দেশে টেকসই উপকরণে তৈরি ডেনিম কাপড় নিয়ে এসেছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন ওয়াশের ডেনিম পোশাকও এনেছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। আবার কারও কারও কাছে রয়েছে টেকনিক্যাল পণ্য। এ ছাড়া লেজার মেশিন, রাসায়নিকসহ বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জামও প্রদর্শন করছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
কয়েক দিন তীব্র তাপপ্রবাহের পর সাতসকালে আকাশজুড়ে মেঘের লুকোচুরি। তারপর স্বস্তির বৃষ্টি। অনেকটা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আজ সোমবার দুপুর ১২টার দিকে পূর্বাচলের আন্তর্জাতিক কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইবিসিসি) আয়োজিত বাংলাদেশ ‘ডেনিম এক্সপো’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী প্রদর্শনীর প্রথম দিনে এমন চিত্রই দেখ গেল। তবে দুপুরের পর দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
এক যুগ ধরে ধারাবাহিকভাবে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করে আসছে বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ (বিএই)। এবারের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, তুরস্ক, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশের ৫৮টি প্রতিষ্ঠান। তবে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের কারণে উভয় দেশের ২০টি প্রতিষ্ঠান আসেনি, এমনটাই জানালেন বিএইর পরিচালক আবু হায়দার কবির।
প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে সিম গ্রুপের আজলান ডেনিম লিমিটেড। নারায়ণগঞ্জের গাউছিয়া এলাকায় আজলানের কারখানায় মাসে ১৫ লাখ গজ ডেনিম কাপড় উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। ভালো ক্রয়াদেশ থাকায় কারখানা সম্প্রসারণ করছে প্রতিষ্ঠান। আগামী জুলাইয়ে তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ লাখ গজ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে আজলান ডেনিমের নির্বাহী পরিচালক (বিপণন ও বিক্রয়) সানাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রয়াদেশ ভালো। সে জন্য আমরা ডেনিম কারখানার সম্প্রসারণ করছি।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা কী ধরনের কাপড় উৎপাদন করছি, তা প্রদর্শনীতে ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরছি। পাশাপাশি অন্যরা কী ধরনের পণ্য উৎপাদন করছে, সেগুলোও আমরা দেখছি।’
ডেনিম এক্সপোতে নিয়মিতভাবেই অংশ নেয় আরগন ডেনিম। বর্তমানে তাদের মাসিক উৎপাদন সক্ষমতা ২২ লাখ গজ। প্রতিষ্ঠানটির প্রতি গজ ডেনিম কাপড়ের গড় দাম ২ ডলার ৮০ সেন্ট। গতানুগতিক ডেনিম কাপড়ের পাশাপাশি টেকসই উপকরণে তৈরি পণ্যও আছে তাদের। এ রকম পণ্যের উৎপাদন এক-পঞ্চমাংশ।
এমন তথ্য দিয়ে আরগন ডেনিমের ব্যবস্থাপক ইয়াসিন আল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, টেকসই উপকরণে তৈরি পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। গতানুগতিক পণ্যের চেয়ে টেকসই উপকরণে তৈরি পণ্যের দাম প্রতি গজে ১০-১৫ সেন্ট বেশি হয়। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে ইউরোপের বাজারে ভালো ক্রয়াদেশ আছে।
প্রদর্শনীতে সর্বোচ্চ ৩৬টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে চীন থেকে। এর মধ্যে একটি ডেনিম কাপড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাক পিওনি টেক্সটাইল কোম্পানি। ঢাকায় তাদের নিজস্ব কার্যালয় রয়েছে।
ব্ল্যাক পিওনি টেক্সটাইলের বিক্রয় ব্যবস্থাপক চাও জি বলেন, বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় বাজার। এখানে বেশি দামের পোশাকের ব্যবসা ধীরে ধীরে বাড়ছে। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কে তাঁদের ব্যবসায় প্রভাব পড়ছে না। কারণ, তাঁরা বৈচিত্র্যময় বাজারে পণ্য রপ্তানি করেন।
প্রদর্শনীতে আমেরিকান অ্যান্ড ইফার্ড বাংলাদেশ, আজগার্ড নাইন, বেস্ট টেক্স কেমিক্যালস, ওয়াইকেকে বাংলাদেশ, খান এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং, ব্লুসাইন টেকনোলজিস এজি, চেরি বাটন, সিলিক্যান্ট, কালার সেন্টার এসএ, ড্যানিস, ডেনিম সলিউশনসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে।
জানতে চাইলে বিএইর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, বর্তমানে টেকসই পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পোশাকের দাম। টেকসই পোশাকের জন্য ক্রেতারা বাড়তি পয়সা খরচ করতে চান না। এ ধরনের পণ্যই এবারের প্রদর্শনীতে এনেছে অধিকাংশ দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
অপরাজেয় রপ্তানি করছে টেকসই পণ্য
২০১৩ সালের ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ধসের পরে ‘নারীপক্ষ’ নামে একটি এনজিওর জন্য ৫০টি পাটের ব্যাগ তৈরির মাধ্যমে শুরু হয় ‘অপরাজেয়’–এর পথচলা। শুরু করার মাত্র চার মাসের মধ্যে দেশি ক্রয়াদেশের পাশাপাশি স্বল্প পরিমাণে শুরু হয় রপ্তানি। পরের বছর প্রতিষ্ঠানের আয় দিয়ে চালু করা হয় ‘সংকলন পাঠশালা’ নামের একটি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। সংকলন পাঠশালার ২৪৫ শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই ছিল রানা প্লাজায় আহত ও অন্য পোশাকশ্রমিকদের সন্তান।
২০১৫ সালে এক অগ্নিদুর্ঘটনায় কারখানা পুড়ে ২৭ লাখ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। তহবিল–সংকট ও অন্যান্য কারণে ২০১৬ সালে বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০১৮ সালে ব্যক্তি বিনিয়োগে ‘অপরাজেয় লিমিটেড’ নামে শতভাগ রপ্তানিমুখী পাটপণ্য ও হস্তশিল্প উৎপাদন কারখানা চালু করেন কাজী মো. মনির হোসেন। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠান পাটের তৈরি ব্যাগ, হোগলাপাতা ও শণের তৈরি বিভিন্ন পণ্য বিশ্বের ২৬টি দেশে রপ্তানি করছে। বর্তমানে দুটি উৎপাদন ইউনিটে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২৪০। এর বাইরেও হস্তপণ্য তৈরির জন্য বগুড়া, রংপুর, নোয়াখালীতে চুক্তিভিত্তিতে কাজ করছেন অসংখ্য নারী।
বর্তমানে ইউরোপের নামকরা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জন্য পণ্য তৈরি করছে অপরাজেয়। বৈশ্বিক ক্রেতাদের শর্ত, কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা ও শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে অপরাজেয় ‘সেডেক্স’সহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সনদ পেয়েছে। একই সঙ্গে দেশের বাজারে মানসম্পন্ন পাটপণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতের ঘাটতির কথা বিবেচনায় নেন কাজী মো. মনির হোসেন ও তাঁর স্ত্রী মুনিয়া জামান। ২০২১ সালে ‘কালিন্দী’ নামে একটি দেশি ব্যাগের ব্র্যান্ড চালু করেন মুনিয়া জামান। কালিন্দীর সব পণ্য অপরাজেয় কারখানার অব্যবহৃত উপকরণ থেকে তৈরি হয়। কালিন্দী পপআপ স্টোর ও অনলাইন থেকে বর্তমানে মাসে দেড় হাজারের বেশি ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে।
শুরুতে শুধু পাটের ব্যাগ তৈরি করলেও বর্তমানে কালিন্দী চামড়ার ব্যাগও বানাচ্ছে। টেকসই পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি দেশীয় ফ্যাশন ও নিত্যপণ্যের নানান উপকরণ তৈরি হচ্ছে। এমনই উদ্যোগ অপরাজেয় ও কালিন্দী। রপ্তানি শ্রেণিতে আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার ২০২৩ পেয়েছে অপরাজেয় লিমিটেড।