Samakal:
2025-09-21@21:10:09 GMT

নির্বাসিত কবির সঙ্গে

Published: 8th, May 2025 GMT

নির্বাসিত কবির সঙ্গে

চলে গেলেন খোকন ভাই। সবাই কবি দাউদ হায়দার নামটির সঙ্গে পরিচিত। খোকন  তাঁর ডাকনাম। নির্বাসিত কবি এই এপ্রিলে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন চির নির্বাসনে।  
মফস্বল শহর হবিগঞ্জ। সেই ছোটবেলার এক দুপুরে ঘুম ভাঙে রাস্তায় লোকজনের কোলাহলে। ছোট্ট আমি সেদিন ঘুমচোখে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেটের কাছে যাই। দেখি, আমার মায়ের দৃষ্টিও তখন গেটের ফাঁক গলে রাস্তার দিকে। রাস্তায় অনেক মানুষ হিংস্র এক মিছিল করায় মত্ত। সেই মিছিল থেকে দাউদ হায়দার নামে একজন মানুষের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠছে। সেদিনই দাউদ হায়দার নামের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তার বেশি কিছুই বুঝতে পারিনি এবং কারও কাছে প্রশ্ন করে কিছু জানার কৌতূহলটাও মাথায় তাড়না তৈরি করেনি। বড় হতে হতে দাউদ হায়দারের কবি পরিচয়, তাঁর লেখা কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় পর্বটা হয়ে যায়। জেনে যাই কবি দাউদ হায়দার একটি কবিতা লেখার অপরাধে নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত। তিনি এক উদ্বাস্তু প্রবাসী মানুষ।
একসময় তাঁর কর্মস্থল দৈনিক সংবাদেই আমি ফিচার এডিটর হয়ে যোগ দিই। ওখানে দীর্ঘদিন কর্মরত আছেন, এমন অনেকের কাছ থেকে আমি সাহসী কবি দাউদ হায়দার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। শুনি কবির পরবাসে জীবনযাপনের অনেক কথা। জার্মানি ঘুরে আসা অনেকের কাছে কবির সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা জানি। জানি, বাংলাদেশের মানুষ পেলে উনি কতটা আপ্লুত হন। রান্না করে খাওয়ান। ঘুরে দেখান বার্লিন শহরের বিভিন্ন জায়গা। তবে আমি কখনও কল্পনাতেও কবির সঙ্গে দেখা হবে, এমন কথা ভাবিনি। মাঝেমধ্যে আমার শুধু ছোটবেলায় দেখা সেই মিছিলটার কথা মনে পড়ত।
২০০৪ সালে আমি সংবাদ পত্রিকায় কাজ করতে শুরু করি। ২০০৫ সালের মার্চে হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকার আমন্ত্রণে সংবাদ পত্রিকা থেকে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক এক কর্মশালায় যোগ দেওয়ার জন্য কলকাতায় যাই। সেই টিমে আমরা ছিলাম দু’জন মেয়ে আর চারজন ছেলে। সঙ্গে আমাদের চিফ রিপোর্টার সালাম জুবায়ের। সালাম ভাইয়ের সঙ্গে কলকাতার কবি-সাহিত্যিকদের বিশেষ সখ্য ছিল। অফিসে অবসর সময়ে সালাম ভাই আমাকে তাঁর সেইসব বন্ধু আর আড্ডার অনেক গল্প বলতেন। তো কলকাতায় পা রাখার পরদিনই সালাম ভাই আমাকে জানালেন, এ শহরে এখন তসলিমা নাসরিন এবং দাউদ হায়দার দু’জনেই আছেন। আমি তো শোনে মুগ্ধ। 

তাহলে কার সঙ্গে দেখা করা যায়? সালাম ভাইয়ের ভোট দাউদ হায়দারের দিকে বেশি। আমিও না চাইতে অনেক পাওয়া ভেবে তাঁর মতেই সায় দিই। ঠিক হলো পরদিন সকালে আমরা দাউদ হায়দারের রেস্ট হাউসে হানা দেব। এমন একজনের সঙ্গে দেখা হবে!! ভেবেই কল্পনায় বয়োবৃদ্ধ একজনের চেহারা মনে এঁকে ফেলি। ভাবি, এমনই হবে হয়তো মানুষটা। কারণ উনি তো দেশ ছেড়েছেন আমার ছোটবেলায়, সেই কবে! পরদিন সকাল সকাল আমি আর সালাম ভাই বেরিয়ে পড়ি। থিয়েটার রোডের সেই রেস্ট হাউসের ঘরে তখন দাউদ হায়দারের বড় তিন ভাই বিছানায় বসে আছেন আয়েশ করে। বেশ একটা জমাটি আড্ডার মুডে তিনজনই। তারাও আমাদের দেশের বিশিষ্ট লেখক এবং কবি। আমি তাদের চিনি, জানি। তবুও সালাম ভাই আমার সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেন। কারণ, তারা তো আর আমাকে চেনেন না। কয়েক মুহূর্তেই তাদের বড় কাছের মানুষ মনে হলো। আমার চোখ তখন ইতিউতি করে দাউদ হায়দারকে খুঁজছে। জানতে পারলাম তিনি শাওয়ার নিচ্ছেন। এর মধ্যে সালাম ভাইয়ের সঙ্গে তিন ভাইয়ের খোকন বলে কাউকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একসময় প্রশ্ন করেই বসলাম, এই খোকন লোকটা কে? এমন সময় বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন দাউদ হায়দার। পরনে জিন্স আর লাল রঙের টি-শার্ট। তরুণকাল অতিক্রম করে এলেও চেহারায় তখনও ধরে রেখেছেন তারুণ্য। চৌকস চেহারা। আপাদমস্তক একজন তুখোড় স্মার্ট ভদ্রলোক। আমরা তো তাকে দেখে বিস্মিত। কোথায় বয়োবৃদ্ধ এক কবি! তিনি তো রীতিমতো তরুণ।
মানুষটা বেরিয়েই আমার কথার উত্তর দিলেন, ‘আমিই খোকন। দাউদ হায়দার আমার পোশাকি নাম। খোকন ডাকটা বাবা-মা, ভাই-বোনের আদরের। এটা আমার ডাকনাম।’ প্রথম কথাতেই আমি মুগ্ধ। বাহ্ বেশ সুন্দর করে কথা বলেন তো! এবার আমি সাহস করে বলে ফেললাম, ‘দাউদ হায়দার নামটাতে মনে হয় একজন বয়স্ক মানুষ। খোকন নামটাই ভালো।’ কবি বললেন, ‘তাহলে তুমি আমাকে খোকন ভাই বলেই ডেকো।’
সেই থেকে উনি হয়ে গেলেন আমার খোকন ভাই।
আমরা কবির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি জেনে প্রশ্ন করলেন, ‘কতটা সময় আমার জন্য বরাদ্দ করে নিয়ে এসেছ?’ সালাম ভাই উত্তর দিলেন, ‘যতক্ষণ আপনি বিরক্ত না হন ততক্ষণ পর্যন্ত।’ হেসে দিলেন কবি। এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হাঁটতে পারো কেমন?’ আমি হাঁটার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী না হলেও মুখে বললাম ‘পারি, মন্দ না।’
‘তাহলে চলো’ বলে একটা ব্যাগ কাঁধে ঝোলালেন। ব্যাগে বিস্তর কাগজপত্র। সেই ব্যাগের ওজনে কবি নিজেও একদিকে ঝুঁকে গেলেন। তবুও তাকে ন্যুব্জ বলে মনে হলো না। তাঁর ভাইয়েরাও আমাদের কবির সঙ্গী হতে উৎসাহ দিলেন। আমরা রেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে পড়ি। রাস্তার উল্টো দিকেই একটা বড় রেস্তোরাঁ। (নামটা আজ আর মনে নেই) ব্রেকফাস্ট করবেন বলে সেদিকেই চললেন। রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করেই বুঝলাম এটা তার পরিচিত জায়গা। কলকাতা এলে এখানেই খাওয়াদাওয়া করেন। আমরা ব্রেকফাস্ট করে এসেছি তবুও নিস্তার নেই কবির সঙ্গে খেতেই হবে। দোসা আর ইডলি খেতে খেতে বললেন, ‘ইডলি অনেকটা আমাদের চিতই পিঠার মতো।’ আমি বললাম, ‘আমারও প্রথম খেয়ে এমনই মনে হয়েছে।’ আমি তখন কবির চেহারায় হঠাৎ বিষন্নতার ছায়া দেখি। জানতে চাইলাম, ‘দেশের চিতই পিঠা মিস করেন?’ তখন তাঁর ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি। সে হাসিতে যেন কষ্টটাই মিলল বেশি। আমি সংবাদ-এর ফিচার এডিটর জেনে আরও উদ্বেলিত হলেন। তাঁর সময়ের সংবাদের অনেক গল্প করলেন। তখনকার বংশালের সংবাদ অফিস আর সাধনা ঔষধালয়ের বানরদের নিয়েও নানান কাহিনি শুনলাম। কথা বলতে বলতে কখনও তার দৃষ্টি উদাস হয়ে কোথাও ঘুরে ফিরছিল। আমি তখন তাঁকে বললাম, ‘আপনার সেই ঢাকা এখন অনেক বদলে গেছে।’ বিভিন্ন জায়গা আর রাস্তার স্মৃতিচারণ করছিলেন। আমি সেসব জায়গার বর্তমান চিত্রটা বলছিলাম। একসময় বললেন, ‘থাক আর বোলো না।’ আমার কথায় তাঁর কোথায় যে ক্ষরণ হচ্ছে, সেটা আমি ঠিক বুঝে নিলাম। তাই আর ও পথে গেলাম না। হৃদয় খুঁড়ে ব্যথা বাড়ালাম বলে আমি নিজেকেই ধিক্কার দিলাম। আসলে আমিও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। নিজেকেই নিজে বললাম, ‘এবার থামো।’
মার্চ মাস। শীত বিদায় নিতে ব্যস্ত। রাস্তায় রোদের কড়া শাসন। এমনই তাতানো প্রকৃতিতে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আমরা কবির সঙ্গে পা মেলালাম। মানুষটা অনেক দ্রুতগামী। তাঁর হাঁটার জোরের সঙ্গে তাল মেলাতে আমি আর সালাম ভাইও হিমশিম খাচ্ছি। মাঝে মাঝে তাঁকে ধরার জন্য আমি ছোটখাটো ম্যারাথনও করছি। হাঁটতে হাঁটতে এলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলে। কয়েকজনের সঙ্গে দেখা করলেন, কথা বললেন। আমাদেরও তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর আবার রাস্তায়। চলতে চলতে কলকাতার অনেক রাস্তাঘাটের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কোথায় কী মিলবে তা-ও মুখস্থ বলে দিলেন।   একেবারে গুগলের ম্যাপসদৃশ। তবে একটু পরপর ডাবওয়ালা দেখে থামছেন আর আমাদের ডাব খাওয়াচ্ছেন। বললেন, ‘পায়ে চলার পথে অন্য কিছু না খেয়ে ডাব খাবে।’ তবে আমাদের চলার গতি শ্লথ হয়ে এলেও কবির  ক্লান্তি নেই।
এবার আমরা পৌঁছালাম স্টেটসম্যান পত্রিকার অফিসে। সরাসরি সম্পাদকের দপ্তরে। সম্পাদক মানস ঘোষ আমাদেরও বেশ সমাদর করলেন। কারণ, আমরা যে দাউদ হায়দারের সঙ্গে এসেছি। আমাকে পাঠালেন তাদের বাংলা বিভাগের সম্পাদকের কাছে। সম্পাদক তখনই আমাকে ঢাকা থেকে তাদের বাংলা বিভাগে কালচারাল নিউজ পাঠাতে বললেন। এ সবই ঘটল খোকন ভাইয়ের কল্যাণে। ঘণ্টাখানেক বসে ওখান থেকে আবার আমরা পথে নামি। এবার চলতে চলতেই খোকন ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলো। জানতে চাইলেন, সংবাদের সাহিত্য পাতা কে চালায়? আমার ছোট্ট উত্তর, ‘ওবায়েদ আকাশ। তরুণ কবি।’ শুনে বললেন, ‘আমি অন্নদা শঙ্কর রায়ের একটা স্মৃতিচারণমূলক পাণ্ডুলিপি দেব বুলবুলকে। বলবে এটা যেন সংবাদের সাহিত্য পাতায় ধারাবাহিকভাবে ছাপে। আর যদি না ছাপে তাহলে আমাকে পাণ্ডুলিপিটা ফেরত দেবে।’ তৎক্ষণাৎ ব্যাগ থেকে বের করে একটা ব্রাউন পেপার খাম ধরিয়ে দিলেন। সালাম ভাই বললেন, ‘অবশ্যই এটা সংবাদে ছাপা হবে।’
ইতোমধ্যে মনে হয় আমরা অর্ধেক কলকাতা শহর হেঁটে ফেলেছি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার মুখে। এবার কবিকে ছেড়ে ফেরার পালা। পার্ক স্ট্রিটের একটা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কবি বললেন, ‘যখনই নিজের দেশটার কথা খুব মনে পড়ে, তখনই পাশের দেশ কলকাতায় চলে আসি।  আমার ভাইয়েরাও তখন এখানে আসে আমার সঙ্গে সময় কাটাতে। দেশ থেকে নিয়ে আসে আমার পছন্দের সবকিছু। কালই আবার কলকাতা থেকে ফিরে যাব। তবে তোমাদের এবং আজকের দিনটা আমার মনে থাকবে।’ আমার চোখের কোণে জলের ঝিলিক খেলে গেল তবে তা আড়াল করলাম। তখনও জানতাম না এটাই কবির সঙ্গে আমার প্রথম দেখা আর শেষ দেখাও। হোটেলে ফিরে খুব মন খারাপ হলো। দু’দিন দেশের বাইরে থাকলেই আমার দেশের জন্য মন খারাপ হয় আর এই মানুষটা এতদিন ধরে কেমন করে দেশছাড়া জানি না! কী ভীষণ মন খারাপ নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি।
তখন হোয়াটসঅ্যাপ ছিল না, ফেসবুকও না; তাই দূরালাপনীতেই আামাদের যোগাযোগটা ঝুলে থাকল। সংবাদে অন্নদা শঙ্কর রায়ের লেখা নিয়মিত ছাপা হলো। কবি খুশি হলেন।
তখন অনেক কথা হতো কবির সঙ্গে। তবে সময় অনেক ক্ষেত্রে সম্পর্কের ওপর যবনিকা টেনে দেয়। আমাদের বেলাতেও তাই হলো। যোগাযোগটা স্তিমিত হতে হতে ক্ষয়ে গেল। তবে পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমি কবিকে অনেক খুঁজেছি, পাইনি। হয়তো সে সন্ধানে জোর ছিল না, তাই পাইনি। এ অপরাধে আজ মন কেমন যেন করছে। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আম র প আম দ র র জন য র অন ক অন ক ক বলল ন করল ন বলল ম কলক ত

এছাড়াও পড়ুন:

রাকসুতে দুঃখ ঘোচাতে চায় ছাত্রদল, জয় ধরে রাখতে মরিয়া শিবির

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর আর মাত্র চারদিন পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন। রাকসু নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে, তেমনি নির্বাচনী মাঠে বেশ জোরালো উপস্থিতি নিয়ে নামছে ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবির।

ডাকসু ও জাকসুর ৫৩টি পদে একটিতেও জয় না পাওয়ার দুঃখ ঘোচাতে চায় ছাত্রদল। অন্যদিকে, ডাকসু-জাকসুতে বড় জয় পাওয়ার পর আত্মবিশ্বাসী ছাত্রশিবির এবার রাবিতেও তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে চায়।

আরো পড়ুন:

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: পোষ্য কোটা নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক হাতাহাতি

রাকসু নির্বাচন: আলোচিত ভিপি প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির ফুলঝুড়ি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু কিংবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকসু নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার রাকসুতে ভিন্নধর্মী কৌশল ও প্রচার গ্রহণ করেছে এ দুই শক্তি।

চলতি মাসের ৯ সেপ্টেম্বর এবং ১১ সেপ্টেম্বর নানা অভিযোগ আর নাটকীয়তার মধ্যে শেষ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। দুইটি সংসদের মোট ৫৩টি পদেই পরাজিত হয়েছে ছাত্রদল মনোনীত প্যানেল। কোথাও কোনো অবস্থানই তৈরি করতে পারেনি সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।

দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের ভোটে বড় জয় পেয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির মনোনীত প্যানেল। ডাকসুর ২৩টি ও জাকসুর ২০টি পদে বিজয়ী হয়েছে তারা। ডাকসুর বাকি পাঁচটি পদের মধ্যে চারটিতে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এবং একটি পদে জয় পেয়েছেন বামপন্থি প্যানেল ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ এর একজন প্রার্থী।

অন্যদিকে, জাকসুর ২৫টি পদের মধ্যে একটি (ভিপি পদ) গেছে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেলের হাতে, দুটি পদ পেয়েছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস), আর দুটি পদে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। বাকি সব পদে জয়ী হয় শিবির সমর্থিতরা।

এছাড়া জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেই আন্দোলনের কয়েকজন নেতাও অংশ নিয়েছিলেন ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে। কিন্তু তারাও ভোটে জিততে পারেননি।

গত ৭ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাকসুর ২৩টি পদে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করে ছাত্রদল। এবারের প্যানেলে তারা ক্লিন ইমেজধারী, নির্যাতিত এবং বহুমাত্রিক পরিচয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দিয়েছে। এতে রয়েছেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়, রাজশাহী ফুটবল দলের গোলকিপার, ব্যান্ড সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, ডিনস পুরস্কারজয়ী শিক্ষার্থী, সংস্কৃতিকর্মী ও জনপ্রিয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

প্যানেলে শীর্ষ তিন পদের মধ্যে একটিসহ মোট চারটি পদে নারী প্রার্থী রাখা হয়েছে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। বিশেষ করে ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবীর তার নম্র স্বভাব, সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখ এবং ইতিবাচক ছাত্র নেতৃত্বের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পেরেছেন।

জিএস পদে আছেন নাফিউল জীবন, যিনি ছাত্রলীগের হাতে বারবার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এজিএস পদে জাহিন বিশ্বাস এষা একজন বলিষ্ঠ নারী কণ্ঠ এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পরিচিত মুখ, যিনি নারী ভোটারদের মনোযোগ কৌশলে টানছেন।

বছরের পর বছর আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে কার্যক্রম চলার পর গত ১৬ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। নবগঠিত এই কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ দলের শীর্ষ অন্তত ২০ নেতার ছাত্রত্ব নেই। তাই তারা প্রার্থী হতে পারেননি। বাকি যাদের ছাত্রত্ব আছে, তাদের ক্যাম্পাসে পরিচিতি যেমন কম, তেমনি অভিজ্ঞতার দিক থেকেও বেশ পিছিয়ে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ছাত্রদলের প্যানেলে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত ও ‘অনভিজ্ঞ’ যাদের প্রার্থী করা হয়েছে, তারা শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে কতটুকু জায়গা নিতে পারবেন!

ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের জিএস প্রার্থী নাফিউল জীবন বলেন, “ডাকসু ও জাকসুর অভিজ্ঞতা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। এবার আমরা নতুন উদ্যম, শিক্ষার্থীদের আস্থা ও সমর্থন নিয়ে রাকসুতে ইতিবাচক ফলাফলের বিষয়ে আশাবাদী। নতুন মুখ মানেই নতুন চিন্তা, নতুন চেতনা এবং নতুন ভাবনা। শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধানে উদ্যম ও সততাই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি—এটাই আমাদের মূল লক্ষ্য।”

তিনি বলেন, “আমরা সহিংসতা নয়, শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জনের জন্য কাজ করছি। শান্তিপূর্ণ প্রচার ও সমস্যার সমাধানের পরিকল্পনাই আমাদের বিজয়ী হওয়ার প্রধান বিষয়।”

ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দীন আবীর বলেন, “ডাকসু কিংবা জাকসুর সঙ্গে রাকসুর তুলনা করা যথার্থ হবে না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবেশ, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আলাদা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ, চলাফেরা এবং ক্যাম্পাস সংস্কৃতিও অন্যদের থেকে ভিন্ন। তাই রাকসুর প্রেক্ষাপটকে ঢাবি বা জাহাঙ্গীরনগরের নির্বাচনের সাথে এক কাতারে ফেলা সঠিক হবে না।”

তিনি বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, যদিও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক সময় ‘শিবিরের ক্যান্টনমেন্ট’ বলা হয়, তবুও শিক্ষার্থীদের আস্থা ও সমর্থন নিয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেল রাকসু নির্বাচনে বিজয়ী হবে।”

অপরদিকে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দীর্ঘদিন ধরেই ছাত্রশিবিরের প্রভাবাধীন বলে পরিচিত। তবে এবারের নির্বাচনে ছাত্রশিবির ভিন্ন পথে হেঁটেছে। ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ নামে একটি বৈচিত্র্যময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল গঠন করে তারা চমক দিয়েছে। এখানে শুধু ভিপি পদে রয়েছেন রাবি ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ। বাকি পদগুলোতে নানা সংগঠন, শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।

জিএস পদে রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ফাহিম রেজা, এজিএস পদে ‘সোচ্চার স্টুডেন্ট নেটওয়ার্ক’ এর সভাপতি সালমান সাব্বির। প্যানেলে আছেন তিনজন নারী শিক্ষার্থী-ছাত্রী সংস্থার সভানেত্রী সাইয়্যেদা হাফসাসহ দুজন। সহ-সমাজসেবা সম্পাদক পদেও নারী প্রার্থী রয়েছেন। নির্বাহী সদস্য পদে আছেন একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থী। এছাড়া জুলাই আন্দোলনে চোখ হারানো দ্বীপ মাহবুবকেও প্যানেলে রেখেছে শিবির।

এ বৈচিত্র্যকে শিবির নেতৃত্বের অন্যতম কৌশল বলা হচ্ছে। তারা প্রচারে ছাত্রদলের মতো আক্রমণাত্মক না হয়ে শিবিরের স্বভাবসুলভ বিনয়ী আচরণ, কুশল বিনিময় এবং সাংস্কৃতিক উপায়ে ভোটারদের কাছে পৌঁছাচ্ছেন।

শিবির প্যানেলের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক প্রার্থী জাহিদ হাসান জোহা এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন প্রচারে। গম্ভীরা গানের সুরে কখনো কৃষক, কখনো শিক্ষক, কখনো গায়ক সেজে ক্যাম্পাস মাতিয়ে তুলছেন তিনি। গানে গানে শিবিরের ইশতেহার শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরছেন, এটি শিবিরের অন্যতম সৃজনশীল প্রচার হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের অনুমিত ‘নিজস্ব ভোট’ রয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার। তাছাড়া ছাত্রী সংস্থার কারণে ছয়টি নারী হলের ভোটারদের বড় একটি অংশ শিবিরের দিকে থাকতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯ হাজার ভোটারের প্রায় ৪০ শতাংশ আবাসিক হলে থাকেন, বাকি ৬০ শতাংশ আশপাশে, যেখানে শিবিরের সামাজিক প্রভাব দীর্ঘদিনের।

রাবি ছাত্র শিবিরের সভাপতি ও ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ এর ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর জাহিদ বলেন, “ডাকসু, জাকসু এবং রাকসু—প্রতিটি নির্বাচনের প্রেক্ষাপট আলাদা এবং সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, নির্বাচনী ধারা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিও স্বতন্ত্র। তাই প্রতিটি নির্বাচনকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। তবে ডাকসু ও জাকসুতে শিক্ষার্থীরা আমাদের প্রতি যে আস্থা রেখেছেন, সেটি আসলে শিক্ষার্থীদের একটি বার্তা। তারা পরিবর্তন চান, তারা সৎ, যোগ্য ও সাহসী নেতৃত্ব চান।”

তিনি বলেন, “এই জয় আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে, আর সেই ধারাবাহিকতাই আমরা রাকসুতেও বজায় রাখতে চাই। অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়কে শিবিরের ঘাটি বলে কিন্তু আমরা এভাবে কখনো বলি না। কারণ এখানে সব মতাদর্শের শিক্ষার্থীরা থাকেন। তাদের মনে আঘাত লাগতে পারে। আমরা নারী শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর সবাইকে সম্মান-শ্রদ্ধা করি। সব মতাদর্শ একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।”

তিনি আরো বলেন, “রাকসুতে আমরা শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও সমস্যাগুলো সরাসরি শুনে সেগুলোর সমাধানকে আমাদের ইশতেহারে রাখছি। আমরা চাই একটি নিরাপদ, স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক শিক্ষাঙ্গন, যেখানে ভিন্নমত দমন নয়, বরং অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি চর্চা হবে। ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক শক্তিকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। 

“আমাদের মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। শেষ পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য একটাই শিক্ষার্থীদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। আমরা বিশ্বাস করি, রাকসুতেও শিক্ষার্থীরা আমাদের ওপর আস্থা রাখবেন,” যোগ করেন শিবির সভাপতি।

ঢাকা/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘আপনাদের কার্যক্রম তো সন্ত্রাসীদের মতো’ সাংবাদিকদের বললেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ভিডিও ভাইরাল
  • ‎ বিশ্বসেরা গবেষকের তালিকায় বেরোবির ৩ শিক্ষক-শিক্ষার্থী
  • ব্যাংকিং খাতে আস্থা বাড়াতে নিজের কর্মপরিকল্পনা ও উদ্যোগের গল্প বললেন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান
  • ভারত ম্যাচের আগে দলে মনোবিদ যুক্ত করেছে পাকিস্তান
  • প্রকাশ্য থেকে গুপ্ত: ভেতর থেকে দেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি
  • ডাকাতি হওয়া ২৩ ভরি স্বর্ণ উদ্ধার, গ্রেপ্তার ৩
  • বেতনের অর্ধেক যদি চলে যায় বাসা ভাড়ার পেছনে...
  • রাজনৈতিক ‘অস্ত্র’ না হয়ে প্রভাবমুক্ত হোক পুলিশ
  • গকসু নির্বাচন: জাহিদের প্রচারণায় সবুজের ডাক
  • রাকসুতে দুঃখ ঘোচাতে চায় ছাত্রদল, জয় ধরে রাখতে মরিয়া শিবির