ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চের পাশে ছুরিকাঘাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য (২৫) নিহত হয়েছেন। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র শাহরিয়ার স্যার এ এফ রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক। সংবাদমাধ্যমকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক জানিয়েছেন, কয়েকজন সহপাঠী রক্তাক্ত অবস্থায় সাম্যকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাঁর ডান কানের পেছনে, বুকের বাঁ পাশে এবং পিঠে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ছাড়া ডান পায়ের ঊরুতে ধারালো অস্ত্রের এক থেকে দেড় ইঞ্চির মতো গভীর ক্ষত দেখা গেছে (সমকাল, ১৫ মে ২০২৫)। 

সাম্যর সঙ্গে থাকা আহত বন্ধু জানিয়েছেন, তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়েছিলেন আরেক বন্ধুর দোকানে কাবাব খেতে। মোটরসাইকেলে ফেরার সময় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির মোটরসাইকেল তাদের মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এ নিয়ে কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা শাহরিয়ারকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়।

ঘটনার পর ছাত্রদলের কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, এর পেছনে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের হাত থাকতে পারে। আবার ছাত্রশিবিরে যুক্ত লোকজন যেভাবে এটাকে মাদকসেবীদের কাজ বলে চালিয়ে দিতে চাইছে এবং সাম্যর চরিত্র হননমূলক ইঙ্গিত করছে, তাতে বিষয়টি রহস্যজনক হয়ে উঠছে। 

অনলাইনে দুই ছাত্র সংগঠনের পরস্পরবিরোধী দাবির বাইরে অফলাইনে যে বিষয়টি চোখে পড়বে, তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায় এড়ানোর অপচেষ্টা। প্রথমে বলা হলো– ঘটনাস্থল ক্যাম্পাসের বাইরে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায় নেই। এর পর উপাচার্য বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সামনে যেভাবে হাজির হলেন, তা আরও হতবাক করে। 

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের শুরু থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু সরকার গঠনের প্রায় ৯ মাস হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে– এমন দাবি করা যাবে না। যথাযথ পদক্ষেপ নিতে না পারায় একের পর এক অঘটন ঘটে চলেছে। দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ নিরসন কিংবা ঢাকায় বিভিন্ন কলেজে সংঘর্ষ মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপ যেমন অপ্রতুল, তেমনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অকার্যকর। আমরা শিক্ষা উপদেষ্টার পরিবর্তন হতে দেখেছি; কিন্তু শিক্ষাঙ্গনের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে– বলা যাবে না। 

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভের ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অনেকেই ষড়যন্ত্রতত্ত্ব সামনে আনছেন। এর আগেও পতিত সরকার ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত তারা সফল হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা ও পরোক্ষ জনসমর্থন নিয়ে। এই সরকারের কেন ষড়যন্ত্রতত্ত্বের প্রয়োজন হবে? কেবল শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সরকার এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। নইলে গণঅভ্যুত্থানের ফ্রন্টলাইনে থাকা ছাত্রনেতা খুন হওয়ার পর তাঁকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধেও সরকারের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না কেন? 

আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নতুন বাস্তবতায় শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ছাত্রদল শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে আসছে। নিজেদের ছাত্রনেতা খুনের শিকার হলেও তারা এখনও কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগ দাবিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে।
সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে যে ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় যেভাবে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের পর উপাচার্য প্রত্যাশিত ভূমিকা দেখাতে পারেননি। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে সহপাঠী খুনের ঘটনায় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সামনে যে চরিত্রে উপাচার্যকে দেখা গেছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত। শিক্ষার্থী খুনের ঘটনায় উপাচার্যের শোকাহত হওয়ার কথা ছিল; তিনি হলেন উদ্ধত। তাঁর আচরণ ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ ছাড়া আর কী?

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রশাসনের প্রথম শর্ত। পিতা-মাতা তাদের আদরের ধনকে জীবন গড়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান; জীবন দেওয়ার জন্য নয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রাণ হারানোর অঘটন এবারই প্রথম নয়। গত দুই দশকে পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০ জনের বেশি মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় বিচারিক পরিণতি দেখা যায় না। প্রতিটি ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি করে। আইন অনুযায়ী মামলা করা হয়। কিছু অভিযুক্তকে আটকও করা হয়। তবে মামলাগুলো চূড়ান্ত বিচারের মুখ দেখে না। বিচার পায় নাভুক্তভোগী পরিবার। আবার কোনো কোনো ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ রয়েছে। 

গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ ছাত্রের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। অভিযোগপত্রভুক্ত ২১ ছাত্রের মধ্যে ছয়জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তারা এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন, বাকিরা পলাতক। প্রকাশ্যে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। সিসি ক্যামেরা ফুটেজে অনেক শিক্ষার্থী জড়িত থাকার বিষয়টি প্রশাসন জানার পরও তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। অনেকে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে ঘুরছেন বলেও জানা যায়। এ হত্যার বিচার না হলে ক্যাম্পাসে এমন আরও অনেক ঘটনা ঘটা যে স্বাভাবিক, তার শেষ প্রমাণ সাম্য জীবন দিয়ে আমাদের দেখিয়ে গেলেন। 
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ জ্ঞানপীঠ। এখানকার ঘটনা সারাদেশের দৃষ্টান্ত। বর্তমান উপাচার্যের মাত্র ৯ মাসের মেয়াদে দুটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের পর একই প্রশাসন বহাল রাখলে তা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা প্রমাণ করবে না। বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন-সংগ্রাম ও লড়াকু মনোভাব বিষয়ে অবহিত। সাম্য হত্যার প্রতিবাদে ইতোমধ্যে উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগের যে দাবি উঠেছে, তিনি তার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবেন বলেই আশা করি। পাশাপাশি নিরাপদ শিক্ষাঙ্গনের দাবিতে আওয়াজের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হবে না, এমন নিশ্চয়তা কে দেবে? 

দ্রুত শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে নিরাপদে পড়াশোনার পরিবেশ নিশ্চিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সাম্য হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় যত দ্রুত আনা সম্ভব হবে, ততই আইনের শাসন দৃঢ় হবে। জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীরা স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন করেছে। অনেকেরই শিক্ষার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। দাবি দ্রুত মেনে নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে নেওয়াই সরকারের কর্তব্য। 

এহ্‌সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক, 
সমকাল; কথাসাহিত্যিক  

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: হত য হত য ক ণ ড র স ম য হত য র উপ চ র য পর স থ ত পদক ষ প র ঘটন য় সরক র র ঘটন য় ব প রক শ ন র পর হত য র র পর ব গঠন র

এছাড়াও পড়ুন:

কারিগরি শিক্ষার্থীদের অবরোধের ঘোষণা সহিংস আন্দোলনের উসকানি: সংবাদ সম্মেলনে বুয়েট শিক্ষার্থীরা

কারিগরি শিক্ষার্থীদের গাজীপুরে রেলপথ অবরোধের ঘোষণাকে ‘সহিংস আন্দোলনের উসকানি ও গভীর ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলছেন, আলোচনার টেবিল ছেড়ে অবরোধ কোনো যৌক্তিক সমাধান হতে পারে না।

আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টার পরে বুয়েট ক্যাফেটেরিয়া প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। ‘প্রকৌশল অধিকার আন্দোলন’ ব্যানারে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বুয়েট শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের তিন দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন আলোচনায় বসে। দাবির যৌক্তিকতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারা প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমাধারী—উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে ডাকে। সবার যুক্তিতর্ক সমানভাবে উপস্থাপনের সুযোগ করে দেয়, যাতে কারও প্রতি কোনোরূপ বৈষম্য না হয়।

লিখিত বক্তব্যে বুয়েট শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, আলোচনার টেবিলে সমাধানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আজ গাজীপুরে রেলপথ অবরোধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে কারিগরি শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। ডিপ্লোমাধারীদের পক্ষ থেকে যে প্রতিনিধিরা আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরাই অবরোধ ডেকে সহিংস আন্দোলনের জন্য ক্রমাগত উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন।

আলোচনার টেবিল ছেড়ে কেন জনদুর্ভোগ করে অবরোধের উসকানি দেওয়া হচ্ছে—এমন প্রশ্ন রাখেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা।

আলোচনার টেবিল ছেড়ে অবরোধ কোনো যৌক্তিক সমাধান হতে পারে না বলে উল্লেখ করা হয় লিখিত বক্তব্যে। এতে বলা হয়, এগুলো শুধুই বিশৃঙ্খলা তৈরির পাঁয়তারা ও গভীর ষড়যন্ত্র, যা প্রথাগত আন্দোলনকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাচ্ছে।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, আলোচনার টেবিল ছেড়ে যাঁরা অবরোধ করে দেশে নৈরাজ্য তৈরির উসকানি দিচ্ছেন, তাঁদের আসল উদ্দেশ্য ও এজেন্ডা খতিয়ে দেখা দরকার।

বুয়েট শিক্ষার্থীরা বলেন, যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য গায়ের জোর খাটিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অবরোধের প্রয়োজন নেই। যৌক্তিক দাবি জানালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে তা আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘স্বৈরাচারের পতন হলেও ষড়যন্ত্রের অবসান হয়নি’
  • কারিগরি শিক্ষার্থীদের অবরোধের ঘোষণা সহিংস আন্দোলনের উসকানি: সংবাদ সম্মেলনে বুয়েট শিক্ষার্থীরা