয়ে মতবিরোধ আছে। হাফিজ ইবনে সাইয়িদুন নাস ‘উয়ুনুল আসার’-এ প্রথম হিজরতকারীদের তালিকায় তার নাম উল্লেখ করেছেন। তবে ইবনে ইসহাক তাকে দ্বিতীয় হিজরতকারীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেন। (কিতাবুল ইসাবাহ ফি তাময়িজিস সাহাবাহ, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৪৬২, মাকতাবায়ে শামেলা)
[email protected]
মওলবি আশরাফ: আলেম, লেখক ও অনুবাদক।
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–এর হিজরত কেন মদিনায় হলো?১০ আগস্ট ২০২৪